বাংলাদেশকে বোঝার একটি চেষ্টা

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনকালে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক বিবর্তনের একটি পরিষ্কার ছবি দেখতে পাওয়া জরুরি। নানা উত্থান-পতন, ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সামনে এগিয়ে চলা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে বিস্ময়কর উত্থান যেমন এই ছবির অংশ, তেমনি এখানে ফুটে ওঠে বৈষম্য-বঞ্চনা-অবহেলার করুণ দিকগুলো। আর তাই এই ছবি আঁকার কাজটি খুব সহজ নয়। তারপরও অর্থনীতিবিদ রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর সে রকম একটি চেষ্টা করেছেন তাঁর ‘যুদ্ধোত্তর থেকে করোনাকাল: বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের রাজনৈতিক অর্থনীতি (১৯৭১-২০২০)’ শিরোনামে প্রকাশিত বইটিতে। তাঁর সেই চেষ্টা কতটা সফল হয়েছে, সে বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে অন্তত এ রকম একটি কাজের জন্য তিনি প্রথমেই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

ভূমিকায় লেখক অবশ্য জানিয়েছেন যে দুই বছর আগে ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও অর্থনৈতিক ফলাফল’ নামের তাঁর যে বইটি বের হয়েছিল, বর্তমান বইটি সেটির সংশোধিত, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ। এখানে করোনাভাইরাস মহামারির ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও পরিবর্তিত হয়েছে, তার ওপর বিশদ আলোকপাত করা হয়েছে।

পাঁচ অধ্যায়ে বিন্যস্ত এই বইয়ে লেখক দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশে শুরু থেকেই বিভাজনের রাজনীতি, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর যথেচ্ছ সুবিধা আদায়ের চেষ্টা আর জনসাধারণের ওপর আমলাতন্ত্রের চেপে বসার যে প্রবণতা তৈরি হয়, তা পরবর্তী বছরগুলোয় নানারূপে জোরদার হয়ে ওঠে এবং এখনো বজায় আছে। এর ফলে সত্যিকারের জনবান্ধব রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। আবার এই প্রবণতাগুলো কেন তৈরি হলো ও বহাল থাকল, সেগুলোর কারণ নির্ণয় করতে গিয়ে লেখক বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করেছেন এবং সাহসিকতার সঙ্গে সেগুলো বিশ্লেষণ করেছেন। এটা এই বইয়ের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। যেমন তিতুমীর লিখেছেন, ‘গোষ্ঠীতন্ত্রের মাধ্যমে দেশে জোরজবরদস্তি, লুটপাট-লুণ্ঠনের মাধ্যমে সম্পদের আদিম সঞ্চয়ন চলছে।...আদিম কায়দায় সম্পদশালী বা ধনীর সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়লেও উত্পাদনশীল খাতের সম্প্রসারণ হচ্ছে না। এভাবে কতিপয়ের হাতে সম্পদের পুঞ্জীভবন ও কেন্দ্রীকরণ আগেও ছিল; তবে আগে এখনকার মতো এত বেশি অর্থ পাচারের ঘটনা ছিল না। এখন একদিকে অর্থ পাচার বেড়ে চলছে, অন্যদিকে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়ানো যাচ্ছে।’ (পৃষ্ঠা ১৬৬-৬৭) আবার তিনি বলছেন যে দেশের উন্নয়নকৌশলের জন্য যে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করা হয়েছে, সেখানে ‘বিজয়ীর সব হাতিয়ে নেওয়ার বা “উইনারস টেক অল” প্রবণতা মাথা চাড়া দিয়ে’ উঠেছে। এর ফলে টাকা দিয়ে সব করা ও কেনা যায়—এহেন মানসিকতার এক বিরাট গোষ্ঠী দাঁড়িয়ে গেছে, যা দেশ ও জাতি গঠনকে কঠিনতর করে ফেলেছে।

যুদ্ধোত্তর থেকে করোনাকাল বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের রাজনৈতিক অর্থনীতি (১৯৭১-২০২০) লেখক: রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০২১ পৃষ্ঠা: ২৫৬; মূল্য: ৪৮০ টাকা প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল

তিতুমীর তাঁর বইতে বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিক্রমায় প্রকৃতি-পরিবেশ-জলবায়ু, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-জীবনাচরণ, প্রবৃদ্ধি-মূল্যস্ফীতি-কর্মসংস্থান, ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাট, স্বজনতোষী মুনাফা-অনুপার্জিত আয়সহ প্রায় সব বিষয়ের ওপর আলোকপাত করে এসবের মধ্যে পারস্পরিক যোগসূত্র খুঁজে বের করেছেন এবং তা সহজভাবেই পাঠকের কাছে তুলে ধরেছেন।

বইটির একটি সীমাবদ্ধতা হলো কোনো রেফারেন্স কিংবা সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি ও তথ্যপঞ্জির উল্লেখ না থাকা। তবে লেখক ভূমিকাতে এ বিষয়ে আগেই স্পষ্ট করে বলে নিয়েছেন। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় সম্পর্কে লেখকের নিজস্ব বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ একাধিক প্রকাশিত প্রামাণ্য গবেষণাকাজ বা বইয়ের সহায়তায় লেখা হয়েছে বলে ধারণা জন্মে।

আর বইটির বিশ্লেষণগুলো লেখক এতটা চমত্কারভাবে উপস্থাপন করেছেন যে যেকোনো পাঠকই বইটি আগ্রহ নিয়ে পড়বেন এবং নিজেরাও হয়তো বিশ্লেষণের চেষ্টা করবেন।