সাক্ষাৎকারে দিলারা হাশেম

নারী স্বাধীনতা না আসার জন্য দায়ী নারীরাই

‘আমলকীর মৌ’ উপন্যাস লিখে সাহিত্য জগতে একসময় সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন দিলারা হাশেম। বাংলাদেশি এই কথাসাহিত্যিক দীর্ঘকাল প্রবাস যাপনের পর মারা গেছেন গেল বছর। গতকাল ১৯ মার্চ ছিল তাঁর প্রথম প্রয়াণ দিবস। মৃত্যুর কিছুদিন আগে ২০২১ সালের ১৬ আগস্ট ই–মেইল মারফত যখন এ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়, তখন তিনি বেশ অসুস্থ। তারপরেও তাঁর ছোট ছোট কথায় তিনি বলেছিলেন বিচিত্র প্রসঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন শারফিন শাহ। তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সাক্ষাৎকারটি আবার প্রকাশিত হলো।

প্রশ্ন:

শারফিন শাহ: আপনার জন্ম ব্রিটিশ ভারতের যশোরে। বাবা সরকারি কর্মচারী হওয়ার সুবাদে নানা জায়গায় বেড়ে ওঠা। ওই সময়ের স্মৃতি কি মনে পড়ে?

দিলারা হাশেম: অবশ্যই মনে পড়ে। হুবহু না হলেও অনেক স্মৃতিই আমার লেখার অন্তর্গত হয়েছে।

প্রশ্ন:

শারফিন: যত দূর জানি, শৈশবে আপনি বেশ কৌতূহলী ও বাধাবন্ধহারা ছিলেন। আশ্চর্য সব বিষয় আবিষ্কারের নেশা ছিল। কীভাবে ওই নেশা ভর করেছিল আপনার ওপরে?

দিলারা: শুধু কৈশোরেই নয়, আশ্চর্য বিষয়গুলোয় এখনো আগ্রহ আছে। আর এ কারণেই আমি লিখে যেতে পেরেছি। এটা আমার জন্মগত ব্যাপার। ঠিক কখন শুরু হয়েছিল, তা মনে করতে পারছি না। এ নেশা সব সময় আমার মধ্যে জাগরূক ছিল এবং সম্ভবত এখনো আছে।

প্রশ্ন:

শারফিন: আপনার পরিবার বিদ্যোৎসাহী ছিল। সে হিসেবে নিশ্চয়ই বই পড়ার পরিবেশ পেয়েছিলেন। বেড়ে ওঠার কালে কী ধরনের বই পড়ার সুযোগ ঘটেছিল?

দিলারা: আমার পরিবার শুধু বিদ্যোৎসাহীই ছিল না। পরিবারের সবাই সংস্কৃতিমান ও খোলা মনের ছিল। মা ও বাবা দুজনেরই বই পড়ার বিশেষ শখ ছিল। বই তাঁরা কিনতেন ও পড়তেন। আমরাও সেখান থেকে পড়ার সুযোগ পেতাম। আমার ছোটবেলা কেটেছে বরিশালে। সেখানকার লাইব্রেরি বেশ বড় ও প্রচুর বইপত্রে ভর্তি ছিল। বাসায় বই আনতেও বাধা ছিল না। সেই সুযোগে আমরা বাসায় বই নিয়ে আসতাম মায়ের জন্য, কেননা তিনি বই পড়তে বিশেষ ভালোবাসতেন।

প্রশ্ন:

শারফিন: আপনি ম্যাট্রিক ও আইএ—দুটো পরীক্ষায়ই স্কলারশিপসহ প্রথম বিভাগ পেয়েছিলেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে ভর্তি হয়েছিলেন। ইংরেজিতে ভর্তির ব্যাপারে কেন আগ্রহ জন্মাল আপনার?

দিলারা: ইংরেজিতে ভর্তির কারণ, সাহিত্যপাঠের সময় উপমা নিতে হতোই। সেটা সরাসরি পড়ে নেওয়ার আগ্রহ থেকেই ইংরেজি নেওয়া বোধ হয়।

প্রশ্ন:

শারফিন: বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যাঁদের পেয়েছিলেন, তাঁরা তো সবাই ছিলেন বিদ্যা-বৈভবে অতুলনীয়...

দিলারা: মুনীর চৌধুরী ও তাঁর বোন নাদিরা আপাকে শিক্ষক হিসেবে পাওয়া ছিল এক বিরাট সৌভাগ্য। তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত সহজ-সরল এবং কোনো বিষয়ে প্রশ্নের জবাব দিতে কুণ্ঠিত হতেন না। ওঁদের কাছ থেকে শিক্ষক হিসেবে যে ব্যবহার পেয়েছি, তা অতুলনীয়। মুনীর চৌধুরী স্যারকে আমার আমলকীর মৌ এ কারণেই উৎসর্গ করেছি। আর জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার বাসায় আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে বহুবার যাওয়া, তাঁর স্ত্রীর তৈরি সন্দেশ ও রসগোল্লা খাওয়ার সুযোগ হয়েছে। এটা গর্ব করে বলতে পারি, তাঁদের ব্যবহার ছিল অতি নিঃসংকোচ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ। জ্যোতির্ময় স্যার দেখা হলেই বলতেন, ‘কী দিলারা, প্রেমে পড়েছ নাকি?’

প্রশ্ন:

শারফিন: আপনার একটি উপন্যাস ‘আমলকীর মৌ’ পাঠকদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। এর সারা চরিত্রটি কি নিছক কল্পনা, নাকি আপনি এমন স্বাধীনচেতা নারী সত্যিই দেখেছেন?

দিলারা: লেখকের কোনো চরিত্রই নিছক কল্পনা হতে পারে না। লেখক একটা বাস্তব চরিত্র ভিত্তি করেই রচনা করেন। আমার ক্ষেত্রেও তা–ই হয়েছে। সারা কিছুটা আমার বোন, কবি সুরাইয়া খানমের ছাপ নিয়েই রচিত হয়েছিল বলে মনে করতে পারি।

প্রশ্ন :

শারফিন: সারা চরিত্র বর্তমানে ঢাকা শহরে অনেকই পাওয়া যাবে। তবু নারীর স্বাধীনতা আসেনি কেন?

দিলারা: এখনো নারী স্বাধীনতা তেমন করে আসেনি যদি মনে করেন, তবে তার জন্য দায়ী নারী নিজেই। নারীর নিজেকেই উদ্যোগী হতে হবে। কেউ তার হাত ধরে এগিয়ে নিতে আসবে না। প্রত্যেক নারীর চেষ্টা থাকতে হবে স্বাধীন পথে পা রাখার। এর জন্য শিক্ষা ও মনের জোর থাকা প্রয়োজন। আমি বিদেশে বসবাস করার কারণে সংঘবদ্ধভাবে নারীমুক্তিতে অবদান রাখতে পারিনি।

প্রশ্ন:

শারফিন: আপনি তো গানও করেছেন। গজল, নজরুলসংগীত, আধুনিক—সবই। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, সিএমভি থেকে আপনার গানের রেকর্ডও বেরিয়েছিল।

দিলারা: কবি জসীমউদ্​দীন তখন আমাদের বাসার কাছেই থাকতেন। একবার তিনি বুলবুল একাডেমির অনুষ্ঠানে তাঁর পল্লিগীতি আমার কণ্ঠে শোনার পর থেকেই একরকম উপযাচিত হয়ে আমার গান শুনতে চাইতেন ও প্রশংসা করতেন। আরও একজন সংস্কৃতিমান ও শিল্পী মানুষ ছিলেন আমার বাসার কাছেই, আব্বাসউদ্দীন আহ্​মদ। আমি তাঁদের কাছে ঋণী। কেননা তাঁরা আমাকে গান গাওয়ার ব্যাপারে বিশেষভাবে উৎসাহিত করেছিলেন। এবং আবদুল করিম নামে আব্বাসউদ্দীনের এক ভাই আমাকে প্রচুর গান শিখিয়েছিলেন, যেগুলো এখনো আমার হুবহু মনে আছে। কিছু সিএমভি থেকে রেকর্ডও করা হয়েছে।

প্রশ্ন:

শারফিন: বিদেশে যাঁরা বাংলা ভাষায় লিখছেন, তাঁদের লেখা কি পড়েন? বিদেশে বাংলার কদর এখন কেমন?

দিলারা: বিদেশে যাঁরা বাংলা ভাষায় লিখেছেন, তাঁদের লেখা আমার বিশেষ পড়া হয়নি বলে এ বিষয়ে মতামত দেওয়া থেকে বিরত থাকতে চাই। বিদেশে বাংলার কদর দিন দিন বাড়ছে এবং বাঙালির সংখ্যাও বাড়ছে।

প্রশ্ন:

শারফিন: আপনার বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই চলে গেছেন পরপারে। বিশেষত সৈয়দ শামসুল হক, আনিসুজ্জামান। মৃত্যু নিয়ে আপনার কোনো বিশেষ ভাবনা কাজ করে?

দিলারা: হ্যাঁ, প্রায় সবাই চলে যাচ্ছে। মৃত্যু নিয়ে আমার কোনো বিশেষ ভাবনা নেই। এটা জীবনেরই একটা অংশ বলে মনে করি। সবাইকে তো মরতে হবেই। ‘জন্মিলে মরিতে হবে অমর কে কোথা কবে?’ সে তো জানেনই। সে জন্য প্রস্তুত আছি। তবে তা কখন হয়, তা তো জানি না। সেটা যেন স্বাভাবিক হয়, আল্লাহর কাছে সেই প্রার্থনা।

প্রশ্ন :

শারফিন: বর্ণাঢ্য ও বিচিত্র কর্মজীবন আপনার। কোন পরিচয়ে সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন?

দিলারা: অবশ্যই লেখক পরিচয়। সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি পরিবার ও তার চারপাশ নিয়ে লিখতে। আর আমি যা ভালোভাবে জানি, তা নিয়ে লিখতে।

প্রশ্ন:

শারফিন: সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য কাজ করেও বাংলা একাডেমি ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা আপনি পাননি। এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ আছে কি?

দিলারা: সম্মাননা দেওয়াটা আমার নিজের হাতে নয়। পেলে সেটা আনন্দের বলে মনে করি, না পেলেও আক্ষেপ করি না। তবে যখন দেখি আমার চেয়ে কম কষ্ট করে বা সামান্য কিছু লিখেই কেউ কেউ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা পেয়ে যাচ্ছেন, তখন অবশ্যই খারাপ লাগে। তবে এই প্রাপ্তি যখন আমার নিজের ওপর নির্ভর করছে না, তখন আক্ষেপ করেই লাভ কী!