হেঁটে হেঁটে হামহামে

ছবির চেয়েও সুন্দর হামহাম জলপ্রপাত
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

তোমরা যারা স্কাউট করো কিংবা গার্ল গাইডসের সঙ্গে যুক্ত, তারা তো হাইকিং সম্পর্কে জানোই। আর তা না হলে বই পড়ে, সিনেমা দেখে কিংবা গল্প শুনেও হয়তো হাইকিং করার স্বপ্ন দেখো। অজানাকে জানার জন্য ভ্রমণে বেরিয়ে পড়াকে বলে হাইকিং। তোমাদের মতো আমিও কত শত দিন কল্পনা করেছি—নিঝুম-নিরালা একটা বুনো পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছি। হাতে লাঠি, কাঁধে ব্যাগ, পায়ে জুতা, মাথায় ক্যাপ। ওহ্, ভাবতেই কী যে দারুণ লাগত! ২০২০ সালে কল্পনা সত্যি হয়ে গেল!

অক্টোবর মাসে আমার পরিবারের সবার সঙ্গে গিয়েছিলাম শ্রীমঙ্গলে। রাজশাহী থেকে প্রথমে ঢাকায় ট্রেনে করে। তারপর ঢাকা থেকে পারাবত এক্সপ্রেসে চেপে সকালবেলা নামলাম শ্রীমঙ্গলে। ছোট্ট সুন্দর স্টেশনটাতে যখন পা রাখলাম, তখন পেটের ভেতর গুড়গুড় করছিল! অতি উত্তেজনায় বোধ হয় এমন হয়।

স্থানীয় শিশুদের হাতে পাহাড়ি রাস্তায় চলার সহায়ক বাঁশের লাঠি, পেছনে আমাদের চাঁদের গাড়ি
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

শ্রীমঙ্গলে আমরা উঠেছিলাম একটা হোটেলে। দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরেই বেরোলাম ঘুরতে। সেদিন আমরা অনেক ঘুরলাম। তবে হাইকিংয়ের জন্য আমার আর তর সইছিল না। সবাই ঠিক করল, পরদিন আমরা যাব মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের হামহাম জলপ্রপাতে! রাতে আমার ঘুমই হলো না।

খুব সকালে একটা চাঁদের গাড়ি ভাড়া করলাম আমরা। চাঁদের গাড়ি চেনো তো? হুডখোলা পুরোনো জিপ গাড়িকে বলে চাঁদের গাড়ি। ওতে চেপেই রওনা হলাম। কী যে সুন্দর চারপাশ, বলে বোঝাতে পারব না! ছিমছাম পিচঢালা পথ। সবুজ

চা-বাগান। লম্বা লম্বা গাছগুলো বাতাসে দুলছিল। দেখে মনে হচ্ছিল ওরা বুঝি আমাদের দেখে খুশি হয়েছে। এসব দেখতে দেখতে গন্তব্যে যেতে লাগল এক ঘণ্টার মতো।

পৌঁছানোর পরপরই আমরা একটা রেস্তোরাঁয় খাবারের ফরমাশ দিলাম, হাইকিং শেষে ফিরে এসে খাওয়ার জন্য। ঠিক হলো, আমাদের জন্য চাঁদের গাড়িটি অপেক্ষা করবে জলপ্রপাতের পাশের গ্রামে।

পথের দুপাশে বাঁশঝাড় আর আমাদের হাতেও বাঁশের লাঠি
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

হামহাম জলপ্রপাতে যাওয়ার দুটি পথ। একটা ঝিরিপথ, মানে পাহাড় থেকে নেমে ঝরনা যে পথে ছুটে চলে, তেমন একটা পথ। অন্যটি পাহাড়ি পথ। হাইকিং যেহেতু করব, তাই আমরা পাহাড়ি পথে যাব বলে ঠিক করলাম। পাহাড়ি পথে জলপ্রপাতে যাওয়ার দূরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। অর্থাৎ যাওয়া-আসা মিলিয়ে প্রায় ১০ কিলোমিটার।

পাহাড়ি পথে সারাটাক্ষণ সাবধান থাকতে হয়
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

হাইকিং শুরু করার আগে আমরা বাঁশের লাঠি ভাড়া করলাম। জানো হয়তো, হাতে লাঠি না থাকলে পাহাড়ি পথে হাঁটা ভীষণ কঠিন। ঝরনার কাছে পৌঁছাতে হলে আমাদের ডিঙাতে হবে ১০টি টিলা! গোপনে ঢোঁক গিললাম! পারব তো, অত দূর যেতে? তবে শেষমেশ অত ভাবাভাবি না করে শুরু করলাম হাঁটা। সারা জীবন সমতলে হেঁটেছি, পাহাড়ি পথ যে কতটা কঠিন, টের পেলাম হাড়ে হাড়ে! সারাটাক্ষণ সাবধান থাকতে হয়। না হলে বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে যেকোনো সময়।

সব মেনে হাঁটছি তো হাঁটছি, পথ আর ফুরায় না! হাইকিংয়ের মজা একসময় হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার জোগাড়! আর পারছিলাম না! পা দুটো এগোতে চাইছিল না একদম, কিন্তু উপায় কী! অবশেষে পাহাড়ি রাস্তায় তিনটা সাঁকো পেরোলাম আমরা। প্রায় চার ঘণ্টা পর পৌঁছালাম হামহাম জলপ্রপাতের সামনে।

জলপ্রপাত দেখেই সব কষ্ট ভুলে গেলাম। অনেকে বলে, ছবির মতো সুন্দর। আমি তো বলব, ছবির চেয়েও সুন্দর।

ঝিরির আরেক নাম ছড়া, সত্যিই ছড়ার মতো ছন্দ আছে এর
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

মনে হলো, কোনো যুদ্ধ জয় করে ফেলেছি! আর ঝরনার পানিতে পা ভেজাতেই মনে হলো, এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতেই পারে না! পানিতে ভেজার পর ঝরনার পাশের দোকান থেকে চা খেলাম আমরা। আর মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলাম মনভরে। তারপর আবার শুরু হলো হাঁটা।

সারা দিনের হাইকিংয়ের কারণে সে রাতে এত ক্লান্ত ছিলাম যে কিছুই আর মনে নেই! তাই আর কিছু বলারও নেই। তবে এতটুকু বলতে পারি, দিনটা আমার সারা জীবন মনে থাকবে।