মানুষ যেন বুঝতে পারে, আমি কোন জীবন কাটিয়ে গেলাম

হাসান আজিজুল হকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল ২০১৭ সালের ২ মার্চ। রাজশাহীর বাসায় বসে এ কথোপকথনে তিনি বলেছিলেন নিজের লেখালেখির শুরুর সময়, লেখক হিসেবে প্রস্তুতিপর্ব, সমাজ-রাষ্ট্রসহ নানা প্রসঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইসমাইল সাদী

প্রশ্ন :

ইসমাইল সাদী: লেখক হওয়ার একটা স্বপ্ন আপনার মধ্যে ছোটবেলা থেকেই ছিল বলে আমরা জানি। লেখক হওয়ার ক্ষেত্রে নিজেকে কতটা সফল মনে করেন?

হাসান আজিজুল হক: ছোটবেলা থেকেই লেখক হওয়ার বিষয়টা ভেতরে হয়তোবা ছিল। এটা কারও থাকে, কারও থাকে না। তবে ছোটবেলা থেকে পড়াটার প্রতি ঝোঁক ছিল খুব বেশি। প্রচুর পড়েছি। ছোটবেলা থেকেই এমন বহু কিছু পড়েছি, যেগুলো জেনে লোকজন বলবে, এগুলো সাহিত্য ধরনের কিছু নয়। যেমন শশধর দত্ত একসময় মোহন সিরিজের ১০০টা বই লিখেছিলেন (মোহন একটা দস্যু চরিত্র)। তার দস্যুতার কাহিনি ১০০টা সিরিজজুড়ে লিখেছিলেন—দস্যু মোহন, এরপরের মোহন, মৃত্যুর পর আবার মোহন ইত্যাদি নাম ছিল সেগুলোর। এটা অনেকটা শার্লক হোমসের মতো। এরপর পাঁচ কড়ি দিয়ে, নীলবসনা সুন্দরী, আয়েশা—এ রকম অনেক বড় বড় গোয়েন্দা সিরিজের প্রচুর বই ওই সময় পড়েছি। রাইডার হ্যাগার্টের বই—ওটার কাহিনি হলো, একবার এক নারী স্নান করে যুবতী হয়ে গেল। এরপর লোভে পড়ে আবারও স্নান করতে গেল। এরপর একেবারে ৫০০ বছর বয়সের মতো বৃদ্ধা হয়ে গেল। এই ধরনের বই খুব পড়েছি। লেখার চেয়ে ওই সময় এসব বই পড়েছি অনেক বেশি। আবার ক্ল্যাসিকগুলোও পড়েছি; তবে সংক্ষিপ্ত সংস্করণে। হয়তো দুটো সিরিজ পড়েছি মাত্র ১০০ পৃষ্ঠায়। তখন ছোট সংস্করণে বইগুলো পাওয়া যেত। এখন সেগুলো পাওয়া যায় না। এসব বই যখন পড়ছি, তখন আমার বয়স ১০-১৫ বছরের মতো। আমি ছিলাম সর্বভুক পাঠক। পড়েছি বেশি। এখনো বেশির ভাগ সময়ই পড়ি। এসব পড়ার পর আমার মনে হতো, আমিও লিখব। চেষ্টাও করেছি টুকটাক। হয়নি হয়তো কিছুই। কিন্তু চেষ্টা করেছি তখন থেকেই।

প্রশ্ন :

সাদী: লেখক হিসেবে আপনি কতটা তৃপ্ত?

হাসান আজিজুল হক: তখন থেকেই ভেবেছি, আমি লেখক হব এবং এটাকেই সর্বাধিকার দেব। অন্য যেকোনো পেশায় থাকি না কেন, সেটা হবে লেখালেখির অধীন পেশা। যেমন শিক্ষকতা। শিক্ষকতাটা লেখালেখির জন্যই বেছে নিয়েছিলাম। কারণ, এতে সময় বেশি পাওয়া যাবে। এ পেশায় থাকলে স্বাধীন চিন্তার ওপর কেউ হস্তক্ষেপ করবে না। শিক্ষকের ওপর কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারে না। লেখক হিসেবে আমি সেই সম্পূর্ণ স্বাধীনতাটুকু চাই—আমার যা খুশি তা-ই লিখব। আর এতে কোনোভাবেই কোনো ব্যক্তির ভয়ে বা রাষ্ট্রভয়ে ভীত হব না, সরকারি অন্যায় নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে চুপ করে থাকব না, যা প্রয়োজন তা বলব—এসব একদম ঠিকঠাক ভেবে নিয়ে আমি লেখক হওয়ার চেষ্টা করেছি। লিখে অর্জন কী করেছি, সেটা বলতে পারব না। তবে আমার কাছে অনেক সময় মনে হয়, লেখক হওয়ার কারণে আমি মানুষের কাছ থেকে প্রচুর বাড়তি সম্মান-ভালোবাসা পেয়েছি। সম্মানের চেয়ে ভালোবাসাই বেশি পেয়েছি। আবার অনেক ক্ষেত্রে আনুকূল্যও পেয়েছি। এ কারণে একটার পর একটা পুরস্কার-টুরস্কার দিয়েছে লোকজন।

প্রশ্ন :

সাদী: এতটা স্বীকৃতি পাবেন লেখালেখির শুরুর সময়ে নিশ্চয়ই ভাবেননি।

হাসান আজিজুল হক: কোনো দিনই ভাবিনি। এখনো পুরস্কার নিয়ে ভাবি না। আসলে ইন্টারমিডিয়েটে খুব ভালো করে পড়াশোনা করেছিলাম। স্ট্যান্ড করেছিলাম। তখন মনে হলো ইংরেজিতে পড়ব। বাংলা পড়ার কথা ভাবিনি। অবশ্য তখনই একটু-আধটু লেখালেখি শুরু করেছি। তখন দু-একটা গল্প কলেজ ম্যাগাজিনে বেরিয়েছে। তখন থেকে শুরু করে এমএ ক্লাস পর্যন্ত নানান জিনিস লিখতাম। টুকটাক লেখালেখির অভ্যাস খুব অল্প বয়স থেকেই ছিল—১২-১৩ বা ১৫ বছর বয়স থেকে। এরপর ঠিক করলাম, লেখাটাই আমার প্রধান কাজ হবে। মানুষকে, সমাজকে দেখতে হবে। আর আমার দেখাটা শেয়ার করা, লিপিবদ্ধ করে রাখা—এসবই স্থির করেছিলাম তখন। যাতে মানুষ আমাকে বুঝতে পারে। তারা যেন বোঝে আমি কোন চোখে জগৎকে দেখে গেলাম, কোন জীবন কাটিয়ে গেলাম, সেখানে মানুষগুলো কেমন ছিল; মানুষ কত ভুগেছে, নির্যাতিত হয়েছে, দারিদ্র্যে কষ্ট পেয়েছে—এসব আরকি।

মানুষের অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপনের মধ্যেও কোথাও কোথাও কোনো আনন্দের মুহূর্ত থাকে। তখন মনে হয়, জীবন তো এ রকমই। তাদের কেন কোনো আনন্দের মুহূর্ত থাকবে না? জীবনের ধর্ম এমনই, জীবন যাপন করার সময় কেউ কখনো দুঃখিত থাকে না। চাষি বা অতিদরিদ্র লোকের কথাই যদি বলি, তারা দৈনন্দিন জীবনে প্রতিনিয়ত দুঃখবিলাস করে, এটা ঠিক না। সে-ও কিন্তু আঙুরের রস নিংড়ে নেওয়ার মতো করে জীবন থেকে একটুখানি রস গ্রহণ করবেই করবে। এই আমার দৃষ্টিটাকে সদর্থক বলা যায়। মানুষকে নঞর্থক জায়গা থেকে আমি দেখি না। যদিও জানি, দুঃখকে যদি বিষয় হিসেবে না তুলে আনি, তাহলে জীবনের পূর্ণতা আসে না। বুদ্ধ বলেছিলেন, মুক্তি পেতে হবে। মুক্তি মানে কী? ভয়ভীতি, দুশ্চিন্তা, মৃত্যুভয়, রোগভয়—এসব থেকে মুক্তির কথাই বলেছিলেন তিনি। সেখানে যদি অবিনাশী আত্মা থেকে থাকে, তাহলে সেই আত্মাকে এই দেহের আকারে এসে এসব জিনিসকে সহ্য করতে হয়। এসব মোটামুটি ভেবেছি।

প্রশ্ন :

সাদী: দর্শনের অধ্যাপক হবেন, এটা কখন ভেবেছিলেন? সমাজকে, সমাজের মানুষকে দেখার যে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, সেটা কীভাবে অর্জন করলেন?

হাসান আজিজুল হক: ছোটবেলা থেকেই ইংরেজি বই-পুস্তক পড়েছি। বহু অনুবাদ সাহিত্য তখনই পড়েছি। আমার মনে হয়, সেই সময় থেকেই দৃষ্টিভঙ্গিটা তৈরি হয়ে থাকবে। ইংরেজি সাহিত্যটা তখন ভালো লেগেছিল। তখনই ভেবেছিলাম ইংরেজিতে পড়ব। কিন্তু তখন খুলনার দৌলতপুর কলেজে ইংরেজি পড়ানোর মতো অধ্যাপক ছিলেন না। তবে তার আগে সক্রেটিসসহ বেশ কিছু দার্শনিকের জীবনী পড়েছিলাম। এ সময় দর্শনশাস্ত্রের একজন পণ্ডিত ছিলেন—অমূল্য দাশগুপ্ত (এডিএস)। একজন সাহিত্যিক ছিলেন। তাঁর নাম ছিল অমূল্যকুমার দাশগুপ্ত (এডিজি)। এই দুজনের মধ্যে অমূল্য দাশগুপ্ত খুব বড় পণ্ডিত ছিলেন। আমাদের মাথার ওপর দিয়ে চলে যেত তাঁর বক্তৃতা। তিনি আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ছাত্র ছিলেন। দর্শনের সেই স্যারকে বললাম, দর্শনে পড়তে চাই। কঠিন জিনিস পড়ার প্রতি একধরনের আগ্রহ ছিল। তাই দর্শনের কথাই বলেছিলাম। বাংলা-ইংরেজি পড়ব না। ম্যাথমেটিকসও নয়—ওটা পারা যাবে না—জ্যামিতি কিছু পারা যাবে, অ্যালজেবরাও কিছু হয়তো পারা যাবে। কিন্তু ম্যাথমেটিকস বলে যে জিনিসটা—তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে বানর দুই ফুট উঠল, এক ফুট নামল—এমন জিনিস আমার কখনো পছন্দ ছিল না।

প্রশ্ন :

সাদী: আপনার স্ত্রী মারা গেছেন সম্প্রতি। ব্যক্তিজীবনে এসেছে নিঃসঙ্গতা। ভবিষ্যতে এই িনঃসঙ্গতাকে িবষয় করে লেখালেখির কোনো পরিকল্পনা আছে?

হাসান আজিজুল হক: এটা নিয়ে এখনো কিছু ভাবিনি। দুঃখবিলাসটা তো আমি করি না। সে জন্যই হয়তো ভাবিনি। এটা ঠিক, যা আমি হারিয়েছি, তা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। কিন্তু সব দুঃখ তো লেখায় তুলে আনা যায় না। দরকারও নেই।

প্রশ্ন :

সাদী: লেখক হুমায়ূন আহমেদকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন? আর স্বীকৃতি হিসেবে প্রাপ্ত অন্যান্য পুরস্কারের পাশাপাশি হুমায়ূন আহমেদ পুরস্কারকে কীভাবে দেখছেন?

হাসান আজিজুল হক: হুমায়ূনের পাঠক আছে, তাঁর স্বীকৃতিও আছে। তার একটা প্রকাশ হয়তো তাঁর নামে প্রবর্তিত এই পুরস্কার। লেখক হিসেবে তাঁকে বড় মনে করি না, কিন্তু তিনি জনপ্রিয়। এমনকি জনপ্রিয়তার জায়গায় শরৎচন্দ্রের যে লেভেলটা, আমি সেভাবেই তাঁকে দেখি। এত মানুষ যেহেতু তাঁকে পড়ে, তাহলে স্বীকার করতেই হবে, তিনিও মানুষকে আকর্ষণ করেছেন। গল্প বলতে জানতেন বলেই তো আকর্ষণ করেছে। যে মানুষটার প্রতি আমার কোনো অশ্রদ্ধা নেই, লোকে কেন মনে করে, তাঁর নামে প্রবর্তিত পুরস্কার আমি নেব না? তাঁর নামের পুরস্কার গ্রহণ করায় কেন লোকে আমাকে ভুল বুঝবে? কবি আলাওল কবে মরে ভূত হয়ে গেছেন। তাঁর নামে প্রবর্তিত পুরস্কারও তো নিয়েছি। এখন তো রাজকবির মতো কাউকে সোনার মেডেল দেওয়া হয় না। দেওয়া ঠিকও না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ঘাড়ত্যাড়া লোক লিখেছেন, ‘আমরা পারিশ্রমিকের জন্য লিখি না, লিখিয়া পারিশ্রমিক আশা করি।’ তাই যা করেছি, এর চেয়ে বেশি কিছু তো করতে পারতাম না। আমি পুরস্কারকে মনে করি মানুষের একধরনের স্বীকৃতি। এটাকে আমি কখনো আমার নিয়ন্ত্রক বলে মনে করি না। আবার এটাও ঠিক, পুরস্কারকে কখনো তোয়াক্কাও করি না। পুরস্কারের অর্থমূল্যকেও বড় করে দেখি না। আমি তো নিতে চাইনি, তবু আমাকে একুশে পদক দেওয়া হয়েছে। আমি গ্রহণ করেছি। কাজেই মানুষ যাঁকে গ্রহণ করেছে, তাঁর প্রতি মানুষের সম্মান না করার কোনো কারণ নেই। আর মানুষের এই সম্মানটাকে আমি শ্রদ্ধার বলে গণ্য করি। সেটাকে অবজ্ঞা করার মধ্যে আমি নেই। তবু যখন বুঝি কোনো পুরস্কার গ্রহণ করা যাবে না, তা আমি গ্রহণ করিনি। আমার মূল আদর্শবিরোধী কারও কাছ থেকে কিছু এলে আমি অবশ্যই না করে দেব। মূল আদর্শ বলতে, আমার সমাজ, রাষ্ট্র, আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তার ঠিক বিপরীতে যে লোকটা দাঁড়িয়ে রয়েছে, তার কাছ থেকে আমি কোনো দিনই কোনো কিছু নেব না।

প্রশ্ন :

সাদী: বর্তমান সমাজ-দেশ-রাষ্ট্র নিয়ে সংক্ষেপে যদি কিছু বলেন...।

হাসান আজিজুল হক: এসব নিয়ে একবাক্যে কিছু বলার নেই। বরং বলি, ‘যে আমারে দেখিবারে পায়/ অসীম ক্ষমায়/ ভালো মন্দ মিলায়ে সকলি’—আমাদের দেশ-সমাজও তা-ই। সমাজকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে নিতে হবে। একটা আন্দোলনে হয়তো এক ইঞ্চি হবে। আরেকটা আন্দোলনে আরেকটু এগোবে। এভাবে এগোতে হবে।