বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের অগ্রযাত্রা

১৯৭১ থেকে ২০২১, এ ৫০ বছরে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক অগ্রযাত্রার গল্প একটি নাতিদীর্ঘ প্রকাশনায় সম্পাদিত করার দুঃসাহস করেছেন এস নারায়ণ ও শ্রীরাধা দত্ত। ২০২০ সালে ভারতের ওরিয়েন্ট ব্লাকসোয়ান থেকে এই বই প্রকাশিত হয়েছে। প্রারম্ভিকা বাদে বইটিতে ১১টি অধ্যায় রয়েছে। অতিরিক্ত প্রাপ্তি হিসেবে এখানে প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান রচিত মুখবন্ধটি অত্যন্ত সুখপাঠ্য এবং পুরো বইতে অন্যান্য প্রবন্ধ পড়ার আগে পাঠকের মনোজগতে একটি জ্ঞান অন্বেষণের স্পৃহা তৈরি করবে। ২০১৯ সালে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনিস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের একটি প্রকল্প হিসেবে বইটির কার্যক্রম শুরু হয়। সম্পাদিত বইটিতে যাঁরা প্রবন্ধ লিখেছেন, তাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপরিচিত ও বিশেষজ্ঞ। বইটিতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, তৈরি পোশাক রপ্তানি, অর্থ খাত—সার্বিক অর্থনৈতিক বিষয়াবলি নিয়ে পাঁচটি মৌলিক প্রবন্ধ সংযোজিত হয়েছে। নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে তিনটি এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের অর্জন নিয়ে আরও তিনটি গবেষণাধর্মী অধ্যায় এখানে সংযোজিত হয়েছে। এসব অধ্যায়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য, বেসরকারি উন্নয়ন খাতের অগ্রযাত্রা, নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, উগ্রবাদের উত্থান, বৈদেশিক সম্পর্ক ও পররাষ্ট্র নীতিসম্পর্কিত বিষয়াবলি নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বেড়ে ওঠার গল্প অনন্যসাধারণ। কারও কাছে এই গল্প অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিস্ময় বা সামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে অগ্রগতি আর বহু মানুষের সম্মিলনীতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র তৈরির প্রচেষ্টা। একই সঙ্গে এই গল্পে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের ও রাজনৈতিক সহনশীলতা অর্জনের ক্ষেত্রে সমস্যাসংকুল পথ পরিক্রমার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত। এগুলোর সমন্বয়ে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে যে দৃশ্যমান পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে, তা সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে সব ধরনের বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার ছোট রাষ্ট্রের ধারণা থেকে বের হয়ে এসে একটি স্বতন্ত্র বাংলাদেশ মডেলের ধারণা এবং তার বিবর্তন এই বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় উঠে এসেছে।

প্রারম্ভিকায় সম্পাদকদ্বয় এই গবেষণাধর্মী প্রকাশনীর যৌক্তিকতা তুলে ধরতে গিয়ে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার মিশ্র অভিজ্ঞতার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। ৫০ বছরের রাজনৈতিক পরিক্রমায় একনায়কতন্ত্র থেকে বহুধাবিভক্ত গণতন্ত্রের উত্থান, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে বেসরকারি খাতের উন্নয়ন, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতি ও বিশ্ব পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের অবস্থানের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ যাত্রায় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে যেসব বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে, তা হলো—রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ভবিষ্যত, তৈরি পোশাক রপ্তানির বাইরে অর্থনীতির অন্য খাতে অপরিপক্কতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত হুমকি। সামাজিক উন্নয়নে সাধারণ মানুষের অবস্থান, সামাজিক ন্যায়বিচার ও এর মূল্যায়নের মিশ্র চিত্র তাঁদের বর্ণনায় ফুটে উঠেছে। এ আলোচনা পরবর্তী অধ্যায়গুলোয় বিশেষজ্ঞ লেখকদের বিশ্লেষণের প্রতি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।

অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান তাঁর প্রবন্ধে বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে একটি ত্রিমাত্রিক ধারণায় আবদ্ধ করেছেন। ভবিষ্যত পথচলায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির স্থিতিশীলতা, সামাজিক অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতিমালার সংযোজন এবং পরিবেশের দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণ—এসবের সমন্বয়ে জাতীয় উন্নয়নকে টেকসই রূপ দেওয়া সম্ভব।

নিম্ন আয়ের দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের ক্ষেত্রে আর্থসামাজিক সূচকের বিস্তারিত তথ্য এ অধ্যায়ে সংযোজিত হয়েছে। এ ছাড়া মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশের সাফল্য ও চ্যালেঞ্জসমূহের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়েছে। অমিতেন্দু পালিত, যিনি এই বইতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিবেশ নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন, ও অধ্যাপক রহমান দুজনই ২০২৪–পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন উন্নত দেশ থেকে প্রাপ্ত বাণিজ্য সুবিধার অভাব দেখা গেলে বাংলাদেশকে বিশ্ব প্রতিযোগিতামূলক বাজারে কীভাবে টিকে থাকতে হবে, তার ওপর আলোকপাত করেছেন। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বিষয়টি মাথায় রেখে লেখকদ্বয় উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, কাঠামোগত উন্নয়ন, অসাম্যতা দূরীকরণসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর সম্যক দৃষ্টি রাখতে সুপারিশ করেছেন। অভ্যন্তরীণ সুশাসনের প্রয়োজনীয়তা অধ্যাপক রহমানের লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে। অমিতেন্দু পালিত মনে করেন, বাংলাদেশের জন্য ২০২৪ সালে মধ্য আয়ের দেশে উত্তরণের পর একটি মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠার বিষয়টিতে গুরুত্ব আরোপ করা প্রয়োজন।

অধ্যাপক সেলিম রায়হান বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে তৈরি পোশাক রপ্তানি খাতের ওপর একটি তথ্যবহুল প্রবন্ধ রচনা করেছেন। এই খাতে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের প্রভাব লক্ষ করা গেছে দেশে এর কাঠামোগত পরিবর্তন এবং ব্যক্তি অর্থনীতিতে বিভিন্ন অবদানের মাধ্যমে। তবে লেখক মনে করেন, ভবিষ্যতে এই খাতে বৈচিত্র্যায়ন দরকার। এ ক্ষেত্রে তিনি কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে নতুন কাজের ক্ষেত্র তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা নীতিনির্ধারকদের চিন্তার খোরাক হিসেবে আলোচনায় এসেছে। সামষ্টিক অর্থনীতির বিভিন্ন অর্জনে আর্থিক খাতের অবদান ও আর্থিক নীতিবিষয়ক অর্জন নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দীন আহমেদ। এতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থিতিশীলতা এবং সেখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়ানোর ওপর সুপারিশ করেছেন। এ ছাড়া সুবিধাভোগী অংশীজন ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে এই খাতের মূল প্রতিবন্ধকতাসমূহ অধ্যায়টিতে খুব বিশদ বিশ্লেষণে অবমুক্ত হয়নি, যা হয়তো পাঠকের মনে একটি আফসোসের জন্ম দিতে পারে।

উন্নয়ন আলোচনায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বেসরকারি বহুজাতিক সংস্থা ও এনজিওদের অবদান অনস্বীকার্য। বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে অংশীদারত্বের মাধ্যমে উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় এনজিও বাংলাদেশের উন্নয়ন এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য দূরীকরণ, পরিবার পরিকল্পনা, নারীর ক্ষমতায়ন, ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের মাধ্যমে নারীকে স্বাবলম্বী করে তোলা ইত্যাদি কার্যক্রমে এসব সংস্থা অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছে। গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক ও প্রশিকার উদাহরণ বাংলাদেশ সম্পর্কে নতুন পাঠকদের আগ্রহ বাড়িয়ে দেবে।

সংকলনটির ষষ্ঠ অধ্যায়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক গঠন নিয়ে প্রথম নিবন্ধটি সংযোজিত হয়েছে। এখানে শ্রীরাধা দত্ত স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বিশদ বিবরণ তুলে ধরেছেন। গত ৫০ বছরের বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সমাজে সংঘর্ষের মাত্রাকে প্রভাবিত করেছে। রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনায় আরও যে বিষয় উঠে এসেছে তা হলো, সুশাসনের অভাব এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দক্ষতার অভাব। আর এসব অভাবের কারণে সাধারণ মানুষ তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

বেসামরিক-সামরিক সম্পর্কের প্রভাব বাংলাদেশ রাজনীতির সংস্কৃতিতে অনস্বীকার্য। এ ছাড়া দেশে ১৯৭৫ সালের পর কট্টরপন্থী ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মূলধারার রাজনীতির সহায়ক শক্তি হিসেবে বেড়ে ওঠার বিষয়টি আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে যুক্ত হয়েছে। মূল ধারার রাজনীতিতে বিভক্তির সুযোগে এই ধরনের শক্তি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভিন্ন সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ। লেখক তাঁর বিশ্লেষণে বলেছেন, একধরনের অতি নিয়ন্ত্রক রাজনৈতিক পরিবেশের উপস্থিতি বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের ধারায় ঋণাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।

বাংলাদেশ অ্যাট ফিফটি: ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস
সম্পাদক: এস নারায়ণ ও শ্রীরাধা দত্ত
ওরিয়েন্ট ব্লাকসোয়ান (২০২০)

সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে কোনো অধ্যায় সংযোজিত না হলেও উগ্রপন্থা ও জঙ্গিবাদ নিয়ে অমিতরঞ্জন ও রোশনী কাপুরের একটি প্রবন্ধ পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে। আলোচ্য প্রবন্ধে বাংলাদেশে উগ্রপন্থার উত্থানের সঙ্গে ১৯৭৫–পরবর্তী সময়ে তৎকালীন সামরিক শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক ধর্মভিত্তিক দলগুলোর উন্মুক্ত রাজনীতি করার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়েছে। একই সঙ্গে ২০০১ সালের ৯/১১–পরবর্তী বিশ্বে আন্তর্জাতিক উগ্রবাদের উত্থানের ফলে বাংলাদেশেও এর প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে। সব মিলিয়ে এ অধ্যায়ে উগ্রবাদের বিস্তারের পাশাপাশি এসব গোষ্ঠীর ব্যবহৃত কৌশল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। তবে উগ্রবাদ দমনে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বা এখানে সুশীল সমাজের অবদান কী এবং এ বিষয়ে ভবিষ্যতে করণীয় কী হতে পারে, তা আরও বিস্তারিত আলোচনা করা যেত।

অধ্যাপক আমেনা মোহসিন সামাজিক উন্নয়নে নারীর ক্ষমতায়নের ওপর একটি গবেষণা প্রবন্ধ লিখেছেন। নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এক যুগান্তকারী উদাহরণ। এ ক্ষেত্রে আমরা যুগপৎভাবে রাষ্ট্র, সুশীল সমাজ ও বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসতে দেখেছি। ১৯৯০ সালের পর নারীর উন্নয়নে রাষ্ট্রের সংবিধান ও অন্য আইনসমূহ বিশেষ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। সংসদে নারী আসন, স্থানীয় রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ এবং বেসরকারি খাতে নারীর অবদান বাংলাদেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে গুরুত্ব বহন করে। একই সঙ্গে সামাজিক পর্যায়ে নারীর অধিকার নিয়ে যে আন্দোলন, তা নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টিকে জাতীয় এজেন্ডায় রূপান্তর করেছে। তবে এত কিছুর পরও নারী পারিবারিক নিগ্রহ এবং সামাজিকভাবে হেয়-প্রতিপন্ন হওয়া থেকে নিজেকে কতখানি মুক্ত করতে পেরেছে, সে প্রশ্ন এ অধ্যায়ে পাঠকদের জন্য রেখে যাওয়া হয়েছে।

বইয়ের শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ও বৈদেশিক সম্পর্ক নিয়ে দুটি অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে। প্রাক্তন পররাষ্ট্র সচিব শমসের মুবিন চৌধুরী বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের পাঁচ দশকের ওপর বিশদ আলোচনা করেছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারের সময়ে ভারতে সঙ্গে বিভিন্ন চুক্তি ও পারস্পরিক যোগাযোগের তথ্য সংকলিত হয়েছে। এতে করে এ সম্পর্কের আনুষ্ঠানিক ভিত্তি যে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের ওপর নির্ভরশীল, এ ধরনের যুক্তির আভাস পাওয়া যায়। বর্তমান সময়ে ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো স্বল্প পরিসরে তুলে ধরার চেষ্টা হলেও বিষয়টি নিয়ে আরও গভীরে আলোচনা করার সুযোগ ছিল। তাহলে ভবিষ্যতে এই সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেত।

সর্বশেষ অধ্যায়ে শ্রীরাধা দত্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির গত ৫০ বছরের একটি সামগ্রিক চিত্র উপহার দিয়েছেন। এ প্রবন্ধে চারটি ১৯৭১-৭৫, ১৯৭৫-৯০, ১৯৯০-২০০৬, এবং ২০০৮-উত্তর—সময়কালের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সম্পর্কের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, এই ধারণায় নির্মিত। স্নায়ুযুদ্ধ উত্তরকালে বাংলাদেশের মুক্তবাজার অর্থনীতিতে অংশগ্রহণের ফলে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন করেছে। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক উভয় পর্যায়ে বাংলাদেশের ভূমিকা একে একধরনের শত্রুবিহীন রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। তবে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জোরপূর্বক বিতাড়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে মায়ানমারের সম্পর্কে এক নতুন ধারার সংযোজন হয়েছে। লেখকের মতে, পরবর্তী দশকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিবেচ্য বিষয় হবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় করা। একই সঙ্গে এটিও পর্যালোচনার বিষয় যে চীন, ভারত, ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্কের বেড়াজালে বাংলাদেশ কীভাবে তার জাতীয় স্বার্থ সর্বাধিক কার্যকর ও আদায় করতে সক্ষম হয়।

সম্পাদিত এই বইয়ে প্রতিটি অধ্যায়ে তথ্যনির্ভর আলোচনা ও যুক্তি পাঠক ও গবেষকদের জন্য নতুনভাবে গবেষণা করার খোরাক জোগাবে। তবে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই বইয়ের আলোচনায় জায়গা করে নিতে পারত। প্রথমত, উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদ বাংলাদেশের সামগ্রিক নিরাপত্তার চিত্রকে প্রতিফলিত করে না। বিশেষত, যে বই ৫০ বছরের বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার বিবরণ তুলে ধরছে, সেখানে মানব নিরাপত্তা ও রাষ্ট্র নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে একটি পরিপূর্ণ অধ্যায় একে আরও পূর্ণতা এনে দিতে পারত। দ্বিতীয়ত, সামাজিক উন্নয়নে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উন্নতি ও প্রতিবন্ধকতাসমূহ পৃথক ও পরিপূর্ণ বিশ্লেষণের দাবি রাখে। তৃতীয়ত, জবাবদিহির প্রতিষ্ঠানগুলোর (ইনিস্টিটিউশনস অব অ্যাকাউন্টিবিলিটি) কার্যক্রম, সফলতা, ব্যর্থতা ও ভবিষ্যত আরও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। এসব বিষয় নিয়ে পৃথক অধ্যায় পরবর্তী কোনো সংকলনে সংযোজন করার ব্যাপারটি সম্পাদকদ্বয় ভেবে দেখতে পারেন।

পরিশেষে এটি নিঃসন্দেহে স্বীকার করতে হবে যে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অগ্রগতির চালচিত্র একটি বইয়ে ও একক সংকলনে নিয়ে আসা একটি সাহসী পদক্ষেপ। বাংলাদেশ বিষয়ে আগ্রহী দেশি ও বিদেশি গবেষক ও শিক্ষার্থীর কাছে বইটি অবশ্যপাঠ্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বাংলাদেশের অধিকতর পাঠকের নিকট সহজলভ্য করতে এই বইয়ের বাংলা সংস্করণের প্রয়োজনীয়তা ভেবে দেখা যেতে পারে।