স্বাধীনতার পরও মানুষের ছবি আঁকায় নিষেধাজ্ঞা এসেছিল

বাংলাদেশের রিকশাচিত্রের ইতিহাসে রাজকুমার দাস আর কে দাস নামে বেশি পরিচিত। ২০২২ সালে তিনি মারা যান। তিনি বাংলাদেশের প্রথম যুগের রিকশাচিত্রী। ২০১৫ সালের এক সন্ধ্যায় নারিন্দার ঋষিপাড়ায় এই শিল্পীর বাড়িতে বসে কথাবার্তা হয়েছিল আর কে দাসের সঙ্গে। সেই আলাপনে উঠে এসেছিল রিকশাচিত্রের বিবর্তনসহ নানা প্রসঙ্গ। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন শাওন আকন্দ

আর কে দাসছবি: সংগৃহীত

শাওন আকন্দ: আপনার জন্ম ও বেড়ে ওঠা নারিন্দার ঋষিপাড়াতেই। যতটুকু জানি, আপনার পারিবারিক পেশা এটা ছিল না। আপনার নিজের ও মা-বাবার পরিচয় দিয়ে কথাবার্তা শুরু করতে পারি...।

আর কে দাস: আমার বাবার স্যান্ডেলের কারখানা ছিল। বাবাকে আমি তাঁর কাজে মাঝেমধ্যে সাহায্য করতাম। আর খুব সিনেমা দেখতাম। তখন কাগজ-কলম অত ছিল না। পেনসিল দিয়েই কাগজে ড্রয়িং করতাম। সে সময় আমার বয়স কত হবে? আনুমানিক ২০-২৫ বছর। সময়টা ছিল ১৯৫০ বা ১৯৫২ সাল।

শাওন: আপনার জন্ম কত সালে?

আর কে দাস: আমার জন্ম আনুমানিক ১৯৩৬ কিংবা ১৯৩৭ সাল হবে

শাওন: সেই সময়ে এখানে কোনো শিল্পী কি ছিলেন, যাঁদের দেখে আপনি ছবি আঁকতে আগ্রহী হয়েছিলেন?

আর কে দাস: ছিল, তখন গিরিন কাজ করত। আমি ছোট্ট ছিলাম। ওরা যেখানে সিনেমার ব্যানারট্যানার করত, ওইখানে আমি গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম।

শাওন: তখন তো ঢাকায় রিকশা বেশি ছিলও না।

আর কে দাস: পুরান ঢাকার শিংটোলায় সুনীল দাস নামের একজন আর্টিস্ট ছিলেন। তখন তাঁর আঁকা বোর্ড রিকশার মধ্যে দেখেছিলাম। তিনি দিলীপকুমার-সুরাইয়ার ছবি আঁকতেন। তখন আমি ফিল্মফেয়ার পত্রিকা কিনে পত্রিকায় সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের ছবি দেখে দেখে আঁকতাম। তখন আমার বাবা বললেন, ‘ভালোই তো আঁকিস। কোনো একটা রিকশার কারখানায় একটা বোর্ড নিয়ে যা। দেখ, তারা কী বলে।’ তো একটা রিকশা কারখানায় গেলাম। সেখানে তাঁরা বললেন, ‘তোমার হাত তো ভালোই, তবে সুনীলের মতো না। আচ্ছা, তুমি আমাদের এখানে কাজ করো। বোর্ড যদি ভালোভাবে করতে পারো, তোমাকে বোর্ডপ্রতি ৩ টাকা দেব।’

আমি কাজ শুরু করে দিলাম। ওখানে বসেই কাজ করতাম। প্রথম দিকে তেমন ভালো হতো না। কিন্তু রাত আটটা বা নয়টা বাজলেই তাঁরা আমাকে ৩ টাকা দিয়ে দিতেন

শাওন: সুনীল দাস কি রিকশার কাজই করতেন নাকি অন্য কাজও করতেন?

আর কে দাস: রিকশার কাজই করতেন

শাওন: সে সময় কী রং ব্যবহার করতেন আপনি?

আর কে দাস: লন্ডনের এনামেল রং ব্যবহার করতাম। তখন বাংলাদেশি কোনো রং পাওয়া যেত না। এরপর দু-তিন মাস বোর্ডপ্রতি ৩ টাকা মজুরিতে কাজ করার পর ওখানকার কাজ ছেড়ে দিয়ে বাড়িতেই কাজ করা শুরু করলাম

শাওন: তখনো শুধু সিনেমার ছবিই আঁকতেন নাকি অন্য ছবিও আঁকতেন?

আর কে দাস: শুধু সিনেমার ছবিই...বিশেষ করে বোম্বে ফিল্মের ছবি আঁকতাম

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রিকশাচিত্রে প্রতিফলিত হয় মুক্তিযুদ্ধের ছবি
শিল্পী: আহমাদ

শাওন: আমরা শুনেছি, সিনেমার বিষয়বস্তু রিকশাচিত্রে আসে আরও পরে। তাহলে কি তথ্যটি সঠিক নয়?

আর কে দাস: না, পঞ্চাশের দশক থেকেই সিনেমার বিষয়বস্তু রিকশা পেইন্টিংয়ে ব্যবহৃত হতো। বোম্বে (এখন মুম্বাই) চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু ধরেই কাজ হতো

শাওন: পঞ্চাশের দশকে রিকশাচিত্রে সিনেমার বিষয়বস্তু মূলত কী ছিল, কী আঁকতেন?

আর কে দাস: তখন আমাদের এখানে, অর্থাৎ ঢাকায় কালার পোস্টার হতো না; শুধু লিথো হতো। বাড়িতে কাজ করতেই করতেই ৩ টাকা থেকে আমার পারিশ্রমিক হলো ৪ টাকা

শাওন: শুধু সিনেমার বিষয়বস্তু নিয়েই কাজ করতেন, না আপনার ইচ্ছেমতো যেকোনো ছবি আঁকতেন?

আর কে দাস: সিনেমার বিষয়বস্তু নিয়েই কাজ করতাম। যাঁরা অর্ডার দিতেন, তাঁরাই বলে দিতেন, ‘দাদা, দিলীপ কুমার, মধুবালা, গীতাবলি, দেবানন্দের ছবি এঁকে দেন। তখন মুম্বাই চিত্রজগতে তাঁরাই ছিলেন বিখ্যাত। তারপর পারিশ্রমিক বোর্ডপ্রতি ৩ থেকে ৪ টাকা, ৪ থেকে ৫ টাকা—এভাবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ১২ টাকা পর্যন্ত হয়েছিল। টিনের শিটের ওপরে এনামেল দিয়ে আঁকতাম।

শাওন: কিন্তু বিষয়বস্তুগত কোনো পরিবর্তন কি ঘটল নাকি সিনেমাই থাকল?

আর কে দাস: সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের সঙ্গে বিভিন্ন দৃশ্য—যেমন গ্রাম, শহর ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দৃশ্য বসিয়ে দিতাম।

শাওন: পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে যখন রিকশা পেইন্টিংয়ের কাজ করতেন, তখন কি আপনি একাই করতেন নাকি আরও অনেকে যুক্ত ছিলেন এ কাজে?

আর কে দাস: সুনীল দাস ছিলেন। তিনি অবশ্য স্বাধীনতার আগেই মারা যান। তখন আমি ছাড়া আরও কাজ করত হাকিম, আলীনুর। ওরা আমার সমবয়সী ছিল। আলীনুর অনেক ভালো কাজ করত। সে রিকশার পাশাপাশি বেবিট্যাক্সি পেইন্টিংও করত, আমিও বেবিট্যাক্সির করতাম। ঢাকার কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জে আছে পলাশ। ওরা তিন ভাই এ কাজ করত। এখনো করে। ওরা বয়সে আমার অনেক ছোট।

শাওন: রিকশাচিত্রের বিষয়বস্তু কী ছিল?

আর কে দাস: বাংলাদেশের গ্রাম ও গ্রামের দৃশ্য—গ্রামীণ বধূরা কলসি কাঁখে ঘাট থেকে পানি নিয়ে যাচ্ছে, রাখাল বাঁশি বাজিয়ে গরু নিয়ে যাচ্ছে, নৌকা, নদী, সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত, প্রাকৃতিক দৃশ্য, কুঁড়েঘর, অনেক রকম তাজমহল, সাদ্দামের শাসনামলে ইরাক যুদ্ধ—এমন বিভিন্ন বিষয়বস্তু ছিল।

শাওন: সাদ্দাম তো অনেক পরের কথা। এই বিষয়বস্তুগুলো আপনারা কোথা থেকে নিতেন?

আর কে দাস: পোস্টার থেকে নিতাম।

শাওন: রিকশাচিত্রের বিষয়বস্তু বা অন্য জায়গাগুলোতে কখন পরিবর্তন এল?

আর কে দাস: পাকিস্তান আমলে, স্বাধীনতার কিছু আগে রিকশা পেইন্টিং সরকার বন্ধ করে দিল। বলা হলো, মানুষের ছবি আঁকা যাবে না। আমরা চিন্তা করলাম, তাহলে কিসের ছবি বা দৃশ্য আঁকতে পারি। তখন মানুষের ছবির জায়গায় জীবজন্তুর ছবি আঁকা শুরু করলাম।

শাওন: এই আইডিয়া নিয়ে আপনিই প্রথম কাজ শুরু করলেন নাকি অন্য কেউ করেছিলেন?

আর কে দাস: আমিও করেছি, তারপর আহম্মদ, হাকিম, আরও অনেকেই করেছে।

শাওন: প্রথমে আইডিয়াটা কার কাছ থেকে এল? একটা ছবি তো একজনই আঁকেন। একাধিকজন তো আঁকেন না। প্রথম নিশ্চয়ই কেউ এঁকেছেন। তারপর তাঁকে অন্যরা অনুসরণ করেছেন।

আর কে দাস: আসলে আলীনুর, আহমাদ, হাকিম ও আমি—আমরা তিন-চারজনে ভাবলাম, কী আঁকতে পারি। তারপরই আমাদের ভাবনা থেকে এই আইডিয়া এসেছে। বাচ্চাদের বইয়ে জীবজন্তুর ছবি থাকে। আমাদের আইডিয়া তৈরিতে বিষয়টি সাহায্য করেছে।

শাওন: আচ্ছা, এই নিষেধাজ্ঞা কেটে গেল কখন?

আর কে দাস: যখন যুদ্ধ (মুক্তিযুদ্ধ) বেধে গেল। তখন যে যার মতো একেক জায়গায় চলে গেলাম। যুদ্ধ শেষ হলে ফিরে এসে ভাবলাম, এখন কোন ধরনের ছবি আঁকা যায়, কোন ধরনের ছবি চলবে। তখন যুদ্ধের ছবি আঁকা শুরু করলাম। যেভাবে পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশের মানুষের চোখ-হাত-পা বেঁধে সারি করে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করত, নারীদের নির্যাতন করত...মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধের ছবি আঁকা শুরু করলাম।

শাওন: অর্থাৎ স্বাধীনতার পর মানুষ আঁকাতে আর কোনো বাধা থাকল না?

আর কে দাস: জি, স্বাধীনতার পর মানুষের ছবি আঁকায় কোনো বাধাই থাকল না। তখন যার যেমন ইচ্ছা, আঁকতে শুরু করলাম।

শাওন: কিন্তু শুনেছি, স্বাধীনতার পরও একসময় বাধা এসেছিল। সেটা কোন সময়?

আর কে দাস: হ্যাঁ, সেটা ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৬ সালের দিকে, যখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো। তারপর...।

শাওন: কী ধরনের নিষেধাজ্ঞা ছিল?

আর কে দাস: ওই তো মানুষের ছবি আঁকা যাবে না।

শাওন: নিষেধাজ্ঞাটা আপনাদের কাছে কীভাবে এল?

আর কে দাস: পৌরসভা থেকে নিষেধ করা হয়েছিল।

শাওন: নিষেধাজ্ঞাটা মৌখিক নাকি লিখিতভাবে করা হলো?

আর কে দাস: যখন পৌরসভা থেকে রিকশার লাইসেন্স রিনিউ (নবায়ন) করতে যাওয়া হতো, তখন মানুষের ছবি থাকলে ছবির মধ্যে কালি দিয়ে ক্রস দাগ দিয়ে দেওয়া হতো। বলত, এই ছবিগুলো চলবে না। এই ছবি পরিবর্তন করে না নিয়ে এলে রিনিউ হবে না।

শাওন: এ ব্যাপারে কি তারা সরাসরি আপনাদের কিছু বলেছে?

আর কে দাস: না, রিকশার মালিকদের বলত। আর মালিকেরা আমাদের জানিয়েছেন, রিকশায় মানুষের ছবি আঁকা যাবে না, নিষেধ করা হয়েছে।

শাওন: নিষেধাজ্ঞার কোনো কারণ তারা উল্লেখ করেছিল?

আর কে দাস: না, উল্লেখ করেনি।

শাওন: মুক্তিযুদ্ধের পর ইচ্ছেমতো, অর্থাৎ মানুষের ছবি আঁকতে পারতেন?

আর কে দাস: তা সম্ভব হয়নি। নানা রকম দৃশ্য ও জীবজন্তুর ছবিই আঁকতে হতো। এর অনেক পরে, আশির দশকে বাইরে থেকে যেমন লন্ডন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া—এসব দেশ থেকে কিছু লোক আসা শুরু করল। তখন তাদের জন্যও কাজ করতাম।