গোলাম মুরশিদের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার

‘নজরুলই বাংলায় গজল প্রবর্তন ও জনপ্রিয় করেছেন’

লেখক ও গবেষক গোলাম মুরশিদের ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে জানাশোনার পরিসর বিস্তৃত। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ হলো কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে লেখা ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত’, মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিয়ে লেখা ‘আশার ছলনে ভুলি’, বাঙালি সংস্কৃতির ওপর লেখা ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’, নারীপ্রগতি নিয়ে ‘রাসসুন্দরী থেকে রোকেয়া’ এবং মুক্তিযুদ্ধ ও ইতিহাস নিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর একটি নির্দলীয় ইতিহাস’।

মৃত্যুর প্রায় বছর দুয়েক আগে এক সাক্ষাৎকারে গোলাম মুরশিদ নজরুলের তাৎপর্য; বিখ্যাত হওয়ার কারণ; নজরুল–রবীন্দ্রনাথ সম্পর্ক; নজরুলের একই সঙ্গে ইসলামি গান, কীর্তন ও শ্যামাসংগীত রচনাসহ আরও নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছিলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন লেখক–সাংবাদিক ধ্রুব সাদিক

প্রশ্ন:

আপনার দৃষ্টিতে বাংলা সাহিত্যে নজরুল ইসলামের কোন কোন অবদানকে বড় মনে হয়?

গোলাম মুরশিদ: এমন একটা সময় তিনি উচ্চকণ্ঠে অসাম্প্রদায়িকতার বাণী উচ্চারণ করেছেন, সম্প্রদায়গত ব্যাপারে যখন সবাই প্রায় নীরব ছিলেন। সাহিত্যের কথা বিবেচনায় আনলে তাঁর বড় একটি অবদান হলো, শব্দ ব্যবহার। আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহারের ফলে বাংলা ভাষার যে ভান্ডার, সেটা যে শুধু বৃদ্ধি পেল তা–ই নয়, নতুন প্রকাশ ক্ষমতাও বেড়েছিল। এটা নজরুলের একটা মস্ত বড় অবদান।

প্রশ্ন:

তাঁর গজলের ভাষায়ও একদম নতুন রকমের কিছু ব্যাপার ছিল…

গোলাম মুরশিদ: হ্যাঁ। সেদিক থেকে তিনি নতুনত্ব সৃষ্টি করেছিলেন। যদিও বলা হয়ে থাকে অতুলপ্রসাদ সেন নজরুলের পূর্বে দু–একটি গজল লিখেছেন; তবু আমি বলব নজরুলের একটি বড় অবদান হলো, তিনিই বাংলায় গজল প্রবর্তন করেছেন, জনপ্রিয় করেছেন। তিনি ব্যাপকসংখ্যক গজল লিখলেন, সুর দিলেন; মনমাতানো সব সুর। বাংলার গ্রামে-গঞ্জে-নগরে, বাতাসে-বাতাসে সেই গজলগুলো ছড়িয়ে পড়ল। নজরুল এত জনপ্রিয় হলেন যে তাঁর গান দিয়েই এ দেশে রেকর্ড ইন্ডাস্ট্রি চালু হয়েছিল। তবে নজরুল শুধু গ্রামোফোন কোম্পানি অব ইন্ডিয়ার জন্য গান লেখেননি, স্বদেশি কোম্পানির জন্যও গান লিখেছিলেন।

প্রশ্ন:

মোহিতলাল মজুমদারের মতো অনেকেই বাংলা সাহিত্যে নজরুলের আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহারের উচ্চশিত প্রশংসা করেছিলেন…

গোলাম মুরশিদ: মোহিতলাল মজুমদার নজরুলকে নিয়ে তাঁর একটি প্রবন্ধে বলেছিলেন, নজরুল যেভাবে আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করে বাংলা ভাষায় চমক সৃষ্টি করেছেন, এটা অন্য কেউ করেনি। নজরুল যে নতুনত্ব এনেছেন বাংলা সাহিত্যে, সেটা আমি অনেক দিন দেখিনি।

প্রশ্ন:

নজরুল ইসলামের একই সঙ্গে ইসলামি গান, কীর্তন ও শ্যামাসংগীত রচনার ঘটনাটিকে কীভাবে দেখেন?

গোলাম মুরশিদ: নজরুল মুসলমান হওয়ায় ইসলামি গান লিখতেই পারেন; কিন্তু তাঁর আগে কেউ ইসলামি গান লেখেননি। তাঁর গানের মধ্যে আমরা একই সঙ্গে দেখি তিনি ইসলামি গান লিখেছেন এবং কীর্তন ও শ্যামাসংগীতও লিখেছেন। সেই শতকে তিনি হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ শ্যামাসংগীত রচয়িতা। তিনি শ্যামাসংগীত লিখলেন আবার বৈষ্ণবদের হয়ে রাধাকৃষ্ণের গানও লিখলেন। এই তিনটি ক্ষেত্র বিবেচনায় নিলে আমরা একটি জায়গায় মিল পাই, সেটা হলো: তিনি ভক্তিবাদী ছিলেন। কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন নজরুল একসঙ্গে ইসলামি গান, শ্যামাসংগীত আর কীর্তন লিখলেন—এখানে হয়তো স্ববিরোধিতা আছে। কিন্তু স্ববিরোধিতা নেই। একসূত্রে এটাকে গাঁথা যায়, সেই সূত্রটা হচ্ছে: নজরুলের ভক্তিবাদ। নজরুল যখন ইসলামি কবিতা লিখেছেন, তখন কিন্তু ইসলামি কবিতা লিখতে গিয়ে আল্লাহকে নিয়ে লিখলেন না, লিখলেন মোহাম্মদকে নিয়ে। যেমন কৃষ্ণকে নিয়ে লিখেছেন, কালীকে নিয়েও লিখেছেন। এটাও তাঁর একটা বড় অবদান।

প্রশ্ন:

নজরুল ইসলাম তো গল্প, উপন্যাস এমনকি প্রবন্ধও লিখলেন?

গোলাম মুরশিদ: প্রবন্ধে তিনি খুব বেশি অবদান রাখতে পেরেছেন বলে আমার মনে হয় না। গল্পের কথা যদি বলি, গল্পে তিনি সামান্য অবদান রেখেছেন। গল্পের মধ্যে মুসলমান চরিত্র নিয়ে এলেন; এটুকু নতুন। এ ছাড়া তাঁর গল্পের মধ্যে যে অভিনব কিছু প্রকাশ পেয়েছে বা তাঁর শৈলীর মধ্যে নতুন কিছু নিয়ে প্রকাশ পেয়েছে, এটা আমার মনে হয় না।

প্রশ্ন:

আর উপন্যাস?

গোলাম মুরশিদ: মনে রাখতে হবে, তাঁর উপন্যাস লেখার সময়কালে বাংলা সাহিত্যের অনেক নামকরা সাহিত্যিক উপন্যাস লিখেছেন। তিনি যখন ‘মৃত্যুক্ষুধা’ লিখেছেন, তত দিনে রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলো উপন্যাস বেরিয়ে গেছে। প্রেমেন্দ্র মিত্র উপন্যাস লিখেছেন, শৈলজানন্দ উপন্যাস লিখেছেন, এ রকম অনেকেই তখন উপন্যাস লিখছেন।

প্রশ্ন:

অসুস্থ হওয়ার পর অসুস্থ কবিকে নিয়ে সে সময় তেমন কোনো আলোচনা হয়নি, এই ব্যাপারটি কীভাবে দেখেন আপনি?

গোলাম মুরশিদ: এটা একটা মস্ত বড় প্রশ্ন। প্রথমত, এরপরে তাঁর গান বা কবিতার মধ্যে নতুন কিছু ছিল না। দুই নম্বর কারণটি হলো, একসময় যারা যে নজরুলকে ব্যবহার করেছিল, সেই লোকগুলোই নজরুল অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পর তাঁর কোনো খবর নিল না। নজরুল আসলে শেষ হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর আর দেওয়ার কিছু ছিল না। তিনি যখন অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন, তখন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও তাঁকে দেখতে যায়নি। এর কারণ, তাঁর সম্পর্কে একটা রটনা রটেছিল যে তাঁর সিফিলিস হয়েছে; কিন্তু সেটা ঠিক না। তাঁর অসুস্থতার ব্যাপারটি আমি আমার বইয়ের একটা চ্যাপ্টারে উল্লেখ করেছি। এ ছাড়া লন্ডনের ডাক্তাররা, ভিয়েনার ডাক্তাররা যখন শুনেছিলেন রোগী একজন কবি, তখন তাঁরা চিকিৎসার জন্য টাকা নেননি।

প্রশ্ন:

নজরুল–রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বলবেন?

গোলাম মুরশিদ: রবীন্দ্রনাথ স্নেহ করতেন নজরুলকে। নজরুলের মধ্যে তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর দেখেছিলেন। স্বাক্ষর যেমন দেখেছিলেন, সেই সঙ্গে পতনও দেখেছিলেন। দেখে বলেছিলেন, তুমি তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁছছ। অর্থাৎ তোমার প্রতিভা দিয়ে তুমি যে সৃষ্টি করতে পারতে, সাহিত্যের যে জায়গায় পৌঁছাতে পারতে, সেখানে পৌঁছাতে পারলে না। তুমি তার বদলে তোমার দাড়ি চাঁছছ তলোয়ার দিয়ে। তলোয়ার জিনিসটা দাড়ি চাঁছার জিনিস নয়। নজরুল ইসলামের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিরোধও হয়েছে, আবার রবীন্দ্রনাথের প্রতি নজরুলের যে ভক্তি, সে ব্যাপারে তিনি বহুবার কবিতায় লিখেছেন। এবং রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরও তিনি দুটো কবিতা লিখেছেন।

প্রশ্ন:

নজরুলের তাৎপর্যটা ঠিক কোথায় বলে আপনি মনে করেন, যে কারণে ভবিষ্যতের পাঠকেরা তাঁকে এড়িয়ে যেতে পারবে না?

গোলাম মুরশিদ: নজরুলের যে প্রাসঙ্গিকতা, আমার ধারণা, নজরুল যে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেছেন, সেটা আগামীর পাঠক এড়াতে পারবেন না। এর তাৎপর্যতা তথা প্রাসঙ্গিকতা এখনো রয়ে গেছে। যার কারণে, এখনো আমরা দেখি, বাংলার ঘরে যে সাম্প্রদায়িকতা একদিন মরে গিয়েছিল, পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী রাজনীতির সময়, এখন সেই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি তথা হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কাজেই নজরুলের মতো লোকের বাণী কাজে দিতে পারে। নজরুল হিন্দু-মুসলমান মিলিত একটা মানবতার বাণী উচ্চারণ করেছেন। তিনি অসাম্প্রদায়িক কথা শুধু বলেননি, অসাম্প্রদায়িকতার অসংখ্য দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছেন।