শুভাশিস সিনহা
মধ্যযুগ থেকে বাংলা কবিতার গীতল যে ধারা, গীতিকা, মঙ্গলকাব্য বা বৈষ্ণব পদাবলির যে ধারা, মধুসূদনে এসে সেটা ভেঙে গেল। আর অনেক ঘাট ঘুরে এসে এখন আধুনিক প্রেক্ষাপটে আমরা যে কবিতা চর্চা করি, সেখান থেকে পরানের গহীন ভিতর একদমই আলাদা। এতে আঞ্চলিক ভাষার ব্যঞ্জনা থাকলেও এ কাব্য আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত নয়। বরং এর মধ্যে ভাষাগত নান্দনিক শব্দচয়ন, যাকে বলা যায় ‘ডিকশন’, সেটা আছে। ভাষাগত শব্দচয়নের দিক থেকে এটি আধুনিকতাকে মান্য করেই এগিয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে শব্দ ও শব্দের ব্যঞ্জনা তৈরির বিভিন্ন কৌশলে আমরা পাব আঞ্চলিকতা নিয়ে এক আধুনিক কবির মনোজাগতিক বিষয়–আশয়—প্রেম, পাওয়া–না পাওয়া ইত্যাদি।
আমরা যা ফেলে আসি তা হারিয়ে ফেলেছি বলে মনে করি, যেটার সঙ্গে অভিযোজন করছি, তা হয়তো আমার না—এমন মনে হয়। এই দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়েই শিল্প ও ভাবনাগুলো টিকে থাকে। সে জন্যই এ ধরনের কবিতার বইয়ের এত গুরুত্ব। কামনা–বাসনা এ বইয়ের কবিতাগুলোতে গুরুত্বপূর্ণভাবে আছে। তবে এর ৩৩টি কবিতার মধ্যে একটি কবিতা একবারে বিচ্ছিন্ন, যেন উদ্ভটভাবে এখানে রয়েছে। এতে সৈয়দ হক বলছেন, ‘আসলে ভাষাই হইল একমাত্র ভাবের পালক... ভাষাই আপন করে আর সেই ভাষা করে পর।’ এটা প্রেম–বিরহ থেকে আসেনি, ভাষা নিয়ে একজন কবির এটা একটা রাজনৈতিক বিশ্লেষণ। প্রবলভাবে রাজনৈতিক।
অনেক সময় আমরা চাই যে কহতব্য জায়গা ডিঙিয়ে এক অসীমতায় পৌঁছাবে কবিতা। এ কাব্য হয়তো তেমন নয়। তবে এতে হৃদয়–আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ থাকায় আমরা এর প্রতি আকর্ষিত হয়েছি। বইটি আমাদের কাছে এসেছে এ বঙ্গের একজন ব্যক্তিমানুষ ও তার পরিপার্শ্ব এবং মানুষের অনায়াস কথা বলার কাব্যিক ধরনকে ধারণ করে। এটাই এ বইয়ের বড় শক্তি।
এখন আধুনিক প্রেক্ষাপটে আমরা যে কবিতা চর্চা করি, সেখান থেকে ‘পরানের গহীন ভিতর’ একদমই আলাদা। এতে আঞ্চলিক ভাষার ব্যঞ্জনা থাকলেও এ কাব্য আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত নয়। বরং এর মধ্যে ভাষাগত নান্দনিক শব্দচয়ন, যাকে বলা যায় ‘ডিকশন’, সেটা আছে।শুভাশিস সিনহা
জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা, আল মাহমুদের সোনালী কাবিন, সৈয়দ শামসুল হকের পরানের গহীন ভিতর, মোহাম্মদ রফিকের কীর্তিনাশা—বইগুলোর ভেতর বাংলা ভূখণ্ডের নান্দনিক অভিপ্রকাশকে আধুনিক কবিতার মধ্যে ধারণ করার একটা শক্তি আছে।
আমাদের এখানে এখন নাগরিক বিচ্ছিন্নতা প্রবল। কিন্তু একেকটা দেশের শিল্পচর্চার নিজস্ব একটা ধারা থাকে, যেটা তার মূল শক্তি, এখানে সেটাকে আমরা বলি লোকায়ত জীবন। বাংলাদেশ এর ওপরেই টিকে থাকবে। যতই নগরায়ণ ঘটুক, এ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে টিকে থাকবে ঐতিহ্যের পরম্পরা। যে জীবন আমরা ক্রমাগত ফেলে এসেছি, যে জীবনে আমাদের ঐতিহ্য আছে—সব কটি নিয়ে এবং ব্যক্তিমানুষের বিচ্ছিন্নতার জায়গা থেকে না–পাওয়ার বিষাদের হাহাকার যুক্ত করে যে কবিতা ভবিষ্যতে লিখিত হবে, সে কবিতা প্রজন্মপরম্পরায় গুরুত্ব বহন করবে, পরানের গহীন ভিতর এটাই করেছে।
পিয়াস মজিদ
বাংলাদেশের সাহিত্যকে যে বইগুলো স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে, ভিন্নমাত্রা দিয়েছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা ও পুনর্মূল্যায়ন জরুরি, বইগুলোর উদ্যাপন জরুরি। সে জন্য এমন একটি উদ্যোগ নেওয়ায় প্রথম আলোকে ধন্যবাদ জানাই।
আলতাফ যথার্থ বলেছেন যে এ কবিতা নিয়ে প্রথমে সৈয়দ হকের দ্বিধা ছিল, নাগরিক মানুষ এটা গ্রহণ করবে কি না। হ্যাঁ, জীবনানন্দেরও একই রকম দ্বিধা ছিল। আমাদের যেহেতু নাগরিক মন, তাই দ্বিধা থাকা অস্বাভাবিক নয়।
আমার নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বইটি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সৈয়দ হক বলেছিলেন, ‘এটা কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভাষা নয়। একবার হঠাৎ কুড়িগ্রামে গেলাম। তখনই মনে হলো, মায়ের সঙ্গে আমি যে ভাষায় কথা বলি, সে ভাষাটা কবিতায়ও তো আসতে পারে।’ বইটি সে ভাষাতেই লেখা হয়েছে।পিয়াস মজিদ
সৈয়দ শামসুল হক পরানের গহীন ভিতর রচনা করেছিলেন একদম স্বতন্ত্র ভাষারীতিতে। ১৯৮১ সালে প্রকাশের পরপর ওই বছরই সব্যসাচী থেকে বইটির আরেকটি সংস্করণ বের হয়। প্রথম সংস্করণে ২৫টি কবিতা ছিল। পরবর্তীকালে আরও আটটি কবিতা যুক্ত হয়। ১৯৮২–তে এটি আবারও বের হয়। পরে ডিপ উইদিন দ্য হার্ট নামে সোনিয়া নিশাত আমিন এর ইংরেজি অনুবাদ করেছেন। কলকাতা থেকেও একটা সংস্করণ বের হয়েছে। প্রকাশমাত্রই বইটি এতভাবে আদৃত হলো কেন? কারণ, এখানে পাওয়া যায় নিজের জনপদের ভাষা আর উচ্চারণ। বৃহত্তর পূর্ব বাংলার প্রেক্ষাপটে কবি এতে উত্তরবঙ্গের মানুষের কথাও বলছেন, ‘মনে হয় আমার থেকেও একা বৃক্ষের পরান,/ আমার থেকেও দুঃখী যমুনা নদীর কিনার।/ আমার তো গেছে এক, কত কোটি লক্ষ গেছে তার।’
আমার নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বইটি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সৈয়দ হক বলেছিলেন, ‘এটা কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভাষা নয়। একবার হঠাৎ কুড়িগ্রামে গেলাম। তখনই মনে হলো, মায়ের সঙ্গে আমি যে ভাষায় কথা বলি, সে ভাষাটা কবিতায়ও তো আসতে পারে।’ বইটি সে ভাষাতেই লেখা হয়েছে। একধরনের নিরীক্ষা হিসেবেই তিনি এটা লিখেছিলেন। নিরীক্ষা সফল হয়েছিল। তাই কলকাতা থেকে যখন বইটি বের হয়, আমরা দেখি যে এ অঞ্চলের ভাষায় লিখিত বইয়ের স্বাদ ওই বাংলার মানুষও গ্রহণ করতে পারছেন। শুভাশিস সিনহার সঙ্গে আমিও একমত, পরানের গহীন ভিতর–এর ভাষা আঞ্চলিক নয়, এখানে আছে ভাষার বিশেষ নানন্দিক বাকভঙ্গি। পাশাপাশি কবিতাগুলো মধ্যে আছে সংলাপধর্মিতা। তবে শুধু ভাষাভঙ্গির কারণেই যে এটা আদৃত হয়েছে তা নয়, আমার মতে, একটা জনপদের সামগ্রিক আবেগ ৩৩টি কবিতায় খণ্ড খণ্ডভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এটা একটা উপন্যাস বা গাথাকাব্যের মতোই। হয়তো পরিসর ছোট। ভেতরে থাকা সাংস্কৃতিক লোকাচার বইটিকে অন্য মহিমা দিয়েছে।
লক্ষ করার বিষয় হলো, বইয়ের তুমুল জনপ্রিয়তার পরও সৈয়দ হক কবিতায় এ ধরনের কাজ আর করেননি। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘কবির ব্যর্থতা হলো নিজেরই পূর্ববর্তী সাফল্যের অনুকরণ করা।’ সে জন্যই হক ভাই সব সময় নতুন নতুন কাজ করতেন। পরবর্তী কবিতাকর্মী হিসেবে এটা আমার কাছে একটা শিক্ষা বটে।
হিজল জোবায়ের
আমি একটু পেছন থেকে আসতে চাই। ১৯৮০ সালের আগে–পরে এই ভাষায় কেন কবিতা লিখলেন ‘বিশুদ্ধতাবাদী লেখক’ হিসেবে পরিচিত সৈয়দ শামসুল হক? কেন তিনি এই মানসিকতা পোষণ করলেন যে নিজেদের ভাষা ও লৌকিক কথাকে কাব্যে তুলে আনা দরকার।
১৯৮০–এর দশকে আমাদের এখানে নগরসভ্যতা তৈরি হচ্ছিল আরও বিস্তৃতভাবে। ঢাকা গড়ে উঠছিল নতুন করে। এই বাস্তবতায় চোখ রেখে যদি প্রশ্ন করি, পরানের গহীন ভিতর আসলে কাদের মধ্যে জনপ্রিয়? দেখা যাবে, এটা মূলত জনপ্রিয় হয়েছে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে, যারা অভিবাসী মানুষ—বিভিন্ন গ্রাম ও মফস্সল থেকে যারা শহর বা রাজধানীতে এসেছে। এই মানুষগুলোর বুকের মধ্যে তাদের ছেড়ে আসা জনপদের ছবি আছে। মানুষগুলো আবার শিকড়ে ফিরতে চায়। কিন্তু ফেলে আসা জায়গায় তো মানুষ আগের মতো আর ফিরতে পারে না। তখন বিষাদময়তার জায়গা থেকে তার ভেতরে মর্সিয়া জেগে ওঠে, পরানের গহীন ভেতর–এর মধ্যে এই ব্যাপারটা শক্তিশালীভাবে দেখতে পাই। কাব্যগ্রন্থটির সফলতার এটা সবচেয়ে বড় কারণ। এর জনপ্রিয়তার পেছনে আবৃত্তিশিল্পীদেরও কিছুটা ভূমিকা আছে।
আমাদের আসলে দেখা উচিত যে আশির দশকে লেখা ‘পরানের গহীন ভিতর’ বা আজকের দিনের ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটির সঙ্গে মানুষ কেন একাত্ম বোধ করে।হিজল জোবায়ের
পরানের গহীন ভিতর–এর আগে আল মাহমুদের সনেটগ্রন্থ সোনালী কাবিন পাঠকমহলে দারুণ সাড়া ফেলেছিল। এই কাব্যগ্রন্থও দাঁড়িয়েছিল বাঙালির লৌকিক উপাদান, ইতিহাস–ঐতিহ্যকে অবলম্বন করে। এটা সৈয়দ হককে অনুপ্রাণিত করেছিল বলে আমার ধারণা।
ফোর্ট উইলিয়ামে তৈরি হওয়া বাংলার আধিপত্যের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতিরোধের জায়গা থেকেও এই বইকে বিবেচনা করার সুযোগ রয়েছে। আমাদের দেশের সাহিত্য বারবারই আসলে দুটো ‘পশ্চিম’ দ্বারা শাসিত হয়েছিল—একটা হলো ইউরোপের পশ্চিম। আর একটা পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম। এখন যদিও সে প্রভাব অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। আমাদের আসলে দেখা উচিত যে আশির দশকে লেখা পরানের গহীন ভিতর বা আজকের দিনের ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটির সঙ্গে মানুষ কেন একাত্ম বোধ করে।
ষাটের দশক পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের গমনভঙ্গি ছিল এক রকম। সত্তরের বিক্ষুব্ধ সময়ে এসে তা একধরনের বিপ্লব–বিদ্রোহের দিকে চলে গেছে। আশিতে সেটা আবার একেবারে অন্য রকম—আমার মতে, খানিকটা বিচ্যুতির দিকে বাঁক নেয়। সেটা ভালো বা মন্দ—সে তর্কে যাচ্ছি না। কিন্তু বাংলা কবিতার ধারায় যেভাবে আমরা জনপদকে তুলে ধরছিলাম, সে জায়গা থেকে এ সময় অনেক দূরে সরে যাই। কিন্তু দেখুন, ওই আশির দশকের পরানের গহীন ভিতর কিংবা একটু আগেকার সোনালী কাবিন মানুষ খুব ভালোভাবেই গ্রহণ করেছে। এ থেকে এটা স্পষ্ট, আপনি যখন নিজের জনপদের মানুষের অনুভূতি প্রকাশের ভঙ্গিকে ধারণ করার জন্য কাজ করবেন, মানুষ সেটা গ্রহণ করবে। এখনকার প্রজন্মের কবি–লেখকদেরও ভাবা দরকার যে আমাদের কোন জায়গাগুলোকে আমরা স্পর্শ করব।
আফরোজা সোমা
মানবজীবনের একটা চিয়ায়ত পরম্পরা আছে। একটা প্রজন্ম আসে এবং এই প্রজন্মের সঙ্গে যুক্ত থাকে পাঁচটি প্রজন্ম—আমি, আমার আগে আমার বাবা ও দাদা এবং আমার পরে আমার সন্তান ও তার সন্তান। এই পাঁচটি জীবন একটা আরেকটার আবর্তন। শিল্পও একই রকমভাবে পরম্পরা ও আবর্তন মেনে চলে। আমরা যদি ‘চর্যাপদ’ বা মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য থেকে শুরু করি, দেখতে পাব, প্রেমের নানা রকম প্রকাশ। প্রেম–বিরহের কথা বলতে গিয়ে এখনো আমরা বলি, ‘হিয়ার পরশ লাগি হিয়া মোর কান্দে।/ পরান পিরীতি লাগি থির নাহি বান্ধে।।’ মৈমনসিংহ গীতিকায় তাকান, ‘মহুয়া’ পালায় দেখতে পাবেন প্রেম আর বাসনার অপূর্ব রূপ, ‘কোথায় পাব কলসি কইন্যা কোথায় পাব দড়ি।/ তুমি হইয়ো গহিন গাঙ আমি ডুইব্যা মরি।’ এই প্রেক্ষাপটে পরানের গহীন ভিতর–এ এসে সৈয়দ হক তাঁর সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁর ভাষায় কথা বলেছেন। তাই বইটিকে বুঝতে আরেকটু বৃহত্তর জায়গায় যেতে হবে।
এখানে একটা কথা এসেছে যে আমরা গ্রামকে বুকে করে শহরে চলে আসি। পরানের গহীন ভিতর–এর ক্ষেত্রে সেটা তো আছেই, এই বইয়ে এর থেকে আরেকটু বেশি কিছু আছে। সেটা হলো চিরায়ত প্রেম, চিরায়ত ব্যথা।
আরেকটা বিষয় খেয়াল করার মতো, কবি একবার নারী হিসেবে কথা বলে উঠছেন, ‘আমি কার কাছে গিয়া জিগামু সে দুঃখ দ্যায় ক্যান,/ ক্যান এত তপ্ত কথা কয়, ক্যান পাশ ফিরা শোয়।’ আবার তাঁর গলায়ই শোনা যায় পুরুষের স্বর, ‘এ বড় দারুণ বাজি, তারে কই বড় বাজিকর/ যে তার রুমাল নাড়ে পরানের গহীন ভিতর।।’ নারী–পুরুষের কামনা–বাসনা–যাতনা এখানে একাকার হয়ে উঠেছে। একটা শিল্প তখনই সার্থক হয়, যখন তা মানুষের হৃদয়কে যুক্ত করে ফেলে। আবেগ আর হৃদয়ের আর্তি আছে বলেই পরানের গহীন ভিতর এখনো পাঠকপ্রিয়।
এখানে একটা কথা এসেছে যে আমরা গ্রামকে বুকে করে শহরে চলে আসি। ‘পরানের গহীন ভিতর’–এর ক্ষেত্রে সেটা তো আছেই, এই বইয়ে এর থেকে আরেকটু বেশি কিছু আছে। সেটা হলো চিরায়ত প্রেম, চিরায়ত ব্যথা।আফরোজা সোমা
আমরা হয়তো থাকব না। আরও কঠিন–কঠোর নাগরিকজীবন আসবে এই দেশে। সেখানে যেসব মানুষ পেলবতার সন্ধান চাইবে, হৃদয়ের আর্তির কাছে পৌঁছাতে চাইবে, তাদের এই বইয়ের কাছে যেতে হবে। এটি ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে টিকে আছে এবং টিকে থাকবে।
সুমন সাজ্জাদ
বইটিকে আমি পাঠ করতে চাই আমাদের আত্মপরিচয়ের সাপেক্ষে। আমরা যদি খেয়াল করি, জসীমউদ্দীনের সোজন বাদিয়ার ঘাট, নক্সীকাঁথার মাঠ, জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা, আহসান হাবীবের কিছু কবিতা, ফররুখ আহমদের নওফেল ও হাতেম এবং সাত সাগরের মাঝি, আল মাহমুদের সোনালী কাবিন, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ সাতনরী হার—এই বইগুলোতে পূর্ববঙ্গের আত্মপরিচয় অনুসন্ধানে কবিরা কাজ করেছেন। এ ক্ষেত্রে তাঁরা ভাষাটা কীভাবে নির্মাণ করবেন, সেদিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। প্রশ্ন হলো, পরানের গহীন ভিতর–এ সৈয়দ হকের ভাষাটা কীভাবে নির্মিত? আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি একধরনের মান বাচনভঙ্গি এ বইয়ে আছে। এর পাঠক মূলত আমরাই—মধ্যবিত্ত শ্রেণি। আজকে আমি যখন গাড়িতে করে প্রথম আলো কার্যালয়ে আসছিলাম, তখন ভাবলাম, আমার গাড়িচালককে পরানের গহীন ভিতর শোনাই। তো ইউটিউব ছেড়ে দিলাম। শেষে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, শুনলেন যে কেমন লাগল? তিনি বললেন, এর মধ্যে একধরনের প্রেম–বিরহ আছে। এ জন্যই ভালো লাগল। আর ভাষাটা সহজ সহজ লাগল। এটুকু বলার পর গাড়িচালক কিন্তু সামগ্রিকভাবে আর কবিতার ব্যাখ্যা করতে পারলেন না। তিনি হয়তো কবিতাগুলোর ভাষাভঙ্গির কারণে এর সঙ্গে একাত্ম বোধ করেছেন। আবার কিছু জায়গায় হয়তো ভাবটা নিতে পারছেন না। নিতে না পারার কারণ হলো, এটা একটা নির্মিত ভাষা, নির্মিত আর লৌকিক—দুই বাকভঙ্গির মিশ্রণ। পরানের গহীন ভিতর–এর ভাষা এই ভাষাগত পরিচয়ের জায়গা থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
এ কাব্যে যে সংলাপ চলছে তাতে একই সঙ্গে পুরুষের গলায় কথা শুনছি, আবার নারীকণ্ঠেও শুনছি। কেউ কেউ ভুল করে বলতে পারে, এটা কি পুরুষ না নারী বলছে! আসলে এতে একটা মিশ্রিত, দ্বৈতস্বর পাওয়া যায়। এ দ্বৈতস্বরের ভেতর একধরনের দার্শনিকতা অছে। যদি ভাবি, এই নারী–পুরুষ আসলে একজন মানুষই—অর্ধনারীশ্বরের মতো, যিনি একই সঙ্গে নারী, একই সঙ্গে পুরুষ!
এখানে শরীরের ভেতর দিয়ে প্রেম খোঁজা হচ্ছে। প্রেমটাকে আবার যেন আত্মার মতো করে অনুসন্ধান করা হচ্ছে। কখনো–বা মনে হয়, রুহ, ইশক বা বঙ্গীয় অঞ্চলের প্রেমে যে রাধাভাব, সমর্পণের যে ভাব আছে, সেটাও পাওয়া যাচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো, সোনালী কাবিন–এ প্রেম যেমন রাজনৈতিক অনুষঙ্গে পরিণত হয়, এখানে তেমন নয়। এখানে একটা চিরায়ত রোমান্টিক ভ্রমণের মধ্য দিয়ে আমাদের আত্মপরিচয় মাথা তুলে দাঁড়ায়।
কবিতাগুলোতে একধরনের সওয়াল-জবাবের মতো ব্যাপার আছে। একটা সনেট হয়তো একটা জবাব, আরেকটায় আবার কিছু প্রশ্ন। যিনি প্রশ্ন করছেন, তিনি হয়তো আবার জবাব দিচ্ছেন।
‘পরানের গহীন ভিতর’ আমাদের একটা সাংস্কৃতিক দ্রব্য, ‘কালচারাল প্রোডাক্ট’ যাকে বলে। এখানে বাংলার লোকাচারের পাশাপাশি গ্রামীণ মানুষের জীবনযাপনের প্রাত্যহিকতা, সংস্কার ও বিশ্বাস, পুরাণ ও দার্শনিকতা রয়েছে। এগুলো আমাদের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের পরিসর তৈরি করে দেয়।সুমন সাজ্জাদ
তারপর আছে প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক। রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থে প্রকৃতি নিজেই একটা চরিত্র। কিন্তু পরানের গহীন ভিতর–এ দেখতে পাই ভিন্নরূপ, এখানে প্রকৃতি প্রতি মুহূর্তে ভাব, বিভাব, মনোভাব—এ প্রতিক্রিয়ায় মানুষের বাসনার মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে।
সবকিছু মিলিয়ে বলা যায়, পরানের গহীন ভিতর আমাদের একটা সাংস্কৃতিক দ্রব্য, ‘কালচারাল প্রোডাক্ট’ যাকে বলে। এখানে বাংলার লোকাচারের পাশাপাশি গ্রামীণ মানুষের জীবনযাপনের প্রাত্যহিকতা, সংস্কার ও বিশ্বাস, পুরাণ ও দার্শনিকতা রয়েছে। এগুলো আমাদের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের পরিসর তৈরি করে দেয়। বইটিকে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটা সমগ্র হিসেবে দেখা যেতে পারে। তাই বাংলাদেশের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থের তালিকা করলে পরানের গহীন ভিতর তার মধ্যে অবশ্যই থাকবে।
আলতাফ শাহনেওয়াজ
কোনো সাহিত্যকর্ম যদি তার জনগোষ্ঠীকে ধারণ করতে পারে, তবে পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা অপ্রাসঙ্গিক না হয়ে তার অর্থ নবায়িত হতে থাকে। আজকের আলোচনার মধ্য দিয়ে এটিই আবার প্রমাণিত হলো। চার দশকের বেশি সময় আগে লেখা পরানের গহীন ভিতর নিয়ে এ সময়ের তরুণ কবিরা যা বললেন, যেসব ভাবনা হাজির করলেন, তা বইটিকে দেখার ক্ষেত্রে এবং পড়ার ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন অনেকগুলো দৃষ্টিকোণ তুলে ধরেছে বলে মনে হয়। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।