বঙ্গবন্ধু, সংবিধান ও আইন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতীয় জীবনের আলোকবর্তিকা। হাজার বছরের শোষণমুক্তির আকাঙ্ক্ষায় ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনে কান্ডারির ভূমিকায় আজীবন সংগ্রাম করেছেন তিনি। তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের ত্যাগ ও ন্যায়নিষ্ঠ আদর্শের দৃষ্টান্ত আজও উত্তর প্রজন্মের সামনে প্রোজ্জ্বল। এরই আলোকোজ্জ্বল প্রকাশ বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নিবন্ধগ্রন্থ বঙ্গবন্ধু: সংবিধান আইন আদালত ও অন্যান্য যুগোপযোগী ১৫টি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে এখানে।

মূলত বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শের পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা লেখকের অভিজ্ঞতায় বঙ্গবন্ধুকে প্রত্যক্ষভাবে দেখা এবং তাঁকে জানার উপলব্ধি থেকেই তাঁর এই বইয়ের অবতারণা। নিবন্ধগুলোর শিরোনাম এ রকম—‘বঙ্গবন্ধু: স্মৃতিতে-অস্তিত্বে’, ‘বঙ্গবন্ধুর দর্শন: সংবিধানের প্রস্তাবনা-সাময়িক ফরমান ও সুপ্রিম কোর্ট’, ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল—বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় প্রত্যয়ের প্রতিফলন’, ‘আইন-আদালত-বিচারব্যবস্থা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা’, ‘বঙ্গবন্ধুর ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মনিরপেক্ষতা’, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান’, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা: কিছু আইনি তর্ক ও সুপ্রীম কোর্ট’, ‘বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা: গণপরিষদ ও সংবিধান’, ‘বঙ্গবন্ধু ও সুপ্রীম কোর্ট’, ‘জাতীয় জীবনে ৪ নভেম্বর’, ‘২৬ মার্চের পূর্বাপর’, ‘বঙ্গবন্ধুর সংসদ জীবনের শেষ দিনটি’, ‘বাবার স্মৃতি-কর্ম ও পথ চলা’, ‘জঙ্গি হামলায় দুই বিচারকের আত্মদান—বিচারকের নির্ভীক পথ চলার প্রেরণা’ এবং ‘জনস্বার্থে মামলা ও গণমাধ্যম’।

শিরোনামযুক্ত বিষয়গুলো দেখলে বোঝা যায় বঙ্গবন্ধুর জীবন অনুসরণ করে এবং সংবিধান ও আইনের সঙ্গে সেই জীবনকে মিলিয়ে কীভাবে এই গ্রন্থের কাঠামো গড়ে তুলেছেন লেখক। আলোচ্য নিবন্ধগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি যেমন একজন দায়বদ্ধ বিচারকের অভিজ্ঞতায় বঙ্গবন্ধুর দার্শনিক ব্যক্তিত্বকে সামনে এনেছেন, তেমনি সংবিধানে প্রতিফলিত জাতির পিতার মহান আদর্শ, ধর্মবিশ্বাস, ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাকে বিশ্লেষণ করে তা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন।

বঙ্গবন্ধু: সংবিধান আইন আদালত ও অন্যান্য বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম প্রকাশক: মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, প্রকাশকাল: মার্চ ২০২১, ২২৮ পৃষ্ঠা, দাম: ২৫০ টাকা।

বঙ্গবন্ধু তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের একদিকে যেমন পূর্ব বাংলার শোষণ-বঞ্চিত-নিষ্পেষিত-নিপীড়িত মানুষকে সব ধরনের শাসন-শোষণের জাঁতাকল থেকে মুক্ত করেছেন, ঠিক তেমনি ১৯৭২ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেই জাতীয় সংসদে সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। সংবিধান সংরক্ষণে সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠায় ঐতিহাসিক কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। তা ছাড়া পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা, আইন-আদালত, বিচারব্যবস্থার প্রক্রিয়া প্রণয়নে দেশ পরিচালনায় এই নেতার দৃঢ়প্রত্যয়ের প্রতিফলন ঘটেছে। বস্তুত এই বইয়ে বঙ্গবন্ধুর ন্যায়পরায়ণ বিচারব্যবস্থার নৈতিক আদর্শকে গণমানুষের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

এখানে লেখক তাঁর অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন এভাবে, ‘অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাঙালি সত্তার মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন দুর্নীতিমুক্ত একজন বাঙালি ও মানুষ হতে হলে “বঙ্গবন্ধু চর্চা ও লালন” অপরিহার্য। নিজে যেন এ চর্চা-লালন করতে পারি সে তাগিদ থেকেই আমার এ লেখাগুলো। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আজ শুধুমাত্র আমার স্মৃতিতে নয়—অস্তিত্বেও সদা বিরাজমান।’

এসব কারণেই বোধ হয় মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ আলোচ্য বইয়ের পর্যালোচনায় বলেছেন, ‘বইটিতে লেখক আমাদের ব্যক্তি ও সামষ্টিক জীবনে বঙ্গবন্ধুর যে প্রভাব তুলে ধরেছেন, তা নতুন প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শ ও চিন্তা-চেতনাকে নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে উৎসাহিত করবে।’

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার অর্ধশতবর্ষপূর্তি পালনের প্রেক্ষাপটে গ্রন্থটির পাঠমূল্য ও তাৎপর্য অপরিহার্য। বইটি তথ্যনির্ভর, যুক্তিনিষ্ঠ ও জ্ঞান অন্বেষী পাঠককে রাষ্ট্রসম্পর্কিত নানা দার্শনিক চিন্তার খোরাক জোগাবে।