অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

১৯৭১। সরলপুর গ্রাম। এক বিকেল। হঠাৎ...

হইচই। চিৎকার। চেঁচামেচি।

আসছে! আসছে!

অমনি শুরু হয়ে গেল ছোটাছুটি।

ঘরবাড়ি ফেলে পালাতে লাগল সরলপুরের মানুষ। যে যেদিকে পারল।

শুধু পালাতে পারলেন না একজন।

রাঙা–রাবেয়ার দাদু। কী করে পারবেন! তিনি যে হাঁটতেই পারেন না! এমনকি বসতেও পারেন না। সারা দিন বিছানায় শুয়ে থাকেন। না, সারা দিন বিছানায় পড়ে থাকতে বাধ্য হন। আর তাকে একলা ফেলে রেখে কী করে যায় রাঙা-রাবেয়া?

ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে রাঙা ও রাবেয়া। বারান্দার চাটাইয়ে শুয়ে আছেন দাদু। ওদের ঘরের সামনে দিয়ে দলে দলে ছুটে পালাচ্ছে মানুষ। সবার চোখেমুখে আতঙ্ক। মনে ভয়। কখন না পাকিস্তানি হানাদার ছুটে আসে!

রাঙা আর রাবেয়াও খুব ভয়ে ভয়ে আছে। মানুষ দেখলেই ছুটে যায়। সবাই ওদের ডাকে সাড়া দেয় না। কেউ কেউ থামে। কেউ থামলেই রাঙা বলে ওঠে, ‘আমার দাদুকেও নিয়ে চলুন।’

‘কোথায় তোমার দাদু?’

‘ওই যে ওখানে।’

চাটাইয়ের ওপর শুয়ে থাকা দাদুকে দেখায় রাবেয়া।

কিন্তু দাদুকে দেখার পর কেউ আর দাঁড়ায় না। সময় কোথায়? তা ছাড়া ওই অচল মানুষটাকে নিয়ে পথচলা কি চাট্টিখানি কথা?

হঠাৎ পাশের বাড়ির জামিল চাচা ছুটে এলেন ওদের কাছে। ধমক দিয়ে বললেন, ‘তোমরা এখনো দাঁড়িয়ে আছ? পাকিস্তানি সৈন্যরা কিন্তু কাউকেই রেহাই দেয় না। যুবক, বৃদ্ধ, শিশু, কিশোর—কাউকে না। চলো, চলো।’

জামিল চাচার কথা শুনে রাবেয়া কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘তাহলে তো আমার দাদুকেও মেরে ফেলবে।’

‘ওরা যাকে সামনে পায়, তাকেই মেরে ফেলে।’

আকুতি জানাল রাঙা, ‘আমার দাদুকেও নিয়ে চলুন না!’

জামিল চাচা বললেন, ‘তোমার দাদুকে নেওয়ার সময় নেই। তার চেয়ে বরং তোমরা চলো।’

বলেই এক হাতে রাঙাকে ধরল। আরেক হাতে রাবেয়াকে।

রাঙা বলল, ‘দাদুকে রেখে আমি যাব না। আপনি রাবেয়াকে নিয়ে যান। আমি দাদুর কাছে থাকব।’

রাবেয়া বলল, ‘আমিও দাদুকে ছেড়ে যাব না। আপনি রাঙাকে নিয়ে যান।’

হঠাৎ জোরালো আর্তচিৎকার ভেসে এল। কেউ একজন চেঁচিয়ে বলল, ‘আগুন! আগুন! ওরা পাশের গ্রামে আগুন দিয়েছে!’

পাশের গ্রামের দিকে তাকাল সবাই। ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। দলা পাকিয়ে পাকিয়ে আকাশে উঠে যাচ্ছে। সঙ্গে গুলির শব্দ। ঠা...ঠা...ঠা।

তাড়া দিলেন জামিল চাচা, ‘সময় নেই। ওরা প্রায় এসে গেছে। বাঁচতে চাইলে শিগগিরই চলো।’

বলেই দুজনকে দুহাতে টেনে নিতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না।

শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রাঙা ও রাবেয়া। দুজন একসঙ্গেই গলা চড়িয়ে জানাল, ‘দাদুকে ছেড়ে আমরা যাব না।’

ঝটকা টানে জামিল চাচার হাত থেকে নিজেদের ছাড়িয়ে নিল তারা।

খালি হয়ে গেল পুরো গ্রাম। সরলপুরের কোথাও কোনো সাড়া নেই।

গ্রামের পথের দিকে তাকাল ওরা। একটা কুকুরও নেই।

বাড়ির ছাদে ও জানালার কার্নিশে তাকাল। একটা বিড়ালও নেই।

গাছেদের দিকে তাকাল। একটা পাখিও নেই। তবে...

দাদু জানতে চাইলেন, ‘একি, দাদুমণিরা! তোমরা এখনো পালাওনি?’

রাঙা বলল, ‘আমি পালাব না।’

রাবেয়া বলল, ‘আমিও যাব না। আপনাকে রেখে কোত্থাও যাব না।’

দাদু বললেন, ‘আমি বুড়ো হয়ে গেছি। নড়তেও পারি না। বেঁচে থেকেও মরে আছি। কিন্তু তোমাদের তো বেঁচে থাকতে হবে। যাও! হায়েনাগুলো আসার আগেই পালিয়ে যাও।’

রাবেয়া বলল, ‘মরলে সবাই একসঙ্গে মরব। তবু আপনাকে ফেলে যাব না, দাদু।’

হঠাৎ কঠিন হয়ে গেল রাঙার চেহারা। বলল, ‘আমরা লড়াই করব।’

অবাক হলেন দাদু, ‘লড়াই করবে! কীভাবে?’

রাঙা বলল, ‘বুদ্ধির লড়াই।’

রাবেয়াও অবাক। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বুদ্ধির লড়াই!’

রাঙার চোখেমুখে তখন আত্মবিশ্বাস, ‘হুম! বুদ্ধির লড়াই।’

বলেই সরলপুরে ঢোকার রাস্তার দিকে তাকাল রাঙা। আর তাকিয়েই চমকে উঠল। চারটা সৈন্য এগিয়ে আসছে!

পিঠে রাইফেল। মাথায় হেলমেট। মুখে শয়তানি হাসি।

তারপর যে–ই আরেকটু এগিয়ে এল, অমনি হঠাৎ...

‘মদদ করো! মদদ করো! বাঁচাও! বাঁচাও!’ চেঁচিয়ে ওঠল চার হানাদার। ‘মুক্তি! মুক্তি! ভাগো! ভাগো।’

হাতে রাইফেল তোলার সুযোগ পর্যন্ত পেল না কেউ। উল্টো ঘুরে পড়িমরি ছুটে পালাতে লাগল। ওদের পেছন পেছন ধাওয়া করে ছুটে যাচ্ছে একঝাঁক মৌমাছি। আর একঝাঁক ভিমরুল।

রাঙা ও রাবেয়ার হাতে তখন দুটো গুলতি।

রাস্তার দুপাশে দুটো বিশাল আমগাছ। ডান পাশের আমগাছের সবচেয়ে মোটা ডালে ঝুলে আছে বিশাল এক মৌচাক। আর বাঁ পাশের আমগাছের মগডালে খুনে ভিমরুলদের বাসা। ভাগ্যিস, মৌমাছি আর ভিমরুলরা তখন বাসাতেই ছিল।

আর কখনো সরলপুরে আসেনি হানাদাররা। ওই গ্রামের কথা বললেই আঁতকে ওঠে ওরা, ‘ওখানে যাব না। ওখানকার মুক্তিরা জাদু জানে। উড়াল দিয়ে এসে হুল ফোটায়। মুক্তি তো নয়, যেন বিষাক্ত বিচ্ছু!’