‘আমি একটু স্বাতন্ত্র্যপ্রিয় মানুষ’

২৮ ডিসেম্বর মারা গেছেন কবি ও কথাশিল্পী আবুবকর সিদ্দিক। জীবনের শেষ দিকে খুলনায় অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিলেন ষাট দশকের এই শক্তিমান লেখক। কবিতার পাশাপাশি তিনি লিখেছেন দারুণ কিছু গল্প ও উপন্যাস এবং কালজয়ী গণসংগীতও। ২০১৫ সালে দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় খুলনায় আবুবকর সিদ্দিকের বাসায়। এখানে ছাপা হলো নির্বাচিত অংশ, যেখানে তিনি বলেছেন তাঁর লেখকজীবনসহ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া বিষয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন শামীমা আক্তার

আবুবকর সিদ্দিক

শামীমা আক্তার: ১৯৬৯ সালে আপনার প্রথম কাব্য ‘ধবল দুধের স্বরগ্রাম’ প্রকাশিত হয়। এটা প্রকাশিত হওয়ার ব্যাপারে কিছু বলেন।

আবুবকর সিদ্দিক: একদিন বিকেলবেলায় তখন আমি বাগেরহাট পিসি কলেজে প্রফেসরি করি। আর বই তো বেরিয়েছে উনসত্তরে, কিন্তু আমি কবি হিসেবে মোটামুটি পরিচিত হয়ে গেছি তার আগেই। তা একদিন বিকেলবেলায় ঢাকার নিউমার্কেটে জ্যোতির সঙ্গে আমার দেখা। জ্যোতি মানে জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত আমাদের বন্ধু, গল্প লেখক। জ্যোতি বলছে, ‘সিদ্দিক সাহেব, আপনি কবিতার বই বের করবেন? আপনি তো অনেক দিন লিখছেন।’ আমি বললাম, ‘জ্যোতি আর কবিতার বই কী করে বের করব?’ বলল, ‘আমি তাহলে হায়াতকে বলি, আমরা ব্যক্তিগতভাবে একটা প্রকাশনী (সাহিত্যশিল্প) করেছি। আমি হায়াতকে বলব, আপনি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন।’ এই জ্যোতি আর হায়াতের অনুপ্রেরণায়...কবিতার বই ওরাই বের করল। সাহিত্যশিল্প থেকে, হাশেম খানের প্রচ্ছদ। আর এর আগে ঢাকায় থাকতে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের দুর্লভ দিন, তাঁর প্রথম কবিতার বইটা ‘সমকাল’ প্রকাশনী থেকে জাফর ভাই (সিকান্‌দার আবু জাফর) বের করেছিল। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আবুবকর, মনিরুজ্জামানের বইটা বেরিয়ে যাক, এরপর তোমার কবিতার বই বের করব। তুমি পাণ্ডুলিপি রেডি করো। দেখো চিন্তা করে, এটা এখনকার কবিরা বিশ্বাস করবে না।’ আমি এই শুনে লজ্জায় আর ভয়ে সরে গেলাম। আমি আর জাফর ভাইয়ের সঙ্গে দেখাও করিনি। কেন? আমি মনে মনে ভাবছি, সে কী! আমার কবিতার বই বেরোবে। না, এটা তো বেয়াদবি হবে। এত অল্প লিখে এত তাড়াতাড়ি কবিতার বই। আর এখন কবিরা নিজের পকেটের পয়সা দিয়ে বই বের করে। তারপর হায়াত, জ্যোতি বের করল আমার কবিতার বই।

আমি প্রচলিত গতানুগতিক ভাষা সহ্য করতে পারি না। কবিতা মৌলিক হওয়া দরকার। চেষ্টা করি করতে।

শামীমা: আপনি যে বললেন, সমকাল পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে আপনি আর দেখা করেননি।এই সমকাল পত্রিকায় লেখালেখির সঙ্গে আপনি কত দিন জড়িত?

আবুবকর: প্রায় এর জন্ম থেকেই। ১৯৫৭ সালেই সমকাল-এ আমার কবিতা ছাপা হয়। হাসান হাফিজুর রহমান ছেপে দিয়েছিলেন। একসঙ্গে দুটো কবিতা। এর পর থেকে নিয়মিত লিখতাম। জাফর ভাইয়ের চিঠি এখনো আছে...

শামীমা: বাংলা সাহিত্যের অনেক বড় বড় কবি, সাহিত্যিক, বাংলা সাহিত্য না শুধু, বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে আপনার যথেষ্ট জ্ঞান আছে। কোন কবি বা লেখক আপনাকে প্রভাবিত করেছেন?

আবুবকর: প্রথম কাব্যজীবনে জীবনানন্দ দাশের দ্বারা অসম্ভব প্রভাবিত ছিলাম। কারণ, স্বভাবতই রোমান্টিক আর বেড়ে উঠেছি বাগেরহাট নামক রোমান্টিক জায়গায়, যেখানে গাছপালা ঘনিষ্ঠ। স্বপ্নের ভরেই আমি কলেজে পড়া অবস্থায় টি এস এলিয়ট, এজরা পাউন্ডের ভক্ত হয়ে গেলাম। কারণ, কবিতা বিচ্ছিন্ন হবে না। কাব্য আন্দোলন ও দৃষ্টিভঙ্গি, নাগরিকতা—এগুলো আমাকে খুব আলোড়িত করে। ফলে পরবর্তীকালে আমার শুধু কবিতায় নয়, আমার চিন্তাভাবনায় এলিয়ট, পাউন্ড—তাঁদের উপাদান এসে গেছে। সত্যি বলতে, ষাটের দশকের গোড়ার দিকে আমি বাম রাজনীতি দিয়ে খুব প্রভাবিত হই। এটা আকস্মিক না, নিজের দেশের রাজনৈতিক দুরবস্থা, ঔপনিবেশিক পরাধীনতা—পাকিস্তান আমলে এসবে খুব উত্তেজিত ছিলাম।

শামীমা: বামপন্থী রাজনীতি তো সর্বহারাদের জন্য কাজ করতে চায়, মানে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা—এই ধরনের...

আববকর: হ্যাঁ, শ্রেণিবিপ্লব এই সব। পরে অবশ্য আমি আরও বেশি করে ষাটের দশকের নকশালাইজড আন্দোলন, তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়।

শামীমা: কিন্তু আমার তো মনে হয়, আপনি রুচির দিক থেকে একটু অন্য রকম, কিছুটা অভিজাত ধরনের।

আবুবকর: আমি অভিজাত-টভিজাত বুঝি না। আমি একটু স্বাতন্ত্র্যপ্রিয় মানুষ, এই।

শামীমা: কিন্তু আমি এটাই বলতে চাচ্ছি যে দুটোর মধ্যে আপনি সমন্বয় কীভাবে করলেন, এই রুচির সঙ্গে ওই রুচির?

আববকর: আমি নিজেই জানি না, এই প্রশ্নের কী উত্তর হবে। সমন্বয় করতে পেরেছি কি না, জানি না। কারণ এ দুটো বড় স্ববিরোধী।

শামীমা: যেমনটা স্ববিরোধী আপনার কবিতা
আর গল্প।

আববকর: দারুণ ইন্টেলিজেন্ট প্রশ্ন, খুব মৌলিক প্রশ্ন ধরেছ।

শামীমা: আপনার গল্পে যে শ্রেণির মানুষকে পাই, কবিতা কিন্তু সে রকম না।

আববকর: থ্যাংক ইউ। খুব ধরেছ। আমার কবিতা সত্যিকার অর্থে ঠিক নির্ধারিত একটি লক্ষ্য বা কেন্দ্র—এভাবে এগোয়নি। প্রথম দিকে দেশ, ভাষা, প্রেম, তারপরে প্রচণ্ডভাবে রাজনীতির প্রভাব এবং রাজনৈতিক সেই উত্তেজনা থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসা—সব মিলিয়ে আমার কবিতায় আমি তো নতুনত্বের অভিলাষী। কিন্তু প্রেম, চিরন্তন যে উপাদান আমার কবিতায় আছে, তা কিন্তু নতুনভাবে, নতুন আঙ্গিকে। আমি প্রচলিত গতানুগতিক ভাষা সহ্য করতে পারি না। কবিতা মৌলিক হওয়া দরকার। চেষ্টা করি করতে। আমার এই বুড়ো বয়সে রাভী নামে একটা কবিতার বই লিখে ফেলি। এগুলো আসলে ভেতর থেকে কাজ করে মাথায়। তারপর জীবনের এই সব চারদিকের ক্ষুদ্রতা, জটিলতা, বাঁচার যে কষ্ট, গ্লানি এবং আরও পরে যে রাজনৈতিক ভণ্ডামি, প্রবঞ্চনা, প্রতারণা, মানুষের যে হতাশা—এগুলো খুব প্রভাব ফেলে। কবিতায় কাজ করে। লেখালেখি অনেক কমে গেছে নানা কারণে। তবে আমার জলরাক্ষস, খরাদাহ—এসব উপন্যাসে জনতার যে সংগ্রামী চেতনা, সেটা এসেছে প্রধানভাবে। আর মুক্তিযুদ্ধের ওপরে আমার একাত্তরের হৃদয়ভস্ম। একাত্তরের স্বাধীনতার পরে মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে, সেই মনের কষ্টে, দুঃখ থেকে লেখা এ উপন্যাস।

শামীমা: আপনার অনেক বন্ধুবান্ধব আছেন। তাঁদের মধ্যে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের

যেসব লেখক আছেন, তাঁদের দু চার জনের কথা বলেন।

আবুবকর: শেষের দিকে আমার খুব বেশি ঘনিষ্ঠতা, প্রেমময় ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে, প্রাণের প্রিয়। আর তার আগে বিষ্ণু দে; তাঁর সঙ্গে। বিষ্ণু দে তো তাঁর কবিতার বই, সংবাদ মূলত কাব্য আমাকে উৎসর্গ করেছেন। উৎপল মারা গেলেন কিছুদিন আগে, উৎপলকুমার বসু। খুব মধুর সম্পর্ক। তুমি-তুমির সম্পর্ক উৎপলের সঙ্গে। বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গেও আমার মোটামুটি ওঠাবসা ছিল। অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এবং আরও অনেকে। খুব লিখতাম একসময় পশ্চিমবঙ্গের পত্রিকায়, কলকাতায় পরিচয়সহ অন্যান্য পত্রিকায়।

শামীমা: কবি শামসুর রাহমানের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?

আবুবকর: কবি শামসুর রাহমান আমার প্রিয়তম। আমার চেয়ে সিনিয়র বয়সে। বড় প্রিয় আমার। সমকাল পত্রিকায় আমি লিখতাম। তিনি মরে গেলে আমি আট-নটা কবিতা লিখেছিলাম এবং আমি ভাগ্যবান হয়তো–বা যে পিজি হাসপাতালের যে রুমে তিনি মারা যান, বাইরের কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি, কিন্তু ডাক্তার আমাকে অ্যালাউ করেছিলেন এবং আমার সামনে ডাক্তার আছেন, কোরআন শরিফ তিলাওয়াত হচ্ছে এবং খাটের পাশে আমি দাঁড়িয়ে, ওই সময় ডাক্তার আমার হাতে একটা টিপ দিয়ে বললেন, ‘এই তো চলে গেলেন।’ এভাবে কবি শামসুর রাহমান চলে গেলেন। আমার জীবনে কিছু বিপর্যয় গেছে, মানসিক বিপর্যয়। একাত্তর সালে যে অত্যাচার গেছে আমার ওপর দিয়ে।

শামীমা: এ প্রসঙ্গে আমার একটা কথা মনে পড়ে গেল, আপনার সম্পর্কে জেনেছি যে আপনি যুদ্ধ করেছেন খুব সক্রিয়ভাবে, কিন্তু আপনি মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নেননি। কেন নিজেকে এভাবে পরিচয় দিতে চাননি?

আবুবকর: এমন একটা প্রশ্ন করলে! প্রথমেই বলি, তুমি একটু ভুল বলছ। আমি যুদ্ধ করিনি। তবে কলমযোদ্ধা অবশ্যই আমি ছিলাম। সেই সময়ে আমি অনেক রিস্ক নিয়েছি। বিপ্লবের দুর্গমাটি বাংলা নামে একটি একাঙ্কিকা এক রাতে লিখেছিআমি নিজে নামিয়েছি। অভিনয় করিয়েছি। রাস্তায় রাস্তায় মিছিলে আমি নেতৃত্ব দিয়েছি। প্রধানত আমার গণসংগীত আমি নিজে আমার দলবল নিয়ে গেয়েছি বাগেরহাটে। খুলনায় গেয়েছি।

তো তোমার প্রশ্নের উত্তর আমি পরে দিচ্ছি। আগে বলি, কলমযোদ্ধা হিসেবে আমি এত বেশি জড়িত ছিলাম, স্বাধীনতা বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে গানগুলো বাজানো হতো। পরে বাগেরহাটে আমাকে ধরে নিয়ে...সেই শহরের নাগেরবাজার এলাকায় রশীদ পরামানিকের অধিকার করা তিনতলা বিল্ডিংয়ে আমাকে টর্চার করা হয়। সেখানে রজ্জব আলী ফকির আর কয়েকজন রাজাকার ছিল। ওইখানে আমাকে জেরা শুরু করল। এই স্বাধীন বাংলা, ওরা তো বলল, ‘জয় বাংলা থেকে বাজানো হয় “ব্যারিকেড বেয়োনেট বেড়াজাল”—এটা কার লেখা? আপনার লেখা না?’ আমি তখন চমকে গেছি। আর তো আমার উপায় নেই, আমি বললাম, ‘না, না, ধুর, আপনারা ভুল শোনেন। আমার হবে কেন? কিছু ভালো লাগলেই মনে করেন আমার লেখা।’ ‘না আমরা গোপন খবরে পাইছি আপনি লেখছেন’ করতে করতেই রজ্জব আলী ফকির আমার ঘাড়ে, পেছন দিক দিয়ে ওর রিভলবার দিয়ে আঘাত করল। আর যাত্রাপুরের রাজাকার ছেলেটা আমার বুকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করল, আমি পড়ে গেলাম। তারপর আমার ডান হাত মোচড়াতে লাগল। ‘হারামজাদা’, ওদের ভাষায় যে বচন, সেই ভাষায় গালাগালি দিতে লাগল। ও হাত মোচড়ায় আর আমি শরীর বাঁকাই। অনেকক্ষণ পর আমাকে ছেড়ে দিল।

এইবার আমি বলি, মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট কেন নিইনি। নিইনি এ কারণে, তখন অমুক্তিযোদ্ধা এবং অন্য ধরনের বহু লোকজন পলিটিক্যাল আঁতাত যাকে বলে—এইসব করে করে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট জোগাড় করছে। ওই দেখে দেখে ঘেন্নায় মনের দুঃখে-কষ্টে আমি আর ওপথে যাইনি।