গোপন এক মর্মকথা

জীবনের ছবি নয়, উপন্যাসের মর্মকথা জীবনের অভিজ্ঞান। সচেতন প্রয়াস ছাড়া তা অর্জন করা যায় না। দশজনের মধ্যে বাস করেও ব্যক্তি যখন নিজেকে ‘একজন’ বলে চিনতে পারছে, তখন থেকেই তো কথাসাহিত্যের সূত্রপাত।

সেই ব্যক্তিকে আরও স্পষ্ট করে চেনার আকাঙ্ক্ষা থেকে বিশ্বজিৎ চৌধুরীর নতুন উপন্যাস গোপন একটি নাম-এর পাঠ শুরু। পড়তে পড়তে মনে পড়ল, সময়ের ভেতরকার স্পন্দন বুঝতে পারা, সমকাল ও ইতিহাসকে পাঠকের কাছে মূর্ত করে তোলা, রক্তমাংস নিয়ে হাজির হওয়া—এই তো কথাসাহিত্যিকের কাজ।

কে যেন বলেছিলেন, উপন্যাস হচ্ছে আধুনিক মিথ। মোহন মিথ্যা থেকে এর জন্ম। গোপন একটি নাম পড়ার সময় প্রশ্ন জাগছিল, উপন্যাস এখন কেমন হওয়া উচিত? উপন্যাসের সেই পথে আমরা কতটুকু হাঁটতে পেরেছি?

নাটকীয়তায় শুরু এ উপন্যাস। লেখক বা উপন্যাসের বর্ণনাকারী বলছেন, আকস্মিকতা, কাকতাল ইত্যাদি বিস্ময় সৃষ্টিকারী শব্দের যত প্রচলনই থাকুক, আমি আজকাল বিশ্বাস করতে শুরু করেছি ‘লাইফ ইজ লার্জার দ্যান ফিকশন।’ ফিকশন রাইটারের বাপের সাধ্য নেই জীবনের চেয়ে বড় কোনো কাহিনি ফাঁদার।

চার বন্ধুর মধ্যে রাহাত বিন আমিনের দিকেই সবচেয়ে বেশি ও সতর্ক নজর রাখছি আমি। কারণ, আপনারা নিয়তি বা ভবিতব্য যা-ই বলেন না কেন, এই কাহিনির প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তারই সবচেয়ে বেশি।

রাহাত, তুমি ম্যান অব ডেসটিনি, নিয়তি-নির্ধারিত চরিত্র। নিয়তিই তোমাকে আত্মহত্যার চেষ্টায় ব্যর্থ এক নারীর সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতায় জড়িয়ে দিয়েছে। আবার এই নিয়তিই তোমাকে আনিকার বিপদের দিনে তার পাশে দাঁড়াতে প্ররোচিত করেছে। না হলে তার পরিকল্পনার বৃত্ত যে পূর্ণ হয় না।

গোপন একটি নাম আদতে নিয়তিতাড়িত এক উপাখ্যান। ঘুরেফিরেই আসে নিয়তির কথা।

এখানে একজন সূত্রধর আছেন। সে ‘আমি’টা কে? লেখক? নাকি এই স্বর নিয়তির! ‘আমি’ বলছে, আমি আপনাদের আগেই বলেছি এখন পুনরাবৃত্তি করছি, নিয়তি-নির্দিষ্ট চরিত্র সে। অভিমন্যুর মতো চক্রব্যূহে ঢুকতে শিখেছে, বেরিয়ে আসার পথটা এখনো চিনে উঠতে পারেনি।

গোপন একটি নাম বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা প্রকাশকাল: জানুয়ারি ২০২১ ১৫৮ পৃষ্ঠা দাম: ৩০০ টাকা।

আমরাও তো চিনতে পারি না পথ বা জীবন। জীবন যদি নাটকীয়ই না হবে, আজ সকালে যে মহিলাটির নিষ্ঠুরতা নিয়ে আলোচনার অবতারণা হয়েছিল কলেজ ক্যানটিনে, সন্ধ্যা হতে না হতে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে তিনিই এসে পৌঁছাবেন কেন?

বিশ্বজিতের ভাষা সরল, টান টান। তরতর করে পড়া যায়। আরাম লাগে। মনে হয়, অত আরাম ভালো না। একটু খোঁচা, একটু অস্বস্তিও দরকার। পাঠককে স্বস্তির পাশাপাশি অস্বস্তিতেও ফেলতে হয়।

থাক, ডা. রাহাতের গোপন বিষয়টি আপনাদের সামনে ভাঙব না। আসুন না, একবার ঢোকা যাক গোপন সেই নামের জগতে। জেনে নেওয়া যাক গোপন মর্মকথাটুকু।

বইটি প্রকাশক প্রথমা প্রকাশন। প্রকাশনায় তারা অনন্য। তবে কাগজ, কালি আর ফন্ট মিলে যে দৃশ্যগ্রাহ্যতা তৈরি করে, তা নিয়ে একটু ভাবতে বলব।