মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রমের সাক্ষাৎকার

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছাইচাপা দিয়ে রাখা যাবে না

মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বীর বিক্রম খেতাব পান। তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য। মুক্তিযুদ্ধের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে

প্রশ্ন:

১৯৭১ সালে আপনি প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। আপনার রেজিমেন্টের বিদ্রোহ ও মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার গল্পটা বলবেন কি?

মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ: ১৯৭১ সালে আমি যশোর ক্যান্টনমেন্টে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়নে কর্মরত ছিলাম। তখন আমার চাকরির বয়স মাত্র আড়াই বছর। ফুটবল খেলার কারণে অনেক সময়ই সেনাদল থেকে বাইরে থাকতাম। পাকিস্তান জাতীয় দল ও সেনাবাহিনী দলের হয়ে বিদেশে কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানে খেলাধুলা নিয়ে থাকতাম। একাত্তরের ১৬ মার্চ পর্যন্ত আমি পাকিস্তানের মুলতান শহরের জাতীয় ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করেছিলাম। টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার পর যশোরে আমার কর্মস্থলে ফিরে আসি।

পশ্চিম পাকিস্তানে থাকার কারণে আমি শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ বা অসহযোগ আন্দোলনের ঘটনা জানতে পারিনি। ফিরে আসার পর দেখি, মানুষ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ এবং উত্তেজিত। তখন শীতকালীন মহড়া চলছিল, আমাকে সীমান্ত এলাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনারা সবাই বাঙালি, কিন্তু কর্মকর্তাদের মধ্যে বাঙালি–পাঞ্জাবি–পাঠানের মিশ্রণ ছিল। সীমান্ত এলাকায় মহড়ায় থাকার কারণে এসব বিষয়ে আমি জানতে পারিনি। ২৫ মার্চ হত্যাযজ্ঞ শুরু হলো। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল যশোরের সীমান্ত এলাকায় থাকায় বাইরের জগৎ থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন ছিলাম। ২৯ মার্চ আমাদের ক্যান্টনমেন্টে ডেকে পাঠানো হলো। এর মধ্যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চারটি ব্যাটালিয়ন বিদ্রোহ করেছে। সেনা কর্তৃপক্ষ ধারণা করেছিল, প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টও বিদ্রোহ করবে। গভীর রাতে আমরা ক্যান্টনমেন্টে ফেরত আসি। ৩০ মার্চ সকাল সাড়ে সাতটার দিকে ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার সরদার আবদুর রহিম দুররানি এসে আমাদের নিরস্ত্র করার আদেশ দিলেন। এ খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সৈনিকেরা দাবানলের মতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিদ্রোহ করে। অস্ত্রাগার ভেঙে অস্ত্রশস্ত্র বের করে। পাশে পাঞ্জাবি সৈনিকদের একটি ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানি ছিল। আমাদের সৈনিকেরাই প্রথম সেখানে গুলিবর্ষণ শুরু করে।

কমান্ডিং অফিসারের কাছে গিয়ে বললাম, ‘স্যার, আমাদের সৈনিকেরা তো বিদ্রোহ করেছে। আমরা এখন কী করব?’ তিনি কোনো নির্দেশই দিতে পারলেন না। আমি বাইরে এসে খানিকক্ষণ চিন্তা করে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার বয়স তখন ২৭ বছর। অবিবাহিত, কোনো পিছুটান নেই।
মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আনোয়ার
ছবি: সংগৃহীত

পাকিস্তানিরা বিদ্রোহের জন্য প্রস্তুত ছিল। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে তারা আমাদের ওপর আক্রমণ চালানো শুরু করে। সে সময় আমার কমান্ডিং অফিসার ছিলেন একজন বাঙালি, লেফটন্যান্ট কর্নেল রেজাউল জলিল। তার পরেই ছিলাম আমি। এরপর ছিলেন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আনোয়ার হোসেন। সেনারা সবাই আমাকে ঘিরে ধরে বলতে থাকে, আমি যেন বিদ্রোহে যোগ দিই। আমি আমার কমান্ডিং অফিসারের কাছে গিয়ে বললাম, ‘স্যার, আমাদের সৈনিকেরা তো বিদ্রোহ করেছে। আমরা এখন কী করব?’ তিনি অত্যন্ত নার্ভাস হয়ে অশ্রু বিসর্জন করতে শুরু করেন। কোনো নির্দেশই দিতে পারলেন না। আমি বাইরে এসে একটা থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে চিন্তা করলাম, এখন কী করব? খানিকক্ষণ চিন্তা করে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার বয়স তখন ২৭ বছর। অবিবাহিত, কোনো পিছুটান নেই। সৈনিকদের একত্র করে জানিয়ে দিলাম, এখন থেকে এই যুদ্ধে আমি কমান্ডার। বিশৃঙ্খল কিছু করা যাবে না। যশোর ক্যান্টনমেন্টে সেদিন আট ঘণ্টা যুদ্ধ হয়। শত্রুর পাঁচ-ছয়টি আক্রমণ আমরা প্রতিহত করি। একসময় সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আনোয়ার হোসেনকে ডেকে নিয়ে আসি। তিনি বিদ্রোহে যোগ দেন। বিকেলের দিকে মেশিনগানের গুলিতে তিনি শহীদ হন।

বিদ্রোহ পরিকল্পিত ছিল না বলে আমাদের কাছে যথেষ্ট গোলাবারুদ ছিল না। গোলাবারুদ শেষ হয়ে আসায় বিকেলের দিকে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাদের ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে যেতে হবে। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আমরা থেকে বেরিয়ে যেতে থাকি। সে সময় পাকিস্তান সেনারা গুলিবর্ষণ করে। আমাদের কয়েকজন সৈনিক হতাহত হন। আমাদের পাল্টা গুলিতে কিছু শত্রুও হতাহত হয়।

যশোর ক্যান্টনমেন্টের পাশের গ্রাম খিতিবদিয়া। আমরা সেই গ্রামে প্রবেশ করলে হাজার হাজার মানুষ দা, খন্তা, কুড়াল হাতে জয় বাংলা ও নারায়ে তাকবির স্লোগান দিয়ে আমাদের জড়িয়ে ধরল। গাছ থেকে ডাব পেড়ে খাওয়াল। তাদের কাছেই প্রথম জানতে পারলাম, দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

প্রশ্ন:

এর পরে কী হলো?

মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ: ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২০০ সৈনিককে নিয়ে আমরা বিদ্রোহ করি। যশোর-কুষ্টিয়া অঞ্চলে আমি মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করতে থাকি। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ করার সময় আমি উপস্থিত ছিলাম। কর্নেল এম এ জি ওসমানীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি ২০০ সৈনিকের সঙ্গে ৬০০ ছাত্র ভর্তি করে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে একটা পূর্ণাঙ্গ ব্যাটালিয়নে পরিণত করার কথা বললেন। পরবর্তী দুই দিনের মধ্যে যশোর, কুষ্টিয়া ও খুলনা থেকে ৬০০ ছাত্র ভর্তি করলাম। তাদের নিয়ে যুদ্ধ করে দুই মাস আমরা বেনাপোল শত্রুমুক্ত রাখতে সক্ষম হই। জুন মাসে প্রশিক্ষণের জন্য আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় মেঘালয়ের তেলঢালায়। সেখানে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল, তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল ও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল—তিনটি ব্যাটালিয়ন নিয়ে গঠিত হয় জেড ফোর্স। কমান্ডার হন মেজর জিয়াউর রহমান। দেড় মাস সেখানে নতুনদের প্রশিক্ষণ চলে। প্রশিক্ষণ শেষে তারা দুঃসাহসী যোদ্ধায় পরিণত হয়।

কেউ কেউ এ–ও বলতে চেষ্টা করে যে একাত্তরে জাতি ভুল করেছে। মুক্তিযুদ্ধে যারা পাকিস্তানিদের সমর্থন করেছে, তারা হীনম্মন্যতাবোধ থেকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন কথা বলছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছাইচাপা দিয়ে রাখা যাবে না। কারণ, এটা আমাদের সবচেয়ে বড় গৌরবময় উপাখ্যান।
মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ

জেড ফোর্স গঠিত হওয়ার পর আমরা জামালপুর জেলার কামালপুরসহ কয়েকটি শত্রুঘাঁটিতে আক্রমণ করি। এরপর আমাদের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া হয়। সিলেটে অনেকগুলো যুদ্ধে আমরা অংশ নিই। এর মধ্যে ২৮ নভেম্বর চারগ্রাম শত্রুঘাঁটির ওপর আক্রমণ করে তা দখল করি। শত্রুর অনেক গোলাবারুদ আমাদের হস্তগত হয়। ২৯ নভেম্বর জকিগঞ্জের গৌরীপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট আমাদের ওপর আক্রমণ চালায়। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে পাল্টা আক্রমণ করে। যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কমান্ডার মেজর সারোয়ারসহ ৮০ জন নিহত হয়। তুমুল যুদ্ধের পর আমরা ৩২ জনকে জীবিত অবস্থায় বন্দী করি। এতে শত্রুর মনোবল ভেঙে যায়, তারা সিলেটের দিকে পিছু হটতে শুরু করে।

জিয়াউর রহমান (১৯ জানুয়ারি ১৯৩৬—৩০ মে ১৯৮১)
প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

ডিসেম্বর মাসে মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে পরিকল্পনা করি, সিলেট দখলের কৃতিত্ব আমাদের নিতে হবে। আমরা অপ্রচলিত পথে হাওর ও চা–বাগানের মধ্য দিয়ে হেঁটে সিলেট এমসি কলেজের প্রিন্সিপালের বাসভবনের কাছে শত্রুর কাছাকাছি পৌঁছে যাই। উঁচু টিলায় অনেকগুলো বাংকার করে তারা শক্ত প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তুলেছিল। আমরা উল্টো দিকের টিলায় অবস্থান নিলাম। বাংকার খোঁড়ার আগেই আমাদের ওপর ভয়ংকর আক্রমণ শুরু হয়। শত্রুপক্ষের গোলায় আমাদের ১৮ জন শহীদ হন। আমরাও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলাম। আমরা ধরে নিয়েছিলাম, সেটাই আমাদের জীবনের শেষ দিন। আমাদের সঙ্গে বেতার সেটসহ একজন ভারতীয় মেজর ছিলেন। একপর্যায়ে আমাদের অনুরোধে ভারতীয় দুটি মিগ বিমান এসে পাকিস্তানি বাহিনীর বাংকারে ১৫ মিনিট ধরে রকেট নিক্ষেপ করতে শুরু করে। বাংকারগুলো তুলার মতো উড়ে যাচ্ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ৩০ মার্চ যশোর ক্যান্টনমেন্টে যে যুদ্ধ আমরা শুরু করেছিলাম, তার সফল পরিসমাপ্তি হলো ১৪ ডিসেম্বর সিলেটের এমসি কলেজ প্রাঙ্গণে। মুক্তিযুদ্ধে সিলেটই একমাত্র জেলা, মুক্তিবাহিনী যেটা একক প্রচেষ্টায় শত্রুমুক্ত করে।

প্রশ্ন:

মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পেছনে আপনাদের স্বপ্ন কী ছিল?

মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ: আমি যে ৬০০ ছাত্রকে রিক্রুট করেছিলাম, তার মধ্যে প্রায় ১০০ জন সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টেরও ১০০ সেনা শহীদ হয়েছিলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধ ছিল জাতির যুদ্ধ, কোনো দলের যুদ্ধ নয়। অনেক রক্ত আর ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। আমরা একটা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলাম। আমাদের ভোটের যেহেতু কোনো মূল্য ছিল না, তাই সবার মধ্যে স্বপ্ন ছিল যাতে নতুন দেশে প্রকৃত গণতন্ত্রের জাগরণ হয়। মানবিক মর্যাদা, সাম্য, সামাজিক সুবিচার অর্জনের জন্যই ছিল সেই যুদ্ধ। বাঙালি স্বাধীনচেতা জাতি। পাকিস্তানিরা ভেবেছিল, বাঙালিরা মাছ–ভাত খায়, তারা যুদ্ধ করতে পারবে না। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ একটি জনযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। একটা জাতির সঙ্গে যুদ্ধ করে কোনো সেনাবাহিনীর পক্ষেই বিজয়ী হওয়া সম্ভব নয়।

সাড়ে ১৫ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ তাদের দুঃশাসন আড়াল করার কারণে কিছু মানুষের মধ্যে একটা বিরোধী মনোভাব জেগে উঠতে পারে। আমি মনে করি, গত ১৬ মাসে এই বিরোধিতা অনেকটাই কেটে গেছে। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত নয়, পরিপূরক।
মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ
প্রশ্ন:

যে স্বপ্ন নিয়ে আপনারা মুক্তিযুদ্ধ করলেন, নতুন রাষ্ট্রে সেটা কতটা বাস্তবায়িত হতে পারল?

মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ: মোটেও নয়। মুক্তিযুদ্ধের পর পরপর আমরা কয়েকটি সামরিক শাসন দেখেছি। গণতান্ত্রিক পর্বে এসেও শেখ হাসিনার আমলে প্রতিটি নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা হলো। সামরিক শাসনের চেয়েও ভয়ংকর ছিল তাঁর শাসন। বিরোধীদের মতবাদকে স্তব্ধ করার জন্য যেভাবে হত্যা-গুম করা হয়েছে, সেটা অকল্পনীয়। দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তারা ধ্বংস করেছে। আওয়ামী লীগই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে।

প্রশ্ন:

নানা সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মুক্তিযুদ্ধকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে। শেখ হাসিনার আমলে তার চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের এই রাজনৈতিক ব্যবহারকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ: এটি খুবই নিন্দনীয়। শেখ হাসিনা জনগণকে বোঝাতেন যে তাঁর পিতা ও পরিবারের লোকেরা দেশ স্বাধীন করেছে। মুক্তিযুদ্ধকে আওয়ামী লীগ দলীয়করণ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে তারা বিকৃত করেছে। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রই বিকশিত হতে দেয়নি।

প্রশ্ন:

গত বছরের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানকে কোনো কোনো গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ: মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চিরভাস্বর থাকবে। আজকাল কেউ কেউ, বিশেষ করে সব সময় যারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে এসেছে—তারা বোঝানোর চেষ্টা করছে, মুক্তিযুদ্ধ কোনো ব্যাপার নয়। চব্বিশের অভ্যুত্থানকে তারা মুক্তিযুদ্ধের ওপরে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে দেশের সব মানুষ জীবনপণ করে জনযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। এর ব্যাপকতা ছিল অকল্পনীয়, অনুপ্রেরণা ছিল উচ্চতর। লাখ লাখ মানুষ এর জন্য জীবন দিয়েছে। কিছু স্বার্থান্বেষী মহল এত বড় একটা জনযুদ্ধকে আমলেই নিতে চায় না। কেউ সেকেন্ড রিপাবলিকের কথা বলে। কেউ কেউ এ–ও বলতে চেষ্টা করে যে একাত্তরে জাতি ভুল করেছে। মুক্তিযুদ্ধে যারা পাকিস্তানিদের সমর্থন করেছে, তারা হীনম্মন্যতাবোধ থেকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমন কথা বলছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছাইচাপা দিয়ে রাখা যাবে না। কারণ, এটা আমাদের সবচেয়ে বড় গৌরবময় উপাখ্যান। সাড়ে ১৫ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ তাদের দুঃশাসন আড়াল করার কারণে কিছু মানুষের মধ্যে একটা বিরোধী মনোভাব জেগে উঠতে পারে। আমি মনে করি, গত ১৬ মাসে এই বিরোধিতা অনেকটাই কেটে গেছে। একাত্তরে যেমন দেশের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল এবং শ্রেণি-পেশার মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছে, গত বছরের গণ–অভ্যুত্থানেও দল-মত-শ্রেণিনির্বিশেষে সব মানুষ সমর্থন দিয়েছে। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান মুক্তিযুদ্ধের বিপরীত নয়, পরিপূরক।