এফডিসির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক নাজির আহমদের একটি সাক্ষাৎকার

এ দেশে চলচ্চিত্রশিল্পের বিকাশে পিতৃপুরুষতুল্য নাজির আহমদের জন্ম ১৯২৫ সালে ঢাকার ইসলামপুরের এক সংস্কৃতিমনস্ক পরিবারে। তাঁর দাদা মির্জা হায়াৎ ঢাকার নবাববাড়িতে প্রদর্শিত নাটকে অভিনয় করতেন। বাবা মির্জা ফকিরও ছিলেন একজন গুণী অভিনেতা। চাচা মির্জা আব্দুল কাদের সরদার ঢাকার শেষ বাইশ পঞ্চায়েতের নেতা, যিনি নাটক, গান ও চলচ্চিত্রের জন্য ছিলেন এক নিবেদিত প্রাণ। মির্জা কাদের ইসলামপুরে ডায়মন্ড থিয়েটার ক্রয় করে প্রথমে লায়ন থিয়েটার নামে চলচ্চিত্র প্রদর্শন ব্যবসা শুরু করেন, পরবর্তী সময়ে নাম পরিবর্তন করে রাখেন লায়ন সিনেমা। নাজির আহমদের কনিষ্ঠ দুই ভাই—শহীদ মিনারের রূপকার শিল্পী হামিদুর রাহমান ও বরেণ্য নাট্যকার সাঈদ আহমদ। বাংলাদেশে শিল্প-সাংস্কৃতির বিকাশে এই পরিবারের অবদান অনস্বীকার্য।

বর্তমান প্রজন্মের কাছে নাজির আহমদ অতটা পরিচিত না হলেও পাকিস্তান আমলে তিনি ছিলেন তুমুল আলোচিত এক নাম। তাঁর রচিত ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ গানটি ১৯৪৭ সালে সদ্য স্বাধীন হওয়া পাকিস্তানের পূর্বাংশে (বর্তমান বাংলাদেশ) অঘোষিত জাতীয় সংগীত হিসেবে স্থান করে নেয়। স্কুল শিক্ষার্থীরা ঘণ্টা পড়ার আগে মাঠে দাঁড়িয়ে দলবেঁধে গাইত সেই গান—‘...খাইবার দ্বারে তার পতাকাবাহী,/মেঘনাকূলে যত বীরসিপাহী,/প্রাচ্য প্রতীচ্যে মিলন গাহি/দুনিয়া করে যে আবাদ!’

নাজির আহমদ একাধারে কবি, গীতিকার, কাহিনিকার, নাট্যকার, অভিনেতা, বেতার অনুষ্ঠান ঘোষক, চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রেমিক।

১৯৪৮ সালে তিনি নির্মাণ করেন এ দেশের প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য প্রামাণ্যচিত্র ‘সালামত’। এর আগে ১৯৪২ সালে ‘অলইন্ডিয়া রেডিও’র একজন ঘোষক হিসেবে তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলে তিনি ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট অলইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্র থেকে ঢাকা রেডিওতে চলে আসেন। নাজির আহমদের কণ্ঠেই প্রথম ঘোষিত হয়, ‘পাকিস্তান ব্রডকাস্টিং সার্ভিস’। ওই সময়কালে তিনি ঢাকা রেডিওর জন্য অসংখ্য গান, গীতিনকশা ও প্রায় অর্ধশত নাটক রচনা করেছেন। সেই সময়ের বেতার নাটক ‘চেঙ্গিস খা’ ও ‘চাঁদনী’তে তাঁর অভিনয় ও প্রযোজনা বহুল প্রশংসনীয় হয়েছিল। প্রযুক্তি ও শিল্পের এক আশ্চর্য মিশেলে বাংলাদেশে বেতারের প্রসারতায় তিনি অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেন। তিনিই সর্বপ্রথম কাজী নজরুল ইসলামের গানকে ‘নজরুলগীতি’ নামে শ্রোতাদের কাছে পরিচিত করে তোলেন। তাঁর আরেকটি যুগান্তকারী কাজ হলো নোহ্ নাটকের সঙ্গে বাঙালিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।

নাজির আহমদ ১৯৪৯ সালে বিবিসিতে যোগ দিয়ে লন্ডন থেকে প্রথম বাংলা অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে নাজির আহমদ দেশে ফিরে ‘ফিল্ম ডিভিশন’ গড়ে তোলেন, সেই ফিল্ম ডিভিশনের প্রধান হিসেবে তিনি পরবর্তী সময়ে এফডিসি গঠনের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। ওই সময় তিনি বেশ কিছু ডকুমেন্টারি ও ফিচার শর্টফিল্মও তৈরি করেছিলেন। ১৯৬২ সালে ব্যক্তিগত কারণে লন্ডন চলে গেলেও ’৬৮-তে মুক্তি পায় তাঁর পরিচালিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘নতুন দিগন্ত’। সরকারি অনুদানে নির্মিত ওই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুলতানা জামান, রহমান, শবনম, সুভাষ দত্ত, কাজী খালেক, রানী সরকার, গোলাম মুস্তাফা প্রমুখ। সোহেল হাশমী চিত্রায়িত, আব্দুর রহীম আদর সম্পাদিত, আব্দুল আহাদ সুরারোপিত ওই চলচ্চিত্রের কাহিনিকার মুনির চৌধুরী ও চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। এফডিসিতে নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আসিয়া’র কাহিনি ও সংলাপ লিখেছেন নাজির আহমদ। প্রামাণ্যচিত্র ‘নবারুণ’সহ অনেক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তিনি প্রযোজনা করেছেন।

নাজির আহমদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না, তবে সৈয়দ শামসুল হক তাঁর জীবনীগ্রন্থ ‘তিন পয়সার জ্যোছনা’য় পাঠকের কাছে এক অন্য নাজির আহমদকে হাজির করেন। সেই নাজির আহমদ এক প্রেমিক পুরুষ। যে প্রেম ছিল তাঁর ভাস্কর নভেরা আহমদের প্রতি। সেই নভেরা আহমদই পরে নাজির আহমদের ছোট ভাই হামিদুর রাহমানের সঙ্গে ছিলেন সহযাপনে। সৈয়দ হক স্মৃতিচারণা করেন, ‘...লন্ডনে বিবিসিতে আমি কাজ করছি, নাজির ভাই প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় আসেন আমাদের আপিস বুশ হাউসে, আমাদের নিয়ে তিনি পানশালায় মেতে ওঠেন গল্পে, সেদিন আমরাই দুজন বসেছি, বাংলা বিভাগের অন্যরা এসে পড়েননি তখনো, নাজির ভাই কী কথার টানে হঠাৎ বলে উঠলেন—জানো, আমি সেই আটচল্লিশে আসি লন্ডনে, তখন আমি ব্যাচেলর, একাই আমার সংসার, হামিদকে নিয়ে আসি, ভর্তি করে দিই লন্ডনের এক আর্ট স্কুলে, নভেরাও তখন বেজওয়াটারের কাছে আমার স্টিফেন গার্ডেনের বাড়িতে আসছেন, মাঝে মাঝে থাকছেন, ও এলেই আমার খুব ভালো লাগত। এইখানে নাজির ভাইয়ের চোখেমুখে যে দীপ্তি হঠাৎ কোমল বিধুর হয়ে ফুটে ওঠে, আমি বুঝে যাই ওই আসা-যাওয়া আর ভালো লাগার গল্পটার গভীরে নাজির ভাইয়ের ছিল আরও কিছু। নাজির ভাই বলে চলেন—তারপর একদিন হামিদের একটা বইয়ের ভেতরে পাই একটা চিঠি, নভেরা লিখেছে হামিদকে! আমি চমকে উঠি! আমি ভাবতেই পারিনি, নভেরা এমন একটা চিঠি লিখেছে, এমন একটা কিছু ওদের ভেতরে চলছে, আমারই তো ছোট ভাই হামিদ, নীরবে আমি চিঠিটা রেখে দিই বইয়ের ভেতরে। দীর্ঘ একটা নিশ্বাস পড়ে নাজির ভাইয়ের।’

মৃত্যুর কয়েক বছর আগে প্রবাসী সাংবাদিক আনা ইসলামকেও নভেরা আহমদ বলেছেন যে নাজির আহমদ তাঁকে ভালোবাসতেন। তাঁর সঙ্গেই ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটসে নভেরা ভর্তি হতে গিয়েছিলেন।

নাজির আহমদ ১৯৯০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর বছর তিনেক আগে তিনি ঢাকায় দৈনিক সংবাদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তার সেই নাতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকারটির প্রকাশকাল ১৯৮৭ সালের ৪ জানুয়ারি। এখানে সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো:

গ্রাফিকস: প্রথম আলো

সংবাদ: কর্মজীবনের শুরুতে অন্য পেশায় না গিয়ে চলচ্চিত্রশিল্পে এসেছিলেন কেন?

নাজির আহমদ: আমার পিতা মির্জা ফকির মোহাম্মদ ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের অনেক আগে থেকেই চলচ্চিত্র পরিবেশন এবং প্রদর্শন ব্যবসা করে আসছিলেন। দেশের অনেক জেলা শহরে আমাদের সিনেমা হল ছিল। ঢাকার সব সাংস্কৃতিক কর্মীর সাথে বাবার ওঠা-বসা ছিল। এছাড়া ছোটকালে পিতার সাথে আমি কলকাতা এবং বোম্বের অনেক চলচ্চিত্র নির্মাণ কেন্দ্র ঘুরে দেখেছি। সে হিসেবে বলা চলে একটি সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেই আমি বড় হয়েছি। ছোট বয়সেই পাড়ায়, স্কুলে, কলেজে নাটক, আবৃত্তি ইত্যাদি করেছি। কাজেই রক্তের মধ্যেই সংস্কৃতির ধারা বহমান ছিল মনে হয়। সে পথ ধরেই পরে চলচ্চিত্র নির্মাণকর্মী হবার প্রেরণা পেয়েছিলাম।

সংবাদ: এ দেশে ফিল্ম ডিভিশন এবং পরে এফডিসি নির্মাণে আপনার সক্রিয় অবদান ছিল বলে আমরা জানি। এ সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?

নাজির আহমদ: আমি বিবিসিতে থাকাকালে দেশের বিভিন্ন ডকুমেন্টারি ফিল্ম লন্ডনে বসে তৈরি করতাম। একবার পাকিস্তানের চিফ মিনিস্টার নুরুল আমিন লন্ডনে এসে আমার প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ পদ্ধতি দেখে মুগ্ধ হয়ে আমাকে দেশে এসে ফিল্ম ডিভিশন গড়ে তোলার অনুরোধ জানান। তাঁর পরামর্শমতো ’৫৩ সালে একটি ক্যামেরা সাথে নিয়ে দেশে এসে ফিল্ম ডিভিশন গড়ে তোলার প্রচেষ্টা নিই। পরে এখানে টেন্ডার দিয়ে একটি ক্যামেরা কেনা হয়। ’৫৪ সালের নির্বাচনের জন্য ফিল্ম প্রসেস করার সুযোগ-সুবিধা গড়ে তোলার বাজেট পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু নুরুল আমিন নির্বাচনে হেরে গেলে সে পরিকল্পনা প্রায় বাতিল হওয়ার উপক্রম হয়। পরে যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান এ ব্যাপারে সক্রিয় অবদান রাখেন। আমি অপারেটিভ ডাইরেক্টর হিসেবে অনারারি দায়িত্ব নিই এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হয়।

নাজির আহমদ, ১৯৪৯, লন্ডন
ছবি: লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ

সংবাদ: এ দেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরুর পর আমরা জানি বেশ কিছু সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব এ কাজে এগিয়ে এসেছিলেন। আপনি ছিলেন তাঁদের মধ্যমণি। সে সময় চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং এফডিসিকে ব্যবহারের ব্যাপারে আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিল?

নাজির আহমদ: উচ্চ রুচিজ্ঞান এবং সুস্থ মানসিকতার ছবি নির্মাণ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল। এ জন্য সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিদের একটা দলকে আমরা একত্র করতে পেরেছিলাম। এফডিসিতে একটি নির্দিষ্টসংখ্যক কমার্শিয়াল ছবি তৈরি করতে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল এবং সেসব ছবি ব্যক্তিমালিকানায় নয়, এফডিসির মাধ্যমে তৈরি হবে। এসব ছবির লাভ দিয়ে একটা ফান্ড গঠন করে তা থেকে ভালো ছবি নির্মাণের পুঁজি সরবরাহ করার চিন্তা আমাদের ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সে ধারা বজায় রাখা যায়নি। আমাদের চোখের সামনে অবস্থা ধীরে ধীরে পাল্টে গেল।

সংবাদ: স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি বলে কী বোঝানো হয়?

নাজির আহমদ: শর্টফিল্মকে একটা নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। তবে স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিকে ছোটগল্প এবং পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবিকে উপন্যাসের সঙ্গে তুলনা করা যায়। শর্টফিল্ম তৈরির চিন্তা বেশি পুরোনো নয়। ইউরোপে আগে পিপসো, ফ্লিক্সশো নামে একধরনের ছবি দেখার প্রচলন ছিল। ১ মিনিট ছিল পিপ বা ফ্লিক্সশো’র সময়। পরে সিনেমা হলে কয়েকটি ছবি অনবরত প্রদর্শনের পদ্ধতি চালু হয়। যখন ইচ্ছা ছবি উপভোগ করা যেত। পঞ্চাশের দশকের শুরু পর্যন্ত এ ব্যবস্থা ইউরোপ-আমেরিকায় প্রচলিত ছিল। এর পরে শর্টফিল্ম নির্মাণের চিন্তা শুরু হয়। সাধারণভাবে ৬০ মিনিট পর্যন্ত প্রদর্শনক্ষণ ছবিকে শর্টফিল্ম বলা হয়। তার ঊর্ধ্বে হলে সেটা পূর্ণদৈর্ঘ্য ফিচার ফিল্ম হবে।

নাজির আহমদের কনিষ্ঠ দুই ভাই, উপর থেকে সর্ব বাঁয়ে নাট্যকার সাঈদ আহমদ ও সর্ব ডানে শিল্পী হামিদুর রাহমান
ছবি: লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ

সংবাদ: আমাদের জানা মতে ‘সালামত’ এ দেশে নির্মিত প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি। এর নির্মাণ সময়ের কিছু কথা আমাদের বলুন।

নাজির আহমদ: কাহিনিচিত্র হিসেবে চিন্তা করলে ‘সালামত’ই প্রথম শর্টফিল্ম; কিন্তু এর আগে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সফরের ওপর ভিত্তি করে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি আমরা তৈরি করেছিলাম কলকাতা থেকে ফটোগ্রাফার এনে। তবে সেটা ছিল সম্পূর্ণতই ডকুমেন্টারি শর্টফিল্ম।

সালামত নামের এক ব্যক্তি আমাদের পরিবারের রাজমিস্ত্রি ছিলেন, ওরা কয়েক পুরুষ ধরে আমাদের পরিবারের রাজমিস্ত্রির কাজ করছিল। সালামত ঢাকা মহানগরীর অনেক বাড়িঘর নিজ হাতে নির্মাণ করেছে। তার চোখের সামনেই ঢাকা শহর ক্রমশ গড়ে উঠেছে। কিন্তু ওর নিজের কোনো বাড়িঘর নেই। এ ব্যাপারটি আমার মনে বেশ আলোড়ন তোলে। সে সময়ে আমরা কয়েকজন মিলে প্রায় প্রতিদিন আড্ডা মারতাম এখনকার রমনা গার্ডেনে। তখন রমনা তৈরি হয়নি। ঢাকা ক্লাবের পাশ দিয়ে বেইলি রোডের দিকে একটি নির্জন রাস্তা ছিল। সেখানে বসেই আমাদের আড্ডা চলত। সে আড্ডায় ছিলেন সৈয়দ নুরুদ্দিন, জয়নুল আবেদিন, মুনসুরউদ্দিন, সালাউদ্দিন প্রমুখ। সৈয়দ নুরুদ্দিন ভালো কবিতা লিখত। নিয়ম ছিল, ও প্রতিদিন একটি কবিতা লিখবে আর জয়নুল একটি ছবি আঁকবে। আড্ডায় সে কবিতা পড়ে শোনাত। আর ছবি দেখা হতো। এ নিয়ে আলোচনা হতো আড্ডায়। যাহোক, সে আড্ডায়ই একদিন সালামতকে নিয়ে আলোচনা হলো। শেষে সৈয়দ নুরুদ্দিন সালামতের কাহিনি লিখে ফেলল। আমি চিত্রনাট্য করলাম। পরে লাহোর থেকে ফটোগ্রাফার ইকবাল মির্জাকে এখানে এনে ছবি করা হলো এবং লাহোরে প্রসেস করা হলো। সালামতের প্রদর্শন সময় ছিল ৩০ মিনিট।

সূত্র : ১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯০, সংবাদ

সংবাদ: শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবির ভূমিকা কতটুকু বলে আপনি মনে করেন?

নাজির আহমদ: চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে শিল্প সৃষ্টির জন্য পূর্ণদৈর্ঘ্যের চেয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য বেশি কার্যকর। স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিতে একজন নির্মাতা তার সৃজনশীলতাকে, মেধাকে এবং শিল্প সৃষ্টির প্রয়াসকে পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারেন। এতে নিজের চিন্তা-চেতনা দিয়ে সবকিছু কন্ট্রোল করা যায়। কিন্তু পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবিতে তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। একটা টিম ওয়ার্কের ফল হচ্ছে পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি। এককভাবে কোনো ক্রিয়েশন নয় তা। স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিতে নিজের প্রতিভার সর্বোত্তম ব্যবহার সম্ভব। এ হিসেবে শিল্প সৃষ্টির জন্য স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি অনেক সাফল্য এনে দিতে পারে।

সংবাদ: আপনি ঢাকায় এসে কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি দেখেছেন। দেশে সাম্প্রতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?

নাজির আহমদ: এখানে কয়েকটি শর্টফিল্ম দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে। নির্মাতাদের সম্পর্কে বেশ উচ্চ ধারণা হয়েছে আমার। এমনিতেই দেশে চলচ্চিত্র কলাকৌশল শিক্ষার কোনো সুযোগ নেই। তারপরও কিছু তরুণ যে এ মাধ্যমে কাজ করছেন, তা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। এখানকার শর্টফিল্মগুলো ‘আইডিয়া’ প্রধান। চলচ্চিত্রে ‘আইডিয়াই’ প্রথম বিবেচ্য, ‘আইডিয়া’র চেয়ে পাওয়ারফুল কিছু নেই চলচ্চিত্রে। ‘আইডিয়া’ পরিচ্ছন্ন থাকলে চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব। তবে শর্টফিল্মগুলো ‘ট্যাকটিক্যালি’ একটু দুর্বল, অবশ্য এটা কাটিয়ে ওঠা খুব কঠিন ব্যাপার নয়।

সংবাদ: স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি নির্মাণে নিয়োজিত কর্মীদের এই মুহূর্তে করণীয় কী বলে আপনি মনে করেন?

নাজির আহমদ: যেসব মেধাসম্পন্ন তরুণ শর্টফিল্ম নির্মাণে এগিয়ে এসেছেন তাঁদের প্রথমে একতাবদ্ধ হতে হবে। বিচ্ছিন্নভাবে কিছু করা সম্ভব নয়। ভালো অর্গানাইজেশন দরকার সৃজনশীল কিছু করার জন্য। অর্গানাইজেশনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সুযোগ–সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবে নতুন ছেলেদের প্রশিক্ষণও হবে। কারিগরি জ্ঞান বাড়বে। সরকারিভাবে অ্যাওয়ার্ড দিলে উৎসাহ বা সৃজনশীলতা বাড়ে বলে আমার মনে হয় না। ও না করে ছবি নির্মাণের জন্য অর্থ জোগান দেওয়া দরকার।