কোনো সৃষ্টিশীল কাজই বাঁধা নিয়মে চলে না

সম্প্রতি ভারতীয় ঔপন্যাসিক গীতাঞ্জলি শ্রীর টম্ব অব স্যান্ড উপন্যাসটি আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার-২০২২ অর্জন করেছে। রেত সমাধি নামে উপন্যাসটি প্রথম হিন্দিতে প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৮ সালে। পরে মার্কিন অনুবাদক ডেইসি রকওয়েল এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। টিল্টেড অ্যাক্সিস প্রেস উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করে ২০২১ সালে। এবারই প্রথম হিন্দি ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনূদিত কোনো উপন্যাস বুকার পুরস্কারে ভূষিত হলো। পুরস্কারের দীর্ঘ তালিকা প্রকাশের পর ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নিউজ নাইন–এ গত ২২ মার্চ গীতাঞ্জলি শ্রীর সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়। গিরিশ মোদির নেওয়া এ সাক্ষাৎকার ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন তুষার তালুকদার

বুকারজয়ী গীতাঞ্জলি শ্রী

প্রশ্ন :

আন্তর্জাতিক বুকারের দীর্ঘ তালিকায় প্রথম কোনো হিন্দি উপন্যাস রেত সমাধি (টম্ব অব স্যান্ড) জায়গা পেল। কেন এর আগে কোনো হিন্দিতে লেখা বই এ তালিকায় জায়গা পায়নি?

গীতাঞ্জলি শ্রী: এটি মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। আমি চাই, সবাই এর উত্তরটি শুনুন। নিশ্চিতভাবে, আমার লেখা উপন্যাসটিই কেবল এ তালিকায় জায়গা করে নেওয়ার যোগ্য, তা আমি মনে করি না। এর আগেও দারুণ সব লেখা হয়েছে হিন্দি ভাষায়, কিন্তু হিন্দি ভাষাভাষীর বাইরে কজন সেসবের খোঁজ রেখেছেন? এক ভাষা থেকে অপর ভাষায় অনুবাদই পারে সেসব ভালো লেখা সবার কাছে পৌঁছে দিতে। তবে কেন অনুবাদ বিস্তৃত আকারে হয়নি বা হয় না, এর পেছনে রাজনীতি রয়েছে, আবার পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত অনুবাদক ও সংশ্লিষ্ট সম্পদের অপর্যাপ্ততা রয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা চলতে পারে, খোলামেলা মতবিনিময় হতে পারে। দেখুন, বিশ্বব্যাপী বেশির ভাগ বই প্রকাশের পর পরিচিত গণ্ডির বাইরে কজন এ সম্পর্কে জানে? অধিকাংশ সাহিত্যিকের বেশির ভাগ লেখা বৃহত্তর পাঠকের কাছে পৌঁছায় না। এসব বিবেচনায় আমাকে ভাগ্যবান মনে করতে পারেন।

প্রশ্ন :

রেত সমাধি উপন্যাস লেখার সময়কালের কিছু আনন্দ-বেদনার মুহূর্ত সম্পর্কে যদি বলতেন...

গীতাঞ্জলি শ্রী: দেখুন, লেখালেখি অ্যাডভেঞ্চারের মতন ব্যাপার। লেখা নামক ভ্রমণের বেলায় আনন্দ, বেদনা, দ্বন্দ্ব, দুশ্চিন্তা, ঝুঁকি প্রভৃতি নানা কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যেহেতু এই লেখার পুরো সময়টা আমি একা থেকেছি, রাজ্যের আবেগ আমার মধ্যে ভর করে। কোনো সৃষ্টিশীল কাজই বাঁধা নিয়মে চলে না। যদিও শুরুতে একজন লেখকই লেখাটা শুরু করেন, কিন্তু সময়ান্তরে সেই লেখার চরিত্ররা এবং সম্ভাব্য ঘটনাপ্রবাহ—এই দুইয়ে মিলে লেখককে দিকনির্দেশনা দেয়। রেত সমাধি যথেষ্ট স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠেছে, ওই স্বাধীনতাই আমাকে পরবর্তী সময় পথ দেখিয়েছে। উপন্যাসটি একটার পর একটা সীমানা পাড়ি দিয়েছে, আমি কেবল সঙ্গে ছিলাম। এর চরিত্র, কাঠামো, গল্প—সব এক এক করে জন্ম নিয়েছে কোনো বাধা ছাড়াই। মনে হচ্ছিল, উপন্যাসটা দুনিয়ার তাবৎ বৈচিত্র্যের প্রাচুর্য উপভোগ করতে চায়। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে স্বাধীনতা কেবল অনুপ্রাণিতই করে না, মাঝেসাজে চিন্তায়ও ফেলে। ফিকশান লেখার বেলায় আপনি পাগলাটে ভাব দেখাতে পারেন, কিন্তু একেবারে সৃষ্টিছাড়া হতে পারেন না। তেমনি আমার উপন্যাসটিও অনেক অনিশ্চয়তার পথ পাড়ি দিয়েছে। সাত-আট বছরের মতো লেগেছিল এই উপন্যাসের নতুন একটি জগৎ নির্মাণ করতে। এতে অনেক ঐতিহাসিক ও মানবিক ঘটনাবলি দ্বন্ধে জড়ায় এবং ধীরে ধীরে এগুলো একটি ভাষা খুঁজে পায়।

লেখা শেষ হওয়ার পরপরই এটিকে কোনো প্রকাশকের হাতে আমি তুলে দিইনি। এমন না যে এর ওপর আরও কাজ করার ছিল। তবু এটি আমাকে ছেড়ে যেতে চাইছিল না।

প্রশ্ন :

ডেইসি রকওয়েল রেত সমাধি উপন্যাসটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। অনুবাদের জন্য তাঁর হাতে বইটি তুলে দিতে কী কী বিষয় আপনাকে সাহস জুগিয়েছে?

গীতাঞ্জলি শ্রী: নির্ভরযোগ্য অনেকের কাছ থেকে শুনেছি, ডেইসি দারুণ কাজ করেছেন। সম্প্রতি বুকারের তালিকাও এ কথার সত্যতা প্রমাণ করেছে। আমি যদি একা তাঁর কাজ বিবেচনা করতাম আমার নিজের কাছেও খটকা লাগত। অনেকেই তাঁর কাজের প্রশংসা করেছেন। নিজের কাজের প্রতি আমার আবেগ ও পক্ষপাত দুটো থাকাই স্বাভাবিক। আমাদের দুজনের ক্ষেত্রে যে ব্যাপারটি খুব কাজে দিয়েছে তা হলো, বোঝাপড়া। আমরা সহমত বা দ্বিমত থেকেও একটা সহজ সমাধানের পথ খুঁজেছি। তাঁর সন্দেহ বা দ্বিমত থাকলে আলোচনায় বসেছি, তারপর একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি।

প্রশ্ন :

উপন্যাসের বিষয়বস্তু এবং এর ভাষা নিয়ে যদি কিছু বলতেন?

গীতাঞ্জলি শ্রী: অনেক বৃদ্ধ নারীকে আমি শুয়ে থাকতে দেখেছি, তাদের পেছনটা আমাদের দিকে মুখ করা। আমি বিস্মিত হয়েছি এটা ভেবে যে তারা কি পেছনটা আমাদের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে, নাকি তাদের পেছন ফিরে শুয়ে থাকাটা জীবনবিমুখতা। এমন ধারণা থেকেই এ উপন্যাসের সৃষ্টি। রেত সমাধি উপন্যাসে যে বৃদ্ধ মা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছেন, তিনি কি দেয়ালে ঢুকে যাবেন জীবন শেষ করে দিতে, নাকি দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে জীবনের নতুন কোনো অর্থ খুঁজবেন? বলতে পারেন এটিই উপন্যাসের সূচনাবিন্দু। মা-মেয়ের সম্পর্কের অনেক গল্প আমরা পড়েছি, আমি এ উপন্যাসে দেখিয়েছি ঠিক এর উল্টোটা—মা যখন মেয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকা শুরু করে, সেই সময় মায়ের শূন্যতা অনুভব করে বড় ছেলে। মাকে দেখতে সে বোনের বাড়িতে যায়, কিন্তু ঘরে ঢোকে না, পাছে মায়ের প্রতি আবেগ প্রকাশ পেয়ে যায়! ব্যাপারটিকে আমি পিতৃতান্ত্রিকতার বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই দেখতে চেয়েছি এবং দেখিয়েছিও। হিন্দি সাহিত্যে এ বিষয় খুব কম আলোচিত।

তবে আমার উপন্যাসটির হিন্দি ও ইংরেজি দুটো ভাষারই শ্রুতিগুণ উপভোগ্য একটা বিষয়। দেখুন, ভাষা মূলত শ্বাস নেওয়ার বিষয়, অনেক রকমের শ্বাস-প্রশ্বাসের মিলিত সুর হলো ভাষা। আমার কাছে ভাষা কেবল ভাব বহনের মাধ্যম নয়, এর নিজস্ব একটা স্বাধীন সত্তা আছে। রেত সমাধির কোনো কোনো বাক্য খুব দীর্ঘ, দুই পাতাজুড়ে একটিই বাক্য। তবে শ্রুতিগুণ (অডিও কোয়ালিটি) নষ্ট হয়নি। আবার কখনো কখনো একটি বাক্য দিয়েই একটি অধ্যায় শেষ হয়েছে। ফলে উপন্যাসটিকে পড়ার ক্ষেত্রে একটা চ্যালেঞ্জ তো পাঠককে নিতেই হচ্ছে।

প্রশ্ন :

সৃষ্টিশীল লেখালেখি কি আপনি শিখেছেন? যদি তা না হয়ে থাকে তবে কীভাবে নিজেকে লেখক হিসেবে তৈরি করলেন?

গীতাঞ্জলি শ্রী: না, সৃষ্টিশীল লেখালেখি আমি শিখিনি! এটা কি আমেরিকান একটা ব্যাপার, না? আমি শঙ্কিত, আমেরিকার প্রশংসা করছি না বলে। তাদের এ-জাতীয় শিক্ষা কি খুব বেশি সার্থক লেখার জন্ম দিতে পেরেছে? লেখালেখি আমি লিখতে লিখতে, পড়তে পড়তে শিখেছি।

প্রশ্ন :

লেখকদের কি সামাজিক, রাজনৈতিক বা জনগণের অধিকারসংক্রান্ত কোনো ইস্যুতে সরাসরি জড়ানো উচিত?

গীতাঞ্জলি শ্রী: এটা অবশ্য লেখকের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আপনি সরাসরি না জড়িয়েও সামাজিক, রাজনৈতিক বা জনসংশ্লিষ্ট কোনো ইস্যুতে কথা বলতে পারেন, আর সেটা হতে পারে আপনার লেখার মাধ্যমে। আবার কোনো লেখক যদি কোনো কার্যক্রমে জড়াতে চান তাতেও দোষের কিছু নেই। আসলে শিল্পসাহিত্য একটা চক্রাকার পথে ঘোরে, যেখানে আপনার ভাবনা বা কণ্ঠস্বর অন্যের কাছে পৌঁছে, আবার অন্যের স্বরও আসে আপনার কাছে।