এক অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধার দৃষ্টিতে অনিবার্য মুক্তিযুদ্ধ

কোলাজ মনিরুল ইসলাম

আমরা যাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা–পরবর্তী প্রজন্ম, তাঁরা অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছি। আমার আজও মনে পড়ে, ছোটবেলায় আমার মা প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় আমাদের ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা ঘটনা এবং তাঁদের দুঃখ-দুর্দশার কথা বলতেন। আমার বাবার ওপর পাকিস্তানিদের হুলিয়া থাকার কারণে মাকে জীবন বাঁচানোর জন্য ৯ মাস বয়সী আমার বড় ভাইকে কোলে নিয়ে মানুষের বাড়ি বাড়ি পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। ড. নূরুন নবীর লেখা ‘অনিবার্য মুক্তিযুদ্ধ’ বইটি আমাকে নিয়ে গিয়েছিল আমার ছেলেবেলায়। বইটি পড়ার সময় মায়ের মুখে শোনা মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলিই যেন ভেসে উঠেছে চোখের সামনে। তবে নবীর ঘটনার প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন একটি জেলা এবং ভিন্ন এক ঘটনাপঞ্জি, এই যা। আদতে আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন মেন্ডেলা ‘লং ওয়াক টু ফ্রিডম’ বইতে ঠিকই বলেছে, ‘দুনিয়ার সব মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস একই। শুধু প্রেক্ষাপট ভিন্ন।’

বাঙালি জাতির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অহংকারের ঘটনা মহান মুক্তিযুদ্ধ। তবে এটা হঠাৎ আবির্ভূত হওয়া কোনো ঘটনা নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বীজ রোপিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে ভারত-বিভক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান নামক একটি অসামঞ্জ্যক রাষ্ট্রব্যবস্থা সৃষ্টির পর থেকেই। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-বঞ্চনা, নিপীড়ন-নির্যাতনের ফলে আমাদের মুক্তির সংগ্রাম হয়ে উঠেছিল অনিবার্য। আর এই অনিবার্যতার ঘটনাপঞ্জি উঠে এসেছে ’৭১ সালের এক অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশের ’৬০ ও ’৭০–এর দশকের প্রায় সব আন্দোলন–সংগ্রামের এক বীর সেনানী নূরুন নবীর লেখায়।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংগঠিত এ যুদ্ধে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা, কৃষক-শ্রমিক, পেশাজীবীসহ সব পর্যায়ের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। নবীর বইয়ে স্বাধীনতার আন্দোলন–সংগ্রাম থেকে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে সেসব মানুষের আত্মত্যাগের কথাই ফুটে উঠেছে। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার আগ্রহ থাকার ফলে এ বিষয়ে অনেক বই পড়ার সুযোগ হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, বইটি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একটি দলিল, যা বস্তুনিষ্ঠ এবং নির্মোহ সত্য তুলে ধরেছে।

‘জন্মেছি এ বাংলায়’ এবং ‘আমার একাত্তর, আমার যুদ্ধ’ শিরোনামে দুই ভাগে বিভক্ত বইটিতে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামে বেড়ে ওঠা, মেধাবী ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত চলার পথে বাংলা মায়ের দুঃসময়ে বিভিন্ন আন্দোলন–সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া—এসব প্রসঙ্গ এসেছে। এরপর সবশেষে ’৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা বিজয়ের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের কথা বলার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে বইটি। বইয়ের প্রথম ভাগ ‘জন্মেছি এ বাংলায়’–এর চারটি অধ্যায়ে লেখক টাঙ্গাইলের গ্রামে বেড়ে ওঠা, ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা ও রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া—এই বৃত্তান্ত যেমন আছে, তেমনি আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ফজলুল হক হলে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়া এবং বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতাসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা।

নূরুন নবী বেড়ে উঠেছেন বাংলাদেশের রাজনীতির এক অগ্নিযুগে। ফলে তিনি তাঁর ‘কী আনন্দ পথে ঘাটে’ অধ্যায়ে টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত এক মোহনীয় গ্রামে কীভাবে তিনি বেড়ে উঠেছেন এবং জড়িয়ে পড়েছেন সামাজিক–সাংস্কৃতিক আন্দোলনে, তার বর্ণনা করেছেন। যদিও বিনয়ের সঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘এখানে আমি আত্মজীবনী বা ইতিহাস লেখার চেষ্টা করিনি।’ তবু তাঁর এই বই আত্মজীবনী ও ইতিহাসের মিশেলে হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের জন্মকথার এক অনন্য দলিল।

অনিবার্য মুক্তিযুদ্ধ
ড. নূরুন নবী
প্রকাশক: মুক্তধারা, নিউইয়র্ক, পৃষ্ঠা: ৩০৩, দাম: ৪৭৫ টাকা।

লেখকের কথায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জীবনে মুক্তিযুদ্ধ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন–সংগ্রাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে, সেই চিত্রও। ছোট ছোট বিষয়সংবলিত এই অধ্যায়টিতে তিনি বলেছেন নিজের শৈশবের কথা, যেখানে স্বাভাবিকভাবে উঠে এসেছে পাকিস্তান আমলে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের হালচাল। যেমন তিনি আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, ‘মৌলিক গণতন্ত্রে জনগণের কাছে চেয়ারম্যানের জবাবদিহির প্রয়োজন রইল না।

কারণ, তাঁরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন। বন্যার সাহায্যার্থে আগত গম, উন্নয়নের জন্য অর্থ, এসব জনগণের কাছে যাবার আগে মৌলিক গণতন্ত্রীরা খেয়ে নিত। এভাবে শুরু হলো গম চুরি ও টাকা আত্মসাতের অভিশপ্ত প্রথা।’ (পৃষ্ঠা ৫২)।

‘কলেজে কোলাহল’ অধ্যায়ে আনন্দ মোহন কলেজজীবনে তাঁর রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক চর্চার কথা তুলে ধরেছেন নূরুন নবী। এখানে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়া এবং ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখার স্মৃতিচারণা করেছেন লেখক। বইটি পড়তে পড়তে জানা যাচ্ছে, ময়মনসিংহের এক সভায় সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আইয়ুব খান সাহেব, আপনার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত বিরোধ নেই। আমি পূর্ব বাংলার জনগণের ন্যায্য দাবিদাওয়ার জন্য আন্দোলন করছি। ছয় দফা দাবি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই কেবল পূর্ব বাংলার জনগণের ভাগ্য উন্নয়ন সম্ভব।’ (পৃষ্ঠা ৬৩)।

‘ঢাকা অভিযান’ অধ্যায়ে লেখক তুলে ধরেছেন ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগে ভর্তি, ফজলুল হক হলে ছাত্ররাজনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়া, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়া এবং ১৯৭০–এর অসহযোগ আন্দোলন ও নির্বাচনের জন্য কাজ করার নানান অভিজ্ঞতার কথা।

এই বইয়ের দ্বিতীয় ভাগের নাম ‘বিদ্রোহী মার্চ’। এখানে লেখক বর্ণনা দিয়েছেন একাত্তরের ২৫ মার্চের কাল রাত ও তৎপরবর্তী সময়ের। এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথে ব্যারিকেড দিতে গিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের বন্দুকের মুখ থেকে অতঃপর ফিরে এসে নূরুন নবী টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধে যোগ যোগ দিয়েছিলেন, তা তুলে ধরেছেন।

২৫ মার্চের কাত রাতের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তিনি স্বচক্ষে অবলোকন করেছেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের নির্মমতা। এ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর রাতের অন্ধকারে সর্বাধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে কাপুরুষের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানিরা মেতে উঠেছিল গণহত্যায়। তাই তিনি লিখেছেন, ‘তখন অবশ্য ভয় ছিল না, কেবল বোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। আবেগহীন মনে ক্যামেরার লেন্সের মাধ্যমে যেন দেখে যাচ্ছি এসব লোমহর্ষক দৃশ্য।’ (পৃষ্ঠা, ১৩০)।

‘প্রতিরোধ’ অধ্যায়ে অকুতোভয় এই মুক্তিযোদ্ধার জন্মস্থান টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসাধারণ ভূমিকার কথা ফুটে এসেছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনবার ভারতে গিয়েছিলেন তিনি। ভারতে মিত্রবাহিনীর সঙ্গে টাঙ্গাইলের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দৃঢ় যোগাযোগও স্থাপন করতে পেরেছিলেন। এই যোগাযোগ স্থাপন করতে গিয়ে তিনি এটাও দেখেছেন যে কীভাবে ভারতীয় মিত্রবাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছিল। বইটিতে আছে তার বর্ণনাও।

ড. নবীর এই বই বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং বিশেষভাবে টাঙ্গাইল অঞ্চলে স্বাধীনতাযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। টাঙ্গাইলের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমার আগ্রহ ছিল। এই বই পড়ে আমার সে তৃষ্ণা মিটল। তবে বইটির বেশ কয়েক জায়গায় মুদ্রণজনিত ত্রুটি রয়েছে। যেমন এক জায়গায় কর্নেল তাহেরকে লেখা হয়েছে কর্নেল তাহেজ। আশা করি, পরবর্তী সংস্করণে লেখক এ ব্যাপারে আরও সচেষ্ট হবেন।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]