শুটিং

অলংকরণ: আরাফাত করিম

ক্যামেরা নিয়ে শট নিতে যাব, এমন সময় বাবুল ভাই চলে এলেন। সব পাড়ায়ই কিছু বড় ভাই থাকেন, যাদের ধারণা, তারা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান। এ ধরনের বড় ভাইদের নাক লম্বা হলেও সবকিছুতে গলাতে গলাতে তা আর লম্বা থাকে না। বাবুল ভাইয়ের অবস্থাও সে রকম। ক্যামেরার ঠিক সামনে এসে ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘কী রে ছাগলের দল, ঘাস খাওয়া ফেলে কী করছিস?’

সাব্বির সবার আগে বলে উঠল, ‘আমরা একটা সিনেমা বানাচ্ছি। নাম এখনো ঠিক হয়নি, তবে আমরা ভাবছি। অতি দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে।’

আমার এত রাগ হলো, যে কী বলব! জিজ্ঞেস করলেই সব বলে দিতে হবে? এত বড় একটা পেট থাকার পরও সাব্বির কেন যে কোনো কথা পেটে রাখতে পারে না, সে এক রহস্য।

‘তোরা বাংলা সিনেমা বানাচ্ছিস? নাম পাচ্ছিস না? আরে, এটা কোনো ঘটনাই না। “তুই খাড়া আমি আইতাছি” নামটা কেমন?’ খুব আগ্রহ নিয়ে বললেন বাবুল ভাই।

জিতু অল্পতেই খেপে যায়। এই কথা তার চলচ্চিত্রবিষয়ক অনুভূতিতে আঘাত হানল। সে বলল, ‘খুবই জঘন্য নাম, একেবারে আপনার মতো। তা ছাড়া আমরা বাংলা সিনেমা বানাচ্ছি না।’

‘তাহলে কী বানাচ্ছিস? হিন্দি সিনেমা?’

‘তা হবে কেন? সিনেমা বাংলাতেই। কিন্তু বাংলা সিনেমা বলতে যা বোঝায়, তা নয়। এটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেব। ভালো হলে সেটা ফেস্টিভ্যালে দেখাবে।’

‘তাহলে নায়কের পার্টটা আমাকে দে। বিনা পয়সায় এত ভালো নায়ক কোথাও পাবি না।’

শুনে সবার মাথায় পুরো সৌরজগৎ ভেঙে পড়ল। বাবুল ভাই অভিনয় করলে আমাদের সিনেমার ১২টা বাজবে। আমরা কত বোঝালাম, ‘ভাই, স্ক্রিপ্ট লেখা শেষ। এখন আপনাকে কীভাবে নেব?’

তার এক কথা, ‘আমাকে নে, নইলে শুটিং প্যাকআপ।’

কিন্তু ততক্ষণে তাঁর অবস্থা কাহিল। মুখ হাঁ করে শ্বাস নিতে নিতে বললেন, ‘আচ্ছা, একটু বিশ্রাম নিলে হয় না?’ বললাম, ‘তা হয়, কিন্তু আলো কমে গেলে আর শট নেওয়া যাবে না।’

শেষে আমি একটা বুদ্ধি বের করে বাবুল ভাইকে নিয়ে নিলাম। খুব হতাশ হলো সবাই। সাব্বির তো একেবারে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল মাঠে। বাবুল ভাইকে বোঝাতে লাগলাম কী করতে হবে, ‘ভাই, আপনার জন্য স্ক্রিপ্ট বদল। আপনি মাঠের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত দুবার দৌড় দেবেন। এটাই প্রথম শট। অ্যাকশন!’

সঙ্গে সঙ্গে মোটা শরীর নিয়ে হাতির মতো দৌড় শুরু করলেন বাবুল ভাই। দুইবার দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘কেমন হলো রে?’

আমি মুখ কালো করে বললাম, ‘ভাই, ক্যামেরার লেন্স কভার খুলতে ভুলে গেছি। শটটা আবার নিতে হবে।’

বাবুল ভাই বললেন, ‘বলিস কী রে? যাহোক, ব্যাপার না। আমি আবার দিচ্ছি। চরিত্রের প্রয়োজনে আমি কঠোর পরিশ্রম করতে পারি। এবার কোনো ভুল করিস না।’

আবার দৌড় শুরু হলো। অর্ধেক গিয়েই

হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন বাবুল ভাই। আমি বললাম, ‘কাট!’

বাবুল ভাই বললেন, ‘ব্যাপার না। আবার দৌড় হবে!’

কিন্তু ততক্ষণে তাঁর অবস্থা কাহিল। মুখ হাঁ করে শ্বাস নিতে নিতে বললেন, ‘আচ্ছা, একটু বিশ্রাম নিলে হয় না?’

বললাম, ‘তা হয়, কিন্তু আলো কমে গেলে আর শট নেওয়া যাবে না।’

বহু কষ্টে উঠে দাঁড়ালেন বাবুল ভাই। শরীর সায় দিচ্ছে না, তবু বিদ্রোহ করে আবার দিলেন দৌড়। দৌড়ে এ মাথায় এসেই ধপ করে বসে পড়লেন। কোনোমতে বললেন, ‘হয়েছে?’

আমি হতাশ হয়ে বললাম, ‘ভাই, রেকর্ড বাটনটাই অন করা হয়নি। আরেকবার!’

‘নাহ্, আর পারব না রে। যে ক্যালরি গেছে, তার জন্যই আগামী তিন মাস ভিটামিন ট্যাবলেট খেতে হবে। তোরা জাহান্নামে যা। এই ফালতু সিনেমায় আমি নেই। গুডবাই।’

কথা শেষ করেই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে গেলেন বাবুল ভাই। উনি দূরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হেসে উঠলাম আমরা। যাক, এবার তাহলে শুটিং শুরু করা যায়। জিতুকে বললাম, ‘কী রে, কেমন বুদ্ধি?’

‘অসাধারণ। দোস্ত, তুই আসলেই একটা জিনিস!’ আমরা মহাখুশিতে শুটিং শুরু করলাম।