ছয় পর্বে মুক্তিযুদ্ধের গ্রন্থমালা

একদিকে পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত সশস্ত্র সামরিক বাহিনী, অন্যদিকে বাংলার সাধারণ মানুষ। যুদ্ধের জন্য দ্বিতীয় পক্ষের অস্ত্র মূলত নিজ ভূমি ও পারস্পরিক সহযোগিতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাক আক্ষরিক অর্থেই পালন করেছিল বাঙালি। যার যা আছে, তা-ই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল একটি অসম যুদ্ধে। বাঙালির মুক্তির সে যুদ্ধের নাম মুক্তিযুদ্ধ।

বোদ্ধাদের থেকে শুরু করে, সাধারণ পাঠকের জন্য মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থমালা’। ছয় পর্বের এ সিরিজ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে গণমানুষের এ যুদ্ধের নানা দিকের ওপর আলো ফেলেছে। পাঠক এ গ্রন্থমালা থেকে মুক্তিযুদ্ধের একটি বস্তুনিষ্ঠ ও সামগ্রিক ধারণা পাবেন।

গ্রন্থমালার প্রথম পর্ব মুক্তিযুদ্ধ: সূচনা থেকে সমাপ্তি। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি হিসেবে বঙ্গবন্ধু উত্থাপন করেছিলেন ‘বাঙালির ছয় দফা’। ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে এটিই একসময় পরিণত হয় বাঙালির মুক্তির সংগ্রামে। এই সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক নিয়ে লিখেছেন আকবর আলি খান, হাসান আজিজুল হক প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা, গীতা মজুমদার, শিরিন বানু মিতিলের মতো নারী মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের অবর্ণনীয় কষ্ট ও বীরত্বের কথা কিংবা বিশ্বগণমাধ্যমের ভূমিকা ও বিশ্বরাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে থাকা পরাশক্তিগুলোর ভূমিকা ইত্যাদি কম আলোচিত, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উঠে এসেছে এ বইয়ে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সামগ্রিক একটি ধারণা পাবেন পাঠক এ পর্বে।

সম্মুখযুদ্ধ ১৯৭১: মুক্তিযোদ্ধাদের কলমে নামের দ্বিতীয় পর্বটি সম্পাদনা করেছেন মতিউর রহমান। বইটির সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব স্বয়ং মুক্তিযোদ্ধাদের কলমে বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত যুদ্ধের খুঁটিনাটি বর্ণনা। চট্টগ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন রফিকুল ইসলাম (বীর উত্তম)। অপারেশন জ্যাকপট বা কামালপুরে জেড ফোর্সের প্রথম আক্রমণের মতো গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধগুলোর ছবি ও নকশা যুক্ত করা হয়েছে এ বইয়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের নিজেদের ভাষ্যে যুদ্ধের এ রকম প্রামাণ্য বর্ণনা নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধকে অনুভব করতে সাহায্য করবে পাঠককে।

গ্রন্থমালার তৃতীয় বই মুক্তিযুদ্ধের নায়কেরা। শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে ইন্দিরা গান্ধী, ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান স্যাম মানেকশর মতো যাঁরা একাত্তরের যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের নিয়ে এ বই। বইটি যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা বাঙালি ও অবাঙালি মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে পাঠককে।

চতুর্থ পর্বটি সাজানো হয়েছে যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল নিয়ে। নাম মুক্তিযুদ্ধের ১০টি তারিখ। নয় মাসব্যাপী এ যুদ্ধের প্রতিটি দিনই গুরুত্বপূর্ণ। তবে কিছু কিছু দিন ঘটনাপ্রবাহ ও গুরুত্বের দিক থেকে ছাপিয়ে গেছে আর সব। শুরুটা হয়েছে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মাধ্যমে। পরে ২৫ মার্চের কালরাত পেরিয়ে ২৬ মার্চের ভোর নিয়ে এল স্বাধীনতার ডাক। শেখ মুজিব গ্রেপ্তার হলেন, কিন্তু তার আগেই বলে গেলেন, সবাই যেন লড়াই চালিয়ে যায়। তাঁর নির্দেশ মেনে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ল যুদ্ধে। ১৭ এপ্রিল গঠিত হলো মুজিবনগর সরকার। শেখ মুজিব সে সরকারের রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন প্রধানমন্ত্রী। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পথচলা শুরু হলো এর মাধ্যমে। ১১ জুলাই গঠিত হয় বাংলাদেশ বাহিনী। এ রকম প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ তারিখ, আলোচিত ও কম আলোচিত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত উঠে এসেছে বইটির দুই মলাটে।

পঞ্চম পর্বটির নাম মুক্তিযুদ্ধে নানা দেশ। বাংলার মাটিতে যখন নির্বিচারে মারা যাচ্ছে নিরীহ মানুষ, বিশ্বমঞ্চে তখন চলছে আরেক যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো পরাশক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। বাংলাদেশের সাহায্যে এগিয়ে আসে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত। পরাশক্তিগুলোর এ কূটনৈতিক যুদ্ধের মুখে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে জাতিসংঘ। বিশ্ব পরাশক্তিগুলোর এই কূটনৈতিক যুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে মুক্তিযুদ্ধে।

শেষ বইটির আলোচ্য বিষয় ফুটে উঠেছে এর নামেইমুক্তিযুদ্ধের চেতনা। একাত্তরের ভয়াবহ সেই যুদ্ধের সময় জীবন বাজি রেখে লড়া মানুষগুলো কী চেয়েছিলেন? কী ছিল তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন? বাঙালিত্ব, মানবাধিকার, সাম্য, অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্রের মতো কিছু মৌলিক অধিকার। সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে কতটা এগিয়েছি আমরা? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কীভাবে আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে ও করছে প্রতিনিয়ত সামনে এগিয়ে যেতে? গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয় উঠে এসেছে এ বইয়ে; রেহমান সোবহান, আনিসুজ্জামান, গোলাম মুরশিদ, মতিউর রহমানের মতো বোদ্ধাদের কলমে। দ্বিতীয় বইটি ছাড়া বাকি পাঁচটি বই সম্পাদনা করেছেন সাজ্জাদ শরিফ

এই গ্রন্থমালার প্রতিটি বই এমনিতে স্বয়ংসম্পন্ন। আলাদাভাবে পড়লেও বোঝা যাবে এর বিষয়বস্তু। তবে সব কটি বই একসঙ্গে মিলে মুক্তিযুদ্ধের নানা দিক চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। পাঠককে সত্যিকার অর্থে যুদ্ধের সময়কার সেই বাংলাদেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে এ গ্রন্থমালা। মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীতে ছয় পর্বের এই সিরিজ তাই হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের বস্তুনিষ্ঠ প্রামাণ্য দলিল।

মুক্তিযুদ্ধের গ্রন্থমালা সিরিজের ছয় বই

সম্পাদক: মতিউর রহমানসাজ্জাদ শরিফ

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরীর চিত্রকর্ম অবলম্বনে অশোক কর্মকার

মুক্তিযুদ্ধ: সূচনা থেকে সমাপ্তি

দাম: ২২০ টাকা

সম্মুখযুদ্ধ ১৯৭১: মুক্তিযোদ্ধাদের কলমে

মূল্য: ৩৫০ টাকা

মুক্তিযুদ্ধের নায়কেরা

দাম: ২০০ টাকা

মুক্তিযুদ্ধের ১০টি তারিখ

দাম: ৩২০ টাকা

মুক্তিযুদ্ধে নানা দেশ

দাম: ২২০ টাকা

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

দাম: ১৫০ টাকা

বইগুলো পাওয়া যাবে prothoma.com এবং মানসম্মত যেকোনো বইয়ের দোকানে।