সেকালে বটতলার বইয়ের বিজ্ঞাপন

বইমেলা সমাগত। কদিন বাদেই বিচিত্র বইয়ের বিজ্ঞাপনে বর্ণিল হয়ে উঠবে পত্রপত্রিকা। বাংলা বইপত্রের বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে বটতলার ছিল বিস্তর অবদান। কেমন ছিল বটতলার সেসব বিজ্ঞাপন?

‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ বলে একদা কবিতা লিখেছিলেন কবি শঙ্খ ঘোষ। তবে পড়ুয়াদের মনে বিজ্ঞাপনও কখনো কখনো ঔৎসুক্য ও স্বপ্নালু আবেশ তৈরি করতে পারে, যদি তা হয় বইয়ের বিজ্ঞাপন। কদিন পরেই বইমেলা। এখন বইমেলা শুরু হলে পত্রপত্রিকায় ছাপা হয় রাশি রাশি বইয়ের বিজ্ঞাপন। তবে অনলাইনের এই যুগে বইয়ের বিজ্ঞাপনের বড় জায়গা উঠেছে ফেসবুক আর ইউটিউবও।

কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞাপনের ধারাটি ছিল একদম অন্য রকম। কেমন? সেটা জানতে ফিরতে হবে সেই উনিশ শতকে। ১৮৬০ সাল। পূর্ববঙ্গে তখন জ্বলছে নীল বিদ্রোহের আগুন। সেই আগুনে ঘৃতাহুতি দিতে সে বছর ঢাকার চকবাজার থেকে প্রথম প্রকাশ হলো দীনবন্ধু মিত্রের নাটক নীল দর্পণখান থেকেই বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্পের মহিরুহ হয়ে ওঠার সূচনা। চকবাজারের বইয়ের জগৎকে ‘বাংলাদেশের বটতলা’ বলে উল্লেখ করেছেন মোহাম্মদ আবদুল কাইউম তাঁর চকবাজারের কেতাবপট্টি বইয়ে। এখন নিশ্চয় জানতে ইচ্ছা করছে, কোথায় ছিল এই বটতলা?

বাংলা সাহিত্যের যে রেনেসাঁ এসেছিল, তার প্রাক্​–মঞ্চায়ন ঘটেছিল কলকাতায়। আরও খুলে বললে কলকাতার শোভাবাজারের বটতলাকে কেন্দ্র করে। মোটামুটি ১৮১৬ সাল থেকে শুরু হয় বটতলা সাহিত্যের যাত্রা। কয়েক শ প্রকাশক বটতলার বাজারে জাঁকিয়ে বসেন বইয়ের পসরা নিয়ে। চটুল আদিরসাত্মক কাহিনি, হিতোপদেশ, ধর্মীয় কাহিনি, পূজাবার্ষিকী ও পঞ্জিকা প্রকাশ করে কম দামে তাঁরা বই তুলে দিতেন সব শ্রেণির পাঠকের হাতে। পরে গোয়েন্দা কাহিনি, পুলিশি তদন্ত আর প্লেটনিক প্রেমকাহিনির বইগুলো বটতলাকে পৌঁছে দিয়েছিল জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তবে নিছক সস্তা বইয়ে আটকে থাকেনি বটতলার সাহিত্যবাজার, রামমোহন রায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, মীর মশাররফ হোসেন এমনকি রবীন্দ্রনাথের মতো রথী-মহারথীদের বই প্রকাশ করেও কলকাতার বটতলা ‘জাতে’ ওঠার চেষ্টা করে।

সে সময় বটতলার ‘হাটুরে সস্তা’ বইগুলো ছিল প্রবল জনপ্রিয়। আর জনপ্রিয় ছিল বলেই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য দরকার পড়েছিল বিজ্ঞাপনমুখী হওয়ার।

কিন্তু সেই বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য এখনকার মতো কোনো ‘মিডিয়া’ ছিল না। তাই বাংলায় বইয়ের বিজ্ঞাপনের সূচনা ঘটে বিচিত্র সব পন্থায়। অবশ্য তখনো সমাচার দর্পণ-এর মতো সদ্যোজাত কিছু পত্রিকা এবং সাময়িকী ছিল। সেগুলোতেও বইয়ের বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো, তবে সে সংখ্যা নগণ্য। ফলে বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে বটতলার বইগুলোই বড় ভরসা হয়ে উঠেছিল।

সেকালে ‘কইয়ের তেলে কই ভাজতে’ বটতলার প্রকাশকেরা ছিলেন দারুণ ওস্তাদ। বুদ্ধি করে এক বইয়ের মলাটের ভেতর তাঁরা পুরে দিতেন আরেক বইয়ের বিজ্ঞাপন। আবার বিজ্ঞাপনের লক্ষ্য যখন সর্বাধিক গ্রাহকের কাছে নিজের পণ্যের কথা প্রচার করা, এ ক্ষেত্রে তখন পঞ্জিকাই ছিল সবচেয়ে বড় মাধ্যম।

বিখ্যাত গবেষক ও লেখক শ্রীপান্থ তাঁর বটতলা নামের বইটিতে লিখেছেন, ‘নতুন বাংলা বইয়ের সংবাদ সমাচার দর্পণ-এর কাল থেকে কিছু কিছু কাগজে ছাপা হতো। কোনো কোনো সাময়িক পত্রে বইয়ের বিজ্ঞাপনও দেখা যায়। যেমন ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের এডুকেশন গেজেট। কিন্তু পঞ্জিকার বইয়ের বিজ্ঞাপনের সঙ্গে এসবের তুলনাই চলে না। বটতলার প্রকাশকেরা পাতার পর পাতা জুড়ে প্রকাশ করতেন নিজেদের বইয়ের বিজ্ঞাপন। কখনো কখনো সচিত্র বিজ্ঞাপন পর্যন্ত।’

বিজ্ঞাপন ছাপার উদ্দেশ্য যেহেতু পাঠকরের দৃষ্টি আকর্ষণ, তাই এর ভাষা হয়ে ওঠে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভাষা চটকদার বা আকর্ষণীয় করতে যত রকম চেষ্টা, তার সব কটিই করতেন লেখক-প্রকাশকেরা। চলতি গদ্যের পাশাপাশি হাটুরে পদ্য কিংবা পুঁথির ভাষাতেও লেখা হতো বিজ্ঞাপন। যেমন, গঙ্গাভক্তি তরঙ্গিনী বইয়ের নামপত্রে লেখা বিজ্ঞাপনের ভাষা ছিল এমন, ‘চিৎপুর রোড আছে সর্বলোকে জানে। দুই শত ছয়চল্লিশ নম্বর ভবনে ॥ / তার সঙ্গে বিদ্যারত্ন যন্ত্র পরিষ্কার ...সেই প্রেশে এই পুঁথি সংশোধন দ্বারে। মুদ্রাঙ্কিত হৈল পুনঃ উত্তম অক্ষরে ॥ / আবশ্যক হবে যার আসিবে হেথায়। লয়ে যাবে ভক্তিভাবে মজিবে মজা।’

এখনকার মতো বিজ্ঞাপনে বইয়ের ছবি বা প্রচ্ছদপট ছাপার চল শুরু হয়েছে এর কিছুদিন পরে। শুধু বিজ্ঞাপন কেন, খোদ বইয়ের প্রচ্ছদেও কিংবা ভেতরে ছবি ব্যবহারের চল শুরু হতে কয়েক বছর লেগে গেছে। আক্ষরিক অর্থেই বইয়ের নিজের মুখই হারিয়ে যেত বিজ্ঞাপনের আড়ালে। এক-দুই কিংবা তিন-চার শব্দে বইয়ের নাম দেওয়ার চল তখনই শুরু হয়েছিল বটে, তেমনি অনেক বইয়ে নামের বদলে প্রচ্ছদপটে থাকত ‘নামপত্র’–এর আড়ালে বিজ্ঞাপন।

বটতলার বিজ্ঞাপনের বড় একটা মাধ্যম ছিল ফেরিওয়ালা। কলকাতা কিংবা ঢাকা—এসব স্থানে তখনো সেভাবে বইয়ের দোকান গড়ে ওঠেনি। ‘শুধুমাত্র কোম্পানির প্রচারের স্বার্থে’ ঢাকা শহরে অলি–গলিতে যেমন তিন শ টাকার পণ্য এক শ টাকায় বিকোচ্ছে দেদার, সেকালে ফেরিওয়ালারা তেমনি একইভাবে তুলনামূলক কম দামে বই ফেরি করে বেড়াতেন। বিংশ শতাব্দীতে যদি বইয়ের বিকিকিনি দোকানকেন্দ্রিক হয়, একবিংশ শতাব্দী হয়ে উঠেছে অনলাইনকেন্দ্রিক; গ্রাহকের ঘরের দরজায় বই পৌঁছে দেন অনলাইন শপগুলোর ডেলিভারি ম্যান, দুই শ বছর আগে ঠিক এই কাজটিই করতেন ফেরিওয়ালারা। বাঁশের ঝুড়িতে বই বোঝাই করে, হেঁকে হেঁকে বই ফেরি করতেন। কখনো কখনো জিরিয়ে নেওয়ার জন্য একটু ছায়াতলে থমকে দাঁড়াতেন, তখন চারপাশে লোক জুটে যেত, গোল হয়ে ঘিরে ধরত ফেরিওয়ালাকে। এ সময় বইয়ের ‘প্রচারের স্বার্থে’ এবং বিক্রিবাট্টা বাড়াতে কাহিনির চুম্বক অংশ কখনো গল্পের ছলে, কখনো পুঁথিপাঠের মতো করে গেয়েও শোনাতেন এই ফেরিওয়ালারা। তাঁকে ঘিরে লোক বাড়ে, লোকে বই নেড়েচেড়ে দেখে, পছন্দ হলে কেনে। সে যুগে এই ফেরিওয়ালারাই ছিলেন বটতলার বইয়ের শোরুম, প্রচারক এবং বড় বিজ্ঞাপনও বটে। ফেরিওয়ালাদের প্রসঙ্গে শ্রীপান্থ রেভারেন্ড লংয়ের উদ্ধৃতিসহ বলেছেন, ‘শুধু কলকাতা আর কাছাকাছি এলাকায় বটতলার ফেরিওয়ালারা বই নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন গ্রামে-গঞ্জে। হাটে-বাজারে, মেলায় পসরা সাজিয়ে বসতেন তাঁরা। এভাবে বছরে আট–নয় মাস সরস্বতীর সেবা করে যে যাঁর গ্রামে ফিরে চাষবাসের দিকে নজর দিতেন। লং বলেছেন, এরা বাংলা বইয়ের সেরা বিজ্ঞাপন। পাঠকেরা জীবন্ত একজন প্রতিনিধিকে দেখতে পান, এমন একজন যিনি বইটি দেখাতে পারেন। বটতলা অতএব শুধু বই প্রকাশ নয়, প্রচারেও সমান উৎসাহী।’

বিজ্ঞাপনের আরও এক কার্যকর পদ্ধতি ছিল—লেখক-প্রকাশকেরা হ্যান্ডবিল ছেপে বিলি করতেন। বইয়ের নামপত্রে কিংবা পেছনের পাতায় বা পঞ্জিকায় যে ভাষা ও ঢঙে বিজ্ঞাপন ছাপানো হতো, একই ছিরি-ছাঁদে বিলি হতো হ্যান্ডবিলের বিজ্ঞাপনও। যশস্বী গবেষক সুকুমার সেন বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস–এ জানিয়েছেন, ‘এক ব্যক্তি আসিয়া তাঁহাদের হাতে কতকগুলো রাঙ্গা ছাপানো কাগজ দিয়া যায়। তাঁহারা পাঠ করিয়া দেখেন—নূতন পুস্তক, নূতন পুস্তক, সংসার-সহচরী মূল্য ৩ টাকা, পৌষ মাস মধ্যে লইলে তৎসহ উপহার দেওয়া যাইবে।’

বিজ্ঞাপনের আরেকটা জনপ্রিয় ধারা ছিল এক লেখকের প্রতি আরেক লেখকের ভালোবাসা। মানে লেখকেরা লেখকদের বিজ্ঞাপন করতেন। সেকালে লেখকদের মধ্যে সদ্ভাব ছিল বেশ, ঢাকার চকবাজারের কেতাবপট্টি থেকে যেসব বই বের হতো, সেগুলোর বেশ কিছুতে দেখা যায় এক লেখক আরেক লেখকের বন্দনা করছেন। সরাসরি বইয়ের বিজ্ঞাপন হয়তো এটা নয়, কিন্তু লেখককে বিজ্ঞাপিত করার মধ্য দিয়ে তাঁর বইয়ের কাটতি বাড়িয়ে দেওয়ার এ ছিল এক মোক্ষম কৌশল। চকবাজারের কেতাবপট্টি বইয়ে বিজ্ঞাপনের এই ঘটনা লক্ষ করা যায়। বইটির লেখক জনৈক কবি শেখ ঘিনুর বন্ধুপ্রীতির উদাহরণ দিয়েছেন এই বলে:

‘আর এক দোস্ত মুন্সি জহিরুদ্দিন নামেতে।

কি কব তারিফ তার রচনার বাতে।।

শুনিলে রচনা তার দেলে হয় খোস।

যত শুনি তত খুশি বাড়ে খোস জোশ।।’

বটতলার এসব বিজ্ঞাপনী কৌশল বইয়ের বিক্রি যে বাড়িয়েছিল, তাতে আর সন্দেহ কী। কিন্তু উনিশ শতকের বটতলার এই বিজ্ঞাপন ধারা দুই শ বছরের ব্যবধানে এখন আরও পরিশীলিত ও উন্নত হয়েছে বটে, তবে বইয়ের বিজ্ঞাপনের বিচিত্র কলাকৌশল বাঙালি শিখেছে বটতলা থেকে—এটা বললে বোধ হয় বেশি বলা হবে না।