ঋত্বিক ঘটকের সাক্ষাৎকার

‘শিল্পী হিসেবে বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততায় বিশ্বাস করি’

১৯৬৭ সালে ঋত্বিক ঘটকের এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় যা ‘মুভি মন্টেজ ভলিউম ১’ এবং ‘নম্বর ২’-এ প্রকাশিত হয়। ১৯৬২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ঋত্বিক ঘটক যেসব সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তা ‘ফেস টু ফেস আ কনভারসেশন উইথ দ্য মাস্টার’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এতে তাঁর মোট ১৮টি সাক্ষাৎকার রয়েছে। গ্রন্থটি সংকলন করেছেন শিবাদিত্য দাশগুপ্ত, সম্পাদনা করেছেন সন্দিপন ভট্টাচার্য। এটি ‘সিনে সেন্ট্রাল কলকাতা’ ও ‘মনচষা ২০০৩’-এ প্রকাশিত হয়।

 আলাপচারিতা: সুনীত সেনগুপ্ত
 অনুবাদ: খান মো. রবিউল আলম

প্রশ্ন:

‘নাগরিক’ ছিল আপনার প্রথম ছবি। বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শকেরা এটি দেখার সুযোগ পাননি, কারণ এটি মুক্তি পায়নি। এই উৎসবে আমরা যেসব চলচ্চিত্র প্রদর্শন করব, তার মধ্যে এটিও থাকবে। চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই।

ঋত্বিক ঘটক: আমি ১৯৫০-৫১ সালে ‘নাগরিক’–এর জন্য চিত্রনাট্য লিখি এবং ১৯৫৩ সালের শুরুর দিকে এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করি। সে সময় কোনো নির্মাতার ছবিই বাস্তবসম্মত ছিল না। এমন বাস্তবতায়, চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য আমি একটি ভালো বিষয় বেছে নিয়েছিলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনের সংকট বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরার এটাই ছিল প্রথম প্রয়াস। একটু স্বস্তির সন্ধানে একজন আত্মবিশ্বাসী নাগরিকের জীবনযাত্রার ওপর এই চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।

কারিগরি দিক থেকে চলচ্চিত্রটি খুব উঁচুমানের ছিল না। হয়তো আজকের দিনের বোদ্ধা দর্শকেরা চলচ্চিত্রটির কিছু বিষয় অপছন্দ করতে পারেন। যেমন চলচ্চিত্রের সাউন্ডট্র্যাক ও মেকআপ ছিল ভয়ংকর। তা সত্ত্বেও আমার কাছে এর বিষয়বস্তুর প্রাসঙ্গিকতা এখনো রয়েছে।

একটি ছোট ছেলে স্বপ্ন দেখেছিল, সে জীবনে উন্নতি করবে। সে চাকরির জন্য একের পর এক সাক্ষাৎকার দিচ্ছিল। সে প্রতিবার হতাশ হয়ে ফিরে আসে। কিছুটা হতোদ্যম হলেও আশা ছাড়েনি। ছেলেটি অনুভব করে, সামনে হয়তো ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। কিন্তু পরে বুঝতে পারে যে সামনে কোনো আশার আলো নেই। বিদ্যমান সামাজিক কাঠামোতে এ আশা সম্ভব নয়। কারণ, আমরা মধ্যবিত্ত শ্রেণি সব সময় এ রকম অর্থনৈতিক দুরবস্থার ভেতর থাকব, কখনোই এ থেকে বের হয়ে আসতে পারব না। এই উপলব্ধির মধ্য দিয়ে গল্পটি শেষ হয়।

একজন সৎ শিল্পীকে সমাজের অংশ হতে হবে। তাঁকে অনেক মানুষের সংগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে এবং সংগ্রামের অংশ হতে হবে। দ্রুত পরিবর্তনশীল সামাজিক পরিস্থিতি ও আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বজায় না রেখে কোনো শিল্পীর পক্ষে ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব নয়।
ঋত্বিক ঘটক

ছবিতে ছেলেটির একজন প্রেমিকা ছিল। চূড়ান্ত পরিণতি ছাড়াই সম্পর্কটি চলতে থাকে। শেষাবধি তারা একে অপরের সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করে। সম্পর্কটির বয়স সাত/আট বছরের হলেও ছেলেটি প্রেমিকাকে বিয়ে করতে পারছে না, কারণ তার চাকরি নেই। চাকরি ছাড়া কাজের কোনো সুযোগ নেই। আর আয়রোজগার ছাড়া বিয়ে করা সহজ নয়। তারপরও ছেলেটিকে বাঁচতে হয়েছিল। অবশেষে ছেলেটি মেয়েটিকে বিয়ে করে। এর পেছনে কাজ করেছিল, তারা একসঙ্গে হলে আরও বেশি কাজ করতে পারবে, আরও শক্তি অর্জন করতে পারবে। গল্পের কাঠামোর মধ্যে আমি বাংলার নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির অবক্ষয় ধরার চেষ্টা করেছি। আমি বিশ্বাস করি, এ বাস্তবতা এখনো বিদ্যমান।

ঋত্বিক ঘটকের ‘নাগরিক’ (নির্মাণ ১৯৫২; মুক্তি ১৯৭৭) চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন:

আধুনিক দর্শকের বিচ্ছিন্নতা ও নির্মাতার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?

ঋত্বিক ঘটক: একজন শিল্পী হিসেবে এটা সত্যি যে আমি বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততায় বিশ্বাস করি। আমি মনে করি, চলচ্চিত্র নির্মাণের সময় আশপাশের মানুষের স্পন্দন অনুভব করা গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে ছবি বানানোর কোনো মানে হয় না। একজন সৎ শিল্পীকে সমাজের অংশ হতে হবে। তাঁকে অনেক মানুষের সংগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে এবং সংগ্রামের অংশ হতে হবে। দ্রুত পরিবর্তনশীল সামাজিক পরিস্থিতি ও আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক বজায় না রেখে কোনো শিল্পীর পক্ষে ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব নয়।

ঋত্বিক ঘটক (জন্ম: ৪ নভেম্বর ১৯২৫—মৃত্যু: ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬)
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

আমি বিশ্বাস করি, বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততা প্রত্যেক শিল্পীর কর্তব্য ও প্রয়োজনীয় দিক। শিল্পীর শিল্পকর্মের বিষয় সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারণা থাকতে হবে, বিষয়টি তাঁর জানাশোনার অন্তর্গত না হলে অভিব্যক্তি স্বতঃস্ফূর্ত হবে না, খাঁটি হবে না। এ ছাড়া কোনো কিছুর সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত না হলে সেটাকে ঘৃণা করা বা ভালোবাসা সম্ভব নয়। কোনো কিছু দৃঢ়ভাবে শিল্পে তখনই প্রকাশ করা সম্ভব, যখন তার সঙ্গে শিল্পীর আবেগ জড়িত থাকে। তবেই দর্শকদের অন্য সব বিষয় থেকে বিচ্ছিন্ন করে শিল্পের বিষয়ের মধ্যে প্রবেশ করানো সম্ভব। শিল্পের বিষয়ের সঙ্গে দর্শকদের সংযোগ প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁদের অন্য বিষয়গুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

আমার চলচ্চিত্র শিশুকথন নয়, যেখানে একটি ছেলে একটি মেয়ের প্রেমে পড়বে, তারা শুরুতে এক হতে পারবে না, কষ্ট পাবে, পরে তারা এক হবে বা কেউ বা আনন্দে একটা পাতিলে লাথি মারবে। বা যখন মিলিত হবে তখন কাঁদতে বা হাসতে থাকবে এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে তা ভুলে যাবে। ঘরে ফিরে তারা হাসি–তামাশা করবে, খাবে এবং ঘুমাবে—আমি দর্শকদের এ ধরনের বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তাদের বোকা বানাতে চাই না। এ ধরনের নিম্নমানের সিনেমা বানাতে চাই না। যেসব বিষয় দর্শককে স্পর্শ করবে না, এমন কাজের সঙ্গে আমি নেই।

প্রতিমুহূর্তে আমি দর্শকদের ঝাঁকুনি দিতে চাই, যাতে তাঁরা অনুভব করেন, আমি তাঁদের সস্তা বিনোদন দিতে আসিনি, যার কোনো বাস্তব কল্পচিত্র তৈরি হয় না। আমি দর্শকদের মাথায় বিষয়বস্তু গেঁথে দিতে চাই যাতে তাঁরা চোখের সামনে একটি কাল্পনিক গল্পের ছবি দেখতে পান এবং উপলব্ধি করেন, আমি কী বলার চেষ্টা করছি। আমার বিষয়টি যে বাস্তব, তা যেন ধরতে পারেন। সিনেমার বিষয়ের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণের জন্য আমি দর্শকদের অন্য সব বিষয় থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করতে চাই।

আমি বিশ্বাস করি, বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততা প্রত্যেক শিল্পীর কর্তব্য ও প্রয়োজনীয় দিক। শিল্পীর শিল্পকর্মের বিষয় সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ ধারণা থাকতে হবে, বিষয়টি তাঁর জানাশোনার অন্তর্গত না হলে অভিব্যক্তি স্বতঃস্ফূর্ত হবে না, খাঁটি হবে না।
ঋত্বিক ঘটক

দর্শক যদি সচেতন হন, তাহলে চলচ্চিত্র দেখার পর সামাজিক অসংগতি বা নেতিবাচক বিষয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে উদ্যোগী হবেন। আমি যদি আমার প্রতিবাদী মনোভাব দিয়ে দর্শককে অনুপ্রাণিত করতে পারি, তাহলেই আমি একজন সফল শিল্পী।

যাহোক, এটাই হলো শিল্পীর বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া এবং দর্শকদের সিনেমার বাইরে অন্যান্য অনুষঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন করার ব্যাপার। আমি একটি বিষয়বস্তু তুলে ধরার জন্য কিছু কাল্পনিক পরিস্থিতি ও চরিত্র স্থির করি, যাতে দর্শক সঠিকভাবে বিষয়টি বিচার ও মূল্যায়ন করতে পারেন। দর্শক যদি সিনেমার বিষয়ের সঙ্গে একমত হন, তাহলে পরিস্থিতি বদলের চেষ্টা করবেন। এটাই হলো সব আধুনিক শিল্পের মূল কথা।

প্রশ্ন:

আপনি আগে লিখেছিলেন যে ‘লা দলচে ভিতা’র প্রশংসা করার জন্য মিকেলেঞ্জেলোর ভাস্কর্য সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান থাকতে হবে। আপনি কি মনে করেন, শিল্পের অন্যান্য শাখার সমালোচক বা ভোক্তাদের চেয়ে সিনেমা সমঝদার বা সমালোচকদের বেশি কিছু দায়িত্ব পালন করতে হয় কি?

ঋত্বিক ঘটক: ‘উম্‌ব্রিয়ান অ্যাঞ্জেল’ নামে পরিচিত মিকেলেঞ্জেলো বউনারোতির কিছু বিখ্যাত ম্যুরাল রয়েছে। ছবিতে ছোট্ট মেয়ে ফেলিনি ও উম্‌ব্রিয়ান দেবদূতের মধ্যে একটি মিল আনার চেষ্টা করেছিলেন। ক্রস-রেফারেন্সের মাধ্যমে দর্শক বুঝতে পারেন যে কীভাবে মেয়েটি অন্ধকারে অন্য সব প্রাণী থেকে আলাদা একটি খুঁটি হয়ে অন্য সবকিছুর বিপরীতে দাঁড়িয়ে গেল। এভাবেই চলচ্চিত্রটি দর্শকের ইন্দ্রিয়ের ভেতর ঢুকে পড়ে।

না, চলচ্চিত্র সমালোচকদের বাড়তি কোনো দায়িত্ব থাকে না। শিল্পের সব শাখার সমালোচকদের দায়িত্ব একই রকম। যেমন জাপানি চলচ্চিত্র ‘সেভেন সামুরাই’-এর সমালোচক যদি সেই সময়ের জাপানের অবস্থা, এর সামাজিক ইতিহাস ও সামুরাইদের জীবনধারা সম্পর্কে না জানেন, তাহলে তিনি চলচ্চিত্রটি নিয়ে কি সমালোচনা করতে পারেন? বার্গম্যানের ‘ভার্জিন স্প্রিং’ দেখার আগে দ্বাদশ শতাব্দীর সুইডেনের ইতিহাস সম্পর্কে জানাশোনা থাকাটা দরকার।

ইতালীয় নির্মাতা ফেদেরিকো ফেলিনির ‘লা দলচে ভিতা’ (১৯৬০) চলচ্চিত্রের শেষ দৃশ্য

আপনি যদি সমালোচক হতে চান, তাহলে আরও বেশি বোঝাপড়া প্রয়োজন। ইউরোপের অন্য অনেক দেশের তুলনায় অনেক পরে সুইডেন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেছে। সুইডেন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করার আগে সেখানে ভাইকিং দর্শন প্রভাবশালী ছিল। সুইডেনে পা রাখার জন্য খ্রিষ্টধর্মকে পৌত্তলিক দর্শনের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে। এই থিমের ওপর বেশ কয়েকটি ব্যালেড রচিত হয়েছে। ভাইকিং দর্শন, পৌত্তলিক দর্শন ও খ্রিষ্টধর্মের মধ্যে বিরোধের কারণগুলো না জানলে চলচ্চিত্রের মূল ভাবগত দিক নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব কি?

বিদেশি সমালোচকেরা ‘অপরাজিতা’ সিনেমার আন্তরিক প্রশংসা করেছেন। ছবিতে প্রজাপতির যে প্রতীকী উপস্থাপনা, তারা কি এর অর্থ ধরতে পেরেছেন? উপনিষদে বলা হয়েছে, যার ওপর প্রজাপতির প্রভাব পড়ে, তার সন্ন্যাস জীবন লাভের সম্ভাবনা থাকে। বিদেশি সমালোচকেরা কি প্রজাপতির ব্যবহার ধরতে পেরেছেন? আমার মনে হয় না, তাঁরা তা ধরতে পেরেছেন।

শিল্প সমালোচকের কাজ কেবল চলচ্চিত্র বা এর কয়েকটি দৃশ্যের প্রশংসা করা নয়। সমালোচকদের কর্তব্য চলচ্চিত্রের গভীরে প্রবেশ করা। চলচ্চিত্রের শেকড় একটি দেশের ইতিহাস ও সমাজের গভীরে প্রোথিত, যার ভিত্তিতে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। দেশ, সেখানকার মানুষ ও সমাজ সম্পর্কে ধারণা না থাকলে কীভাবে চলচ্চিত্র নিয়ে সমালোচনা করা যাবে?

সুইডিশ নির্মাতা ইঙ্গমার বার্গম্যানের 'দ্য ভার্জিন স্প্রিং' (১৯৬০) চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

যেমন বিদেশি সমালোচকেরা ‘অপরাজিতা’ সিনেমার আন্তরিক প্রশংসা করেছেন। ছবিতে প্রজাপতির যে প্রতীকী উপস্থাপনা, তারা কি এর অর্থ ধরতে পেরেছেন? উপনিষদে বলা হয়েছে, যার ওপর প্রজাপতির প্রভাব পড়ে, তার সন্ন্যাস জীবন লাভের সম্ভাবনা থাকে।। সন্ন্যাস লাভ করলে কেউ বাড়ি বানাতে পারে না। বিভূতিবাবুর বেশির ভাগ গল্পে প্রজাপতি দেখানো হয়েছে। ছবিতে অপু জলের ভেতর নিজের প্রতিবিম্ব দেখে আশ্চর্য হয়। এতে অপুর যে অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয়েছে, তা সন্ন্যাস জীবনের ইঙ্গিত বহন করে। বিদেশি সমালোচকেরা কি প্রজাপতির ব্যবহার ধরতে পেরেছেন? এর গভীরতা স্পর্শ করতে পেরেছেন? উপনিষদে প্রজাপতি কী দার্শনিক প্রতীক, তা উপলব্ধি করা সম্ভব। আমার মনে হয় না, তাঁরা তা ধরতে পেরেছেন।

শিল্প সমালোচকের কাজ কেবল চলচ্চিত্র বা এর কয়েকটি দৃশ্যের প্রশংসা করা নয়। সমালোচকদের কর্তব্য চলচ্চিত্রের গভীরে প্রবেশ করা। চলচ্চিত্রের শেকড় একটি দেশের ইতিহাস ও সমাজের গভীরে প্রোথিত, যার ভিত্তিতে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। দেশ, সেখানকার মানুষ ও সমাজ সম্পর্কে ধারণা না থাকলে কীভাবে চলচ্চিত্র নিয়ে সমালোচনা করা যাবে?
ঋত্বিক ঘটক

জর্জ সাদুল আমাকে ‘সুবর্ণরেখা’ ব্যাখ্যা করতে বলেছিলেন, কারণ, ইউরোপে পার্টিশনের কোনো দহন নেই। আমরা কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের তীব্রতা বুঝতে পারি? তাই ‘অ্যাশেজ ও ডায়মন্ড’ বোঝার জন্য আমরা পোল্যান্ডের পুরো ইতিহাস পড়ি।

প্রশ্ন:

শুরুতে আপনি নাটকের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। পরে আপনি চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। এর পেছনে আসল কারণ কী?

ঋত্বিক ঘটক: গণনাট্য সংঘ আন্দোলনের সঙ্গে শুরুর দিনগুলোয় আমি গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম। আগে অভিনয় করতাম। আমি চলচ্চিত্রে কীভাবে এলাম? শুরুতে গল্প লিখতাম। আমি দেখেছি, গল্প বা কবিতা মানুষকে সরাসরি প্রভাবিত করে না। এগুলোর প্রভাব বেশ দূরবর্তী। তাই আমি মঞ্চনাটকের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলাম। আমি দুই হাজার, পাঁচ হাজার মানুষকে উত্তেজিত করব, যাঁদের আমি দর্শক হিসেবে পাব। আমি ভেবেছিলাম, তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হবে। পরে আমি বুঝতে পারলাম যে চলচ্চিত্র আরও বেশি শক্তিশালী মাধ্যম। এটি আরও বেশি মানুষের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। আমি যা বলতে চাই, তার তাৎক্ষণিক ও জরুরি প্রভাব পড়বে। সেই বিবেচনায়, চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে আমার কাছে এক আদর্শ মাধ্যম।

প্রশ্ন:

এখন আপনার পুরোনো একটি ছবি নিয়ে আলোচনা করতে চাই। আপনার অন্যান্য চলচ্চিত্রের তুলনায় ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ একটি ভিন্ন ধরনের ছবি। যদিও এটি কলাকৌশলের দিক থেকে পরীক্ষামূলক, তবে এর বিষয়বস্তু ভিন্ন কিছু নয়। চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে আপনার মতামত কী?

ঋত্বিক ঘটক: হ্যাঁ, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ অন্যান্য ছবি থেকে আলাদা। এটি শহরের একটি শিশুর দৃশ্য। তাই আমি এখানে একটি ভিন্ন ধরনের লেন্স ব্যবহার করেছি। হ্যাঁ, আমি এর প্রযুক্তিগত দিকে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছি। কিছু সময়ের জন্য সাউন্ডট্র্যাকটি বিশেষ উপায়ে বাজিয়েছি। যেমন আমি একটি নির্দিষ্ট গতিতে গান রেকর্ড করেছি। তবে এটি চলচ্চিত্রে ব্যবহার করার সময় আসল গতির চেয়ে প্রায় তিন গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। লং ফোকাসে ৩০০ মিমি লেন্স ব্যবহার করে ছবি নিয়েছি। ফলে ছবিতে দেখা যাবে গাড়ি ও চাকা চললেও যানবাহন চলেনি। এটি দর্শকদের কাছে অসাধারণ মনে হবে। আবার কখনো কখনো আমি ইচ্ছাকৃতভাবে ১৮ মিমি লেন্স ব্যবহার করে বিষয়বস্তুগুলো ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছি (বিকৃত) যাতে বিষয়গুলোর প্রতি ছোট ছেলেটির মনোকল্পনা প্রকাশ পায়।

আমি চলচ্চিত্রে কীভাবে এলাম? শুরুতে গল্প লিখতাম। আমি দেখেছি, গল্প বা কবিতা মানুষকে সরাসরি প্রভাবিত করে না। তাই আমি মঞ্চনাটকের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছিলাম। পরে আমি বুঝতে পারলাম যে চলচ্চিত্র আরও বেশি শক্তিশালী মাধ্যম। এটি আরও বেশি মানুষের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।

আমি বাজ পাখিকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছি। ছবিতে ছেলেটির হতাশা দেখা যাবে। ক্যামেরায় একটি বাজ পাখি দেখা যাবে যে নিচে পড়ে গেছে। এটি দর্শকদের সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘চিল’ কবিতার কথা মনে করিয়ে দেবে। এটি ক্রস-রেফারেন্সের ব্যবহার। ছবিটির শেষে আমি একজন কুলিকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলতে বাধ্য করেছিলাম, ‘এটি একটি যুদ্ধক্ষেত্র; কলকাতা শহরে কোনো দয়া বা বিবেচনা নেই। কথা হলো, এখানে জায়গা হবে না। বাড়ি ফিরে যাও।’

আরও পড়ুন

চিত্রনাট্য প্রস্তুত। যদি সুযোগ পাই, তাহলে ছবিটা করব। প্রমথেশ বড়ুয়ার ভূমি গৌরীপুরের শিকারিদের জীবন নিয়ে আমি একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চাই। এটি আমার নিজের গল্পের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হবে। আসুন, দেখি কী হয়, কারণ সবকিছুই আমাদের প্রযোজকদের ওপর নির্ভর করে।

আরও পড়ুন

‘বগলার বঙ্গদর্শন’ হালকা মেজাজের একটি চলচ্চিত্র। আমি ইতালীয় লেখক ব্লাসেটির একটি গল্প নিয়েছি। অনেক কাজই শেষ করে ফেলেছি। বাকি অংশটি বিভিন্ন কারণে শেষ হয়নি। যাহোক, আমি এটি সম্পূর্ণ করতে চাই।