স্মরণ
পটুয়ার ১০০
গতকাল ২ ডিসেম্বর ছিল কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী কামরুল হাসানের জন্মশতবর্ষ। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমাদের এ আয়োজন...
কামরুল হাসান নিজেকে শিল্পী নয়, বলতেন ‘পটুয়া’। এর অর্থ জানো তো? গ্রামবাংলার যে লোকশিল্পীরা পটচিত্র আঁকেন, তাঁদের বলা হয় পটুয়া। এই পটুয়াদের অনেক উঁচু দরের শিল্পী হিসেবে শ্রদ্ধা করতেন কামরুল হাসান। তাই নিজেও হতে চেয়েছিলেন লোকশিল্পীদের মতো খাঁটি শিল্পী। তাঁর আঁকা ছবিগুলো যদি তুমি দেখো, তাহলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। তাঁর আঁকা দেখে মনে হয়, আমরা বাংলাদেশকেই দেখছি। আমাদের মানুষ, সমাজ, গ্রাম, পশুপাখি, প্রকৃতি সবকিছুকে তিনি পরম ভালোবাসায় ক্যানভাসে এঁকেছেন।
শুধুই কি সাদা কাপড়ের ক্যানভাসে? উঁহু, কামরুল হাসান ছবি এঁকেছেন নানান মাধ্যমে। কখনো কাগজে, কখনো দেয়ালে, কখনোবা শাড়িতেও! কার্টুন এঁকেছেন, আমাদের সংবিধানের নকশা করেছেন, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় প্রতীক পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছে তাঁর তত্ত্বাবধানে। বইয়ের প্রচ্ছদ, বিজ্ঞাপনের জন্য তুলি ধরেছেন। ডাকটিকিট ও টাকার নকশাতেও তাঁর অবদান অনেক।
এত কিছু করার জন্য প্রচুর প্রাণশক্তিও ছিল তাঁর। কেবল কি প্রাণশক্তি? বাহুবলও কিন্তু কম ছিল না! ছেলেবেলা থেকেই শরীরচর্চা করতেন। ১৯৪৫ সালে বডি বিল্ডিংয়ে হয়েছিলেন বেঙ্গল চ্যাম্পিয়ন। আর ছেলেবেলা থেকেই যুক্ত ছিলেন পত্রপত্রিকার সঙ্গে। শিশু ও আবীর নামের দুটি পত্রিকা বের করেছিলেন ছোটদের জন্য। শিশু সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন ওতপ্রোতভাবে।
কামরুল হাসানের জন্ম হয়েছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান জেলার কালনা থানার নারেঙ্গা গ্রামে। ১৯৪৮ সালে সপরিবার চলে আসেন ঢাকায়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ডাকে যুক্ত হন গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস (এখন যেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) প্রতিষ্ঠার কাজে। এরপর সেখানেই শুরু করেন শিক্ষকতা।
এরপর একে একে তাঁর হাত ধরে পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পচর্চার নতুন নতুন সব দুয়ার খুলে যায়। ১৯৬০ সালে শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর নেন কামরুল হাসান। ১৯৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থানের কথা জানো তোমরা। সে অভ্যুত্থানে তিনি অংশ নেন সক্রিয়ভাবে। একইভাবে ১৯৭১ সালেও মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশ স্বাধীনের জন্য রাখেন অসামান্য অবদান।
১৯৭১ সালে আমরা বাংলাদেশ পেলাম। নতুন দেশে কত কিছুই তো দরকার—জাতীয় পতাকা থেকে মুদ্রার নকশা, সংবিধানের নকশা থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লোগো। সবকিছুতেই কামরুল হাসান অবদান রাখলেন সামনে থেকে। আর নকশাগুলোতে তিনি প্রাধান্য দিলেন চিরায়ত বাংলার উপাদানে। অর্থাৎ যা কিছুই তিনি করেছেন, সবই হয়ে উঠেছে একান্ত আমাদের। এভাবেই কামরুল হাসান আমাদের পটুয়া হয়ে উঠলেন।
বাংলাদেশের শিল্পকলার কথা বললে কামরুল হাসানের নাম চলে আসে শুরুতেই। সারা বিশ্ব বাংলাদেশকে চিনেছে তাঁর নানান শিল্পকর্মের মাধ্যমে। দেশে তো বটেই, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাঁকে ভূষিত করেছে নানান সম্মাননায়।
কামরুল হাসান তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাংলাদেশকে আরও সুন্দর করে তোলার জন্য কাজ করে গেছেন। গতকাল ছিল তাঁর জন্মশতবর্ষ। আমাদের প্রিয় পটুয়ার জন্য ভালোবাসা।
চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান ও ছড়াকার ফয়েজ আহ্মদের মধ্যে ছিল কাজের ও মনের দারুণ মিল। তাই দুজনের হাতের ছোঁয়ায়, রঙে আর রেখায় দুটি অনবদ্য বই পেয়েছি আমরা। একটি হলো কামরুল হাসানের চিত্রশালায়, আরেকটির নাম তুলির সাথে লড়াই। চিত্রশিল্পী ও ভাষাশিল্পীর এই যুগলবন্দীর পরিচয় মেলে সাহিত্য প্রকাশ থেকে বের হওয়া বই দুটির পাতা ওল্টালে। আজ এখানে পড়ো কামরুল হাসানের চিত্রশালায় বইয়ের দুটি ছড়া...
কামরুল হাসানের চিত্রশালায়
ফয়েজ আহ্মদ
১.
কামরুল হাসানের তুলিতে কী কাণ্ড,
কখনো আঁকবে ছোট কখনো প্রকাণ্ড।
কখনো দেখবে তাঁকে ইয়া ব্রাশ হস্তে,
লম্বার চেয়ে ছবি বড় হলো প্রস্থে।
হয়তো এঁকেছে তিন কৃষকের কন্যা,
অথবা বাংলাদেশে শ্রাবণের বন্যা।
গরুর গাড়িতে তার অতিথিরা চলছে,
টিমটিমে হারিকেন সারা রাত জ্বলছে...
মুক্তিযুদ্ধকালে শত্রুর চিত্র
দানবের মতো মুখ, নয় সে যে মিত্র।
রং–তুলি–চিত্রের নেই যেন অন্ত,
আনন্দ কোলাহলে ঘরটা জীবন্ত।
২.
শিল্পী কামরুল চিত্রশালা তাঁর মস্ত,
এসো না দলে দলে চলো না যাই দেখি ত্রস্ত।
কবে যে নাম ছিল ‘লৌহ সুপুরুষ’ বঙ্গে!
দেখা কি হয়েছিল সেই সে শিল্পীর সঙ্গে?
গিয়েছি তাঁর বাড়ি সেদিন ছিল ভারি বৃষ্টি,
ঘরটা নিশ্চুপ কত যে অপরূপ সৃষ্টি।
সারাটা ঘরে তাঁর ছবির সম্ভার খুলছে,
শুভ্র কেশ ভার স্কন্ধ দেশে তাঁর দুলছে।
বৃষ্টি পরিশেষে মিষ্টি পরিবেশে দিনটি,
চায়ের ফাঁকে ফাঁকে আপন ছবি আঁকে তিনটি।
হঠাৎ কথা কয় কারা যে ঘরময় হাসছে,
হাসিতে লুটোপুটি বেদম ছুটোছুটি আসছে।