বইচিত্রের বৈচিত্র্য

অলংকরণ: আরাফাত করিম

মহামারি করোনা যখন জেঁকে বসেছিল আমাদের ওপর, তখন ‘এটা কোরো না, ওটা ধোরো না’—এ ধরনের নানা জাতের উপদেশ ও নিষেধাজ্ঞাও জেঁকে ধরেছিল আমাদের। তখন ঘরবন্দী মানুষকে অনেক কিছুর সঙ্গে সন্ধি করতে হয়েছে। প্রচণ্ড উড়নচণ্ডী মানুষও তখন ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস করেনি। তাদের দিন কেটেছে হোম অফিসের হোমানলে। অন্য সব প্রাণীর মতো মানুষও মানিয়ে নিতে পারে প্রতিকূলতার সঙ্গে। মানিয়ে নেওয়ার এই প্রবৃত্তি ও প্রবণতা বাংলাদেশের মানুষের চেয়ে ভালো জানে আর কোন দেশের লোক? সারা পৃথিবী যখন করোনার আতঙ্কে সিঁটিয়ে ছিল, ‘স্টে হোম’ যখন ছিল আন্তর্জাতিক স্লোগান, তখনো বাংলাদেশের বহু হোমলেস মানুষ রাস্তায় বা ফুটপাতে দিন কাটিয়েছে। সহজাত প্রতিবাদী স্বভাবে তারা প্রতিরোধ করতে পেরেছে জীবনসংহারী এই মারণব্যাধিকে।

কিন্তু মধ্যবিত্ত মানুষের যখন ঘরছাড়ার উপায় নেই, ঘরছাড়া আর কোনো জায়গা নেই, যখন তাসুড়েদের সান্ধ্য আড্ডা বিলুপ্তপ্রায়, তখন তারা কোথায় যায়? বিশ্বব্যাপী মানুষ কোথায় গেছে আমরা জানি। ব্রিটেনে লকডাউনের সময় মুদ্রিত বইয়ের বিক্রি আগের আট বছরের সব রেকর্ড ভেঙে ২০২০ সালে ২০ কোটি ছাড়িয়েছে, যার আর্থিক মূল্য ৬৪০ কোটি পাউন্ড। আমেরিকায়ও একই বছর বিক্রি হয়েছে ৭৫ কোটি বই, যা আগের ১১ বছর পর সর্বোচ্চ। দেশটিতে বই পড়ার হার সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ষাটোর্ধ্ব এবং ২০ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের। সে দেশে বিশেষ করে বয়স্করা তাঁদের গৃহবন্দী একাকিত্ব কাটাতে খুঁজে নিয়েছিলেন বইকে। লকডাউন না থাকলে তাঁরা রাস্তায় হেঁটে মানুষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতেন কিংবা কোথাও হতেন স্বেচ্ছাসেবী। অন্য সব ব্যবসায়ীরা যখন করোনার ঘায়ে ধরাশায়ী, ইংল্যান্ড–আমেরিকার বই প্রকাশকেরা আশা করছিলেন, লকডাউন ও সামাজিক মেলামেশার কঠোর বিধিনিষেধ চালু থাকলে বইবিমুখ মানুষেরা ঘরে ফিরে আসবেন, তাঁদের ব্যবসাও হবে জমজমাট।

জানি না, হুল্লোড়ে মার্কিনদের বই পড়ার বাতিক বৃদ্ধির কারণ করোনা মহামারির মানসিক চাপ থেকে মুক্তি, নাকি জীবনানন্দের ঈষৎ পরিবর্তিত ভাষায় সব বিনোদন ‘যার বোঝা হলো, দেখুক সে’ বই ‘ভালোবেসে, কিংবা এই’ বইগুলি ‘একবার ভালোবেসে দেখি!’ মানুষ যখন ঘরবন্দী হয়ে সকল বিনোদন থেকে বঞ্চিত হয়ে মৃত্যুভয়ে আক্রান্ত, তখন বই-ই হয়ে ওঠার কথা তাদের একমাত্র আশ্রয়। সেটিই হয়েছিল পাশ্চাত্য দুনিয়ায়।

অথচ লকডাউনের সময় আমেরিকা বা ইংল্যান্ডে বই বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি সম্পর্কে একাধিক সংবাদমাধ্যমের উচ্ছ্বসিত খবরে উল্লসিত হতে পারছেন না আমাদের দেশের প্রকাশক বা বিক্রেতারা। লকডাউনের সময় বিভিন্ন পণ্যের অনলাইন বিক্রি লাফিয়ে উঠলেও বই বিক্রিতে তার কোনো প্রভাব পড়েনি বলেই মনে করেন তাঁরা। প্রকাশকদের কাছে আয়কর বিভাগের কর্তারা যেমন, লেখকেরাও তেমনই। কারও কাছেই বই বিক্রির কথা স্বীকার করা যায় না। সুতরাং করোনা মহামারির সময় ইউরোপ আমেরিকায় বই বিক্রির রমরমা গেলেও আমাদের দেশে তার কোনো বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যান নেই। সুতরাং মহামারির এই কালবেলায় প্রকাশকের মুখ কালো হবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অবশ্য কারও কারও বিক্রি যে বাড়েনি, এমন নয়। প্রথমা প্রকাশন, বাতিঘরসহ আরও দু–একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দাবি করেছে, এ বছর তাদের বইয়ের বিক্রি বেড়েছে। এ ছাড়া অনলাইনে বই বিক্রির পরিমাণ অনেক গুণ বেড়ে গেছে—এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু তাই বলে বই বিক্রির মোট পরিমাণ বেড়েছে—সরাসরি এ রকম সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না। আমাদের দেশের পাঠকের সঙ্গে পাশ্চাত্য বিশ্বের পাঠকের চরিত্র ও সামর্থ্যের পার্থক্যের কথাও বিবেচনা করতে হবে। স্বাভাবিক সময়েও সেসব দেশের মানুষ বেড়াতে গেলেও ট্রেনে বা বাসে ডিকশনারি সাইজের বই নিয়ে যে বিভোর হয়ে থাকে, সুইমিংপুলের পাশে ঢাউস বই মুখের ওপর নিয়ে যে কুমিরের মতো শুয়ে শুয়ে রোদ পোহায়, সে রকম দৃশ্য আমাদের দেশে কখনোই দেখা যায় না। তবু আমাদের দেশে প্রতিবছর একুশে বইমেলায় যে মচ্ছব হয়, তার উপলক্ষও তো বই বৈকি। ওদের দেশে তো আমাদের মতো ফি বছর একুশের গ্রন্থমেলা হয় না।

শোনা যায় ডিজিটাল যুগে ছাপানো বইয়ের কদর কমে যাচ্ছে, প্রতিবছর একুশের গ্রন্থমেলার ক্রমবর্ধমান কলেবর দেখে সে কথা বিশ্বাস করার উপায় নেই। ছাপানো বইয়ের কদর না থাকলে আমাদের বইমেলা প্রতিবছর বড় হতো না, প্রকাশকেরাও বিশাল প্যাভিলিয়ন সাজিয়ে বসতেন না। তবু বই এসব গোলমেলে ব্যাপারে না যাওয়াই ভালো। বিশ্বের নামকরা সংবাদমাধ্যমগুলো যখন বলছে, সেসব দেশে করোনা মহামারির সময় বই বিক্রি আগের চেয়ে বেড়েছে, আমরা সেদিকেই তাকিয়ে ভাবতে থাকি, আমাদের দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যেমন বাড়ছে, বই বিক্রির স্পৃহাও তার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে কি না।