শূন্যের দুঃখ

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

সে কোনো এক সময়ের কথা। সে সময় কোনো একখানে কোনো একটা দেশ ছিল, যেখানে থাকত কেবল সংখ্যারা। ১, ২, ৩, ৪ থেকে ৯ পর্যন্ত সবাই তো থাকতই, আরও থাকত শূন্য। তবে শূন্যরা থাকত একটু দূরে দূরে। অন্য সংখ্যাদের সঙ্গে ওদের খুব একটা মেলামেশা ছিল না। কারণ, সংখ্যার জগতে শূন্য বেচারাদের নাকি নিজেদের কোনো মান নেই। যখন অন্য কোনো সংখ্যার মান বাড়ানোর প্রয়োজন হতো, কেবল তখনই ডাক পড়ত তাদের। এই নিয়ে তাই শূন্যদের মনে ছিল একরাশ দুঃখ আর কষ্ট।

এদের মধ্যে আবার ছিল ছোটখাটো দুটো শূন্য। আকারে বেশ ছোট বলে ওদের কেউ বিশেষ পাত্তা দিত না। সংখ্যারা তাদের মান বাড়ানোর জন্য কখনো ওদের ডাকত না। তাই এই দুই শূন্য সারাটা দিন কেবল গড়িয়ে গড়িয়েই সময় পার করত।

সংখ্যার দেশের পাশেই ছিল একটা নদী। আর তার পাশেই ছিল বর্ণমালার দেশ। সেই দেশে বাস করত অ, আ, ই, ক, খ, গ আরও অনেক সব বর্ণ। বর্ণমালার সেই দেশে সবাই ছিল সমান। সেখানে কারও মানসম্মান আলাদাভাবে দেখা হতো না। প্রতিটা বর্ণই ছিল একে অন্যের বন্ধু। এর সঙ্গে ও মিলেমিশে কত যে সুন্দর সুন্দর শব্দ তৈরি করত বর্ণরা! আর শব্দেরা আবার পাশাপাশি চলতে চলতে তৈরি করত ছড়া, কবিতা, গল্প আর গান।

একদিন হয়েছে কি, বর্ণরা সবাই মিলে ঠিক করল, তারা বনভোজনে যাবে। যে-ই ভাবা, সে-ই কাজ। বনভোজন করতে সব বর্ণ এল নদীর পাড়ে। তাদের মনে সে কী আনন্দ! তারা ঘুরে ঘুরে একে অন্যের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শব্দ তৈরির খেলায় মেতে উঠল। নতুন শব্দ তৈরি করতে কোনো বর্ণকে সাদরে ডেকে নেয় অন্য বর্ণ। আবার কেউ-বা হাত ছেড়ে যোগ দেয় অন্য বর্ণের সঙ্গে। এভাবে তারা কখনো ‘বন’, কখনো ‘ফুল’, কখনো ‘পাখি’ হয়ে ওঠে। একটা সময়ে তারা অনেক বর্ণ আর শব্দ পাশাপাশি নেচে নেচে কী যে সব সুন্দর সুন্দর কবিতা আর গান তৈরি করতে লাগল! ‘আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা’ কিংবা ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’—এই সব কবিতা আর গান গাইতে গাইতে আনন্দময় সময় পার করতে থাকল তারা।

সে সময় নদীর আরেক পাড়ে বসে ছিল ছোট্ট দুই শূন্য। বর্ণমালাদের কাণ্ডকারখানা দেখে তারা তো ভারি অবাক। বর্ণদের সবার মধ্যে এত মিল দেখে ওদের খুব ভালো লাগল। তখন এক শূন্য বলল, ‘ইশ্, বর্ণদের দেশটা কী আনন্দের! চল, আমরা ওদের দেশে চলে যাই।’

কিন্তু এ কথা বললেই তো আর হবে না। বর্ণমালার দেশে সংখ্যার তো কোনো জায়গা নেই। তাহলে কী আর করা! দূর থেকে বসে বসে দুটি শূন্য শুনতে লাগল বর্ণদের হাসি আর কলরব।

শূন্যদের ফিরে যেতে হবে নিজেদের দেশে; যেখানে নেই কোনো গান, ছড়া, কবিতা। মনটা তাই ভার করে সব বর্ণমালার কাছ থেকে বিদায় চাইল দুটি শূন্য। কিন্তু ‘দ’ আর ‘খ’ কিছুতেই ছাড়তে চাইল না ওদের।

এমন সময় ভারি একটা অঘটন ঘটল। নদীর পাড়ে বড় একটা গাছের ডালে দড়ি বেঁধে দোল খাচ্ছিল ‘দ’ আর ‘খ’ দুই বন্ধু। হঠাৎ কীভাবে যেন পা ফসকে নদীতে পড়ে গেল ‘দ’। ‘দ’কে বাঁচাতে ‘খ’ও ঝাঁপ দিল পানিতে। কিন্তু নদীতে অনেক ঢেউ থাকায় ‘খ’ কিছুতেই ‘দ’কে ধরতে পারছিল না।

তা দেখে ছোট্ট শূন্য দুটি পানিতে দিল একটা বড় লাফ। পানির ওপর দিয়ে গড়াতে গড়াতে ওরা এসে ঠিক ধরে ফেলল ‘দ’ আর ‘খ’কে। তারপর টেনে তুলল ডাঙায়।

এর মধ্যে চারদিকে তো হইচই পড়ে গেছে। সব বর্ণ এসে ভিড় করেছে নদীর পাড়ে। ‘দ’ আর ‘খ’কে পানি থেকে উদ্ধারের পর সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। শূন্যদের সাহস দেখে সবাই ওদের প্রশংসা করতে লাগল, ধন্যবাদ দিতে থাকল।

বর্ণদের সব থেকে বড় বোন ‘স্বরে অ’ এসে জড়িয়ে ধরল শূন্যদের। এত সব প্রশংসা আর ভালোবাসা পেয়ে শূন্যরা লজ্জায় আরও ছোট হয়ে গেল। এমন তারিফ বা আদর এর আগে কেউ কখনো করেনি ওদের।

যাহোক, এবার বিদায় নেওয়ার পালা। শূন্যদের ফিরে যেতে হবে নিজেদের দেশে; যেখানে নেই কোনো গান, ছড়া, কবিতা। মনটা তাই ভার করে সব বর্ণমালার কাছ থেকে বিদায় চাইল দুটি শূন্য। কিন্তু ‘দ’ আর ‘খ’ কিছুতেই ছাড়তে চাইল না ওদের। তারা গিয়ে বড় বোন ‘স্বরে অ’র কাছে আবদার করল, শূন্যদের এই দেশে রেখে দেওয়ার জন্য। ওদের কথার সঙ্গে তাল মেলাল অন্য সব বর্ণও। সবার ইচ্ছার কথা শুনে ‘স্বরে অ’ তখন শূন্যদের জিজ্ঞেস করল, ‘আমাদের সবার খুব ইচ্ছা তোমরা আমাদের দেশে থেকে যাও। তোমরা কি রাজি আমাদের সঙ্গে থাকতে?’

দারুণ এই প্রস্তাব পেয়ে শূন্যরা তো একেবারে খুশিতে আটখানা। এ যেন মেঘ না চাইতেই জল! ওরা দুই শূন্য সঙ্গে সঙ্গে এই সুন্দর দেশে বাস করার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। বড় বোন ‘স্বরে অ’ ওদের নতুন নাম দিল—বিসর্গ। সব বর্ণ আনন্দে হাততালি দিতে থাকল। এরপর থেকেই ‘দ’ আর ‘খ’র মাঝখানে শূন্য দুজন বিসর্গ হয়ে খুশিমনে বাস করতে লাগল। ‘দুঃখ’ লিখতে আমাদের যতই দুঃখ লাগুক না কেন, বর্ণমালার দেশে বিসর্গের মনে কিন্তু কোনো দুঃখ নেই।