অনেক দিন আগে উরুগুয়ে বা ব্রাজিল সীমান্তে, সান্ত’আনা দো লিভ্রামেন্তোতে কী হয়েছিল আপনার?
বোর্হেস: সেই সময়টাতেই আমি একজন মানুষকে হত্যা করতে দেখেছিলাম। আমার জীবনে ওটাই একমাত্র সময় যখন আমি একজন মানুষকে হত্যা করতে দেখছি। সেই সময়টা আমাকে মুগ্ধ করেনি তখন; কিন্তু পরে আমাকে মুগ্ধ করেছিল। ব্যাপারটা আমার স্মৃতির ভেতর আরও বড় হয়ে ওঠে। কল্পনা করুন: স্বচক্ষে একজন মানুষকে হত্যা করা দেখছেন আপনি।
আপনি কি আসলেই দেখেছিলেন?
বোর্হেস: হতে পারে, হয়তো আমি দেখিনি। (হাসি) আমরা মিথ্যাবাদী।
না, না। আমি তা বোঝাতে চাইনি...আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম যে আপনি কি এতটা কাছে ছিলেন যে নিজের চোখে দেখতে পেয়েছিলেন, নাকি যখন এটা ঘটেছিল তখন সেই একই ঘরে ছিলেন বা কাছাকাছি কোথাও ছিলেন?
বোর্হেস: আমার মনে হয় তা–ই। যা–ই হোক, সেই সকালে। ঘটনাটা ঘটেছিল একটা বারে, মাত্র কয়েক ফুট দূরে। সেখানে ছিল গভর্নরের ছেলের দেহরক্ষী এই কৃষ্ণাঙ্গ লোকটা। তখন সেই গরুর পালক ভেতরে ঢুকে পড়ল, একজন উরুগুয়ের...আমার মনে হয় সে মাতাল ছিল, সত্যিই মাতাল। তাকে হত্যা করার কোনো কারণ তার ছিল না, তবু সে তাকে হত্যা করেছিল। দুবার গুলি চালিয়েছিল সে।
আমি আগে কখনো এই বিবরণগুলো শুনিনি।
বোর্হেস: আচ্ছা, কারণ হচ্ছে, সময় বদলে যায়। তাই আমি এ ঘটনাটিকে এমনভাবে সাজিয়েছি, যাতে একঘেয়ে না হই। (হাসি)
আর অন্যরা...
বোর্হেস: আচ্ছা, বাকিরা ভাগ্যক্রমে সবাই মারা গেছে। আমার কথাকে ভুল বলতে পারেন এমন কেউ নেই। তাদের মধ্যে আছেন, আমার এক চাচাতো ভাইয়ের বউ এনরিক আমোরিম এবং মার্কেজ মিরান্ডা, প্রত্নতাত্ত্বিক। আর্জেন্টিনা প্রজাতন্ত্রের একজন প্রত্নতাত্ত্বিকের তদন্ত করার মতো তেমন কিছু নেই। আচ্ছা, সহজ কাজ, তাই না?
সেই অভিজ্ঞতা কি আপনার কথাসাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে?
বোর্হেস: আমারও তা–ই ধারণা। আমি যা পড়েছি। আমার বিশ্বাস এমারসনই বলেছিলেন, ‘কবিতা থেকে উৎপন্ন হয় কবিতার’ অথবা ‘কবিতা থেকে জন্ম হয় কবিতার।’ আমার ঠিক মনে নেই। পড়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর আলোনসো কুইক্সানো, যিনি ডন কুইক্সোটে নামে পরিচিত হয়েছিলেন, তিনিও এ বিষয়ে কিছু জানতেন। কারণ, কেউ যদি ডন কুইক্সোট পড়ে থাকেন, তবে তিনি গল-এর আমাদিস, তিরান্ত লো ব্ল্যাংক, ইংল্যান্ডের পালমেটিন এবং অন্যান্য ‘বীরত্বের বই’ও পড়েছিলেন, যা লেখা হয়েছিল উজ্জ্বল বর্ম পরা নাইটদের সম্পর্কে...
গত বছর আমি আর্জেন্টিনার এক সংবাদপত্রে পড়েছিলাম আপনি উল্লেখ করেছিলেন যে আপনি একবার সিসিলিয়া ইনজেনিরোসের প্রেমে পড়েছিলেন... [নৃত্যশিল্পী এবং কোরিওগ্রাফার, হোসে ইনহেনিরোসের কন্যা, আর্জেন্টাইন চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট, ইতিবাচক দার্শনিক এবং প্রাবন্ধিক।]
বোর্হেস: হ্যাঁ, এটা সত্যি।
কিন্তু প্রতিবেদক সেটা অনুসরণ করেননি আর। আপনি কি এ বিষয়ে কথা বলতে চান?
বোর্হেস: আচ্ছা, সে বিরক্ত হয়ে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আর সংগত কারণেই, আমি নিশ্চিত। আমি অনেক দিন ধরে তাকে দেখিনি। মানে এখন... এখন সে বিবাহিত, তার সন্তান আছে। একসময় আমরা প্রণয়ী ছিলাম, এ কথা না বলার বা গোপন করার কোনো কারণ নেই। আমি তাকে খুব স্নেহের সঙ্গে স্মরণ করি। আমার মনে হয় এটা বলা যায়, তাই না? ভালো মানুষটা জিতেছে। হ্যাঁ, আমি এখন এটা বলতে পারি, কিন্তু সেই সময়ে, পারতাম না। সে খুব সম্মানজনকভাবেই সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। সে আমাকে মাইপু এবং কর্ডোবার [সেন্ট জেমস] একটা টি-রুমে তার সঙ্গে দেখা করতে বলেছিল। আমি কিছুদিন তার সঙ্গে কথা বলিনি। আমি তখন ভাবছিলাম। কী অদ্ভুত, সে আমাকে ফোন করেছে। আনন্দ বোধ করছিলাম। তারপর সে আমাকে বলল, আমি তোমাকে এমন কিছু বলতে চাই, যা তুমি হয়তো কারও না কারও থেকে শুনতে পাবে, কিন্তু আমি চাই প্রথমে আমার মুখ থেকে শোনো: আমার বাগদান হয়ে গেছে, বিয়ে হবে কিছুদিনের মধ্যে। আমি তাকে অভিনন্দন জানালাম। এই ছিল কাহিনি। কমনীয় একটা মেয়ে ছিল। আমেরিকান মার্থা গ্রাহামের ছাত্রী... ভালো নৃত্যশিল্পী হতে পারত। আচ্ছা, সে নিউইয়র্কে মার্থা গ্রাহামের কাছে এক বছর পড়াশোনাও করেছিল। আমার মনে হয় সেখানের কোনো গ্রামে। আচ্ছা, আসুন আমরা নির্বিকারভাবেই এ বিষয়ে কথা বলি। অতীতের কথা।
আপনি বলেছিলেন গ্রেটা গার্বো বিশেষ আকর্ষণীয় ছিল। ঠিক কী কারণে তিনি এত আকর্ষণীয় ছিলেন?
বোর্হেস: আহ, গ্রেটা গার্বো—পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি, গ্রেটা গার্বো। অনন্য। আমি ক্যাথরিন হেপবার্নের প্রেমে পড়েছিলাম। আর একজন অভিনেত্রীর প্রেমে পড়েছিলাম—মিরিয়াম হপকিন্স—তাকে ভুলে গেছে সবাই। আমরা সবাই তার প্রেমে পড়েছিলাম, আমার প্রজন্মের সবাই। সে সত্যিই সুন্দরী ছিল। আর ছিল এভলিন ব্রেন্ট, যিনি জর্জ ব্যানক্রফ্টের সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন, ‘প্রিন্স অব গ্যাংস্টারস’। ড্র্যাগনেট, শোডাউন ইত্যাদিতে। আমরা সবাই মিরিয়াম হপকিন্স, গ্রেটা গার্বো, ক্যাথরিন হেপবার্ন এবং আরও কয়েকজন সুন্দরীর প্রেমে পড়েছিলাম।
বিবিসি আপনার জীবন নিয়ে একটি চলচ্চিত্র তৈরি করেছে...
বোর্হেস: খুব ভালো ছিল ওটা। খুব ভালো। এখানে [আর্জেন্টিনায়] তারা করত না...আমি খুব একটা পছন্দ করিনি। এখানে ওটা তৈরি করা যেত না। ছবিটি প্যারিসের ‘L'Hôtel’-এ তৈরি হয়েছিল, যা হোটেল ডি’আলসেস নামে পরিচিত ছিল, যেখানে অস্কার ওয়াইল্ড গত শতাব্দীর শেষ বছরে মারা গিয়েছিলেন। ১৯০০ সালে। না, আমি বলতে চাইছিলাম এর এক বছর আগে, ১৮৯৯ সালে, কিন্তু আসলে ১৯০০ সালে। কিছু অংশ বেজমেন্টে চিত্রায়িত হয়েছিল—খুবই অদ্ভুত—হোটেলের বৃত্তাকার বেজমেন্টে। সিলিন্ডার আকৃতির ছিল, বেশ বড় এবং দেয়ালগুলো আয়না দিয়ে মোড়া। তাই কোনো না কোনোভাবে, বেজমেন্টটি ছিল অসীম প্রকৃতির। পরে চিত্রায়িত হয়েছিল বিভিন্ন জায়গায়, উরুগুয়ের কলোনিয়া শহরের কাছে, উরুগুয়ের অভিনেতাদের সঙ্গে, শহরের ঠিক বিপরীতে, মন্টেভিডিও হাইটসের সেই বিশাল পাহাড়ে। চলচিত্রটি আমার জীবনের গল্প নিয়ে তৈরি। আমিও এতে অভিনয় করেছি। মারিয়া কোডামাও অভিনয় করেছেন। আমার ছোটগল্প থেকে বেশ কিছু দৃশ্য নেওয়া হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সিনেমাটিতে আমি ১২–১৩ বছরের একটি ছেলের সঙ্গে কথা বলেছি যে চশমা পরে—সে আমার শৈশবের প্রতিনিধিত্ব করে, আর এই দৃশ্যটি আমার ছোটগল্প ‘দি আদার’ থেকে নেওয়া—তারপর আমি আরও ছোট একটি বাচ্চার সঙ্গে কথা বলি, যেমন আমার গল্পে আছে। আচ্ছা, এটা খুব সিরিয়াস সিনেমা, খুব ভালো সিনেমা।
সিনেমাটা কি দেখা যাবে?
বোর্হেস: আপনি কি এখানে বুয়েনস এইরেসে দেখার কথা বলতে চাইছেন?
যেকোনো জায়গায়।
বোর্হেস: হয়তো যাবে। হয়তো মিউনিসিপ্যালিটিতে দেখা যায় কি না, পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। ওখানে মিস্টার ডেভিড নামে একজন ছিলেন...আমার শেষ নাম মনে নেই। যা–ই হোক, সে যা–ই হোক।
বিভিন্ন সময়ে, আপনি স্পেনের মধ্যাঞ্চল, ক্যাস্টিলের প্রতি কিছুটা বিদ্বেষ দেখিয়েছেন। কিন্তু কেন?
বোর্হেস: হ্যাঁ, বিশেষ করে ক্যাস্টিলের কথা বলছি, সাধারণভাবে স্পেন নয়। আমি গ্যালিসিয়া, কাতালোনিয়া, আন্দালুসিয়ার কথা বলছি না, ওগুলো প্রশংসনীয় জায়গা—প্রায় দেশ—কিন্তু আমি ক্যাস্টিলের কথা বলছি। সাধারণ স্পেনীয়রা ভালো মানুষ, নীতিগতভাবে বিশ্বের সেরা, কিন্তু স্প্যানিশ সাহিত্য আমাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেনি, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া: সার্ভান্তেসের ডন কুইক্সোট, ফ্রে লুইস ডি লিওন—এরা ছাড়া। কিন্তু ক্যাস্টিল...ক্যাস্টিল হলো সেই স্থান যেখানে সেই বিজেতারা এসেছিলেন, সেই সঙ্গে সেই সমস্ত সামরিক ব্যক্তিরা, বোকা সামরিক ব্যক্তি, ধর্মান্ধ ক্যাথলিক, যারা সবাই আমাদের দেশগুলোতে [হিস্পানিক আমেরিকা] তাদের নোংরা ছাপ ফেলেছে। সামরিকবাদ, ধর্মান্ধতা, একগুঁয়েমি—সবই ক্যাস্টিল থেকে এসেছে। ক্যাস্টিল আমাদের সব সামরিকবাদ, একনায়কতন্ত্রের উৎস...
সামরিকবাদের কথা বলতে গেলে, যখন সামরিক জান্তা পেরনের বিধবা স্ত্রীকে উৎখাত করে ১৯৭৬ সালে আর্জেন্টিনার সরকার দখল করে, তখন আপনি খুশি হয়েছিলেন...
বোর্হেস: আচ্ছা, হ্যাঁ। কিন্তু তারা এটা করার আগে আমিই-বা কীভাবে জানতাম যে পরে তারা কী করবে? এমনকি সেটারও পরে...আমরা এখানে নিখোঁজ, নির্যাতন, হত্যা সম্পর্কে জানতাম না, কারণ সেখানে সম্পূর্ণ সেন্সরশিপ আরোপ করা ছিল। কিন্তু, আমি ভুল ছিলাম।
চিলির একনায়ক জেনারেল পিনোশে আপনাকে একটা অলংকরণ উপহার দিয়েছিলেন...
বোর্হেস: না, না, না। কোনো সাজসজ্জা ছিল না। আমি চিলি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম যেখানে আমাকে ডক্টর অনারিস কৌসা উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছিল। যখন আমি সান্তিয়াগোতে সেই সম্মানসূচক ডক্টরেট গ্রহণ করছিলাম, তখন প্রেসিডেন্ট আমাকে ডিনারে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ডিনারে আমন্ত্রণ ছাড়া আর কিছুই না। আর যেহেতু আমি সান্তিয়াগোতে ছিলাম, তাই আমি অস্বীকার করতে পারিনি, তাই না?
নৈরাজ্যবাদ কি সমাজের একটি কার্যকর রূপ?
বোর্হেস: আমার মনে হয় আমাদের প্রায় ২০০ বছর অপেক্ষা করতে হবে—খুব অল্প সময়, তাই না?—কোনো সরকার না থাকা, পুলিশ বাহিনী না থাকা, বর্তমানের থেকে আলাদা একধরনের মানুষ হওয়ার জন্য। কিন্তু এ মুহূর্তে—এটা সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়—এখানে সরকার একটা অপরিহার্য খারাপ জিনিস। আর এখন, আমি মনে করি এই দেশে আমাদের আশা করার একটা নির্দিষ্ট অধিকার আছে, আশা করা ছাড়া আর কিছু নেই। আমি বিশ্বাস করি, পাঁচ বছর বা তারও বেশি সময় পরে...আচ্ছা, দীর্ঘ সুস্থতার পর, আমরা কী বলব, এত মন্দের পরে... পেরোনিজম, সন্ত্রাসবাদ, সামরিক জান্তা, অপহরণ, নির্যাতন, মৃত্যু এবং তারপর...? আশাই তো। ব্যাপারটা ‘এই পৃথিবীর অর্থকে সংক্ষিপ্ত করে,’ তাই না? তারপরও আমি আশা করি, অনেক আশা আছে আমার...। যা–ই হোক, আলফনসিনকে [প্রেসিডেন্ট হিসেবে] পাওয়া সত্যিই আনন্দের, যদিও আমি [আলফনসিনের] রেডিক্যাল পার্টির সদস্য নই।
আপনার প্রাথমিক কবিতা এবং একই যুগের ট্যাঙ্গো গানের মধ্যে কি কোনো পারস্পরিক প্রভাব থাকতে পারে?
বোর্হেস: আশা করি নেই, তাই না? কারণ ওগুলো খুব বাজে। (হাসি) আমার মনে হয় না কোনো প্রভাব আছে। না, ট্যাঙ্গো নয়। মিলোঙ্গা, হ্যাঁ। আমি মিলোঙ্গা গানের একটা বই লিখেছি। মিলোঙ্গা মানুষের প্রিয়; কিন্তু ট্যাঙ্গো কখনো প্রিয় ছিল না। আপনি জানেন, ট্যাঙ্গোতে ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্রগুলো ছিল পিয়ানো, বাঁশি ও বেহালা। যদি ট্যাঙ্গো মানুষের প্রিয় হতো, তাহলে বাদ্যযন্ত্র হতো গিটার, যেমন মিলোঙ্গায় আছে। গিটারের কথা বলতে গেলে, আসুন ব্যুৎপত্তিগত অঞ্চলে একটু প্রবেশ করি। গিটার শব্দের উৎপত্তি হলো জাইথার শব্দ থেকে। প্রায় একই শব্দ। আপনি [স্প্যানিশ ভাষায়] গিটারা বা সিটারা বলেন, স্বরবর্ণগুলো ঠিক একই রকম, তাই না? মনে হচ্ছে তারের এই যন্ত্রগুলো মধ্য এশিয়ার কোথাও আবিষ্কার করা হয়েছিল। তারের যন্ত্রগুলো থেকে বীণা, বেহালা, জাইথার, গিটার তৈরি হয়েছিল। কিন্তু গিটারের উৎপত্তি গ্রিক ভাষায় জাইথার শব্দ থেকে, অর্থাৎ কিথারা থেকে। একটু ব্যুৎপত্তিগত কৌতূহল মেটাতে বললাম আরকি। আর আপনি কোত্থেকে এসেছেন?
আমার জন্ম নিউ জার্সিতে, কিন্তু আমি নিউইয়র্ক রাজ্যে, বাফেলোর কাছে এক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করি।
বোর্হেস: আমি বাফেলোর সঙ্গে পরিচিত। নায়াগ্রা জলপ্রপাতে গিয়েছি। আর নিউ জার্সি, এটা নিউইয়র্ক সিটির পশ্চিম দিক, তাই না?
নিউইয়র্ক শহরের পশ্চিমে, হাডসন নদীর ওপারে।
বোর্হেস: আহ, হ্যাঁ, অবশ্যই। হাডসন...আপনি জানেন কি না, মিসিসিপি মানে ‘জলের জনক’, আমাদের মহান জলপ্রপাত, ইগুয়াজুর মতো, যার অর্থ ‘বড় জল’।
আচ্ছা, ট্যাঙ্গো এবং মিলোঙ্গার কথায় ফিরে আসা যাক: বাদ্যযন্ত্র ছাড়াও ট্যাঙ্গো এবং মিলোঙ্গার মধ্যে সংগীতের কী পার্থক্য রয়েছে?
বোর্হেস: মিলোঙ্গা একধরনের সাহসী, বন্য সংগীত। আনন্দময় সংগীত, অন্যদিকে ট্যাঙ্গো অত্যন্ত আবেগপ্রবণ, ‘সম্মানজনক’ (শব্দের সবচেয়ে খারাপ অর্থে) সংগীত। হ্যাঁ। মিলোঙ্গা [বোর্হেস মানে ট্যাঙ্গো] কখনো জনগণের সংগীত ছিল না। প্রমাণ হচ্ছে যে তারা এখানকার টেনিমেন্ট ভবনগুলোতে কখনো ট্যাঙ্গো নাচেনি। কিন্তু টেনিমেন্টগুলো এমন ছিল যেখানে আপনি বুয়েনস এইরেসের প্রতিনিধিত্বকারী জনগণকে খুঁজে পেতে পারেন। তারা সেখানে কখনো ট্যাঙ্গো নাচেনি। মিলোঙ্গা, হ্যাঁ; ট্যাঙ্গো, না। না, ট্যাঙ্গো হবে পতিতালয়ের, অশ্লীল ঘরের সংগীত। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই একে প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু আমি পুরুষদের একসঙ্গে নাচতে দেখেছি। কারণ, কোনো মহিলাকে ট্যাঙ্গো নাচতে দেখা যাবে না। কারণ এটা পতিতাবৃত্তির সঙ্গে সম্পর্কিত নাচ ছিল। কিন্তু দুটি নৃত্য [ট্যাঙ্গো এবং মিলোঙ্গা] আফ্রিকান বংশোদ্ভূত। এমনকি নামের শব্দগুলোও আফ্রিকান: মিলোঙ্গা, ট্যাঙ্গো, তাই না? যেসব অ্যাঙ্গো, ওঙ্গা, ওঙ্গো, যেমন কঙ্গোতে।
আপনার ছোটগল্প—‘দি ইন্ট্রুডার’। কেন বলেছেন একে আপনার লেখা সেরা গল্প বলে মনে করেন?
বোর্হেস: না, আমার তা মনে হয় না যে এমন কথা বলেছি। আর শুনুন, আমি আপনাকে বলতে চাই... এ গল্পের ওপর ভিত্তি করে তৈরি একটা ভয়াবহ সিনেমা আছে। এড়িয়ে যাবেন সেটা। ওই সিনেমার গল্পে এমন দুটি উপাদান ঢুকিয়ে দিয়েছে, যা আমার গল্পে ছিল না। আমার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই ওগুলোর। উপাদানগুলো হলো: অজাচার আর সমকামিতা। ওহ, হ্যাঁ। এবং পায়ুকাম। আচ্ছা, এই ভদ্রলোক [পরিচালক], [কার্লোস হুগো] ক্রিস্টেনসেন, সম্ভবত তাঁর নাম। তিনি তাঁর ভাইকিং পূর্বপুরুষদের অযোগ্য বংশধর। আমার গল্পে সমকামিতা, অজাচার এবং পায়ুকামিতা প্রবর্তন করেছেন। হাস্যকর সব দৃশ্য... উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আমার গল্পে আমি লিখেছি দুই ভাই একই মহিলাকে ভাগ করে নিচ্ছে, কিন্তু এটা বোঝা যাচ্ছে আমি একই সঙ্গে নয়, ধারাবাহিকভাবে বোঝাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ক্রিস্টেনসেনের এই দৃশ্যটি কমিক ইফেক্টের জন্য তৈরি। যেখানে একজন অভিনেত্রী পোশাক খুলে দাঁড়িয়ে আছেন। তারপর একজন লোক বাঁ দিক থেকে তাঁর দিকে এগিয়ে যান, আর আরেকজন ডান দিক থেকে। তাঁরা বেশ অস্বস্তিকর সেক্স করেন। কিন্তু আমার ধারণা, এটা করা হয়েছে কমিক ইফেক্টের জন্য।
রাফায়েল ক্যানসিনোস-অ্যাসেন্সের কথা কি মনে আছে আপনার?
বোর্হেস: আমার কনসার্ন, তিনি আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করা একজন মানুষ। আমি জানি না, তাঁর বই পড়ে আপনিও একই রকম অনুভব করবেন কি না। কিন্তু তাঁর সঙ্গে কথা বলা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। উদাহরণস্বরূপ বলছি, তিনি একবার, ‘আমি চৌদ্দটি ভাষা জানি...’ বলার পরিবর্তে, বলেছিলেন, ‘আমি ধ্রুপদি এবং আধুনিক এমন চৌদ্দটি ভাষার তারকাদের অভিবাদন জানাতে পারি।’ তিনি গ্যালসওয়ার্দির একটা সম্পূর্ণ রচনা অনুবাদ করেছিলেন এবং ডি কুইন্সিরও কিছু অংশ অনুবাদ করেছিলেন। তারপর তিনি হেনরি বারবুসের উপন্যাস লা’অ্যাফেয়ার এবং আরও কিছু ফরাসি থেকে অনুবাদ করেছিলেন। তিনি আরবি থেকে দ্য থাউজেন্ড অ্যান্ড ওয়ান নাইটস বইটির সরাসরি অনুবাদ করেছিলেন। আমার মতোই ইহুদি বংশোদ্ভূত ছিলেন। তালমুডের একটা সংকলন তৈরি করেছিলেন। তারপর তিনি গ্রিক থেকে জুলিয়ান দ্য অ্যাপোস্টেটের রচনা অনুবাদ করেছিলেন। তিনি লাতিন জানতেন। আমি তাঁর সঙ্গে প্রথম যখন দেখা করি, আমরা সারা রাত ধরে টমাস ডি কুইন্সির কথা আলোচনা করেছি। ক্যানসিনোস-অ্যাসেন্সের জন্ম সেভিলে, কিন্তু তিনি মাদ্রিদে থাকতেন। সমুদ্র সম্পর্কে খুব সুন্দর কবিতা লিখেছিলেন। সে জন্য আমি তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। ‘হ্যাঁ,’ তিনি বললেন, ‘সমুদ্রবিষয়ক সুন্দর কবিতা। আশা করি একদিন সমুদ্রের দিকে একবার নজর দেব।’ তিনি কখনো সমুদ্রের দিকে তাকাননি!
আপনি এইমাত্র উল্লেখ করেছেন যে আপনি ইহুদি বংশোদ্ভূত, আর আমি দেখেছি আপনার মায়ের পূর্বনাম—আচেভেদো—পর্তুগিজ-ইহুদি নাম। এটা কীভাবে জানলেন আপনি?
বোর্হেস: আচ্ছা, এটা কৌতূহলজনক। একদিন ক্যানসিনোস-অ্যাসেন্স ইনকুইজিশনের আর্কাইভগুলো অনুসন্ধান করার সময় তাঁর পারিবারিক নামটি পেয়েছিলেন তিনি। ক্যানসিনোস নামটি খুঁজে পেয়েছিলেন। সেই সময় থেকে, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তিনি একজন ইহুদি। যাঁদের একসময় জোর করে ক্যাথলিক ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল, তাঁদের বংশধর। ফলে তিনি হিব্রু ভাষা শিখতে শুরু করেন। তিনি El candelabro de lossietebrazos (সাত-শাখাযুক্ত ক্যান্ডেলাব্রাম) নামে একটি প্রেমমূলক গীতসংহিতার বই লিখেছিলেন। সেখানে মেনোরার কথা উল্লেখ আছে। যা–ই হোক, আমার ক্ষেত্রে, Rosas y sutiempo (রোজাস আর তার সময়) নামে একটি খুব ভালো বই আছে। সেই বইতে সেই সময়ের বুয়েনস এইরেসের পারিবারিক নামের একটি তালিকা রয়েছে। সে অনুযায়ী তারা পর্তুগিজ-ইহুদি ছিল। আচ্ছা, সেখানে প্রথম নামটা হলো ওকাম্পো। এবং সে কারণেই বুয়েনস এইরেসের উচ্চসমাজের কিছু লোক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে ‘ইহুদি আপস্টার্ট’ হিসেবে উল্লেখ করে (হাসি), তাই না? আচ্ছা, এই পর্তুগিজ-ইহুদি পরিবারগুলোর নাম ছিল ওকাম্পো; পিনেইরো—আমার পরিবারের একটি নাম—আচেভেদো, আমার মায়ের কুমারী নাম; সানজ-ভ্যালেন্তে এবং, দেখা যাক...আরও কী নাম আছে? আচ্ছা, বুয়েনস এইরেসের পুরোনো পরিবারের বেশ কিছু পুরোনো নাম—পর্তুগিজ-ইহুদি। এখন, বোর্হেস নামটি কিন্তু ইহুদি নয়। বোর্হেস ইংরেজিতে বার্গেসের মতো; এর অর্থ ‘বুর্জোয়া’, বার্গের মানুষ, স্পেনের এডিনবার্গ, হামবুর্গ, রোথেনবার্গ, বার্গোসের মতো, তাই...কী আশ্চর্য, আমার প্রথম নামের অর্থ ‘গ্রামের মানুষ’, কারণ হোর্হে [ইংরেজিতে ‘জর্জ’] মানে ‘মাটির মানুষ,’ আপনি ভার্জিলের জর্জিকস জানেন এবং ভূগোল হলো পৃথিবীর অধ্যয়ন। ভূতত্ত্ব, পৃথিবীর পাথর। আচ্ছা...জ্যামিতি, পৃথিবী পরিমাপ...যাতে আমার প্রথম নাম ‘কৃষক’-এর মতো কিছু বেরিয়ে আসে, তাই না? অবশ্যই। এবং আমার শেষ নামের অর্থ বিপরীত; এর অর্থ ‘শহরবাসী’, বুর্জোয়া...।
একটা প্যারাডক্স?
বোর্হেস: হ্যাঁ। যখন কমিউনিস্টরা বলে যে আমি বুর্জোয়া, আমি বলি, ‘না, আমি বুর্জোয়া [স্প্যানিশ ভাষায় বার্গেস] নই; আমি বোর্হেস।’ একদিন ভায়ামোন্ট [স্ট্রিট]-এ...আমি জানি না আপনি এটা জানেন কি না, কিন্তু ভায়ামোন্টে একসময় রেডলাইট জেলা ছিল। কিন্তু সেটা ছিল এল বাজোর দিকে ভিয়ামোন্টে, উদাহরণস্বরূপ, সান মার্টিন এবং প্যাসিও দে জুলিও নামে পরিচিত একটা অঞ্চলের মধ্যে, যা এখন আলেম নামে পরিচিত। যা–ই হোক, ওটা ছিল পতিতালয়ের অঞ্চল। পরে, লাল-লাইট জেলাটি লাভালে এবং জুনিনে ছিল এবং সেখানেই ট্যাঙ্গো আবিষ্কার হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। তবে এটা [রোজারিও শহরে] এবং মন্টে ভিডিওতেও উদ্ভাবিত হয়েছিল বলে জানা যায়। হ্যাঁ, ট্যাঙ্গো কোথায় উদ্ভাবিত হয়েছিল, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু, পার্থক্য কী? অপরাধ এবং পতিতাবৃত্তির আশপাশের এলাকা সম্পর্কে বলতে গিয়ে, আমি একবার এক পুলিশপ্রধানকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘বুয়েনস এইরেসের সবচেয়ে বিপজ্জনক জেলা কোনটি?’ তিনি বললেন, ‘আমার মনে হয় এটা ফ্লোরিডা এবং কোরিয়েন্তেসের কোণ।’ (হাসি) আপনি দেখুন, কারণ সেখানেই সবচেয়ে বেশি অপরাধ সংঘটিত হয়। কারণ হচ্ছে সেসব উচ্চমূল্যের দোকান। তিনি বললেন, ‘আমার মনে হয়, সবচেয়ে বিপজ্জনক জেলা হলো ফ্লোরিডা ও কোরিয়েন্তেস।’ আজকাল এখানকার মানুষের দারিদ্র্যের কথা ভাবলে সত্যিই ভয়ংকর লাগে, সেখানে কী করে বিক্রি হয় উচ্চমূল্যের বিলাসবহুল সব জিনিসপত্র। ভয়ংকর। তাই না? বছরের পর বছর ধরে সেখানে চলছে অব্যবস্থাপনা। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা...তারা হয়তো বলতে পারে যে [প্রেসিডেন্ট] আলফোনসিন মাঝারি মানের, কিন্তু সৎ, যদিও কাউকে সৎ রাজনীতিবিদ বলাটা স্ববিরোধী বলে মনে হতে পারে।
আপনি ‘চীনের প্রথম সম্রাট’ শিহ হুয়া তি সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন...
বোর্হেস: হ্যাঁ, ‘দ্য ওয়াল অ্যান্ড দ্য বুকস।’ আর সিলভিনা ওকাম্পো আমাকে বলেছিলেন আমি ওই প্রবন্ধের মাধ্যমে একটা নতুন ধারা তৈরি করেছি। কিন্তু প্রবন্ধের ওই ধারণাটি এসেছে হারবার্ট অ্যালেন জাইলসের হিস্ট্রি অব চায়না থেকে, যেটি তিনি চুয়া তজু থেকে অনুবাদ করেছিলেন। আর অস্কার ওয়াইল্ড একবার চুয়াং তজুর সেই প্রথম অনুবাদ সম্পর্কে একটা মন্তব্য করেছিলেন। এখন চুয়াং তজু, আমার বিশ্বাস, খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতাব্দীতে লেখা হয়েছিল। তাই ওয়াইল্ড বইটা সম্পর্কে কথা বলছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি যে মূল বইটি লেখার ২ হাজার ৬০০ বছর পরে প্রকাশিত এই অনুবাদটি অবশ্যই অপরিণত।’
অপরিণত?
বোর্হেস: হ্যাঁ, অপরিণত। দেখুন, অস্কার ওয়াইল্ড অত্যন্ত গভীর মনের মানুষ ছিলেন। আমার মনে হয়, তিনি নিজের গভীরতা দেখে লজ্জিত ছিলেন। আর তাঁর রসবোধও ছিল বেশ মৌলিক। তিনি সমকামী ছিলেন, জানেন? এখন অনেকেই আছেন যাঁরা সমকামী হওয়ার ভান করেন। একবার তিনি তাঁর এক পরিচিতকে পরামর্শ দিচ্ছিলেন, বললেন, ‘কাউকে বলা জরুরি নয় যে সে সমকামী; জরুরি হচ্ছেকে সমকামী নয় সেটা বলা, যাতে নিজের দিকে মনোযোগ না আসে।’ (হাসি) আপনি ব্যাপারটাকে হালকাভাবে নিতে পারেন। (হাসি)
আচ্ছা, আপনার প্রবন্ধ দ্য ওয়াল অ্যান্ড দ্য বুকস-এ ফিরে আসি...
বোর্হেস: যদি স্মরণ করতে পারতাম, ভালো হতো। নিজের লেখা ফিরে আর কখনো পড়ি না। এই বাড়িতে আপনি আমার একটাও বই পাবেন না। আর এখানে আমার সম্পর্কে লেখা কোনো বই নেই, কারণ আমি লাইব্রেরিটাকে এসব থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করি। এমারসন, বার্নার্ড শ, বা কোলরিজ বা ওয়ার্ডসওয়ার্থের ওপর বই আছে...
সেই প্রবন্ধে, চীনের সম্রাট ইতিহাস ধ্বংস করেন, সম্রাট হওয়ার আগে লেখা সমস্ত বই ধ্বংস করেন...
বোর্হেস: কারণ সে অতীতকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। একইভাবে একই ইতিহাস তার সঙ্গে শুরু হয়।
…এবং, একই সঙ্গে গ্রেট ওয়াল নির্মাণের নির্দেশ দেয়...
বোর্হেস: একধরনের জাদুকরি স্থান তৈরি করার জন্য, তাই না?
আমার মনে হয়, আপনি যা করেছেন তার সঙ্গে এগুলোর কিছু মিল আছে, কারণ আপনি তো আপনার আগে লেখা কিছু কাজও ধ্বংস করে দিয়েছেন, যেমন ইনকুইসিসিওনেস...
বোর্হেস: যুক্তিসংগত কারণ ছিল সেটার। আমি বিশ্বাস করি যেমন উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস বলেছেন, ‘আমি নিজেকেই পুনর্নির্মাণ করি।’ যখন তিনি অতীতকে সংশোধন করেন, তখন তিনি নিজেকেই সংশোধন করেন, কারণ অতীত এতটাই নমনীয়।
যখন ওই প্রবন্ধটা লিখেছিলেন, তখন আপনার আর শিহ হুয়াং টির মধ্যে কোনো মিল ছিল বলে মনে হয়নি?
বোর্হেস: অবশ্যই না, হে ঈশ্বর! আমি এমনকি কোনো বইও পোড়াইনি, আমার নিজের বই ছাড়া, যার কোনো হিসাব নেই, আর আমি কোনো পাহাড়ও তৈরি করিনি। না, না।
আপনি আপনার বাকি যে সাহিত্যকর্ম নির্মাণ করেছেন, তা একেবারে পাহাড় সমতুল্য হবে, তাই না? কথাটা এই অর্থে যে আপনার পরবর্তী কাজ, পাহাড়ের মতো, গৌরব এনে দেয়, আর আপনি যা পুড়িয়ে দিয়েছেন, যেমন আপনি উল্লেখ করেছেন, আপনাকে অভিযুক্ত করে ...কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।
বোর্হেস: ব্যাপারটা মোটেও এমন নয়। আমি যা লিখি, তা ওই পাহাড়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ নয়। তেমন কিছুই না, মোটামুটি খসড়া...
অন্যরা এ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে একমত নন।
বোর্হেস: হ্যাঁ, কিন্তু আমি তাই করি। তা ছাড়া অনেক সুইডিশ আছেন যাঁরা আমার সঙ্গে একমত হবেন: যাঁরা সম্মানিত সুইডিশ একাডেমির সদস্য। তাঁরা খুবই বিচক্ষণ। খুবই বিচক্ষণ, হ্যাঁ। বলুন তো, আপনি কোথা থেকে এসেছেন?
নিউ জার্সি থেকে, কিন্তু আমি বাফেলোর দক্ষিণে ফ্রেডোনিয়ায় থাকি।
বোর্হেস: আমি যুক্তরাষ্ট্রে আর্জেন্টিনার সাহিত্যের বেশ কয়েকটি কোর্স পড়িয়েছি। প্রথমটি ছিল হার্ভার্ডে, ‘ইংলিশ মাস্টার্স’। আমি হার্ভার্ড থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট পেয়েছি। তারপর আমি মিশিগানের ইস্ট ল্যান্সিং নামক একটা ছোট শহরে আরেকটা কোর্স পড়িয়েছি। তারপর ইন্ডিয়ানার ব্লুমিংটনে আরেকটা। এবং...আরেক জায়গা আছে...।
অস্টিন, টেক্সাস।
বোর্হেস: অবশ্যই, সেটা ছিল প্রথম এবং সবচেয়ে স্মরণীয়! আমার মায়ের স্মৃতি আছে সেখানে। ১৯৬১ সালে প্রথম আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলাম। আর আমার মা সেখানে একটা ভয়াবহ ভুল করেছিলেন। ওখানে দুটি মূর্তি ছিল। তারা আমার মাকে বলল, ‘এটা ওয়াশিংটনের মূর্তি...’ ‘হ্যাঁ,’ আমার মা বললেন, ‘আর অন্যটি লিংকনের।’ সবাই ভয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল, কারণ টেক্সাসে লিংকনের কথা বলতে গেলে, গৃহযুদ্ধ, কনফেডারেসি...আর তখন আমার মা কেমন অনুভব করেছিলেন... জানেন, আমেরিকান গৃহযুদ্ধ ছিল উনিশ শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ যুদ্ধ। নেপোলিয়নের যুদ্ধের চেয়ে, বিসমার্কের যুদ্ধের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল সেই যুদ্ধে...। আচ্ছা, এখানকার স্বাধীনতাযুদ্ধের চেয়েও। গেটিসবার্গ তিন দিন ধরে চলেছিল। এখানে যুদ্ধগুলো ছিল [তুলনামূলকভাবে] মামুলি সংঘর্ষ। এখন দেখুন, জুনিনের যুদ্ধ, যেখানে আমার দাদু অংশ নিয়েছিলেন, তিন-চতুর্থাংশ ঘণ্টা স্থায়ী হয়েছিল। স্যাবার এবং বর্শা দিয়ে লড়াই হয়েছিল। একটিও গুলি চালানো হয়নি। সেগুলো ছিল সংঘর্ষ। কিন্তু গেটিসবার্গ তিন দিন স্থায়ী হয়েছিল। আর ওয়াটারলুতে, একদিন। গেটিসবার্গের তুলনায় ওয়াটারলুতে কম লোক মারা গিয়েছিল।
তবে কি স্পেনীয়দের যতটা আগ্রহ ছিল ইউনিয়ন থেকে স্বাধীন থাকার ব্যাপারে, যতটা আগ্রহ ছিল উত্তরাঞ্চলীয়দের দক্ষিণকে ইউনিয়নে রাখার ব্যাপারে, তার চেয়ে কম আগ্রহ ছিল দক্ষিণ আমেরিকার এই অঞ্চলগুলোকে ধরে রাখার ব্যাপারে?
বোর্হেস: হ্যাঁ। স্প্যানিশরা এখানে দরিদ্র ছিল, কারণ জেসুইটদের নেতৃত্বে গুয়ারানি ইন্ডিয়ানরা আগের যুদ্ধগুলোয় স্প্যানিশদের সহজেই পরাজিত করতে পেরেছিল। সেই ইন্ডিয়ানরা স্প্যানিশ বা পর্তুগিজদের চেয়েও দক্ষ সৈনিক ছিল।
আপনার ছোটগল্পে—‘দ্য সিক্রেট মিরাকল’—জারোস্লাভ হ্লাদিক—
বোর্হেস: ওহ, হ্যাঁ, মনে আছে...আচ্ছা, এটা একটা ধারণা যে... বেশ প্রাচীন ধারণা, এই যে... সময়কে ছোট করা যেতে পারে, তাই না? অথবা দীর্ঘায়িতও করা যেতে পারে। তাহলে, এই গল্পের সময়ও দীর্ঘায়িত হয়, তাই না?
হ্যাঁ। আপনি সময় নিয়ে খেলেছেন, তাই না?
বোর্হেস: ঠিক তাই।
কিন্তু আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছিলাম...হ্লাদিকের একটা স্বপ্ন ছিল। আমি জানি না আপনি সেটা মনে রেখেছেন কি না...?
বোর্হেস: না।
স্বপ্নে—
বোর্হেস: অবশ্যই। সে মানচিত্রে ঈশ্বরকে খুঁজে পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। নাকি ছিল না?
হ্যাঁ। গল্পের দ্বিতীয় স্বপ্ন ছিল ওটা।
বোর্হেস: আচ্ছা, আমি একটা গল্প লিখি, আর আপনি সেটা অনেকবার পড়েন, তাই না? এইভাবে, গল্পটা আমার চেয়ে আপনারই বেশি। আপনি আমার চেয়ে বেশি সময় দিয়েছেন। ব্যাপারটা কৌতূহলজনক, আমি সেগুলো লিখি কিন্তু সেগুলো আর পড়ি না। ব্যাপারটা আমাকে মহান মেক্সিকান লেখক আলফোনসো রেয়েসের সঙ্গে আমার একটা কথোপকথনের কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি আমার প্রতি খুব সদয় ছিলেন। প্রতি রোববার তখন মেক্সিকান দূতাবাসে যেতাম [যখন তিনি আর্জেন্টিনায় মেক্সিকান রাষ্ট্রদূত ছিলেন] তাঁর সঙ্গে ডিনার করতাম। ডন আলফোনসো সেখানে থাকতেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর স্ত্রী এবং ছেলে। আমরা আসলে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে কথা বলতাম। তিনি একবার আমাকে বলেছিলেন, ‘আমরা বই প্রকাশ করি কেন?’ আমি বললাম, ‘আমিও প্রায়ই নিজেকে একই প্রশ্ন করি। পৃথিবীতে কেন?’ তিনি বললেন, ‘আমার মনে হয় আমি সমাধান খুঁজে পেয়েছি।’ ‘কী সমাধান?’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, ‘ভুল সংশোধন করতে আমাদের পুরো জীবন ব্যয় না করার জন্যই আমরা বই প্রকাশ করি।’ আমি তাঁর সঙ্গে একমত হই। যদি আমি একটা বই প্রকাশ করি, তাহলে সেই কাজ সেখানে শেষ। এরপর অন্য কাজ শুরু করতে পারি।
এটা আমাকে মনে করিয়ে দেয়...
বোর্হেস: যেহেতু আমি যা প্রকাশ করি, তা সবই মোটামুটি খসড়া, কারণ প্রতিটি লেখাই সংশোধনযোগ্য। অনির্দিষ্টকালের জন্য।
প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত?
বোর্হেস: এখন দেখুন, আমার মতে, যখন কেউ বই প্রকাশ করে, তখন সে প্রকাশিত আকারে লেখার ওপর নিজেকে সমর্পণ করে দেয়। যদি দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়, তখন অবশ্যই, সে এটা সংশোধন করার চেষ্টা করবে।
যেটা বলছিলাম, এটা আমাকে মনে করিয়ে দেয়...লেখাকে ভুলে যাওয়ার জন্যই বই প্রকাশনা। অন্য কাজে ইনভলভ হওয়ার জন্য প্রকাশনা। আমার বিশ্বাস, আপনিই কোথাও বলেছিলেন, কেন একজন পুরুষ কোনো নারীর সঙ্গে প্রেম করে: যেন তাকে ভুলে যেতে পারে। আপনি এই ভুলে যাওয়ার সঙ্গে লেখাকে ভুলে যাওয়া সমান্তরাল চোখে দেখেন?
বোর্হেস: হ্যাঁ। কিন্তু, স্বাভাবিকভাবেই, যদি মহিলাটি পুরুষের ভালোবাসার প্রতিদান না দেয়, যদি পুরুষের ভালোবাসা অপূর্ণ থাকে, তাহলেই তো পুরুষটি তার কথা ভাবতে থাকে। কিন্তু যদি মেয়েটা তাকে কিছুটা মনোযোগ দেয়... হ্যাঁ, ধারণাগুলো অবশ্যই সমান্তরাল।
প্রথম স্বপ্নে ‘দ্য সিক্রেট মিরাকল’-এ ফিরে যেতে—
বোর্হেস: কিন্তু, স্বপ্ন একটাই...।
না, প্রথম স্বপ্নটি ভারতের মানচিত্রের সঙ্গে তো নয়। ওটা এমন একটা স্বপ্ন যেখানে হ্লাদিক ‘কোনো বৃষ্টিবহুল মরুভূমির মধ্য দিয়ে দৌড়াচ্ছেন’, দাবা খেলায় তার পদক্ষেপের জন্য সময়মতো পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন।
বোর্হেস: ওহ, হ্যাঁ, অবশ্যই। এখন মনে পড়ছে। হ্যাঁ, হ্যাঁ।
আপনি খেলাটিকে দুই ব্যক্তি নয়, বরং দুটি মহান পরিবারের খেলা বলে বর্ণনা করছেন। আর স্বপ্নে হ্লাদিক দাবার নিয়ম ভুলে গেছে।
বোর্হেস: আহ, হ্যাঁ, হ্যাঁ। কিন্তু আমি নিশ্চিত নই যে [দাবার স্বপ্ন] সেই গল্পে [‘দ্য সিক্রেট মিরাকল’] ছিল কি না।
হ্যাঁ, ‘দ্য সিক্রেট মিরাকল’ এই স্বপ্ন দিয়ে শুরু হয়। গল্পের প্রথম বাক্যটাই এই স্বপ্নের বর্ণনা দেয়।
বোর্হেস: হ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। বিভিন্ন প্রজন্ম থাকে এবং একটা নির্দিষ্ট প্রজন্মের প্রতিটা ব্যক্তি একটা পদক্ষেপ নেয়। তাই... হ্যাঁ, অবশ্যই আমি সেই স্বপ্নটি রেখেছি, কারণ এটা মূল কাহিনির বিপরীত। প্রথমে, আমাদের একটা দাবা খেলা আছে এবং বেশ কয়েকটা প্রজন্ম। তারপর, একটা নাটক লেখা যা মাত্র এক মিনিট স্থায়ী হয়। সেই কারণেই আমি একে গল্পে রেখেছি। পুরো ধারণার মধ্যে সেই বৈপরীত্যটা অর্জন করার জন্য, একটা খেলা যা কয়েক প্রজন্মের চেয়ে বেশি সময় স্থায়ী হয়। হ্যাঁ। ঠিক তাই। কিন্তু, আপনি কি নিশ্চিত যে এটা একই গল্পের?
ওহ, হ্যাঁ। ‘দ্য সিক্রেট মিরাকল’ শুরু হয় সেই স্বপ্ন দিয়ে।
বোর্হেস: হ্যাঁ। অবশ্যই, একই গল্প থেকে হতে হবে। একই গল্প থেকে হতে হবে, কারণ যদি না হয়—
হ্লাদিকই সেই ব্যক্তি যিনি এটা স্বপ্নে দেখেন।
বোর্হেস: হ্যাঁ, হ্যাঁ। এটা প্রাগে ঘটে। আমি জার্মানের [কাল্পনিক জুলিয়াস রোথ] কথা উল্লেখ করেছি, তাই সে শোপেনহাওয়ার, রিখটার, নোভালিস, শিলার...হ্যাঁ পড়তে পারত।
স্বপ্নে সময় পরিচালনা এবং গল্পে এর কার্যকারিতার মধ্যে পার্থক্য ছাড়াও, স্বপ্নের দাবা খেলাটিকে কি ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যক্তির পরিবর্তে জাতির বিরুদ্ধে জাতির যুদ্ধের প্রতীক হিসেবে ভাবা সম্ভব?
বোর্হেস: হ্যাঁ, যদি আপনি চান। হ্যাঁ। তবে যুদ্ধ দাবা খেলার চেয়ে কম আকর্ষণীয়।
মানুষ আপনাকে পড়ে শোনায়?
বোর্হেস: আমি আর কী করতে পারি? যদি আমি পড়তে না পারি, তাহলে লিখতেও পারি না। অক্ষরগুলো একসঙ্গে মিলে যায়। আর কোনো উপায় নেই। নিজেকেই ত্যাগ করতে হয়। ত্যাগ স্বীকার করা সহজ। জন্মের পর থেকেই আমি ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলছিলাম, যার ফলে জীবন আমার কাছে ধীর গোধূলি, একটা দীর্ঘ গ্রীষ্মের গোধূলি। জীবনে এমন কোনো নাটকীয় মুহূর্ত ছিল না যে হঠাৎ করে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। বরং ধীরে ধীরে, সবকিছু ধীরে ধীরে আমার দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ঠিক আমার গল্পের মানুষদের মতো, যাদের আমি ভুলে গেছি। কী যে ভাগ্য আমার!