আমি অতীতের সময়টাকে সমসাময়িক করে লিখেছি

১৪ জুন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ৭৫তম জন্মদিন। জন্মদিনের ক্ষণে নিজের সাহিত্যজগৎ উন্মোচন করেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ

নিজের বাসায় সেলিনা হোসেন, ৭ জুন ২০২২। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

প্রশ্ন :

আলতাফ শাহনেওয়াজ: আর কয়েক দিন পরেই আপনার ৭৫তম জন্মদিন। আপনি নিরবচ্ছিন্নভাবে সাহিত্যচর্চা করছেন ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে। এ সময়ে নিজের লেখালেখি নিয়ে আপনার উপলব্ধি কী? এ ক্ষেত্রে আপনার কতটা প্রাপ্তি এবং কতটা অপ্রাপ্তি আছে?

সেলিনা হোসেন: আমি সৃজনশীল চর্চাকে নিজের সাধনায় ভরে তুলেছিলাম আমার লেখালেখির একদম সূচনাপর্ব থেকে। আমি প্রথম গল্প লিখি ১৯৬৪ সালে। তখন আমি রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। সেই বছরে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার বিভাগের অধীনে সব কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে সাহিত্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন। আমাদের কলেজ থেকে আমার নাম পাঠানো হয় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য। মোট সাতটি বিষয়ে নাম দেওয়া হয়। তার মধ্যে আবৃত্তি, বিতর্ক, গল্প লেখা, উপস্থিত বক্তৃতা—এমন অনেক কিছু ছিল। অধ্যাপক আবদুল হাফিজ ছিলেন আমাদের কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক। তিনি ছিলেন প্রতিযোগিতায় কে যাবে না যাবে, তার দায়িত্বে। তাঁর কাছে গিয়ে আমি বললাম, স্যার, আমি তো কোনো দিন গল্প লিখিনি। আমি লিখতে জানি না।

স্যার আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, লেখনি তো কী হয়েছে? একটু চেষ্টা করো, চেষ্টা করে লেখো। ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড হতে হবে না। অংশগ্রহণ করাটা জরুরি। যা পারো লিখে গল্প জমা দাও। যাও তৈরি হও। ভয়ে আমি কাঁদতে শুরু করি। তখন স্যার আরও বকা দেন আমাকে। বলেন, যতগুলো বিষয়ে নাম দিয়েছি, ততগুলোতেই অংশ নেবে। যাও, নিজেকে তৈরি করো। গল্প লেখার চেষ্টাও করো। তো কলেজের শিক্ষকের হুকুমে আনেক চেষ্টাচরিত্র করার পর আমি গল্প লিখলাম। স্যারের নির্দেশ মেনে সেই গল্প জমাও দিলাম। কলেজের শিক্ষকেরা ছিলেন বিচারকমণ্ডলীতে। ফলাফল যখন দেওয়া হলো, অবাক হয়ে দেখলাম আমার গল্প প্রথম হয়েছে! এই ফল দেখে আমি একরকম বিস্ফারিত হয়ে যাই। সাতটি বিষয়ে অংশ নিয়ে ছয়টিতে প্রথম হই, একটিতে তৃতীয়। সেবার আমি চ্যাম্পিয়ানশিপ গোল্ড মেডেল পেয়েছিলাম। এই হলো আমার গল্প লেখার সূচনা। তারপর ১৯৬৪ থেকে ২০২২—অনবরত লেখার চেষ্টা করেছি। লেখালেখিকে আমি জীবনের সূত্র বলে মেনে নিয়েছি। অনবরত উপন্যাস লেখার সূত্র খুঁজেছি। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বকে ‘কনটেম্পরারি প্যারালাল’ করার চিন্তা ছিল আমার লেখালেখির মৌলিক দিক। আমি যা, যতটুকু পেরেছি, তা–ই লিখেছি। বিষয় বিবেচনায় নতুন অর্থ আমি খুঁজেছি সব সময়। এটাই হয়তো আমার প্রাপ্তির জায়গা। আর অপ্রাপ্তি? অপ্রাপ্তি নিয়ে আমার কোনো ভাবনা কখনো ছিল না।

কলেজে–বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি গিটার বাজাতে শিখেছিলাম। অভিনয় করতাম। ১৯৭০ সালে ২ জুলাই বাংলা একাডেমির চাকরিতে যোগদানের পরে মনে হলো এক জীবনে এত কিছু করা সহজ হবে না। এখন থেকে লেখালেখিই হবে আমার সাধনা।

প্রশ্ন :

আলতাফ: আপনার শিক্ষক আবদুল হাফিজের ‘হুকুমে’ আপনি লিখতে শুরু করলেন। যত দূর জানি, আপনাকে তিনি আরও বহুভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। সেই ঘটনাগুলো যদি বলেন...

সেলিনা: ওই প্রতিযোগিতায় গল্প লিখে প্রথম হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলাম। তখন একদিন স্যার আমাকে বললেন, তুমি লেখালেখি ছাড়বে না। অনবরত চেষ্টা না করলে লেখালেখিতে সিদ্ধি আসবে না। স্যারের এই কথাটি আমি মন ও মাথায় ধরে রাখি। ১৯৬৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বেশ অনেকগুলো গল্প লিখি। এমএ পরীক্ষা দেওয়ার পরে হাফিজ স্যার বললেন, এই গল্পগুলো দিয়ে একটা বই করে ফেলো। আবার আমার দুচোখ পানিতে ভরে যায়। স্যারকে বলি, স্যার, কে আমার বই করবে?

স্যার ধমক দিয়ে বললেন, কেউ করবে না। বাবা-মায়ের কাছে টাকা চাও। একটা বই থাকলে তোমার জীবনবৃত্তান্ত অন্যদের চেয়ে আলাদা হবে। চাকরি পেতে সহজ হবে। মায়ের কাছে গিয়ে যখন বললাম, মা খুশি হয়ে বললেন, আমার সংসার খরচ থেকে টাকা দেব। আমি বাবার কাছে গেলাম। চাকরি পাব শুনে বাবাও খুশি হয়ে বললেন, হ্যাঁ আমিও টাকা দেব। তোর স্যারকে গিয়ে বল একটা প্রেস ঠিক করে দিতে। স্যার প্রেস ঠিক করে দিলেন। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হলো আমার প্রথম গল্পের বই উৎস থেকে নিরন্তর। এরপর ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমিতে আমার চাকরি হয়।

প্রশ্ন :

আলতাফ: ঠিক কখন থেকে মনে হলো, আপনি লেখকই হবেন?

সেলিনা: কলেজে–বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি গিটার বাজাতে শিখেছিলাম। অভিনয় করতাম। ১৯৭০ সালে ২ জুলাই বাংলা একাডেমির চাকরিতে যোগদানের পরে মনে হলো এক জীবনে এত কিছু করা সহজ হবে না। এখন থেকে লেখালেখিই হবে আমার সাধনা। আমি লেখকই হব। বাংলা একাডেমিতে চাকরি করার সময়ই লেখক হওয়ার চিন্তা করেছি, অন্য কোনো কিছুতে আর মনোযোগ দিইনি।

প্রশ্ন :

আলতাফ: এই যে ‘অন্য কোনো কিছু’ মানে আপনার গিটারবাদন ও অভিনয়—এ সম্পর্কে কিছু বলুন...

সেলিনা: সেসব তো এখন ঠিকমতো মনেও নেই। আগেই বলেছি, ইন্টারমিডিয়েট পর্যায়ে পড়তাম রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজে। এ সময়ই আমি গিটার শিখি ও অভিনয় করতে শুরু করি। তখন নাটকে টুকটাক অভিনয়ও করেছি। পাশাপাশি বিতর্ক, কবিতা আবৃত্তি—সবই করতাম। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আব্বার কাছে গিটার কিনে দেওয়ার আবদার করলাম। তিনি কিনে দিলেন। তখন মনের সুখে গিটারে গান তুলতাম। আর অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আমার পদচারণ তো ছিলই। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে ১৯৬৫, ’৬৬, ’৬৭ ও ’৬৮ সালে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন ছিলাম আমি। জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন জিন্নাহ হলের (এখন শের-ই-বাংলা ফজলুল হক হল) প্রভোস্ট। তিনি একটি নাটক করবেন। তো একদিন তিনি আমাকে বললেন, তোমাকে নাটকে অভিনয় করতে হবে। শুনে খানিক জড়সড় হয়ে তাঁকে বললাম, স্যার, কত সুন্দর সুন্দর মেয়ে আছে, তাদের বাদ দিয়ে আমি কেন? তিনি বললেন, এটা গ্রামীণ পটভূমির নাটক। এ নাটকের নায়িকা চরিত্রে তোমাকেই লাগবে। স্যারের কথায় আবার নাটকে অভিনয় করলাম। তবে নাটকের নাম কী ছিল বা আমার অভিনীত চরিত্রের নাম কী, এত বছর পরে তা আজ আর মনে নেই।

প্রশ্ন :

আলতাফ: স্বাধীনতার আগে যখন আপনি লেখালেখি শুরু করেছিলেন, সেই সময় নারীর জন্য সমাজটি ছিল নানা রকম বিরুদ্ধতায় ভরা। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশেও বহু দিন এই বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে নারীদের—পারিবারিক ও সামাজিক নানা সংস্কার এবং সমাজের মধ্যে থাকা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাসহ আরও বিভিন্ন কারণ আছে এর নেপথ্যে। এই বাস্তবতায় আপনি কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছিলেন? আপনার লড়াইটি কেমন ছিল?

সেলিনা: আমি পরিবার ও সমাজের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হইনি। কারণ, লেখার জগৎ নিয়ে আমার আচরণে কোনো বাড়াবাড়ি ছিল না। রাজশাহী থেকে ঢাকার বিভিন্ন কাগজে লেখা ডাকে পাঠাতাম। ছাপা না হলে মনে করতাম, আমার লেখাটি ভালো হয়নি, সে জন্য ছাপেনি। আবার আর একটি পাঠাতাম। তখন হয়তো দেখতাম যে ছাপা হয়েছে। এভাবে আমি নিজেকে তৈরি করেছি। চেষ্টা করছি অনবরত। বড় ধরনের কোনো প্রতিবন্ধকতায় বাধাগ্রস্ত আমি হইনি। আমি খুব সৌভাগ্যবান এ কারণে যে লেখালেখির ক্ষেত্রে পরিবারকে আমি শুধু পাশেই পাইনি, আমার লড়াইয়েও পরিবারের মানুষজন আমাকে সঙ্গ দিয়েছেন।

প্রশ্ন :

আলতাফ: প্রবন্ধ, গল্প-উপন্যাস মিলিয়ে অনেক লিখেছেন আপনি। এর মধ্যে যদি একটি বা দুটি বইকে বেছে নিতে বলা হয় তবে নিজের লেখা কোন বইটি বেছে নেবেন?

সেলিনা: আমার ১১৬টি বইয়ের মধ্যে একটিকে বেছে নিলে অন্যগুলোর প্রতি অবিচার করা হবে। কারণ, সব বইয়ের পাণ্ডুলিপি আমি প্রবল নিষ্ঠায় সময় নিয়ে রচনা করি। আমার নীল ময়ূরের যৌবন উপন্যাসটি পশ্চিমবঙ্গের ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগেও পাঠ্য। তবে এই প্রশ্নের উত্তরে জানাই, গায়ত্রী সন্ধ্যা উপন্যাসটি আমার বিশেষ প্রিয়। কারণ, এখানে ১৯৪৭ সাল থেকে ’৭৫ পর্যন্ত আমাদের অঞ্চলের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক পটভূমি রয়েছে। এ সময়ে সমাজ, রাজনীতি ও ব্যক্তিমানুষের মধ্যে যে উত্থান–পতন ছিল, তা আমি সৃজনশীলভাবে কাহিনির আকারে লিখতে চেষ্টা করেছি।

প্রশ্ন :

আলতাফ: সমাজের জ্যান্ত প্রসঙ্গ ও ইতিহাসের নানা বিষয়কে উপজীব্য করে উপন্যাস লিখেছেন আপনি। মুক্তিযুদ্ধ ও বীরাঙ্গনা নিয়ে যেমন একাধিক উপন্যাস আছে, তেমনি চর্যাপদের কাল, মির্জা গালিবের সময়কাল—এগুলোও উপন্যাসে বিষয় হয়ে এসেছে। কথা হলো, এ বিষয়গুলো নিয়ে উপন্যাস লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন কেন? অনেকে এমনও বলেন যে, যেহেতু সমাজ ও ইতিহাসের মধ্যে এই বিষয়গুলো আগে থেকেই কাহিনি আকারে উপস্থিত, তাই এগুলো নিয়ে উপন্যাস লেখা খানিকটা সহজও বটে। এখানে একদম শূন্য থেকে কল্পনা করে এগোতে হয় না। এ বিষয়ে কী বলবেন?

সেলিনা: বিষয়গুলোকে আঙ্গিকগতভাবে আমি ‘কনটেম্পরারি প্যারালাল’ বা অতীতের সময়টাকে সমসাময়িক করে লিখেছি। নীল ময়ূরের যৌবন–এর কথাই বলি, এ উপন্যাসে আমি চর্যাপদের সময়কালকে ধারণ করেও এ কথা বলেছি যে এই বাঙালির একদিন নিজস্ব ভূখণ্ড হবে। এভাবেই আমি অতীতকে বর্তমানের সঙ্গে সংযুক্ত করেছি। ভারতের উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপককে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনারা নীল ময়ূরের যৌবনকে পাঠ্য করলেন কেন? উত্তরে তিনি বললেন, উপন্যাসটি আপনি চর্যাপদের পটভূমিতে একদম অন্য রকম করে লিখেছেন। বইটিকে চর্যাপদের সময়ের পটভূমিতে কনটেম্পরারি প্যারালাল করেছেন। এই নতুন মাত্রার জন্য আমরা ছাত্রছাত্রীদের বইটি পড়াতে চাই।

মির্জা গালিব তাঁর সময়ে রাজদরবারে কবিতা পাঠ করতেন। তাঁর কবিতা এখন সাধারণ পাঠকের কাছে পৌঁছেছে। দিল্লিতে তাঁর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আমার মনে হয়েছিল, তাঁকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখব যেন সাধারণ পাঠক তাঁর সময়কে বুঝতে পারে। আমি তো এ ধরনের উপন্যাসে নিজেদের ঐতিহ্য ধারণ করে তাতে আবার নতুন কল্পনা সংযোজন করি। অনেক পাঠকের কাছে সেটি নন্দিতও হয়।

প্রশ্ন :

আলতাফ: কোন কোন লেখক আপনার লেখকজীবনকে প্রভাবিত করেছেন?

সেলিনা: কোন লেখকের দ্বারা আমি প্রভাবিত হইনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার প্রিয় লেখক। তিনি যে শিলাইদহ, পতিসর, শাহজাদপুরে ছিলেন, সেই পটভূমিতে আমি উপন্যাস লিখেছি পূর্ণ ছবির মগ্নতা নামে। উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা দেবযানী সেনগুপ্ত। শ্রীলঙ্কার ভাষায় অনুবাদ করেছেন দয়া দিসানায়েক। শ্রীলঙ্কা থেকে এটি প্রকাশিতও হয়েছে।

প্রশ্ন :

আলতাফ: লেখালেখিতে নারীরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয়, তাঁদের লেখা আদৃতও হচ্ছে। পরবর্তী প্রজন্মের কাদের লেখা আপনার ভালো লাগে?

সেলিনা: নবীন লেখক—ছেলে ও মেয়ে—সবার লেখাই আমার কম-বেশি ভালো লাগে।

প্রশ্ন :

আলতাফ: বাংলাদেশের কথাসাহিত্য এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? আপনার কাছে কথাসাহিত্যের সাম্প্রতিক প্রবণতাগুলো কী কী বলে মনে হয়?

সেলিনা: আমাদের কথাসাহিত্য আমাদের মতো। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ’৬৬–এর ছয় দফা, ’৬৯–এর গণ–অভ্যুত্থান, ’৭১–এর মুক্তিযুদ্ধসহ নানা ঘাত–প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গিয়েছি আমরা। আমাদের কথাসাহিত্যেও তা প্রতিফলিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়েই আমাদের কথাসাহিত্য অন্যদের চেয়ে স্বতন্ত্র অবস্থানে পৌঁছেছে। আর সাম্প্রতিক প্রবণতার কথা যদি বলতে হয়, তাহলে বলব যে বিষয়বৈচিত্র্য বেড়েছে, নানা রকম বিষয়ই এখন গল্প–উপন্যাসে উঠে আসছে। আরেকটি কথা বলতে হবে, আগে পুরুষের চোখ দিয়েই আমরা সবকিছু দেখতাম। গল্প–উপন্যাসে এখন নারীর চোখে আরও বেশি মাত্রায় তাঁদের জীবনযাপন দেখতে পাচ্ছি। এটা খুব আশার কথা।

প্রশ্ন :

আলতাফ: লেখালেখি নিয়ে সামনে আপনার পরিকল্পনা কী? নতুন কী লিখছেন বা লিখতে চান?

সেলিনা: শরণার্থীর সুবর্ণরেখা নামে একটি উপন্যাস লিখছি আমি। মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থীরা ভারতের যেখানে ছিলেন, সেই পটভূমিতেই লেখা হচ্ছে উপন্যাসটি। আসলে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের শরণার্থীদের যে অবদান, তা সেভাবে আলোয় আসে না, এই উপন্যাসে আমি তাঁদের কথা বলতে চাই। এ জন্য প্রস্তুতিও নিয়েছি। ১৯৭১ সালে যাঁরা শরণার্থী ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছি, এ–সংক্রান্ত যেখানে যা কিছু আছে সবকিছু পড়ার চেষ্টা করেছি। এরপরেই লিখতে বসেছি।

প্রশ্ন :

আলতাফ: গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, জীবন দুঃখময়। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এ যে দীর্ঘ জীবন কাটালেন, আপনার জীবনের গভীরতম দুঃখটি কী? এই জীবন নিয়ে আপনার উপলব্ধিই–বা কী?

সেলিনা: আমার দুঃখ হলো আমার চোখের সামনে আমার ছোট মেয়ে ফারিয়া লারার মৃত্যু। আর উপলব্ধি যে কী...আসলে যে জীবন কাটিয়েছি তা সুখ-দুঃখ পূরণ করে টেনে যাচ্ছি বেঁচে থাকার সবটুকু নিয়ে।