তোমরা নিশ্চয়ই জেনে গেছ যে কাজীদা—কাজী আনোয়ার হোসেন আর আমাদের মধ্যে নেই। কাজী আনোয়ার হোসেন বললেই যে নামটি মনে আসে, সেটি হলো মাসুদ রানা। বলতে পারো, তিনি তো শুধু বড়দের জন্য কাজ করে গেছেন। আমাদের জন্য কী করেছেন?
তোমাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন কাজী আনোয়ার হোসেন। সবার আগে যেটা উল্লেখ করতে হবে তা হলো, সেবা প্রকাশনী নামে একটি বই প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। সেখান থেকে প্রকাশ করেছেন শিশু–কিশোর উপযোগী অসংখ্য ধ্রুপদি বিদেশি সাহিত্য।
চার্লস ডিকেন্স, জুল ভার্ন, আলেকজান্ডার দ্যুমা, রবার্ট লুই স্টিভেনসন, মার্ক টোয়েন, জ্যাক লন্ডন—কার সাহিত্য অনুবাদ করাননি তিনি? প্রতিটি বই তোমাদের মনের দরজা খুলে দেবে একের পর এক।
তোমরা বলতে পারো বড়দের রহস্য পত্রিকার কথা। কিন্তু তোমাদের জন্যও কাজী আনোয়ার হোসেন দীর্ঘ সময় ধরে বের করেছেন চাররঙা কিশোর পত্রিকা। গল্প, অনুবাদ, ছড়া–কবিতা, ফিচার, পাঠকদের লেখা, সাক্ষাৎকার, চিঠিপত্র, সমসাময়িক ঘটনা, কার্টুন, খেলা—কত যে বিভাগ ছিল সেখানে! বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিকদের নতুন–পুরোনো লেখা ছাপা হতো। সে পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন নিজেই। মাসের প্রথম দিনই হাতে চলে আসত সুন্দর এই পত্রিকা।
রকিব হাসানের বিখ্যাত চরিত্র তিন গোয়েন্দার কথা তো জানোই—সেই কিশোর পাশা, রবিন মিলফোর্ড আর মুসা আমান। আমরা ছোটবেলায় সবাই কিশোর পাশা হতে চাইতাম। রবিন আর মুসার মতো বন্ধু খুঁজতাম। একটাই সমস্যা ছিল, সবাই কিশোর পাশা হতে চায়। ফলে তিনজন কিশোর পাশা মিলে আমরা দল গড়তাম। সেই রকিব হাসানকে ডেকে নিয়েছিলেন কাজীদা। নিজে হাতে ধরে লিখিয়েছেন।
তিন গোয়েন্দা ছাড়া কত বিস্তর লেখা যে লিখিয়েছেন রকিব হাসানকে দিয়ে। শুধু রকিব হাসান কেন, শেখ আবদুল হাকিম, কাজী শাহনূর হোসেন, রওশন জামিল, কাজী মায়মুর হোসেন—এমন অনেক লেখক উঠে এসেছেন কাজীদার হাত ধরে।
তোমরা অবশ্য বলতে পারো, এতজনকে দিয়ে লিখিয়েছেন, নিজে কই লিখলেন আমাদের জন্য? লিখেছেন। বেশ কিছু লেখা কাজীদা লিখেছেন তোমাদের জন্য।
প্রথমেই বলব ইসকুল বাড়ির কথা। মার্কিন লেখক লুইসা মে অ্যালকটের গল্প। সেই গল্পের ছায়া অবলম্বনে লিখলেন ইসকুল বাড়ি। শহর থেকে অনেক দূরের একটি স্কুলের গল্প। ডক্টর আবদুর রহমান অক্সফোর্ড থেকে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে এসেছেন দেশ গড়ার ব্রত নিয়ে। এসে তিনি কাজ শুরু করলেন শিশুদের নিয়ে। ওই শিশুদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। সেখানে সবাই সমান। সবার জন্যই সমান গুরুত্ব। অন্য অনেকের সঙ্গে সেই স্কুলে এসে ওঠে সালাম নামের এক বেয়াড়া ছেলে। এই বই সালামের পাল্টে যাওয়ার গল্প। পড়তে পড়তে তোমরা হাসবে–কাঁদবে, মিশে যাবে প্রতিটি চরিত্রের সঙ্গে।
লুইসা মে অ্যালকটের নামটি স্মৃতি থেকে লিখলাম। সেই কবে পড়েছি, অথচ নামটা মাথায় গেঁথে আছে। এমন অনেক লেখকের নামই কাজী আনোয়ার হোসেনের কল্যাণে মাথায় ঢুকে গেছে।
কাজী আনোয়ার হোসেনের আরেকটি বই আছে, এরিখ কেস্টনারের দ্য ফ্লাইং ক্লাসরুম–এর ছায়া অবলম্বনে ক্লাস এইট। সেবা প্রকাশনীর বইয়ের সঙ্গে তোমরা যারা পরিচিত, তারা জানো যে বইয়ের শেষে ছোট্ট একটি কাহিনি সংক্ষেপ দেওয়া থাকে। ক্লাস এইট থেকে সেই অংশটুকু তুলে দিচ্ছি: ‘মফস্বল শহরের নামকরা মডেল স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ে ওরা। সেকেন্ডারি স্কুলের ছাত্রদের সঙ্গে ওদের সাপেনেউলে সম্পর্ক। অ্যানুয়েল পরীক্ষার পর হঠাৎ তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে লেগে গেল মারপিট।...হোস্টেলে ফিরে এসেই ধরা পড়ল ক্লাস টেনের কড়া প্রিফেক্ট আনিস চৌ–এর হাতে। সব শুনে সুপার হারুন স্যার কঠিন শাস্তি দিলেন—ছুটির পর এক বিকেলে সুপারের ঘরে ওদের চা–নাশতার দাওয়াত। বিশ্বাস হয়?’
কি, এটুকু পড়ে মনে হচ্ছে না বইটা এখনই পড়ে ফেলা উচিত? কাজী আনোয়ার হোসেনের লেখাই এমন। পড়তেই হবে।
ফ্র্যান্সেস হজসন বার্নেটের দ্য সিক্রেট গার্ডেন অবলম্বনে লিখলেন ফুলবাগান। হঠাৎ ৯ বছরের কান্তার মা–বাবা মারা গেলেন সড়ক দুর্ঘটনায়। ছোট্ট কান্তার আশ্রয় হলো খালুর গ্রামের বাড়িতে। সেখানে বিশাল ভূঁইয়াবাড়ির ঘরগুলো সব বন্ধ। দেয়ালঘেরা এক বিরাট বাগানে তালা মারা, গভীর রাতে কে যেন ডুকরে ডুকরে কাঁদে! সেখানেই জুটে গেল কয়েক বন্ধু—যার মধ্যে ছোট্ট একটা পাখিও আছে। এই গল্পে একটিও খারাপ চরিত্র নেই। আছে শুধু নিজেকে ভালো করার ইঙ্গিত।
এর বাইরেও আছে ছোটকুমার, ঘরের শত্রু, ইতিকথা। প্রতিটি বই তোমাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য। আরেকটু বড় হলে কাজী আনোয়ার হোসেনের অনুবাদে পড়তে পারো শেরউড জঙ্গলের বিখ্যাত দস্যু গরিবের বন্ধু রবিনহুডের বই।
আচ্ছা, মাসুদ রানায় কি তোমাদের কোনো কথা নেই? আছে। এই সিরিজের অগ্নিপুরুষ নামের একটি বই আছে—দুটি খণ্ডে বের হয়েছে। বইটি যদিও বড়দের। কিন্তু এই বইয়ে ছোট্ট মিষ্টি একটি মেয়ে আছে। কিডন্যাপাররা ধরে নিয়ে গেল তাকে। আর মেয়েটির জন্য পুরো ইতালির খারাপ লোকেদের শায়েস্তা করে মাসুদ রানা। এই বই কখনো পড়লে বুঝবে, তোমাদের জন্য কতটা মমতা ধারণ করতেন কাজীদা।
তোমরা ধারণ করবে না তার জন্য মমতা?