আমরা সবাই রাজা

কদিন পরই বাংলাদেশের বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তি উদ্‌যাপন করব আমরা। আগামীকাল ২০ নভেম্বর বিশ্ব শিশু দিবস। ৪ নভেম্বর ছিল প্রথম আলোর ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছিল ছোটদের ছবি আঁকা প্রতিযোগিতা ‘আমার বাংলাদেশ’। ১৬ নভেম্বর হয়ে গেল এর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। সব আনন্দ যেন এক সুতায় গেঁথে গেছে। বিস্তারিত জেনে নাও এখানে...

‘আমার বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের সঙ্গে (বাঁ থেকে) চিত্রশিল্পী আবদুল মান্নান, রফিকুন নবী, ট্রান্সকম গ্রুপের সিইও সিমিন রহমান, চিত্রশিল্পী আবুল বারক্‌ আল্‌ভী ও ফারেহা জেবাছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

তিন বছর বয়সী জয়ীতা রহমান ঢাকার সূত্রাপুর থেকে শাহবাগে আসতে আসতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তাই মায়ের কোলে ঘুমিয়ে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল। চেঁচামেচির শব্দে হুট করে ঘুম ভাঙতেই জয়ীতা দেখে, একাধিক পুরস্কার হাতে মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছে সে! চোখের সামনে অনেক আলোকচিত্রী ক্লিক ক্লিক করে তার ছবি তুলে যাচ্ছেন। তারকাদের মতো পুরস্কার হাতে পোজ দিয়ে ছবি তুললেও বেশ বিরক্তই হলো জয়ীতা। ভাবখানা এমন—পুরস্কার পেয়েছি বলে ঘুম থেকে ওঠাতে হবে নাকি! ধুর!

পুরস্কারপ্রাপ্ত খুদে আঁকিয়ে জয়ীতার ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করছেন অতিথিরা
ছবি: জাহিদুল করিম

প্রথম আলোর ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ১৩ নভেম্বর রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরে নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনকক্ষে শুরু হয়েছে ‘আলোয় আঁধারে’ শিরোনামে বিশেষ প্রদর্শনী। এতে দেখানো হচ্ছে ‘আমার বাংলাদেশ’ শিরোনামে ছোটদের ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় সারা দেশ থেকে শিশুদের পাঠানো আঁকাগুলো। ১৬ নভেম্বর বিকেলে প্রদর্শনীতে ‘আমার বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এসেছিল জয়ীতা। শুধু জয়ীতা নয়, প্রতিযোগিতার ক ও খ বিভাগের সেরা ২০ আঁকিয়েকে অভিভাবকসহ আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। নারায়ণগঞ্জ, শেরপুর, ঝিনাইদহ, রংপুর ও চট্টগ্রাম থেকে এসেছিল অনেকেই।

দুপুরের পর থেকেই ছোটদের পদচারণে মুখর হয়ে উঠেছিল পুরো গ্যালারি। যেন আলো-আঁধারে উড়ছে একঝাঁক জোনাকি। সবচেয়ে বেশি ভিড় জমেছিল প্রদর্শনকক্ষের ডিজিটাল পর্দার সামনে। সবাই যখন পর্দার স্লাইড শোতে একদৃষ্টে তাকিয়ে নিজের আঁকা ছবির অপেক্ষা করছে, তখনই মঞ্চ থেকে এল ডাক। সবাই রওনা হলো মঞ্চের দিকে।

‘আলোয় আঁধারে’ প্রদর্শনীতে নিজেদের আঁকা ছবি দেখছে খুদে আঁকিয়েরা, সঙ্গে আছেন অভিভাবক
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

বিকেল পাঁচটা বাজতে তখনো মিনিট পাঁচেক বাকি। প্রথম আলোর ফিচার সম্পাদক সুমনা শারমীনের সঞ্চালনায় শুরু হয় প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হন বরেণ্য চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী। ট্রান্সকম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিমিন রহমান অনুষ্ঠানে এসেছিলেন শিশুদের হাতে পুরস্কার তুলে দিতে। সিমিন রহমানের আরও একটি পরিচয় আছে, তিনি সাহসী সন্তান ফারাজ আইয়াজ হোসেনের মা। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রতিযোগিতার বিচারক বীর মুক্তিযোদ্ধা চিত্রশিল্পী আবুল বারক্‌ আল্‌ভী। বিচারকমণ্ডলীর মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন চিত্রশিল্পী আবদুল মান্নান ও ফারেহা জেবা।

নিজের মুগ্ধতার কথা বলছেন চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী
ছবি: জাহিদুল করিম

‘টোকাই’ চরিত্রের স্রষ্টা রফিকুন নবী অনুষ্ঠানে এসে প্রকাশ করেন তাঁর মুগ্ধতা, ‘বাচ্চারা তাদের আঁকায় এমন সব চিন্তা ও উপাদান ব্যবহার করে, যা আমরা (শিল্পীরা) ভাবতেও পারি না। বাচ্চাদের আঁকার অনেক কিছুই আমরা অনুকরণ করার চেষ্টা করি। কারণ, ওরা খুব ইনোসেন্টলি ও মজা করে ছবি আঁকে। তবে আমাদের আঁকায় সেসব উপাদান ব্যবহার করলেও ওদের মতো সুন্দর হয় না।’

বিচারকমণ্ডলীর দুই সদস্য চিত্রশিল্পী ফারেহা জেবা ও আবদুল মান্নান
ছবি: জাহিদুল করিম

সিমিন রহমান তাঁর কথায় জানিয়েছেন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার আসল আনন্দ কোথায়। তিনি বলেন, ‘শিশুরা বাংলাদেশকে নিয়ে ছবি এঁকেছে মনের আনন্দে। প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার মানে পুরস্কার পাওয়া নয়। আনন্দ নেওয়া ও আনন্দ দেওয়াটাই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার মূল কথা।’ আবুল বারক্‌ আল্‌ভী ও বাকি দুজন বিচারকমণ্ডলী জানান দুহাজারের বেশি আঁকা থেকে সেরা ২০ বেছে নেওয়া ছিল কতটা কঠিন।

নলিনীকান্ত ভট্টশালী প্রদর্শনকক্ষ সেদিন ছিল সরগরম
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

পুরস্কার ঘোষণার পালা আসতেই নড়েচড়ে বসেন অভিভাবকেরা। শিশুদের চেয়ে মা-বাবার আগ্রহই যেন একটু বেশি! বিজয়ীর নাম ঘোষণার আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়—‘ফিরবে না কেউ খালি হাতে’। দুই বিভাগে সেরা ২০ আঁকিয়ের সবাই পাবে পুরস্কার। প্রথমেই একে একে মঞ্চে ডেকে নেওয়া হয় খ বিভাগের বিশেষ পুরস্কার বিজয়ী সাতজনকে।

পুরস্কারজয়ী ইয়াফিন কী বলেছিল যে সবাই এমন হাসছে
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

প্রত্যেকেই পুরস্কার হিসেবে পায় পাঁচ হাজার টাকার বই কেনার কুপন। ক বিভাগের বিশেষ পুরস্কারপ্রাপ্ত পাঁচ আঁকিয়েও পায় একই পুরস্কার। ক ও খ বিভাগের প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুরস্কার বিজয়ী আঁকিয়েরা পায় যথাক্রমে ৫০ হাজার, ৩০ হাজার ও ২০ হাজার টাকার বইয়ের কুপন।

সেদিন কেউ ফেরেনি খালি হাতে
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

‘আলোয় আঁধারে’র প্রদর্শনী ততক্ষণে বেশ রঙিন হয়ে উঠেছে। এত পুরস্কার সামলাতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল ছোট ছোট হাতগুলো। অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে মঞ্চে হাজির হন শিল্পী অবন্তী সিঁথি। ছোট-বড় সবাই তাঁর সঙ্গে গলা মেলায় ‘আমরা সবাই রাজা’ গানে।

অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে গান শুনিয়েছেন অবন্তী সিঁথি
ছবি: জাহিদুল করিম

ঘুমবাবু জয়ীতার ঘুমের ঘোর ততক্ষণে কেটে গেছে। একদম অল্প বয়স বলে সে গলা মেলাতে পারছিল না, তাই গানের সঙ্গে লাফালাফি করেই তাল মিলিয়েছে সে। গান শেষে আবার ঘুম। এবার বাড়ি ফেরার পালা। আজ প্রদর্শনীর শেষ দিন। মা-বাবাকে নিয়ে ছুটির দিনে দেখে আসতে পারো ছোটদের আঁকা দারুণ ছবিগুলো।

এক ফ্রেমে অতিথিদের সঙ্গে খুদে আঁকিয়ের দল
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
আরও পড়ুন