সিদ্দিকা জামানের মধুর-বিধুর স্মৃতি

সিদ্দিকা জামান এক বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী। কামরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাকালে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে কণ্ঠ শাণিত করেছেন। গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষে দীর্ঘ পেশাজীবন অতিবাহিত করেছেন ব্রিটিশ কাউন্সিল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের গ্রন্থাগারে।

এর আগেও তিনি লিখেছেন, বাংলা একাডেমি প্রকাশিত রশীদ হায়দার সম্পাদিত স্মৃতি: ১৯৭১ বইতে। তবে এবার প্রকাশিত হলো তাঁর প্রথম বই আমার বিপুলা পৃথিবী। ১৯৬১ সালে যাঁর সঙ্গে তিনি যুগল-জীবনের পথচলা শুরু করেন, সেই আনিসুজ্জামান যখন তাঁদের দাম্পত্য জীবনের ছয় দশক পূর্তির কিছু আগে প্রয়াত হন, তখন সিদ্দিকার স্মৃতিসিক্ত কলম আমাদের উপহার দেয় এই বই।

নয় অধ্যায়ের বইয়ের সূত্রপাত আনিসুজ্জামানের সঙ্গে লেখকের প্রথম পরিচয়, প্রণয় ও পরিণয় দিয়ে। তবে তাঁর দেখার সামগ্রিকতা বাড়িয়েছে লেখার প্রসন্নতা, তাই দুজনের গল্পে শুরু থেকেই ঘিরে থাকে আশপাশের অনেকে।

বিয়ের আট বছর পর আনিসুজ্জামানের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের খবর দিয়ে যে দ্বিতীয় অধ্যায়-বিন্যাস, তা পাঠককে যেন বলতে থাকে ‘নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়।’ এখানে মহান মু্ক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ এসেছে নিপুণ বিবরণে; ভারতে অবস্থানকালে দেশে আইনজীবী চাচা আব্দুল আহাদের শাহীদ হওয়ার খবরে সিদ্দিকা যেমন ভেঙে পড়েছেন, তেমনি প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আনিসুজ্জামানের সাহসী ভূমিকার কথা বর্ণনা করেছেন।

আমার বিপুলা পৃথিবী

সিদ্দিকা জামান

প্রচ্ছদ: মাসুম রহমান

প্রকাশক: অন্যপ্রকাশ, ঢাকা

প্রকাশকাল: একুশে বইমেলা ২০২১

১৪৪ পৃষ্ঠা

দাম: ৪৮০ টাকা।

পরের অধ্যায়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ‘নীপবন’ নামের ব্যতিক্রমী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার গল্প আমাদের মুগ্ধ করে। গবেষণাসূত্রে আনিসুজ্জামানের বিদেশযাত্রার স্মৃতিচারণার পাশাপাশি গবেষণাসূত্রে ক্লিনটন বি সিলির বাংলাদেশে আসা ও তাঁদের আবাসে অবস্থানকেও স্মৃতি চিত্রিত করে রেখেছেন লেখক, ‘১৯৮১ সালে আনিসুজ্জামান আলজিয়ার্সে যাওয়ার আগে আমেরিকান অধ্যাপক ড. ক্লিনটন বি সিলি আমাদের বাসায় অতিথি হয়ে এসেছিলেন। উনি জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে গবেষণা আর কবিতা অনুবাদ করে খুব প্রশংসিত হয়েছিলেন। সেবার এসেছেন গবেষণার উপকরণ সংগ্রহের জন্য। পরিকল্পনা করেছেন ঢাকা ও চট্টগ্রামে তিন মাস করে মোট ছয় মাস বাংলাদেশে থাকবেন। আনিসুজ্জামান আমায় বলল, “উনি আমাদের বাসায় থাকলে কোনো অসুবিধা হবে কি না?”’

না, অসুবিধা তো নয় বরং আনিসুজ্জামান ও সিদ্দিকা জামান পরিবারের অনাড়ম্বর অথচ আন্তরিক আতিথেয়তায় ‘উনি একেবারেই বাঙালিদের মতো থাকতেন। লুঙ্গি, শার্ট ও ফতুয়া পরতেন। নিজের কাপড় নিজে ধুতেন। সব সময় বাংলায় কথা বলতেন। ছেলেমেয়েরা তাঁকে “ক্লিন্ট চাচা” ডাকত।’

পঞ্চম অধ্যায় হলো চট্টগ্রাম থেকে আনিসুজ্জামানের ঢাকায় প্রত্যাবর্তন এবং বৃহত্তর জীবনের বিভায় স্নাত হওয়ার আখ্যান। বিশ্ববিদ্যালয়পাড়ায় বন্ধুবান্ধব ও প্রতিবেশীদের সাহচর্যে তাঁদের জীবন কতটা আনন্দময় ছিল, তা কৃতজ্ঞচিত্তে বারবার বলতেও তিনি অক্লান্ত। এখানে পাওয়া যাবে ব্যক্তি আনিসুজ্জামানের মানবিক দিকও, ‘একবার পাড়ার কোনো ভাবির রুটির দরকার হলে আনিসুজ্জামান নিজে গিয়ে দোকান থেকে রুটি এনে দিল।’

সিদ্দিকা জামানের লেখার বড় গুণ তাঁর রসবোধ। আনিসুজ্জামান তাঁর আত্মজীবনী কাল নিরবধির উৎসর্গবাক্যে লিখেছিলেন, ‘সাতপাঁচ ভেবে বেবীকেই’। (সিদ্দিকা জামানের ডাকনাম বেবী)। এ প্রসঙ্গে সপ্তম অধ্যায়ে লেখক লিখেছেন, ‘বন্ধুবান্ধবরা মজা করে বলল, আপনি জিজ্ঞেস করলেন না, কেন এত ভাবতে হলো?’

এ বইয়ে আনন্দের ফোয়ারার সঙ্গে আছে বেদনারও। জামাতা সুমনের অকালমৃত্যুর ঘটনা তাঁদের বাকস্তব্ধ করে দেয়। আবার আনিসুজ্জামানের অসুস্থতায় পরিবার ও পরিপার্শ্বের উদ্বেগাকুল হৃদয় অশ্রুর অক্ষরে ধারণ করেছেন সিদ্দিকা জামান। ১৪ মে ২০২০-এ আনিসুজ্জামানের বর্ণিল জীবনের সমাপনকে তিনি বাণীবদ্ধ করেছেন এভাবে, ‘বর্ণহীন হতে শুরু করল আমার বিপুলা পৃথিবী।’

খ্যাতকীর্তি আনিসুজ্জামানকে নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে এবং নিশ্চিতভাবেই আরও হবে। কিন্তু মানুষ আনিসুজ্জামানের অজানা ভুবন উন্মোচনে এই বইটি বিশিষ্ট বলেই বিবেচিত হবে।