মিথুর চকলেট

.
.

নেই! মিথু ভালো করে কৌটার ভেতরটা আরও একবার দেখল।
নাহ, নেই! আস্ত একটা টবলেরন ডার্ক চকলেট। মুখে দিলেই নিশ্চয়ই চোখ বুজে আসত, হাতে ধরে রাখলে গলে গলে পড়ত, আঙুলে লেগে থাকা চকলেট চেটেপুটে খেতে খেতে হাতটাই খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হতো...হায়! চাপা কষ্টে মিথুর চোখে পানি এসে গেল।
চকলেটটা বড় চাচা পাঠিয়েছেন গত সপ্তাহে। খেয়ে ফেললে তো শেষই হয়ে গেল। তাই সে যত্ন করে লুকিয়ে রেখেছিল, পরীক্ষার পর খাবে বলে।
মিথুর ঘরে বাবার পুরোনো একটা বুকশেলফ আছে। ভেতরে মোটা মোটা বই। সবগুলোই মলাট লাগানো। মিথু সুন্দর করে মলাট দিয়ে একটা মোটা বইয়ের খোলস বানিয়ে রেখেছে। এই ‘নকল বই’টাই হলো তাঁর গুপ্তধনের সিন্দুক। কম নম্বর পাওয়া অঙ্ক খাতা থেকে শুরু করে ঈদে সেলামি পাওয়া চকচকে ১০০ টাকার নোট, সবই লুকানো থাকে বইয়ের খোলসের ভেতর। এবারও সেখানেই রেখেছিল কৌটাটা। বাইরে থেকে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই। বাসার কেউ জানেও না, এমনকি বুকশেলফের ধারেকাছেও সাধারণত কেউ ঘেঁষে না। সেখান থেকে চকলেট হাপিশ হয় কী করে?
নাহ, এর একটা বিহিত করতে হবে। চোখ মুখ শক্ত করে তদন্ত শুরু করল গোয়েন্দা মিথু!


তদন্ত 
শুরু

মিথু ঠিক করল, বাসার সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। আগে সন্দেহভাজনদের একটা তালিকা তৈরি করতে হবে। গোয়েন্দা গল্পে-সিনেমায় দেখা যায়, যাকে নিয়ে সন্দেহ থাকে সবচেয়ে কম সে-ই আসল অপরাধী। অতএব, সন্দেহের তালিকা থেকে কাউকেই বাদ দেওয়া যাবে না।

সকালে স্কুলে যাওয়ার আগেও মিথু দেখেছে, চকলেটটা কৌটায় ছিল। বাবা মিথুর আগে বেরিয়ে গেছেন। অতএব বাবা বাদে সন্দেহভাজনদের তালিকাটা হলো এমন:

১. মা ২. দাদু ৩. বানু খালা ৪. নিশা আপু ৫. তেলাপোকা/পিঁপড়া ৬. ভূত(!)

যাদের সন্দেহ হয় কম, মিথু তাদেরই আগে জিজ্ঞাসাবাদ করল।

সন্দেহভাজন এক: মা

মা যদি চকলেট সরিয়ে থাকেন, সে ক্ষেত্রে ‘মোটিভ’ (এই শব্দটা মিথু গোয়েন্দা গল্প থেকে শিখেছে। এর অর্থ হলো অপরাধ সংঘটনের সম্ভাব্য কারণ) কী হতে পারে, সেটা মিথু ভেবে দেখল। মিথুকে দাঁতের পোকার হাত থেকে রক্ষা করতে মা এই কাজ করতে পারেন, আবার পরীক্ষার পরে দেবেন বলে লুকিয়েও রাখতে পারেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বড়দের বুদ্ধি-বিবেচনার ওপর মিথুর খুব একটা ভরসা নেই। জন্মের পর প্রথম পাঁচ বছর বাবা-মা মিথুকে হাঁটা আর কথা বলা শিখিয়েছেন। পরের পাঁচ বছর মিথু যে কথাটা সবচেয়ে বেশিবার শুনেছে, সেটা হলো, ‘একদম চুপ করে বসে থাকো।’ চুপ করে বসিয়েই যদি রাখবে, তাহলে এত কষ্ট করে হাঁটা-কথা বলা শেখালে কেন!

যাই হোক, মায়ের সঙ্গে কথোপকথন হলো এ রকম—

: মা, তুমি কি আমার চকলেট নিয়েছ?

: আজকে না তোর ক্লাস টেস্টের খাতা দেওয়ার কথা?

: উফ! তোমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আগে বলো, চকলেট নিয়েছ কি না?

: কথা ঘুরাবি না। ক্লাস টেস্টে কত পেয়েছিস? সত্যি করে বল!

কী আশ্চর্য! মিথু কই, মা নিজেই কথা ঘুরাচ্ছেন। ঠিকঠাক উত্তর পাওয়া গেল না কিছুতেই। অপরাধ আড়াল করতে অপরাধীরা এমন কাজ করতেই পারে। মিথু নোট বইয়ে মায়ের নামের পাশে লাল দাগ দিয়ে রাখল।


সন্দেহভাজন 
দুই: দাদু

দাদুর ঘরে গিয়ে দেখা গেল, তিনি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। তাঁকে অবশ্য প্রশ্ন করেও খুব একটা ফল হবে না। দাদুর কোনো কথাই মনে থাকে না। চকলেট খেলেও সেটা নিশ্চয়ই তিনি ইতিমধ্যেই ভুলে গেছেন।

মিথু খুব কাছ থেকে দাদুকে দেখল। হুম...এমন শান্তির ঘুম একটা আস্ত টবলেরন ডার্ক খাওয়ার পর হলেই মানায়! দাদুর ওপর সন্দেহ বেশি দুটি কারণে ১. বুকশেলফের কাছে মাঝেমধ্যে দাদুই যান ২. যেটা তাঁর খাওয়া নিষেধ, সেটার প্রতিই তাঁর আগ্রহ বেশি।


সন্দেহভাজন 
তিন: বানু খালা

বানু খালা মিথুদের বাসায় কাজ করেন। খুবই চতুর মহিলা। অপরাধী তিনিই হয়ে থাকলে ধরা কঠিন হবে। মিথু তাই কৌশল অবলম্বন করল।

‘দেখি খালা, আপনার দাঁত দেখি। বলেন ইইই।’

কথা শুনে খালা কেমন ভড়কে গেলেন। ‘ক্যান? দাঁত দেখামু ক্যান?’

‘দেখিই না।’

‘আমার মনে এত ফুর্তি নাই যে দাঁত বাইর কইরা হাসুম। ম্যালা কাম। তোমাগো বাসারটা শ্যাষ কইরা সিয়ামগো বাসায় যাইতে হইব।’

‘হাসতে বলিনি তো। দাঁত দেখাতে বলেছি। বলেন ইইই।’

‘আমার এহন ঢং করনের সময় নাই।’ বলেই বানু খালা গটগট করে হেঁটে গেলেন।

হুম...খুবই সন্দেহজনক! তাঁর দাঁতে চকলেট লেগে থাকার সম্ভাবনা প্রবল! বানু খালার নামের পাশেও মিথু মোটা করে লাল দাগ দিল।


সন্দেহভাজন 
চার: নিশা আপু

নিশা আপুকে মিথুর সন্দেহ হয় সবচেয়ে বেশি। সব সময় মিথুর বিরুদ্ধে ঘটনাগুলো নিশা আপুই ঘটান। কিন্তু গোয়েন্দা হতে হলে যুক্তি দিয়ে এগোতে হবে। নিশা আপুর সঙ্গে মিথুর কথা হলো এ রকম—

: আমার টবলেরন তুমি নিয়েছ, তাই না?

: বিরক্ত করিস না তো।

: আমি জানি, তুমি নিয়েছ। বড় চাচা চকলেটটা পাঠানোর পর তুমিই লোভী চোখে তাকিয়ে ছিলে।

: উফ! আমি তো আজ সকাল থেকে বাসায়ই ছিলাম না। আর ওই নোংরা বুকশেলফের কাছেও আমি যাইনি। অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে খুব ব্যস্ত আছি। যা দূর হ।

নিশা আপু প্রায়ই মিথুর ঘরে উঁকিঝুঁকি দেয়। অতএব তাকেও রাখা হলো সন্দেহের ওপরের দিকে।


তেলাপোকা
, পিঁপড়াভূত

তেলাপোকা আর পিঁপড়া এক দিনের মধ্যে একটা আস্ত চকলেট খেয়ে শেষ করতে পারবে না। কৌটা থেকে বেরও করতে পারবে না। অতএব এদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যায়।

বাকি রইল ভূত! এই জিনিসের উপদ্রব মিথুদের বাসায় খুব বেশি। প্রায়ই এটা-ওটা হারিয়ে যায়, রাত-বিরাতে অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়। ব্যাপারটা ভেবেই মিথুর গা ছমছম করে উঠল। যেহেতু ভূতদের জিজ্ঞাসাবাদের কোনো সুযোগ নেই, তাই তদন্ত এখানেই শেষ করতে হলো।

এখন প্রশ্ন হলো, চকলেটটা নিল কে?!



ধাঁধার 
সমাধান
গল্পের ধাঁধার উত্তর
চকলেট নিয়েছে নিশা আপু। সে কীভাবে জানল, চকলেটটা আজই হারিয়েছে? আর বুকশেলফের ভেতর ছিল, সেটাই বা জানল কী করে!