ডাবল আনন্দ
আমার বার্বি ডল চাই। আব্বু আমার জন্য এটা এনেছে।—না, আমি নেব বার্বি ডল। এটা আমার পছন্দ। দুবোনে বার্বি ডল নিয়ে টানাহেঁচড়া চলে। দুবোনের টানাহেঁচড়ায় বার্বি ডলের প্রায় যায় যায় অবস্থা। একপাশে পড়ে আছে পাজল। সেটার দিকে কারও আগ্রহ নেই। বার্বি ডল ছেড়ে দুজনে তখন হাতাহাতি লেগে যায়। সেখান থেকে চুলোচুলি। অবশ্য শান্তার চুল নেই। আম্মু ন্যাড়া করে দিয়েছিল কদিন আগে। সামান্থার চুল ধরে টানে শান্তা। আর শান্তার কান ধরে আছে সামান্থা। ড্রয়িং রুমে বসে পেপার পড়ছিলেন আম্মু। দুজনের চেঁচামেচি শুনে ছুটে আসেন। —কী হয়েছে তোমাদের? একটু শান্তিতে থাকতে দেবে না নাকি? —আম্মু, দেখো, ও আমার বার্বি ডল নিয়ে যাচ্ছে। আব্বু তো আমার জন্য এনেছে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে শান্তা। —ইশ! ওনার জন্য এনেছে! আমিই তো গতবার আব্বুকে বললাম বার্বি ডল আনতে। তাইতো আব্বু আনলেন। ঠিক আছে, দুজনের কেউ পাবে না বার্বি ডল। দাও, আমাকে দাও। বলে আম্মু বার্বি ডলটা নিতে হাত বাড়ান। দুজনেই আঁকড়ে ধরে রাখে। কিন্তু আম্মু জোর করেই ছিনিয়ে নেন। তারপর আলমারিতে রেখে দিয়ে, তালা মেরে দেন। বলেন, দুজনে আগে ঠিক করো, কে নেবে। প্রতিজ্ঞা করো, মারামারি করবে না। তাহলেই পাবে। দুজন মিলে তখন কাঁদতে বসে। আব্বু থাকেন রাঙামাটি। চাকরির সুবাদে। শান্তা আর সামান্থারা চট্টগ্রামে। সম্প্রতি বদলি হয়েছে আব্বু। তাই এখনো শান্তা-সামান্থাদের নেওয়া হয়নি। আব্বু প্রতি মাসে দুবার চট্টগ্রাম আসেন। প্রতিবার আসার সময় দুবোনের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসেন। আম্মু দেখে রাগ করেন। বলেন, কী দরকার পয়সা নষ্ট করার? এমনিতেই বেতনের টাকায় সংসার চলে না। জিনিসপত্র দিয়ে মেয়েগুলোকে বরং লোভী বানিয়ে তুলছ। —থাক, এ আর কয় টাকার ব্যাপার। ওদের শখ-আহ্লাদ আছে না? পাজলটা পড়ে ছিল অনাদরে, অবহেলায়। আম্মু পুতুলটা আলমারিতে তুলে রাখার পর সামান্থা পাজলটা তুলে নেয় হাতে। শান্তা হাত বাড়ায় ওইটির দিকে। বলে, দেখি না একটু। —না, এটি আমার। তাহলে তুমি আমার পুতুল ধরেছিলে কেন? —পুতুল তো তুমি দাওনি আমাকে। তাহলে এইটা চাও কেন? দুজনে পাজল নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে যায়। আম্মু ছুটে এসে দুজনের পিঠেই গুম গুম করে কিল বসান। দুজনই গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করে। তাতে ঝগড়া আপাতত বন্ধ হয়। আব্বু বাজারে গিয়েছিলেন সকাল সকাল। ফিরে এসে আম্মুর কাছ থেকে দুবোনের কীর্তিকলাপের অভিযোগ শোনেন। সব শেষে আম্মু উপসংহার টানেন, তোমার এই দুই মেয়ে আমার মাথা খেয়ে ফেলল। এদের তুমি নিয়ে যাও সাথে করে। আব্বু কাছে ডেকে দুজনকে বোঝান। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, এত দুষ্টুমি করে না, মা। আম্মুকে এত বিরক্ত করে না...ইত্যাদি। এসব শুনে শুনে শান্তা-সামান্থার কান ঝালাপালা। আব্বুর এসব কথা শুরু হলে দুবোন চোখাচোখি করে। ঠোট টিপে হাসিবিনিময় করে। আর মনে মনে বলে, এই শুরু হলো আব্বুর লেকচার।দুপুরে ভাত খাওয়ার পর আব্বু দুজনকে ডেকে তাদের খেলনাগুলো হাতে তুলে দেন। শান্তাকে বার্বি ডল আর সামান্থাকে পাজল। বলেন, সামান্থা তো এখন বড়। বুদ্ধি খাটানোর প্রয়োজন। তুই ওর জন্য পাজল। সামান্থা হাত বাড়িয়ে পাজল নেয়। কিন্তু চোখ ট্যারা করে তাকিয়ে থাকে বার্বি ডলের দিকে। মনে মনে বলে, দাঁড়াও! তোমার বার্বি ডল আমি টুকরো টুকরো করে ছাড়ব...। শান্তা বার্বি ডল নিয়ে খেলে। রাতে কোলে নিয়ে শোয়। ঘুমায়। রাতে এক পরী এসে শান্তার সামনে দাঁড়ায়। কোলে বেশ বড় এক বার্বি ডল। কথা বলতে পারে। এ রকম বার্বির কথা শুনেছে শান্তা। কখনো দেখেনি। শান্তা জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে টকিং বার্বির দিকে। মনে মনে ভবে, ইশ, এমন একটা যদি তার থাকত!—নেবে নাকি? পরী যেন তার মনের কথা পড়তে পারে। —নাহ্। শান্তা লজ্জায় মুখ নুইয়ে নেয়। —নাও। নিলে আমার খুব উপকার হয়। —কী উপকার? শান্তা অবাক। —আমি ডাবল আনন্দ পাব। —সেটা কী রকম? শান্তার ভুরু কুঁচকে প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে যায়। —কোনো জিনিস পেতে তোমার নিশ্চয় আনন্দ হয়, তাই না?—হ্যাঁ। পেতে কার না ভালো লাগে? —কিন্তু কোনো জিনিস দিতেও যে আনন্দ হয় তা কী জানো? —যাহ্, দিতে আনন্দ হবে কীভাবে? আনন্দের বিপরীত তো দুঃখ। দিতে তো দুঃখ হয়।—তুমি জানো না, দিতেও আনন্দ হয়। শুধু আনন্দ নয়—ডাবল আনন্দ। —যাহ্, তুমি চাপা মারছ। —মোটেও না। যে পায় তার আনন্দ হয়, এটাতো মানো? —হ্যাঁ, মানি। —যে পায় তার আনন্দ এক গুণ। ‘পেলাম’ এই আনন্দ। আর যে দেয় তার আনন্দটা হলো অন্যকে আনন্দ পাইয়ে দেওয়ার আনন্দ। কয়টা আনন্দ হলো, বলো? —দুটো। কথাটা মূর্তির মতো বলে শান্তা। কারণ ব্যাপারটা মুখে বললেও মনে তখনো বিশ্বাস হয়নি তার।অবশ্য বিশ্বাস না হলেও পরীর কথাগুলো বেশ মজার সেটা বুঝতে পারে। মনে একটা কৌতূহল জাগে।চট করে মাথায় বুদ্ধি আসে। আচ্ছা, পরীক্ষা করে দেখলে কেমন হয়? যেই ভাবা সেই কাজ। সামান্থাকে ডেকে ‘এই নাও আপু’ বলে বার্বি ডলটা দিয়ে দেয়। সামান্থা অবাক। তারপর তিন লাফ দেয়। গালে চুমু খেয়ে বলে, ‘থ্যাংক ইউ। তুমি আমার সুইট বোন’। শান্তা টের পায়, তার বুকে ফুরফুরে আনন্দ। গতকাল আব্বু যখন পুতুলটা দিয়েছিল, তার চেয়ে ডাবল কি না নিশ্চিত না। তবে তার চেয়ে যে বেশি, এটা বুঝতে পারছে। মনে মনে কিছুটা বিরক্ত, দূর, আনন্দ মাপার কোনো স্কেল নেই।