লাসলো ক্রাসনাহোরকাই ১৯৫৪ সালে হাঙ্গেরির প্রাদেশিক শহর গিউলেতে জন্মগ্রহণ করেন। তখন সোভিয়েতযুগ। ১৯৮৫ সালে তিনি তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘সাতানট্যাঙ্গো’ প্রকাশ করেন। এরপর ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’ (১৯৮৯), ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ (১৯৯৯) ও ‘ব্যারন ওয়েনখাইম’স হোমকামিং’ (২০১৬)। এই উপন্যাসগুলো ভাষার বিপুল বিস্তার, বৈশ্বিক গভীর প্রজ্ঞা (তিনি বৌদ্ধদর্শনের ধ্রুপদি চিন্তার সঙ্গে পরিচিত, যেমনটা তিনি যুক্ত ইউরোপীয় বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যের সঙ্গে), আচ্ছন্ন বা ঘোরগ্রস্ত চরিত্র, আর বৃষ্টি বিধৌত ভূপ্রকৃতি, হয়তো এনে দিয়েছে শেষ দিকের আধুনিকতাবাদী আমিত্বের অভিব্যক্তি, কিন্তু এগুলো একই সঙ্গে পয়েন্টিলিস্ট (ইম্প্রেশনিস্ট চিত্রকলার একটা ধরন, যেখানে বিচিত্র খাঁটি রং নিয়ে বিন্দু দিয়ে দিয়ে ছবিটি আঁকা হয়, সেসব মিশে একটা ছবি ফুটে ওঠে), আভিজাত্যময় ও সূক্ষ্মভাবে কৌতুকপ্রদ। তাঁর গাম্ভীর্যে আছে পরিশীলিত মেজাজ। তাঁর উপন্যাসের পাশাপাশি অন্য রচনাতেও রয়েছে সমন্বিত স্বরের দৃশ্যময়তা; বিশেষ করে ছোট উপন্যাসে, যেমন ‘অ্যানিমেলসাইড’ (২০১০) এবং ভৌগোলিক বিপুলায়তনসম্পন্ন রচনাতেও, যেমন ‘ডেসট্রাকশন অ্যান্ড সরো বিনিথ দ্য হ্যাভেন’ (২০০৪) ও ‘সেইওবো দেয়ার বিলো’ (২০০৮)।
যদিও এখনো হাঙ্গেরিতে ক্রাসনাহোরকাইয়ের বাড়ি আছে, তিনি মূলত থাকেন বার্লিনে। প্রথমবারের মতো আমি এই সাক্ষাৎকারের জন্য লন্ডন থেকে বার্লিনে পৌঁছাই ২০১৬ সালের শীতে, কুয়াশার কারণে আমার বিমানযাত্রা বাতিল হয়ে গিয়েছিল। কয়েক ঘণ্টা পর নতুন ফ্লাইট ট্যারম্যাকে, বিমান উড্ডয়নের পিচ বাঁধানো পথে, আমাদের বলা হলো প্রকৌশলগত জটিলতার কারণে আমাদের রওনা হতে দেরি হবে। বার্লিনে পৌঁছাই একেবারে শেষ সময়ে এবং একটা ট্যাক্সি পাই। সেই ট্যাক্সি ছুটছিল এক অস্বাভাবিক গতি নিয়ে কারণ এর চালক আমাকে জানায়, সে একটা বাথরুম খুঁজে পাওয়ার জন্য একদম মরিয়া দশায় আছে। আমি ক্রাসনাহোরাকাইকে পেলাম হ্যাম্যানপ্লাজের ইউ-বান-এর প্রবেশমুখে, ততক্ষণে আমার লন্ডন ছেড়ে আসার ১২ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। আমার হয়তো তাঁর সঙ্গে বেইজিংয়ে দেখা হতে পারত। এই ঘোরপ্যাঁচে পড়া সমকালীন ভ্রমণের প্রহসনে, আমার মনে হলো, এটা দারুণ অসংগতিপূর্ণভাবে কৌতুকময়। কিন্তু আমি শনাক্ত করতে পারলাম ক্রাসনাহোরাকাইয়ের সৃষ্টি সব সময় অ্যাবসার্ডের এক নিরাময়শালা, যেখানে এই জগৎ চিত্রিত হয় এক অপ্রতিরোধ্য প্রতিপক্ষ হয়ে।
ক্রাসনাহোরকাই কথা বলেন যে ইংরেজিতে, তাতে মধ্য ইউরোপীয় প্রভাব এবং মাঝেমধ্যে আমেরিকান উচ্চারণ, এর পেছনে আছে নব্বই দশকের নিউইয়র্কে অ্যালেন গিন্সবার্গের অ্যাপার্টমেন্টে কিছুদিন থাকার ব্যাপারটি। ক্রাসনাহোরকাই বেশ দীর্ঘকায়, নমনীয় ভদ্র মানুষ, প্রায় সময় হেসে ওঠেন বা মৃদু হাস্যপ্রবণ এবং তার ভেতরে দারুণ প্রাণবন্ত আন্তরিকতা। আমার শীত লাগছে দেখে তিনি আমাকে একটা সোয়েটার ধার দেন, আমার জন্য উপহার হিসেবে দেন দুয়ার্স গ্রুনবাইনের কবিতার সংগ্রহ ‘উনা স্তোরিয়া ভেরা’, আর গির্য়োজি কুর্ট্যাগের গানের রেকর্ড। তাঁর লম্বা চুল আর শোকার্ত চোখের দৃষ্টিতে তাঁকে সৌম্য সাধকের মতো মনে হচ্ছিল। তিনি একজন অতীব একান্তে বা নিভৃতিতে থাকা ও নীরবতাপ্রিয় মানুষ। এ জন্য তিনি তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে সাক্ষাৎ করতে চাননি, তার বদলে কোয়েৎসবের্গজুড়ে থাকা নানা ক্যাফে ও রেস্তোরাঁয় কয়েক দফায় আমাদের আলাপ হয়।
— অ্যাডাম থ্রেয়েল
চলুন, কীভাবে আপনার লেখক হিসেবে শুরু, সে প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ করি।
ক্রাসনাহোরকাই: আমি চিন্তা করেছিলাম বাস্তবজীবন, সত্যিকার জীবন হয়তো অন্য কোথাও আছে। ফ্রানৎস কাফকার ‘দ্য ক্যাসেল’, আর একটা সময়ে আমার কাছে বাইবেলের মতো হয়ে থাকা ম্যালকম লায়রির ‘আন্ডার দ্য ভালকানো’, পাশে রেখে এমনটা মনে হতো তখন। এটা বলছি ষাটের দশকের শেষ দিকটায় বা সত্তরের শুরুতে। একজন লেখকের যে ভূমিকা, সেটা আমি গ্রহণ করতে চাইনি। আমি কেবল একটিমাত্র বই লিখতে চেয়েছিলাম এবং এরপর আমি কিছু ভিন্ন ধরনের কাজ করতে চেয়েছিলাম, বিশেষ করে সংগীতে। সবচেয়ে দরিদ্রতম মানুষদের সঙ্গে আমি থাকতে চেয়েছিলাম। আমি ভাবতাম, সেটাই ছিল বাস্তব জীবন। আমি খুবই গরিব এলাকায়, বলা যায় একদম হতদরিদ্র গ্রামে বাস করতাম। আমার তেমন কোনো ভালো কাজটাজ করার ছিল না। আমি প্রায় জায়গা বদলে বদলে থাকতাম, বলতে গেলে প্রতি তিন কি চার মাস পরপরই, এটা বলতে গেলে বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে কাজ করার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য।
তারপর যে মাত্র আমি কিছু অল্পস্বল্প লেখা প্রকাশ করতে শুরু করলাম, পুলিশ আমাকে ডেকে পাঠাল। আমি হয়তো কিছুটা অধৈর্য হয়ে গিয়েছিলাম, কারণ প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরে আমি বলছিলাম, ‘দয়া করে আমাকে বিশ্বাস করুন, রাজনীতি নিয়ে আমার কোনো কারবার নেই।’ ‘কিন্তু আমরা তো তোমার সম্পর্কে কিছু জিনিস জানি।’ ‘না, না। আমি চলমান রাজনীতি নিয়ে কিছু লিখি না।’ ‘আমরা তোমাকে বিশ্বাস করি না।’ কিছুক্ষণ পর আমি কিছুটা রেগে উঠলাম আর বললাম, ‘তোমারা কি সত্যিই কল্পনা করতে পারো যে তোমাদের মতো মানুষদের নিয়ে আমি কী লিখতে পারতাম?’ এটা তাদের ক্ষেপিয়ে দিল, নিশ্চিতভাবেই, এবং পুলিশ অফিসারদের একজন বা গোয়েন্দা পুলিশের কেউ একজন আমার পাসপোর্ট জব্দ করতে চাইল। সোভিয়েত আমলের কমিউনিস্ট যুগে আমাদের দুটো পাসপোর্ট থাকত—নীল ও লাল, এবং আমার কেবল লালটাই ছিল। কিন্তু লালটা তেমন চমকপ্রদ নয়। কারণ এর মাধ্যমে তুমি কেবল সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে যেতে পারতে, যেখানে কিনা নীল পাসপোর্ট মানে হলো মুক্তি। তাই আমি বললাম, তুমি কি সত্যিই লালটি চাও? সেটি কিন্তু এখনো তাদের জিম্মায় আছে। ১৯৮৭ সালের পর থেকে আমার কোনো পাসপোর্ট নেই।
এটা ছিল আমার লেখক জীবনের প্রথম গল্প এবং হয়তো সহজেই এটাই হতে পারত শেষ গল্প। সম্প্রতি গোয়েন্দা পুলিশের নথিপত্রে আমি সেই নোটগুলি দেখলাম, যেখানে সম্ভাব্য তথ্যদাতা ও গুপ্তচর হিসেবে তারা আলোচনা করেছিল। তারা আমার ভাইয়ের বেলায় কিছু সুযোগ নিয়েছিল, তারা ভুক্তি লিখেছিল, কিন্তু লাসলো ক্রাসনাহোরাকাই, তার বেলায় এটা চূড়ান্তভাবেই অসম্ভব। কারণ, সে এতটাই কমিউনিস্টবিরোধী। এটাকে এখন কী হাস্যকর দেখায় তাই না, কিন্তু সেই সময়ে এটা মোটেই হাস্যকর ছিল না। কিন্তু আমি কখনোই কোনো রাজনৈতিক প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিইনি। আমি স্রেফ আমার ছোট গ্রামে থাকতাম এবং আমার প্রথম উপন্যাসটি লিখতে শুরু করেছিলাম।
সেটা আপনি কীভাবে প্রকাশ করলেন?
ক্রাসনাহোরাকাই: সময়টি ছিল ১৯৮৫। বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে ‘সাতানট্যাঙ্গো’ প্রকাশ করা সম্ভব। কারণ, কমিউনিস্ট ব্যবস্থায় এটা আর যাই হোক কোনো ঝামেলা তৈরির উপন্যাস ছিল না। সেই সময়ে সমকালীন সাহিত্যের একটি প্রকাশনা সংস্থার পরিচালক ছিলেন একসময় আবার গোয়েন্দা-পুলিশের সাবেক প্রধান এবং হয়তো তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন তখনো তাঁর ক্ষমতা অক্ষুণ্ন আছে, যথেষ্ট ক্ষমতা আছে এটা দেখানোর যে তার সাহস আছে এই উপন্যাস প্রকাশ করার। আমার মনে হয়, কেবল এ কারণেই বইটি প্রকাশিত হয়েছিল।
আমি রাতের পাহারাদার হয়ে তিন শটি গরু দেখাশোনার কাজ করেছিলাম। এটা ছিল আমার অন্যতম প্রিয় কাজ। গোশালাটি ছিল একদম সীমান্তবর্তী নো ম্যানস ল্যান্ডে। এর ধারেকাছে কোনো গ্রাম, কোনো নগর, কোনো শহরই ছিল না। কিছু মাসের জন্য আমি পাহারাদার হিসেবে কাজ করেছি, তা হয়তো একটা বেচারার জীবন—যার এক পকেটে থাকত ‘আন্ডার দ্য ভলকানো’ আর অন্য পকেটে দস্তয়েভস্কি।লাসলো ক্রাসনাহোরকাই
কী কী ধরনের চাকরিবাকরি আপনি করেছিলেন?
ক্রাসনাহোরকাই: খনিতে কিছু সময়ের জন্য কাজ করেছিলাম। এটা বলতে গেলে খুবই কৌতুকপ্রদ, আসল খনির কাজে থাকা মানুষেরা আমার কাজটি করে দিত। এরপর আমি বুদাপেস্ট থেকে দূরে বিভিন্ন গ্রামের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলাম। প্রতিটি গ্রামে একটি করে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল, যেখানে লোকজন ক্ল্যাসিক বইপত্র পড়ার সুযোগ পেত। তাদের দৈনন্দিন জীবনে লাইব্রেরিতে পড়ার ব্যাপারটাই ছিল সব কিছু। এবং শুক্র আর শনিবার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের পরিচালক সংগীত উৎসবের আয়োজন করতেন বা এমন কিছু একটা, যা তারা পছন্দ করবে, যেটা আসরে তরুণ যুবকদের জন্য খুবই স্বাস্থ্যপ্রদ ছিল। আমি প্রায় ছয়টি গ্রামে এই পরিচালকের কাজ করেছিলাম, যার মানে হলো তাদের মধ্যে আমার যাওয়া–আসা ছিল। এটা ছিল দারুণ চাকরি। আমি কাজটা ভালোবাসতাম। কারণ, আমি আমার বুর্জোয়া পারিবারিক আবহ থেকে অনেক দূরে বাস করতাম।
এ ছাড়া আরও কী বলা যায়? আমি রাতের পাহারাদার হয়ে তিন শটি গরু দেখাশোনার কাজ করেছিলাম। এটা ছিল আমার অন্যতম প্রিয় কাজ। গোশালাটি ছিল একদম সীমান্তবর্তী নো ম্যানস ল্যান্ডে। এর ধারেকাছে কোনো গ্রাম, কোনো নগর, কোনো শহরই ছিল না। কিছু মাসের জন্য আমি পাহারাদার হিসেবে কাজ করেছি, তা হয়তো একটা বেচারার জীবন—যার এক পকেটে থাকত ‘আন্ডার দ্য ভলকানো’ আর অন্য পকেটে দস্তয়েভস্কি।
বলা আবশ্যক, সেই ওয়ান্ডারারা এলাকায় আমি মদ্যপান শুরু করেছিলাম। হাঙ্গেরির সাহিত্যে এই ঐতিহ্য ছিল যে সত্যিকারের সব জিনিয়াসরাই ব্যাপকভাবে মদ খেতেন। আমিও একেবারে পাগলের মতো মদ খেতাম। কিন্তু তখন সেই মুহূর্ত এল, যখন আমি একদল হাঙ্গেরীয় লেখকের সঙ্গে বসতাম, যারা দুঃখজনকভাবে ঐকমত্য পোষণ করত যে এটা অনিবার্য, যেকোনো হাঙ্গেরীয় জিনিয়াসকে বেঢপ মাতাল হতেই হবে। আমি তখন এটা মেনে নিতে চাইলাম না এবং একটা বাজি ধরলাম, এটা ছিল বারো বোতল শ্যাম্পেনের বাজি যে আমি আর কখনো মদ খাব না।
এবং আপনি আর খাননি?
ক্রাসনাহোরকাই: এবং আমি আর মদ খাইনি। কিন্তু এখনো এই সময়ে সমকালীন গদ্যলেখকদের মধ্যে, এর ভেতরে একজন লেখক ও মদ্যপ সবিশেষভাবে আছেন—পিটার হ্যাজনোজি। তিনি একজন জীবন্ত কিংবদন্তি এবং প্রচণ্ড মদ্যপায়ী, অনেকটা ম্যালকাম লায়রির মতোই। তাঁর মৃত্যু হাঙ্গেরীয় সাহিত্যের জন্য বিরাট একটা ঘটনা বৈকি। তিনি খুবই অল্প বয়সী ছিলেন, হয়তো ৪০ মাত্র। আর যে জীবন আমি যাপন করতাম, আমি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত ছিলাম না—এটা খুবই রোমাঞ্চকর জীবন, সব সময় দুটো শহরে যাওয়া-আসা করতে হতো, ট্রেনস্টেশন ও রাতের বারগুলো, লোকজনকে পর্যবেক্ষণ করা, মাঝেমধ্যে অল্পস্বল্প গালগপ্পো করা। ধীরে, আমি আমার মাথার ভেতরে বই লিখতে শুরু করলাম।
এভাবে কাজ করাটা বেশ ভালো। কারণ, আমার মধ্যে এটা শক্তিশালীভাবে অনুভূত হতে শুরু করল যে সাহিত্য হলো একটা মরমি—মাঠে কাজ করার ব্যাপার, যেটা অন্যত্র, একেবারেই একই যুগে, হ্যাজনোজি, য়ানোস পিলিনিস্কি, স্যান্দোর ওরায়া এবং আরও অনেক দুর্দান্ত সব কবি বেঁচেছিলেন এবং লিখেছিলেন। তখন গদ্যসাহিত্য ছিল কম শক্তিশালী। আমরা সবাই কবিতা ভালোবাসতাম। কারণ, এটা আরও বেশি চমকপ্রদ এবং অনেক গূঢ়গোপন ব্যাপার। গদ্য অনেকটাই বাস্তবতালগ্ন। গদ্যলেখকদের যাঁরা জিনিয়াস, তাঁরা হলেন তেমন কেউ, যিনি বাস্তবজীবনের খুবই কাছে অবস্থান করেন। এ জন্য, প্রথাগতভাবে, হাঙ্গেরীয় গদ্যলেখক, যেমন জিগমুন্ড মোরি, ছোট ছোট বাক্য লিখতেন। কিন্তু কুরুদি তা করতেন না, আমার একমাত্র প্রিয় লেখক হাঙ্গেরীয় গদ্যসাহিত্যের—গিউলা কুরুদি। একজন অসামান্য লেখক। নিশ্চিতভাবেই তাঁর লেখা প্রায় অনুবাদযোগ্য নয়। হাঙ্গেরিতে তিনি হলেন দন জিওভান্নি—লম্বায় দুই মিটার, অতিকায় মানুষ, একদম এক অভূতপূর্ব মানুষ। তিনি এতটাই আকর্ষণীয়, যা কেউ ঠেকাতে পারে না।
আর তাঁর বাক্যগুলো?
ক্রাসনাহোরকাই: তিনি যেকোনো গদ্যলেখক থেকে ব্যতিক্রমী বাক্য ব্যবহার করেন। তাঁর লেখাকে সব সময় মনে হয় কিছুটা মাতলামো করা মানুষের মতো, যে খুব বিষাদগ্রস্ত, জীবন সম্পর্কে যাঁর কোনো মোহ নেই, যিনি খুবই শক্তিশালী, কিন্তু তাঁর এই শক্তিমত্তা পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু কুরুদি আমার জন্য এমন এক ব্যক্তি, এক কিংবদন্তি। সাহিত্যিক বোধের দিক থেকে পিলিনস্কি আমার জন্য আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাঁর ভাষার কারণে, তিনি লেখেন কথকের ভঙ্গিতে। আমি তাঁকে একটু নকল করার চেষ্টা করব:
প্রিয় অ্যাডাম—আমাদের উচিত নয়—অপেক্ষা করা—কোনো মহাপ্রলয়ের জন্য, আমার বেঁচে আছি—ঠিক এখন বলো তো—মহাপ্রলয়ের ভেতরে—আমার প্রিয় অ্যাডাম—দয়া করে কোথাও যেও না—কোথাও না...
খুবই উঁচু মানের, তীক্ষ্ণ স্বরের, ধীরগতিময়; প্রতিটি শব্দের মধ্যে বিরাজ করছে নীরবতা আর থমকে থাকা। প্রতিটি শব্দের শেষ অক্ষরটি সব সময় অভিব্যক্ত হচ্ছে খুবই স্পষ্টভাবে, যেন কোনো যাজক বা পাদরি সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে কথা বলছেন—কোনো আশা ছাড়া; কিন্তু একই সঙ্গে বিপুল আশা নিয়ে। কিন্তু তাঁর লেখা গিউলা কুরুদির চেয়ে আলাদা। পিলিনস্কি হলেন অনেকটা মেষশাবকের মতো। কোনো মানুষের মতো নয়—কোনো এক মেষ যেন।
অনুবাদ লেখা কি তখন খুব সুলভ ছিল?
ক্রাসনাহোরাকাই: সেটা এমন সময় ছিল, যখন আমরা বিপুল পরিমাণ পশ্চিমা সাহিত্য হাতে পেতাম, উইলিয়াম ফকনার, ফ্রানৎস কাফকা, রিলকে, আর্থার মিলার, জোসেফ হেলার, মার্সেল প্রুস্ত, স্যামুয়েল বেকেট—বলতে গেলে প্রায় প্রতি সপ্তাহে একটা নতুন মাস্টারওয়ার্ক চলে আসত। কারণ, কমিউনিস্ট শাসন আমলে তারা নিজেদের কাজগুলো প্রকাশ করতে পারতেন না, সবচেয়ে বড় লেখক ও কবি—সবাই অনুবাদক হয়ে উঠেছিলেন। এ কারণে আমরা পেয়েছিলাম শেক্সপিয়ার, দান্তে, হোমার এবং আমেরিকার প্রত্যেক মহান লেখকের লেখা, ফকনার থেকে আরও যারা যারা। পিঞ্চনের ‘গ্রাভিটি’স রেইনবো’ প্রথম অনুবাদটি তো ছিল অসামান্য।
আর দস্তয়েভস্কি?
ক্রাসনাহোরকাই: দস্তয়েভস্কি আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। কারণ, এটা তাঁর নায়কেরা, তার রচনাশৈলীর জন্যও নয় বা তার কাহিনিগুলোর জন্য। তোমার কি ‘হোয়াইট নাইটস’ বয়ানকারী কথকের কথা মনে পড়ে? প্রধান চরিত্রটি কিছু ‘ইডিয়টে’র মিশকিনের মতো, একজন পূর্ববর্তী—মিশকিনের চরিত্র। আমি ছিলাম এই বয়ানকারীর অন্ধভক্ত এবং পরবর্তীকালে মিশকিনের—তাঁদের ভঙ্গুরতা ও আত্মরক্ষাহীনতার জন্য। একজন আত্মরক্ষাহীন, দৈবদূতের মতো চরিত্র। আমার লেখা প্রতিটি উপন্যাসে তুমি এমন চরিত্রদের দেখা পাবে, যেমন ‘সাতানট্যাঙ্গো’র এস্তিকা বা ‘মেলানকোলি’র ভালুসকা, যারা এই জীবনজগতের হাতে ক্ষতবিক্ষত। এই ক্ষতবিক্ষত হওয়া তাদের প্রাপ্য নয় এবং আমি তাদের ভালোবাসি। কারণ, তারা এমন একটা মহাজগতে বাস করে, যেখানে সবকিছুই দারুণ সুন্দর, এমনকি মানুষের অস্তিত্বও, এবং আমি এই বিষয়কে সম্মান করি যে তারা সবাই বিশ্বাসী। কিন্তু এই মহাবিশ্ব সম্পর্কে তাদের চিন্তা, এই পৃথিবী নিয়ে তাদের চিন্তা এবং পাপহীনতা, বিশ্বাস—এসব আমার জন্য সম্ভব নয়।
আমার জন্য, আমরা অনেক বেশি জীবজন্তু নিয়ে চিন্তিত। আমরা নিজেরা পশু, আমরা হলাম সেই পশু, যারা জয়ী হয়েছি। যদিও আমরা অতীবভাবে মনুষ্যত্ব আরোপমূলক (কেবলই মানুষকে ঘিরে/নৃতত্ত্বকেন্দ্রিক) জগতে বাস করি। আমরা বিশ্বাস করি, এই মানুষের পৃথিবীতে প্রাণীরা, উদ্ভিদেরা বা পাথরেরা কেবল অংশমাত্র। এটা একেবারেই ঠিক নয়।
তাহলে আপনি বলছেন যে আপনার নিজস্ব দর্শন পুরোটাই বিশুদ্ধ বস্তুবাদী?
ক্রাসনাহোরকাই: ওহো তা নয়, মিশকিনও তো বাস্তব। দুঃখিত।
এমন সময় ছিল, যখন আমরা বিপুল পরিমাণ পশ্চিমা সাহিত্য হাতে পেতাম, উইলিয়াম ফকনার, ফ্রানৎস কাফকা, রিলকে, আর্থার মিলার, জোসেফ হেলার, মার্সেল প্রুস্ত, স্যামুয়েল বেকেট—বলতে গেলে প্রায় প্রতি সপ্তাহে একটা নতুন মাস্টারওয়ার্ক চলে আসত। কারণ, কমিউনিস্ট শাসন আমলে তারা নিজেদের কাজগুলো প্রকাশ করতে পারতেন না, সবচেয়ে বড় লেখক ও কবি—সবাই অনুবাদক হয়ে উঠেছিলেন।লাসলো ক্রাসনাহোরকাই
না, আমাকে আরেকটু যদি খুলে বলতেন।
ক্রাসনাহোরকাই: ফ্রানৎস কাফকা তাঁর জীবনের গল্প এবং তাঁর বইপত্র নিয়েও একজন ব্যক্তি। কিন্তু সেখানে ‘কে.’ চরিত্রটিও আছে, আছে এই মহাজগতে এক স্বর্গীয় পরিসর নিয়ে, এবং মনে হয় আমার উপন্যাসের কিছু চরিত্রও সেখানে বসবাস করে। উদহারণ হিসেবে, ইরিমিয়াস ও ডাক্তার যেমন ‘সাতানট্যাঙ্গো’তে বা ‘মেলানকোলি’তে মিস্টার এস্তার ও ভালুসকা, আমার নতুন উপন্যাসে, ব্যারন যেমন একজন। তারা সবাই চূড়ান্ত—তারা বেঁচে আছে।
তুমি কি প্রশ্ন তুলবে যে ওই মিশকিন একমাত্র কল্পিত? অবশ্যই। কিন্তু সত্য এটা নয়। মিশকিন বাস্তবতার মধ্যে ঢুকে পড়ছে কারও না কারও মাধ্যমে, যেমন দস্তয়েভস্কির মাধ্যমে, কিন্তু এখন, আমাদের জন্য, সে একজন বাস্তব ব্যক্তি। প্রতিটি চরিত্র যেগুলো তথাকথিত অমর কথাসাহিত্যে বিদ্যমান, সেগুলো এসেছে একেবারে সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে। এটা একটা গূঢ়গোপন প্রক্রিয়া, কিন্তু আমি পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত যে এটা সত্য। উদাহরণ হিসেবে বলি, ‘সাতানট্যাঙ্গো’ লেখার কিছু বছর পর, আমি একটা বারে ছিলাম, কেউ একজন আমার কাঁধে হালকা চাপড় দিল। সে ছিল ‘সাতানট্যাঙ্গো’র হ্যালিচ। সত্যি বলছি! আমি কোনো ঠাট্টা করছি না! সে জন্য লেখালেখির ব্যাপারে যা আমি লিখছি, সে সম্পর্কে আমি আরও বেশি সতর্ক হলাম। আরেকটা দৃষ্টান্ত হলো, ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ নামের যে বই প্রকাশিত হলো, সেটি তার চেয়ে অনেকটাই আলাদা। সেখানে মূল লেখাটিতে প্রথম ১০০ পৃষ্ঠায় ডিল করেছে কোরিনের আত্মবিনাশ নিয়ে, কিন্তু এই সম্ভাব্যতায় আমি একটু ভয় পেলাম যে পরে যদি পরিস্থিতিমতো আমার সঙ্গে তার দেখা হয় এবং আমি আসলে তাকে কোনো সাহায্য করতে পারতাম না। আমি সেই সম্ভাবনা সম্পর্কেও ভীত ছিলাম যে আদৌ সেই শহর ছেড়ে চলে যেতে পারত কি না। এ কারণে আমি তাকে সেখান থেকে অন্য কোথাও পেতে চাইলাম যে ইচ্ছা নিয়ে সে কোথায় একবার যেতে চায়, তার জীবনের শেষ দিকে, পৃথিবীর একদম কেন্দ্রে। আমি এটা ঠিক করিনি যে সেটা নিউইয়র্ক হতে পারে কি না, কিন্তু এভাবেই আমি নিজেকে সেই গল্প থেকে মুক্ত করি, যেখানে সে সেই প্রদেশিক জায়গায় চিরন্তরভাবে বাস করে।
আমি কেবল চিন্তা করছি, যা আপনি বললেন মানুষের বাঁচাটা মনুষ্যত্ব আরোপমূলক জগতের বাঁচা। এটা মাঝেমধ্যেই আমার ক্ষেত্রে ঘটে যে উপন্যাসগুলো প্রফুল্লভাবেই মনুষ্যত্ব আরোপমূলক। তাহলে অক্টোপাসরা কোথায়? কোথায় শৈবাল? আপনার উপন্যাসের যেসব বিষয় আমি পছন্দ করি, সেটি হলো সেগুলো তেমনটা (কেবলই মানুষকে ঘিরে) হতে চায় না, যেমনটা হয়ে আসছে, প্রাদেশিকভাবে মানবকেন্দ্রিক। কিন্তু এটা একই সঙ্গে দুটো বিপরীতার্থক বিষয়। তারা আর কী হতে পারত?
ক্রাসনাহোরকাই: এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা। উপন্যাসের যে কাঠামো বা ফ্রেম হয়তো অতীব নৃকেন্দ্রিক বা নরত্ব আরোপমূলক। সমস্যাটা উপন্যাসে থাকা বর্ণনাকারীর প্রথম সমস্যা এবং এটা চিরায়তভাবেই একই রকমের হয়ে আছে। কীভাবে তুমি বর্ণনাকারীকে উপন্যাস থেকে সরিয়ে দেবে? আমার সাম্প্রতিক উপন্যাসে, প্রতিটি পৃষ্ঠায় কেবল মানুষেরাই একে অন্যের সঙ্গে কথা বলছে এবং এটা হলো বর্ণনাকারীকে এড়ানোর একটা উপায়, কিন্তু এটা স্রেফ একটা কৌশল। কারণ, আমি তোমার সঙ্গে একমত—উপন্যাসের কাঠামো ও এই পৃথিবী হলো নৃকেন্দ্রিক। কিন্তু যদি আমাকে বেছে নিতে হয় এমন এটা জগৎ, যার কোনো কাঠামো থাকবে না এবং কাঠামোওয়ালা মানবপ্রজাতি—এই দুটোর কোনো একটাকে, তাহলে আমি মানবপ্রজাতিকেই বেছে নেব।
আমাদের কোনো ধারণাই নেই যে এই জগৎটা আসলেই কী ও কতটা। প্রাজ্ঞ লোকেরা আমাদের সব সময় বলে এসেছেন যে এটা প্রমাণিত, তোমার চিন্তাই করা উচিতই নয়, কারণ চিন্তা তোমাকে কোথাও পৌঁছে দেবে না। তুমি স্রেফ ভুল–বোঝাবুঝির ওপর ভিত্তি করে এই বিপুল নির্মাণ তৈরি করছ, যেটাকে বলা হচ্ছে সংস্কৃতি বা কালচার। সংস্কৃতির ইতিহাস হলো মহান চিন্তকদের চিন্তাকে ভুল বোঝার ইতিহাস। সুতরাং আমাদের সব সময়ই শূন্যতে (০) ফিরে যেতে হবে এবং ভিন্নভাবে আবার শুরু করতে হবে। কেঁচে গণ্ডূষ যাকে বলে। এবং হয়তো এর ফলে অন্তত একটু ঘটতে পারে যে তোমার একটা সুযোগ তৈরি হলো, ঠিক বোঝার সুযোগও হয়তো নয়, কিন্তু যাতে আবার ভুল–বোঝাবুঝিগুলো না করার মনটা তৈরি হয়। কারণ, এটা হলো এই প্রশ্নের বিপরীত দিক—মানব সংস্কৃতিকে বাতিল করে দেওয়ার মতো সত্যিকার সাহস আমার আছে কি? আমি কি ততটা সাহসী? মানুষের উৎপাদনের ভেতরে যে সৌন্দর্য, সেটিকে ভালোবাসা কি আমি থামিয়ে দেব? এর উত্তরে ‘না বলা’ সত্যিই জটিল।
আপনি এখনো উপন্যাস লিখছেন, তবু...
ক্রাসনাহোরকাই: হ্যাঁ, হয়তো এটা কোনো ভুল। আমি আমার সংস্কৃতিকে সম্মান করি। প্রতিটি ক্ষেত্রে মানুষের অতি উচ্চ মানের ভাষা, ভাষ্য ও উচ্চারণকে আমি শ্রদ্ধা করি। তবে এই সংস্কৃতির শিকড় কিন্তু মিথ্যা। এবং তুমি যদি কিছুই না করো, যেকোনোভাবেই হোক না কেন সবকিছুই কিন্তু চলমান থাকবে। আর হয়তো এটাই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনো সারবত্তা ছাড়াই সবকিছুকে অবশ্যই চলমান রাখতেই হবে, সেটি যা-ই হোক না কেন এবং অন্যদের সেই প্রশ্নগুলোও চলমান থাকুক।
যেমনটা লেখা বিষয়টি এবং প্রতিটি শিল্পাঙ্গিক—সবগুলোরই উচিত একদম ধর্মতত্ত্বমুক্ত উপাসনা হয়ে ওঠা?
ক্রাসনাহোরকাই: এটা চিন্তা করা সম্ভব যে লেখার কাজটি উপাসনার মতো করে করা—কোনো কোনো সময় বারবার শব্দের পর শব্দ পুনরাবৃত্তি করা, বাক্যের পর বাক্য। এটা অর্থে নয় যেভাবে ক্ল্যাসিক আভা-গার্দ বিংশ শতাব্দীর শুরুতে যার সূচনা করেছিলেন, যেমন দাদাবাদীদের দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, যেটা আসলে শিল্পীকে কোথাও পৌঁছে দেয় না। কারণ, তাঁরা বিষয়বস্তুকে এড়িয়ে যেতে চাইলেন এবং সেটিই ছিল, বেচারা প্রতিভাবানদের কাজ, তাঁদের ভ্রান্তি। কিন্তু তুমি যদি লেখার কাজটি মনে করো যে উপাসনার মতো করে বা এবাদতের মতো করে করতে, এবং যদি একই সঙ্গে তুমি নিজেকে দেখতে চাও যে তুমি একেবারে মাটিলগ্ন হয়ে আছো, এবং তুমি যদি শব্দের পর শব্দ লিখে চলো...এবং তারপর তোমার একটা বইও লেখা হয়ে যায়। তুমি থামো। তোমার বইটি বন্ধ করো। এবং তুমি আরেকটা খুলতে শুরু করো, যে বইয়ের পাতাগুলো ফাঁকা। এবং তুমি লিখে চললে, বারবার, নিরন্তরভাবে, অবিরামভাবে। শব্দের পর শব্দ। বাক্যের পর বাক্য। বন্ধ করো বইটা। আবার তারপরেরটাও...। এই হলো কৃত্য। হতে পারে এটা তোমার লেখা সম্পর্কে কী ভাবতে হবে, তা নয়, কিন্তু হতে পারে এটাই তা-ই, যা তুমি করো।
কিন্তু এই পয়েন্ট—আমাদের যারা পাঠক, তাদের সম্পর্কে আমাদের যেটা মনে রাখা উচিত। কারণ, পাঠকদের দরকার, আমার মনে হয়, আমাদের লেখাটাই। এবং এই ছোট পরিসরে—যেখানে আমরা বই লিখি, উপন্যাস, কবিতা লিখি—সেখানে একই সঙ্গে আমাদের পাঠকদেরও জায়গা আছে। এই সহমর্মিতা, এই অনুভব খুবই গুরুত্বপূর্ণ—যাঁরা লেখেন, যাঁরা কাঠামো তৈরি করেন, এবং যাঁরা পড়েন, যাঁদের আমরা যা করি, সেগুলো তাঁদের প্রয়োজন হয়—এই দুয়ের ভেতরে একটা সাধারণ সারবত্তা খুঁজে পাওয়াটা জরুরি। হয়তো এই জগৎ বিচিত্র রকমের ছোট ছোট পরিসর দিয়ে তৈরি—এদের প্রতিটিরই নিজস্ব সময়, সারবত্তা, চরিত্র, সৃষ্টিশীলতা, অনুষ্ঠান, এবং আরও যা যা আছে। ভিন্নধর্মী ধারণার সঙ্গে ভিন্নধর্মী স্থান বা পরিসর আছে। যেমনটা আমরা এখানে, এই পৃথিবীতে, আমার মানবপরিসরের ছোট জায়গায় এখন আছি।
আমাদের কোনো ধারণাই নেই যে এই জগৎটা আসলেই কী ও কতটা। প্রাজ্ঞ লোকেরা আমাদের সব সময় বলে এসেছেন যে এটা প্রমাণিত, তোমার চিন্তাই করা উচিতই নয়, কারণ চিন্তা তোমাকে কোথাও পৌঁছে দেবে না। তুমি স্রেফ ভুল–বোঝাবুঝির ওপর ভিত্তি করে এই বিপুল নির্মাণ তৈরি করছ, যেটাকে বলা হচ্ছে সংস্কৃতি বা কালচার। সংস্কৃতির ইতিহাস হলো মহান চিন্তকদের চিন্তাকে ভুল বোঝার ইতিহাস।লাসলো ক্রাসনাহোরকাই
আপনি আপনার এই স্টাইলে কীভাবে এলেন—এই প্রসারিত, বিপুলভাবে প্রবর্ধিত বাক্যের সৃষ্টিতে?
ক্রাসনাহোরকাই: কোনো একটা স্টাইল খুঁজে পাওয়া আমার জন্য কঠিন কিছু ছিল না। কারণ, আমি কখনোই এটা খুঁজতে চাইনি। আমি একটা ধরাবাঁধাজীবন যাপন করতাম। আমার সব সময় কিছু বন্ধুবান্ধব ছিল, কিন্তু সেটি হলো একেক সময়ে মাত্র একজন বন্ধু। এবং সেই প্রত্যেক বন্ধুর সঙ্গে, আমার সম্পর্ক ছিল, যার ভিত্তিতে আমরা একে অন্যের সঙ্গে আলাপ করতাম, কেবল মনোলোগে বা একালাপের মাধ্যমে। একদিন, একরাত্রি, আমি বললাম এককভাবে। পরের দিন বা রাত্রে, সে হয়তো বলল। কিন্তু আলাপটা প্রতিবারেই আলাদা। কারণ, আমরা চাইতাম কিছু অতীব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে, অন্য প্রান্তে যে ব্যক্তি আছে, তার জন্য, এবং যদি তুমি এমন কিছু বলো, যেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এবং তুমি যদি তোমার পার্টনারকে এ বিষয়ে বোঝাতে সম্মত করতে পারো—সেটা আরও গুরুত্বপূর্ণ, তোমার কোনো দাঁড়ি বা বিরামচিহ্ন লাগবে না, কিন্তু শ্বাস থামানো বা ছন্দ—ছন্দ ও গতি এবং সুরেলা দশা লাগবে। এটা খুব সচেতনভাবে বেছে নেওয়া কিছু ছিল না। এই ধরনের ছন্দ, সুর ও বাক্যপ্রকরণ এসেছে বরং অন্য ব্যক্তিকে বোঝানোর তাগিদ থেকেই।
তাহলে বলা যায়, এটা সাহিত্যিক প্রবণতা থেকে নয়? যেমনটা কোনো শৈলী বা স্টাইল তৈরিতে থাকে, যেমনটা প্রুস্ত বা বেকেটের ছিল?
ক্রাসনাহোরকাই: হতে পারে আমি যখন টিনএজার, কিন্তু সেটা ছিল তাঁদের জীবনকে অনুসরণ করা, ভাষাকে নয়। তাঁদের স্টাইলকেও নয়। আমার বিশেষ সম্পর্ক ছিল কাফকার সঙ্গে, কারণ অনেক অল্পবয়স থেকেই আমি তাঁকে পড়তে শুরু করেছিলাম, এতটাই অল্প বয়সে যে আমি ঠিক বুঝতে পারতাম না, কী বলা হচ্ছে, যেমন ‘দ্য ক্যাসেল’ আসলে কী সম্পর্কে লেখা। আমি ছিলাম অতি অল্প বয়সী। আমার একজন বড় ভাই ছিলেন, আর আমি তাঁর মতো হতে চাইতাম, তাই আমি তাঁর কাছ থেকে বই চুরি করতাম আর সেগুলো পড়তাম। ফলে কাফকা হলেন আমার প্রথম পরিচিত লেখক—এমন একজন লেখক, যাঁকে আমি বুঝতে পারতাম না, কিন্তু ঠিক ততটাই একজন—যিনি ব্যক্তি হিসেবে বিস্ময়কর। আমার প্রিয় বইগুলোর একটা যখন আমার বয়স বারো কি তেরো, সেটি ছিল গুস্তাফ জানোচের ‘কনভারসেশন উইথ কাফকা’ (কাফকার সঙ্গে কথাবার্তা)। বইটির মাধ্যমে কাফকার দিকে যাওয়ার বিশেষ পথ পেলাম।
হয়তো এ কারণে আমি আইন বিষয়টা অধ্যয়ন করলাম—ঠিক কাফকারই মতো। আমার বাবা কিছুটা অবাক হয়েছিলেন। তিনি নিজে চাইতেন, আমি আইন অনুষদেরই পড়ালেখা করি, কিন্তু তিনি প্রায় নিশ্চিত ছিলেন যে আমি না বলব। কারণ, আমার একমাত্র আগ্রহের জায়গা ছিল শিল্পসাহিত্যে, সংগীতে, চিত্রকলায়, দর্শনে, মোদ্দাকথা সবকিছুতে কেবল আইন ছাড়া। কিন্তু অংশত রাজি হলাম, আমি চিন্তা করলাম, কারণ আমাকে ক্রিমিনাল সাইকোলজি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে। সেই সময়ে, সেই সত্তর দশকের শুরুতে, হাঙ্গেরিতে এটা নিষিদ্ধ বিজ্ঞান ছিল। এটা ছিল পশ্চিমা এবং এ কারণে সন্দেহযোগ্য। কিন্তু আইন পড়ার আসল কারণ হলেন, আমার মনে হয়, কাফকা, কিন্তু মাত্র তিন সপ্তাহের ভেতরে আমি ওই পরিবেশ পরিস্থিতি আর সহ্য করতে পারলাম না, এবং আমি ছেড়ে দিলাম—কেবল আইন অনুষদই নয়, সেই শহর থেকেও চলে এলাম।
সেটা কোথায় ছিল?
ক্রাসনাহোরকাই: শহরটির নাম ছিল সিগেদ। কারণ, মিলিটারি সার্ভিস ব্যবস্থায় এটা ছেড়ে আসা খুব সহজ ছিল না। যদি আমি ছেড়ে দিই, তাহলে আমাকে মিলিটারি সার্ভিসে যেতে হবে। সাধারণত মিলিটারি সার্ভিসটি দুই বছরের মতো হয়ে থাকে, কিন্তু তুমি যদি গ্র্যাজুয়েট হও মানে স্নাতক পাস করো, তোমার মাত্র এক বছর লাগবে। যাহোক, আমি অল্প দিনের ভেতরেই শুরুতেই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিলাম, আমাকে দ্বিতীয় বর্ষে ফিরে যেতে হলো। সুতরাং আমি সময়ক্ষেপণ করা শিক্ষার্থীতে পরিণত হলাম, আর কিছুদিনের জন্য বুদাপেস্টে থাকলাম, পড়ার বিষয় হলো এবার ধর্ম ও ভাষাতত্ত্ব। আমি প্রাচীন গ্রিক ও ল্যাটিন অধ্যয়ন চালিয়ে গেলাম, কিন্তু এতে পরীক্ষা দেওয়াটা ছিল কঠিন। কারণ, আমি তো যথাযথভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম না। ফলে চূড়ান্তভাবে, চার বছর পর আমার দুটো সন্তান হলো। আর বাচ্চা থাকার ফলে মিলিটারি সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। কারণ, যদি তোমার দুটো সন্তান থাকে, তাহলে ওই ভয়াবহ বাধ্যবাধকতা থেকে তোমার মুক্তি মিলে যাবে।
মিলিটারি সার্ভিস, আমার জন্য, বলতে গেলে মৃত্যুরই মতো। সারা বছর একবারের জন্যও আমি কখনো ক্যাম্প ত্যাগ করার অনুমতি পাইনি। আমি কোনো বীরনায়ক বা একজন হাতাশাবাদী লোক নই, কিন্তু তুমি যদি একটা ওয়াচপোস্টে থাকো, এবং সেখানে তোমাকে থাকতে হবে একটা বন্দুক নিয়ে এবং সারা দিন কিছু না করে। মাঝেমধ্যে একজন অফিসার এসে আমাকে দেখে যেত, এবং যদি আমি কাফকা পড়া শুরু করি, আমি একেবারে পড়া থামাতে পারি না। কারণ, নির্বোধ অফিসারের চেয়ে কাফকা অনেক বেশি চমকপ্রদ, অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং। ফলে সব সময় আমাকে ক্যাম্পের বন্দীশালায় শাস্তি পেতে হতো। সেটা খুব ভয়াবহ ছিল না, কিন্তু এর মানে এ–ও না যে আমি ক্যাম্প ছেড়ে কোথাও যেতে পারব। এটাই ছিল আমার জন্য ভয়াবহ—সেখানে একটানা সব সময় থাকতে হবে।
মিলিটারি সার্ভিসের শুরুটা আমার জন্য সবচেয়ে জটিল ছিল। যখন আমি রাতের ট্রেনে রওনা হলাম, সঙ্গে অন্য সব নতুন মিলিটারি সৈনিকেরা, মনে হচ্ছিল যে আমি একদম শেষ হয়ে গেছি। আমি কারও সঙ্গে কোনো কথা বলিনি। সবাই নানা রকমের ঠাট্টা–মশকরা করতে চাইল, কিন্তু আমি একদম পাত্তা দিলাম না। আমি দেখলাম, আরও একজন, এক তরুণ, যাঁর দশা একেবারেই আমার মতো। সুতরাং আমরা দুজন অল্প কিছু কথাবার্তা বললাম। আমরা কথা বললাম, যদি সুযোগ হয় কীভাবে, যদি আমরা একে অন্যের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করব। এক সপ্তাহ পর যখন আমি একটা ফাঁকা সময় পেলাম, আমি সেই বিল্ডিংয়ে গেলাম, যেখানে সে কাজ করে এবং জানতে চাইলাম, আমি তাকে কোথায় পেতে পারি? কেউ একজন বলল, তৃতীয় তলায়। তৃতীয় তলায় গিয়ে আমি আবারও জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় আমি সেই ব্যক্তিকে পেতে পারি? তখন কেউ একজন বলল, ওই ব্যক্তিকে শাস্তি হিসেবে অস্ত্রশস্ত্রের স্টোরে পাঠানো হয়েছে। সে অস্ত্র পরিষ্কার করছিল, যেই মাত্র দরজাটা খুলল, সে নিজের মুখে গুলি করল। একদম হুবহু একই মুহূর্তে। আমি দরজা খুললাম আর আমার ওই বন্ধু নিজেকে গুলি করল। আমি তো তখন বাচ্চামতো ছিলাম। আমরা সবাই তখন বলতে গেলে শিশু। আমাদের সবার বয়স তখন খুব বেশি হলে ১৮ বছরের এদিক–ওদিক।
আচ্ছা, তোমার প্রশ্নটা যেন কী ছিল?
আমি স্রেফ আপনার দিনপিঞ্জর একটা খসড়া রূপরেখা পেতে চেষ্টা করছি। আপনি গিউলেতে জন্ম নিলেন, এরপর এল মিলিটারি সার্ভিসে যোগ দিলেন, অধ্যয়ন করলেন সিগেদ বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন, আপনার ওয়ান্ডারারে, এবং ‘সাতানট্যাঙ্গো’ প্রকাশিত হলো। আপনি বার্লিনে এলেন ১৯৮৭ সালে এবং হাঙ্গেরিতে ফিরলেন ১৯৮৯ সালে।
ক্রাসনাহোরকাই: আমি সব সময় বারবার জার্মানিতেই ফিরে এসেছি। নব্বই দশকের শুরুর দিকে আমি ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লিখতে শুরু করলাম। আমি জানতে চাইছিলাম রোমান সাম্রাজ্যে সীমান্ত বা বর্ডার বলতে আসলে কী বোঝাত। দৃষ্টান্ত হিসেবে আমি যেমন ডেনমার্কে গেলাম বা গ্রেট ব্রিটেনে, ফ্রান্সে, ইতালিতে, স্পেনে, গ্রিসে—খুঁজে পেতে চেষ্টা করলাম মিলিটারি প্রতিরক্ষার ক্ষয় এবং অবশেষগুলো। আমি সব সময় ছিলাম সফরের ভেতরে। এটা ছিল ১৯৯৬ সালের আগপর্যন্ত। আমার মনে হয় যে সত্যিকার অর্থে ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ লিখতে শুরু করলাম, যে সময়ে আমি নিউইয়র্কে, অ্যালান গিন্সবার্গের ফ্ল্যাটে ছিলাম।
কোনটা উপন্যাস বা কোনটা ছোটগল্প, সেটা পৃষ্ঠাসংখ্যার ওপর নির্ভর করে না। একটি উপন্যাসের থাকে বিপুল নির্মাণ-প্রযুক্তি, অনেকটা সেতু তৈরির মতো, স্তম্ভ-খিলান, একেবারে শুরু থেকে শেষ অব্দি। গল্পের বেলায়, খিলান বা স্তম্ভের কোনো দরকার নেই। অন্যদিকে একটি ছোটগল্প হলো কালো বাক্স, এর ভেতরে কী ঘটছে কেউ জানে না।লাসলো ক্রাসনাহোরকাই
গিন্সবার্গের সঙ্গে কীভাবে আপনার দেখা হলো?
ক্রাসনাহোরকাই: আমাদের দুজনের সঙ্গেই একজনের পরিচিত ছিল, যে আবার ছিল আমাদের মিচ্যুয়াল ফ্রেন্ড। অ্যালেন খুবই বন্ধুসুলভ মানুষ। তাঁর অ্যাপার্টমেন্টের দরজা ও এর লক ছিল একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। লোকজন অবিরাম আসছে আর যাচ্ছে। সেখানে থাকাটা এক অসামান্য অভিজ্ঞতা, কিন্তু গিন্সবার্গের সার্কেলে থাকাটা আবার একই সঙ্গে খুবই বিরক্তিকর। দিনের বেলায় আমি কাজ করতে পারতাম, আর রাতের বেলা, সেটা ছিল এমন সময়, যখন গিন্সবার্গ সত্যিকারভাবে জীবন্ত হয়ে দেখা দিত, আমি ওদের সঙ্গে পার্টিতে, আড্ডায় আর গানবাজনায় অংশ নিতাম। আমি কখনো তাদের বলিনি যে আমি গিউলে থেকে এসেছি, কিন্তু ব্যাপারটা আমি একমুহূর্তের জন্য ভুলে থাকতে পারতাম না, তুমি জানো? সেটা আমি যথার্থই ছিলাম এক প্রাদেশিক মফস্সলের বালক, যার কোনো চুল নেই, কিছু দাঁত পড়ে গেছে, যে একটা পোড়খাওয়া মানুষ, রান্নাঘরে অ্যালেনের পাশে বসার সময় আমি ছিলাম তা-ই, আর অন্যদিকে সেই সব গায়ক, কবি, পেইন্টার—যারা সবাই অবিনশ্বর মানুষ।
আমার মনে পড়ে আপনি একবার একধরনের সময়হীনতা বা নিষ্কালের বোধ অনুভব করতেন সব সময় এবং এর সঙ্গে সোভিয়েত সাম্রাজ্যের ভেতর বেড়ে ওঠার ব্যাপার কেমন ছিল, যেটা ইতিহাসে এখন বিলুপ্ত।
ক্রাসনাহোরকাই: এটা ছিল একটা সময়হীন সমাজ, কারণ তারা চাইত তুমিও এই চিন্তা করবে, যে বিষয়গুলো আর কখনোই বদলে যাবে না। সব সময় একই ধূসর আকাশ আর বিবর্ণ গাছপালা, পার্ক আর রাস্তাগুলো, বিল্ডিং আর শহরনগরগুলো, এবং বারে সব সময় থাকবে সেই ভয়বাহ পানীয় এবং দ্রারিদ্য ও নিষিদ্ধ জিনিস নিয়ে তুমি কখনোই সশব্দ কিছু বলতে পারবে না। তুমি বেঁচে থাকবে এক অনন্তের জগতে। এসব ছিল খুব হতাশাব্যঞ্জক। আমার প্রজন্মই প্রথম নয়, যারা কমিউনিস্ট তত্ত্বে বা মার্ক্সবাদে কেবল অবিশ্বাস করত, না তা নয়, তারা দেখল এটা বড়ই হাস্যকর ও বিরক্তিকর। যখন আমি এই ব্যবস্থার শেষাবধি যে এর ভেতর দিয়ে এলাম, এটা ছিল সত্যিই বিস্ময়কর। রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাওয়ার স্বাদের কথা আমি কখনোই ভুলব না। এ কারণেই আমার এখন জার্মান নাগরিকত্ব আছে, কারণ আমার কাছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থই হলো আগ্রাসী মূঢ়তা, যা এখনো পূর্ব ইউরোপের ঈশ্বর হয়ে আছে, এর বিরুদ্ধে মুক্তির স্বাদ।
আমি এসেছি একটা বুর্জোয়া জগৎ থেকে, যেখানে কমিউনিস্ট তত্ত্বের কখনোই কোনো ভূমিকা ছিল না। আমরা ছিলাম সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, আমার পরিবার, আমার বাবা ছিলেন একজন উকিল, এবং তিনি গরিব মানুষদের সাহায্য করতেন। সেটাই ছিল আমার জীবনের বাস্তবতা—সপ্তাহে দুই কি তিন দিন সন্ধ্যায় দরিদ্র মানুষেরা আমাদের কাছে আসত, আমার বাবা কোনো রকম ফি নেওয়া ছাড়া তাদের সাহায্য করতেন। পরের দিন, একবারে সকালের শুরুতে, তারা এল এবং দরজার বাইরে কিছু রেখে গেল—দুটো মুরগি, আমি জানি না কী।
আর আপনার মা–বাবা তো ইহুদি, তাই না?
ক্রাসনাহোরকাই: আমার বাবার শিকড় ইহুদি বংশে। কিন্তু তিনি এই গোপন বিষয়টি তখন ফাঁস করলেন, যখন আমার ১১ বছর বয়স। এর আগে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। সমাজতান্ত্রিক যুগে এটা উল্লেখ করা তো নিষিদ্ধ ছিল। যাহোক, আমি হলাম আধা ইহুদি, কিন্তু ঘটনাগুলো যদি বজায় থাকত, তাহলে হাঙ্গেরিতে যেমনটা তারা করত বলে মনে হয়, আমি শিগগিরই পুরো ইহুদিতে পরিণত হতাম।
যুদ্ধের সময় আপনার বাবা কীভাবে রক্ষা পেলেন?
ক্রাসনাহোরকাই: আমাদের আসল নাম হলো কোরিন, এটা ইহুদি নাম। এই নাম নিয়ে তিনি কোনোভাবেই টিকে থাকতে পারতেন না। আমার পিতামহ ছিলেন দারুণ প্রাজ্ঞ মানুষ। তিনি আমাদের নাম ক্রাসনাহোরকাইয়ে বদলে দিলেন। ক্রাসনাহোরকাই হলো আদি দেশের উৎসে ফেরার পক্ষে থাকার মতো নাম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর হাঙ্গেরি এর তিন ভাগের দুই ভাগ হারাল। এর প্রধান রাজনৈতিক ধারা হলো রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী সরকার, তাদের কাজ ছিল হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করা। তখনকার একটি বিখ্যাত গান আছে, একটি অপ্রতিরোধ্য আবেগময় গান, যেটা ছিল ক্রাসনাহোরকাই ক্যাসেল বা দুর্গ নিয়ে। যুদ্ধের পর এটা চেকশ্লোভাকিয়ার অংশ হয়ে যায়। ক্রাসনাহোরকাই দুর্গের গানটা খুব দুঃখজাগানিয়া এবং বিষাদকালো এবং সবকিছু সেখানে হতাশায় ভরা। হয়তো এ কারণে আমার পিতামহ সেটা বেছে নিয়েছিলেন। আমি ঠিক জানি না। কেউ জানে না, কারণ তিনি ছিলেন খুবই চাপা ধরনের মানুষ। বছরটি ছিল ১৯৩১, প্রথম ‘হাঙ্গেরীয় ইহুদি আইন’ তৈরির ঠিক আগের বছর।
আপনার লেখালেখি নিয়ে আরও কথা বলতে চাই। একটা বিষয় আমার কাছে গূঢ় ষড়যন্ত্রের মতো মনে হয়, আপনাকেও মনে হয় যে আপনি মাত্র চারটি উপন্যাস লিখেছেন।
ক্রাসনাহোরকাই: সেখানে আছে ‘সাতানট্যাঙ্গো’, ‘দ্য মেলানকোলি অব রেজিস্ট্যান্স’, ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’, ব্যারন ওয়েনখাইম’স হোমকামিং’।
সেখানে আপনি, যেমন ‘অ্যানিমেলসাইড’-এর মতো লেখাকে কোথায় রাখবেন?
ক্রাসনাহোরকাই: ‘অ্যানিমেলসাইড’ও একটি উপন্যাস, যদিও খুব আঁটো বিবেচনায় এটা উপন্যাস নয়। কিন্তু কোনটা উপন্যাস বা কোনটা ছোটগল্প, সেটা পৃষ্ঠাসংখ্যার ওপর নির্ভর করে না। আমি আমার লেখকজীবনের শুরুতে কিছু ছোটগল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম, যেগুলো আছে ‘রিলেশন অব গ্রেস’-এ (১৯৮৬)। সেই সব ছোটগল্প খুব স্বল্প পরিসরে কাজ করে, কাজ করে খুব ধারাবাঁধা সময়ের সীমায়, এর মধ্যে থাকে একটা একক চরিত্র। একটি উপন্যাসের থাকে বিপুল নির্মাণ-প্রযুক্তি, অনেকটা সেতু তৈরির মতো, স্তম্ভ-খিলান, একেবারে শুরু থেকে শেষ অব্দি। গল্পের বেলায়, খিলান বা স্তম্ভের কোনো দরকার নেই। অন্যদিকে একটি ছোটগল্প হলো কালো বাক্স, এর ভেতরে কী ঘটছে কেউ জানে না।
নতুন উপন্যাস ‘ব্যারন ওয়েনখাইম’স হোমকামিং’, এটার বেলায় কী বলবেন? এটা কি ওডিসি–জাতীয় কিছু?
ক্রাসনাহোরকাই: হ্যাঁ। এর প্রধান চরিত্রের জন্য, এটা এমন এক হোমকামিং, যা তার জীবনের শেষ সময়ে বাড়ি ফিরে আসাকে নিয়ে ঘটেছে। সে একজন বুড়ো মানুষ, যে বুয়েনস এইরেসে বসবাস করে। সে খুবই সংবেদনশীল, যেমনটা গিউলা কুরুদি। কিন্তু খুবই হতভাগ্য—সে সব সময়ই সারা জীবন ধরে কেবল ভুলই করে গেছে।
এ জন্যই তার নাম মিশকিন, আপনার প্রতিরক্ষাহীন চরিত্র?
ক্রাসনাহোরকাই: হ্যাঁ, অনেকটা এস্তাকের মতো। কারণ, এই উপন্যাস হলো আমার সারমর্ম, আদতে, আমার সব উপন্যাসে—তুমি বিপুল পরিমাণ সমান্তরাল চরিত্রর সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারবে, অনেক গল্পের সঙ্গেও মেলাতে পারো। আমি ‘সাতানট্যাঙ্গো’ নিয়ে মজা করেছি, এবং আরও অন্যগুলো নিয়ে যা যা। বোধ করি, এটাই আমার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
আমি আসলে মাত্র একটি বই লিখতে চেয়েছিলাম। আমি আমার প্রথম উপন্যাসটি দিয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম না এবং এ জন্য আমি দ্বিতীয়টা লিখলাম। আমি দ্বিতীয়টিতেও তৃপ্ত হতে পারলাম না, এ জন্য তৃতীয়টি লিখলাম, এবং এভাবেই বিষয়টি ঘটে চলল। এখন এই ব্যারনের সঙ্গে আমি এই গল্প বেছে নিলাম। এই উপন্যাসের মাধ্যমে আমি প্রমাণ করতে পারি যে আমি সত্যিকার অর্থেই সারা জীবন ধরে একটা বই-ই লিখতে চেয়েছি। বইটা হলো ‘সাতানট্যাঙ্গো’, ‘মেলানকোলি’, ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ ও ‘ব্যারন’। এগুলো আসলে আমার একটিই বই।লাসলো ক্রাসনাহোরকাই
আপনার শ্রেষ্ঠ?
ক্রাসনাহোরকাই: সবচেয়ে মজার বই অর্থে। এটি ধ্বংসাত্মক কোনো বার্তা দিয়ে পরিপূর্ণ নয়। বরং এটা স্বয়ং ধ্বংস। এটা ইতিমধ্যে এসে গেছে।
কিন্তু তারপর আমার মনে হয়, আপনার সব বইয়ের ভেতরে এই ধ্বংসাত্মক প্রবণতা ইতিমধ্যে বিদ্যামন, নিহিতভাবে গোপনে এসেছে। আমি অবাক হব যদি বলি, জগতে এখন মাত্র দুই ধরনের ঔপন্যাসিক আছেন। তাঁরা প্রতিটি উপন্যাসে আলাদা বিষয় বেছে নেন, এবং আরেক দিকে আছেন যাঁরা, তাঁরা একটা উপন্যাসই বারবার লিখে চলেন, যাতে তাঁদের সব উপন্যাস এর সঙ্গে জুড়ে যায়।
ক্রাসনহোরকাই: আমি হাজারবারের মতো বলেছি যে আমি আসলে মাত্র একটি বই লিখতে চেয়েছিলাম। আমি আমার প্রথম উপন্যাসটি দিয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম না এবং এ জন্য আমি দ্বিতীয়টা লিখলাম। আমি দ্বিতীয়টিতেও তৃপ্ত হতে পারলাম না, এ জন্য তৃতীয়টি লিখলাম, এবং এভাবেই বিষয়টি ঘটে চলল। এখন এই ব্যারনের সঙ্গে আমি এই গল্প বেছে নিলাম। এই উপন্যাসের মাধ্যমে আমি প্রমাণ করতে পারি যে আমি সত্যিকার অর্থেই সারা জীবন ধরে একটা বই-ই লিখতে চেয়েছি। বইটা হলো ‘সাতানট্যাঙ্গো’, ‘মেলানকোলি’, ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ ও ‘ব্যারন’। এগুলো আসলে আমার একটিই বই।
আপনি কি তাড়না বোধ করেছিলেন এমন কিছু লিখবেন, যা সম্পূর্ণ এই উপন্যাসগুলোর বাইরের কোনো বিষয়?
ক্রাসনাহোরকাই: না। এটা নিয়ে আমি মোটেও মাথা ঘামাইনি, যেমন জোহান সেবাস্টিয়ান বাখ যদি সারা জীবন ধরে একই অবস্থানে থাকলেন।
আপনি প্রায়ই বাখের কাছে ফিরে যান—আরেকজন বারোক সংগীত-সুরকার, যেমন রুমৌ। এ কারণেই কি বারোকরীতি আপনার কাছে এত গুরুত্ব পায়?
ক্রাসনাহোরকাই: বাখের সুরের মূর্ছনা-ঐক্যতানের কারণে কাঠামোগতভাবে জটিল, যে জন্য আমি রোমান্টিক কোনো সুর একেবারেই নিতে পারি না। শেষ দিকের বারোকের পর সংগীত আরও বেশি বেশি অশ্লীল হতে শুরু করে, এবং এই অশ্লীলতা চূড়ান্তে চলে আসে রোমান্টিকদের সময়। এর ভেতরে কিছু ব্যতিক্রমী সুরকার আছেন, যেমন স্ট্রেভেনিস্কি বা শাস্টাকোভিচ বা বার্টক বা কুর্তাগ, যাঁদের আমি খুবই পছন্দ করি, কিন্তু আমি এ–ও মনে করি যে তাঁরা যেমনটা সব সময় ব্যতিক্রমীদের মধ্যে পড়েন। আমার কাছে সংগীত একটা পরম্পরার ব্যাপার। এবং দুই হাজার বছর পর সাহিত্যের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা ঘটবে। কিন্তু অশ্লীলীকরণের প্রক্রিয়াটিকে বিশ্লেষণ করার বিষয়টি খুবই কঠিন। আধুনিক সমাজের ভেতরে ভয়াবহ বিপ্লব ঘটে চলেছে এবং বস্তুত ঘটে গেছে। এর মানে গণসংস্কৃতির জয় হয়েছে তা কিন্তু নয়, জয় হয়েছে টাকাপয়সার। কালেভদ্রে একটি অতি উচ্চমানের সাহিত্যকর্ম লেখা হলে মধ্যম স্তরে কিছুটা পৌঁছায় এবং বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছায়—সমকালীন লেখকদের বেশির ভাগেই এই হয়তো নিয়তি।
আপনার উপন্যাসের ক্ষেত্রে?
ক্রাসনাহোরকাই: না, আমার উপন্যাসগুলো মধ্যস্তরের ওপরে কাজ করে না, কারণ আমি কখনোই আপস করিনি, আমার জন্য সাহিত্য হলো অতীব একান্ত কাজ। আমার নিজের লেখা সাহিত্য নিয়ে কথা বলতেও আমি লজ্জা পাই, কুণ্ঠাবোধ করি—এটা অনেকটা একই রকমের যদি তুমি আমার সবচেয়ে ব্যক্তিগত গোপন বিষয়গুলো সম্পর্কে জানার ইচ্ছা পোষণ করতে। আমি কখনো সাহিত্যিক জীবনের অংশ ছিলাম না কোথাও, কারণ আমি লেখক হিসেবে সামাজিক বোধের দিক থেকে, অনেক কিছু মেনে নিতে পারি না। কেউ আমার সঙ্গে সাহিত্য নিয়ে কথাবার্তা বলতে পারে না—শুধু তুমি ও তোমার মতো অল্প কিছু লোক ছাড়া। সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে আমার ভালো লাগে না, আরও বিশেষ করে তা যদি হয় আমার লেখা সাহিত্য নিয়ে। সাহিত্য খুবই ব্যক্তিগত একটা বিষয়।
যখন আমি কোনো বই লিখি, সেটাকে আমি আমার মাথার ভেতরে লিখে ফেলি। যখন থেকে আমি একদম তরুণ, আমি এই প্রক্রিয়াতেই কাজ করতাম। আমার শৈশবে, আমার স্মৃতি ছিল একদম অস্বাভাবিক। আমার ছিল একেবারে ফটোগ্রাফিক মেমোরি। এবং এ জন্য আমি উপযোগী কাঠামো, একটি বাক্য, কিছু কিছু বাক্য, আমার মাথায়, যখন পুরো প্রস্তুত হয়ে যায়, আমি তখন সেটা লিখতে বসি।
আপনি পুনর্লিখন করেন না?
ক্রাসনাহোরকাই: প্রতিটি মুহূর্তে আমি কাজ করি, যেমন করে কোনো কারখানা অবিরাম উৎপাদন করে চলে। যদি আমি অসুস্থ থাকি, আমি তখনই কেবল লিখতে পারি না। এবং আমি মদে চুর হতাম যে সময়টায়, তখন আমি একদম লিখতে পারতাম না। এ রকম ব্যতিক্রমী দশা ছাড়া আমি কাজ আর কাজ নিয়ে কাটাই, কারণ একটি বাক্য শুরু হওয়া মানে এর পরে এক শ বাক্য, এর তালে তালে হাজার বাক্য হাজির হতে থাকে, যেভাবে সুন্দর সুতা ছাড়তে থাকে কোনো মাকড়শা। তাদের একটি বাক্যই অন্য সব বাক্যের চেয়ে আলাদা আলাদা করে গুরুত্বপূর্ণ, এবং আমি ওটা আলাদা করে তুলে নিয়ে ওর ওপর কাজ করতে থাকি, সংশোধন করি, ঠিকঠাক করে সেটি গড়ে তুলতে থাকি। এ কারণে যদিও আমার বইগুলোর দারুণ সব অনুবাদ হয়েছে, আমার ইচ্ছা করে, তুমি যদি এগুলো মূল ভাষায় পড়তে, কারণ যখন আমি কাজ করি, বাক্যটির সঙ্গে প্রথম যে কাজটি করি তা মাথার ভেতরে সারি, যাতে সেটি ছন্দময়তার দিক থেকে নিখুঁত হয়। যখন আমি কাজ করি, তাতে আমি সেই কলাকৌশলই ব্যবহার করি, যেটা কিনা সংগীতে সুর দিতে প্রয়োগ করা হয়, এবং সে রকমই সাহিত্যের নির্মাণে। সংগীত, সাহিত্য, দৃশ্যনির্ভর শিল্পকলা একই উৎসজাত—ছন্দের কাঠামো ও গতির দিক থেকেও—আর আমি সেই উৎস থেকেই কাজটা করি। সংগীতের বেলায় এবং উপন্যাসের বেলায় দুয়ের বিষয়বস্তু যদিও একেবারেই আলাদা। কিন্তু সারবত্তা, আমার জন্য, সত্যিকারভাবেই একই রকম।
শেষ করার আগে একটা শেষ প্রশ্ন। আপনি বলেছিলেন ‘ব্যারন ওয়েনখাইম’ হতে পারে আপনার শেষ উপন্যাস। কিন্তু আমি তো জানি, আপনি এখনো লিখে যাচ্ছেন। এর মানে কি এই যে আপনি যেটা এখন লিখছেন, তা কোনো উপন্যাসজাতীয় কিছু নয়?
ক্রাসনাহোরকাই: ছোট আকারের জিনিস। কোনো বড় কাঠামোজাত কিছু নয়। আমি শেষ উপন্যাসটির পরও ইতিমধ্যে তিনটি ছোট বই লিখেছি। এর প্রথমটি হলো ‘দ্য ম্যানহাটান প্রজেক্ট’ (২০১৭)। এটা হলো আমার পরের দ্বিতীয় বইটার প্রলোগ, আমার নিউইয়র্ক বই। এর আপাতত নাম হতে পারে কিছুটা এ ধরনের ‘স্পেডওয়ার্ক ফর আ প্লেস’। এবং আমি সেই সঙ্গে আমি আরও একটা বই লিখতে চাইছি, যেটা আমি একদম শুরু থেকে, কারণ একেবারে তরুণ বয়স থেকে আমি হোমারের ভক্ত। এই গত শরতে আমি দালমেইশাতে বেড়াতে গিয়েছিলাম, অ্যাড্রিয়াটিক উপকূলে। এই সফরে আমি অ্যাড্রিয়াটিকের একটা দ্বীপে গিয়েছিলাম, সেখানে হঠাৎ ওডিসির একটা পৌরাণিক ঘটনা ফিরে এল। আমি সেটা নিয়েই একটা বই লিখছি। একটি ছোট বই, নভেলার মতো কিছু একটা হবে আরকি।
আপনি কি ‘ব্যারেন ওয়েনখাইম’স হোমকামিং’–এর পর আরেকটি উপন্যাস লেখার কথা সত্যি চিন্তা করছেন?
ক্রাসনাহোরকাই: উপন্যাস? না। যখন তুমি এটা পড়বে, তুমি বিষয়টা বুঝতে পারবে। ‘ব্যারেন ওয়েনখাইম’স হোমকামিং’ই হবে আমার শেষ লেখা উপন্যাস।