বুড়ো আংলা নামের দারুণ এক বই আছে। বইটা পড়েছিলাম অনেক দিন আগে—সেই ছোটবেলায়। এখনো মাঝেমধ্যে পড়ি। তোমরাও পড়েছ হয়তো। পড়ে থাকলে বইয়ের চমৎকার কাহিনিটা তো জানোই। তারপরও বলি, ছেলেটার নাম রিদয়, কিন্তু ও আসলে হৃদয়হীন। যাকে বলে বিচ্ছু ছেলে। দুষ্টুমি করেই দিন কাটে। মানুষ, পশুপাখি, কীটপতঙ্গ—সবাই রিদয়ের জ্বালাতনে অতিষ্ঠ। একদিন সেই বিচ্ছু রিদয় জ্বালাতে গেল গণেশঠাকুরকে। গণেশঠাকুর এমন অভিশাপ দিলেন যে চোখের পলকেই রিদয় হয়ে গেল বুড়ো আঙুলের সমান, মানে সে হয়ে গেল বুড়ো আংলা!
রিদয় এখন কী করে? সুবচনী দেবীকে পূজা দেওয়ার জন্য মায়ের পোষা একটা খোঁড়া সাদা হাঁস ছিল। সে হাঁসেরই পিছু নেয় রিদয়। আর ওই সময় একদিন ওদের গ্রাম আমতলির ঠিক ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল একঝাঁক বালিহাঁস। ওরা আসছিল সেই সন্দ্বীপ থেকে। হিমালয় পেরিয়ে মানস সরোবরের দিকে যাবে ওরা। বালিহাঁসের ঝাঁকটা দেখে খোঁড়া হাঁস অমনি উলুঘাসের ঝোপ ছেড়ে সাদা দুই ডানা মেলে বাতাসে গা ভাসাল। অনেক দিন ওড়েনি বলে বেচারা প্রথমবারের চেষ্টায় মাটিতে পড়ে গেল গোত্তা খেয়ে। দ্বিতীয়বার উড়তেই রিদয় লাফ দিয়ে হাঁসের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমিও যাব।’
ব্যস, সুবচনীর হাঁসের সঙ্গে রিদয়ও উড়াল দিল মানস সরোবরের দিকে। আর সেই থেকে বিচিত্র এক যাত্রার সঙ্গী হয়ে গেলাম আমরা—তুমি, আমি, সব্বাই! উড়ে যেতে যেতে হাঁসের দলের সঙ্গে কত জায়গাই না দেখল বুড়ো আংলা। হাঁসের দল একসময় সুন্দরবন ছাড়িয়ে বাংলাদেশের বুকের ওপর দিয়ে উড়ে চলল। আকাশ থেকে নিচে তাকাতেই রিদয়ের কাছে সবকিছু রোদে পেতে রাখা নানান রঙের ছক কাটা চমৎকার এক কাঁথা মনে হলো। রিদয় দেখল, মাটির বুকে গ্রামে গ্রামে ঘরের চালে পাহারায় বসে আছে কুঁকড়ো, মানে মোরগের দল। উড়ন্ত পাখিরা ওদের কাছ থেকে জেনে নিচ্ছে নানান খবরাখবর। কোথায় কী পাওয়া যায়, কোথায় কোন বিপদ ওৎ পেতে আছে—এসব আরকি। এভাবে একসময় ওরা বলাবলি করল—‘কার বাড়ি?’ ‘ঠাকুর বাড়ি।’ ‘কোন ঠাকুর?’ ‘ওবিন ঠাকুর—ছবি লেখে।’
কেমন অদ্ভুত কথাবার্তা না? ওবিন ঠাকুর নামের মানুষটা নাকি ‘ছবি লেখে’! ছবি আবার কেউ লেখে নাকি? কে এই ওবিন ঠাকুর?
পাখিদের কথোপকথনে একটা ইঙ্গিত আছে। সেটা হলো ‘ঠাকুর বাড়ি’। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির কথা তো জানোই, যেখানে জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের দিকপাল—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথের ওই ঠাকুর বাড়িরই লোক এই ওবিন ঠাকুর। পুরো নাম অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবিঠাকুরের ভাইপো তিনি। ভারতীয় চিত্রকলা, মানে ছবি আঁকাআঁকির ক্ষেত্রটি সমৃদ্ধ করতে তাঁর বিশাল অবদান। ছবিই আঁকছিলেন তিনি। হঠাৎ একদিন রবীন্দ্রনাথের পরামর্শে ছোটদের জন্য কলম ধরেছিলেন।
সেই কলম দিয়ে এঁকেছেন বুড়ো আংলার মতো আশ্চর্যে ভরপুর এক পৃথিবীর ছবি। কল্পনার রঙে তুলি ডুবিয়ে ছোটদের জন্য তিনি কখনো লিখেছেন গল্প, ছড়া, রূপকথা আর কখনো নাটক। তাঁর শকুন্তলা, ক্ষীরের পুতুল, রাজ কাহিনী, খাজাঞ্চির খাতার মতো বইগুলো যেন আনন্দ আর বিস্ময়মাখা একেকটি ছবি। এ কারণেই হয়তো অবনীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘ওবিন ঠাকুর—ছবি লেখে।’ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৭১ সালের ৭ আগস্ট। অর্থাৎ আজ তাঁর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী। তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে।