মোহাম্মদ আজমের সাক্ষাৎকার

‘বাংলা একাডেমিকে এর স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করতে দিতে হবে’

গত বছর গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আশীষ-উর-রহমান

প্রথম আলো:

’২৪–এর গণ-অভ্যুত্থানের পর এমন এক সময়ে দায়িত্ব পেলেন যখন নতুন কিছুর জন্য সবার অনেক প্রত্যাশা। আপনি কেমন চ্যালেঞ্জ অনুভব করলেন?

মোহাম্মদ আজম

একটা কথা বলে রাখা দরকার। গণ-অভ্যুত্থানের পর লোকে নতুনত্বের কথা বেশি বলেছে। এ ধরনের নতুনত্ব আসলে হয় না। কোনো রাষ্ট্র, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তন একটা ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। বড় গণ-আন্দোলনের কারণে মানুষের আকাঙ্ক্ষার পারদ তুঙ্গে ছিল। এটা হওয়া খুব স্বাভাবিক। আকাঙ্ক্ষাই মানুষকে চালিত করে। তবে আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিলাম যে পরিবর্তনটা আসলে প্রাতিষ্ঠানিক হওয়া উচিত; প্রতিষ্ঠানের সূত্র মেনে এবং ধারাবাহিকভাবে হওয়া উচিত। সে কারণে বাংলা একাডেমিতে যোগ দিয়ে প্রথম থেকেই মূলত বাংলা একাডেমিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সচল ও মসৃণ করার ব্যাপারেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। সেভাবেই চিন্তা করেছি। এখন পর্যন্ত সে রকম কাজই করেছি।

প্রথম আলো:

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের সাংস্কৃতিক পরিসরে কেমন পরিবর্তন এল?

মোহাম্মদ আজম

এখানে দুটি ভাগ করা দরকার। একটা হলো সাংস্কৃতিক ও চিন্তার জগতে যে পরিবর্তন, সেটা। আরেকটা হলো সেই পরিবর্তন একাডেমিক রচনা বা তৎপরতায় রূপান্তরিত হওয়া। বাংলা একাডেমি যেহেতু একাডেমিক, অর্থাৎ দ্বিতীয় ভাগ নিয়ে কাজ করে, সেহেতু বাংলা একাডেমির ওপর এর প্রভাব কম পড়ার কথা এবং কমই পড়েছে।

আমি প্রত্যক্ষভাবে যে ব্যাপারটা বোধ করেছি, সেটা হলো অনেক সময়ই আমাদের বিভিন্ন একাডেমিক কাজে আমরা এমন অনেককে পাইনি, যাদের ভালোভাবে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে। এই পরিবর্তনটা আমি বেশি বোধ করছি।

প্রথম আলো:

এতে কি বাংলা একাডেমি নিয়ে আপনার পরিকল্পনামতো কাজ ব্যাহত হচ্ছে?

মোহাম্মদ আজম

ব্যাহত হয়েছে, সেটা বলব না, তবে কঠিন হয়েছে। বাংলা একাডেমি যে ধরনের কাজ করে, তার জন্য রাতারাতি যোগ্যতা অর্জন করা কঠিন। ফলে যা সহজেই হতে পারত, তা অনেক বেশি পরিশ্রম করে করতে হয়েছে।

প্রথম আলো:

এতে কি কাজের গতি ধীর হয়েছে?

মোহাম্মদ আজম

না, তা আমি বলব না। আমাদের বেশি পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমরা সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, পত্রিকা করছি। এগুলোর একটা নির্দিষ্ট সীমা আছে।

‘চূড়ান্ত স্বায়ত্তশাসন ইউটোপিয়ান কন্ডিশন। রাষ্ট্রের প্রভাব থাকবেই, প্রশ্ন হলো মাত্রা কতটা। গণ-অভ্যুত্থানের পরে লোকে নতুনত্বের কথা বেশি বলেছে। এ ধরনের নতুনত্ব আসলে হয় না। পরিবর্তনটা প্রাতিষ্ঠানিক ও ধারাবাহিক হওয়া উচিত। ’
মোহাম্মদ আজম, মহাপরিচালক-বাংলা একাডেমি
প্রথম আলো:

বাংলা একাডেমি কি রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে কাজ করতে পারছে বা ভবিষ্যতে পারবে?

মোহাম্মদ আজম

পুরোনো ধারাবাহিকতা নিঃসন্দেহে নেই। সরকারি প্রভাব আমি খুব বেশি বোধ করিনি, বেশির ভাগ কাজে বোধ করিনি। তবে চূড়ান্ত স্বায়ত্তশাসন কিংবা রাজনীতি বা রাষ্ট্রের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকা খুবই আদর্শ পরিস্থিতি, একটা ‘ইউটোপিয়ান’ পরিস্থিতি। এটা দুনিয়ার কোথাও হয়নি। প্রশ্ন হলো এর মাত্রা কতটা, ক্ষেত্র কী কী এবং কী ধরনের। সেদিক থেকে বিচার করলে বলব, রাষ্ট্রের একটা প্রভাব, একটা চাহিদা বাংলা একাডেমির ওপর থাকবেই। কারণ, রাষ্ট্রের বহু ধরনের ব্যাপারের সঙ্গে বাংলা একাডেমি যুক্ত। সে ব্যাপারগুলো যে স্বায়ত্তশাসনের ক্ষতি করে বা কাজের খুব বাধা তৈরি করে, ব্যাপারটা ঠিক তেমন নয়। যদি এটা রুচি, মাত্রা, সীমা—এসব ছাড়িয়ে যায় তখন ক্ষতির কারণ হয়। একটা বই প্রকাশিত হবে, গবেষণা পরিচালিত হবে কিংবা বিধান প্রণীত হবে—এ ধরনের কাজে সরকার চাইলে কী করতে পারে? যার বই প্রকাশের যোগ্য নয়, এমন লোকেরা এই বলে চাপ দিতে পারেন যে ‘আমার বইটা প্রকাশ করেন’। এগুলো রুচি ও মাত্রার লঙ্ঘন। এমন লঙ্ঘন না হলে আমি বলব বাংলা একাডেমির ওপর সরকারের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ বেশ সীমিত।

প্রথম আলো:

কিন্তু অতীতে তো প্রভাবের ঘটনা দেখা গেছে। যেমন ১০০টি বইয়ের একটি সিরিজ প্রকাশিত হয়েছিল, যার লেখক ও লেখার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি অন্য প্রকাশনীর বইও এই সিরিজে অন্তর্ভুক্ত করে বাংলা একাডেমি প্রকাশ করেছিল।

মোহাম্মদ আজম

আপনি ঠিকই বলেছেন। ওই সময়টাতে বাংলা একাডেমি অনেক বেশি পরিমাণে নিজের কাজের পরিবর্তে রাজনৈতিক কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। দলীয় কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। কুৎসিতভাবে বাংলা একাডেমির ওপর আমরা সরকারি ও দলীয় প্রভাব বিস্তার হতে দেখেছি। সেটার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হয়েছে। আমরা এখন এর দায় বহন করছি। একদিকে সংস্কৃতির অবনতি, অন্যদিকে বাংলা একাডেমির নিয়মিত কাজ—যেমন প্রকাশনা—সেগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে। গত এক বছরে নানা কারণে এটা অনেক কম ছিল।

প্রথম আলো:

এবার তো বাংলা একাডেমির পুরস্কার নিয়ে অনেক বিতর্ক হলো। অনেকে বলছেন, সরকারের ভেতর থেকে চাপ ছিল। আসলে দায় কার?

মোহাম্মদ আজম

পুরস্কারের ব্যাপারে সরকারের কোনো প্রভাব ছিল না। কমিটি নিজেদের মধ্যে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কোনো কোনো সিদ্ধান্তে হয়তো ভুল হয়েছে। সে কারণে এ ঘটনা ঘটেছে। তবে সেটা আমাদের কারণেই হয়েছে। আগের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল, না পরেরটা—ভবিষ্যৎ সেটা নির্ধারণ করবে।

ভবিষ্যতে যে এ ধরনের বিতর্ক হবে না, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত বা খুব আশাবাদী নই। কারণ, যাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এগুলো শুধু তাঁদের ওপর নির্ভর করে না। আপনি কী নিয়ে কতটা বিতর্ক করবেন, এটা জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, ইতিহাস আর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপরে নির্ভর করে।

প্রথম আলো:

বাংলা একাডেমির ওপরে বিগত গণ-অভ্যুত্থানের প্রভাব কেমন?

মোহাম্মদ আজম

বাংলা একাডেমিতে যে এককেন্দ্রিক চর্চা ছিল, মানে ইতিহাসের একটা ধারা চর্চিত হবে, প্রগতির একটা সুনির্দিষ্ট ধারা চর্চিত হবে, একটা মতাদর্শিক বা দলীয় অংশ এখানে আসবে, সে রকম যে চূড়ান্ত চর্চা ছিল, তা ভেঙে পড়েছে। গণ-আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য যে উন্মুক্ততা এবং বহুজনের ও সম্ভাব্য সব পক্ষের অংশগ্রহণ সে ধরনের একটা পরিস্থিতি এখানে বিদ্যমান আছে। সেদিক থেকে পরোক্ষভাবে গণ-আন্দোলনের প্রত্যাশার প্রতিফল এক বছর ধরে বাংলা একাডেমিতে ঘটেছে।

প্রথম আলো:

বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা। সেই লক্ষ্য কতটা অর্জিত হয়েছে?

মোহাম্মদ আজম

প্রথম কথা হলো, বাংলা একাডেমির চর্চা যে আন্তর্জাতিক মানের হয়নি, তাতে সন্দেহ নেই। দ্বিতীয় কথা হলো, বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উপস্থাপনের দায়িত্ব ঠিকমতো পালিত হয়নি বা খুব কম হয়েছে। তবে আমাদের মাথায় রাখতে হবে, বাংলা একাডেমি বা এ ধরনের পৃথিবীর যেকোনো একাডেমি আসলে একধরনের প্রমিতায়নের কাজ করে। সে ভাষা, ব্যাকরণ, সংস্কৃতি বা ইতিহাসের প্রমিতায়ন করে। বাংলা একাডেমি মোটামুটি গ্রহণযোগ্যভাবে একাডেমিক কায়দায় উৎপাদিত জ্ঞানরাশির চর্চা করে, কিন্তু একাডেমির কর্মচারী বা কর্মকর্তারা এটা করে না। আমরা বাইরে থেকে পণ্ডিতদের ধার করে আনি। এখন কর্কশভাবে বললে বলতে হবে, একাডেমি কোন মানের কাজ করতে পেরেছে, তা নির্ভর করে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সংশ্লিষ্ট বিদ্যায়তনের চর্চার মানের ওপর। আমরা জানি, এ ব্যাপারে ঘাটতি আছে। এর বাইরেও একাডেমির নিজস্ব কিছু প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের ক্ষেত্রেও নানা ধরনের ঘাটতির কথা বলা যেতে পারে। আমরা সেগুলো খানিকটা অতিক্রম করার চেষ্টা করেছি। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে কোনো গুরুতর উদ্যোগ নিতে পারিনি।

প্রথম আলো:

বাংলা একাডেমি বিশেষজ্ঞদের এত কম পারিশ্রমিক দেয় যে অনেকে কাজে আগ্রহী হন না। একাডেমিতে পাণ্ডুলিপি জমা দিলে প্রকাশের ক্ষেত্রেও দীর্ঘসূত্রতা আছে। লেখক জানতে পারেন না কবে তাঁর পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হবে কিংবা আদৌ হবে কি না। এতেও লেখকেরা তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাংলা একাডেমিকে দিতে নিরুৎসাহিত হন।

মোহাম্মদ আজম

এই দুই ক্ষেত্রেই আমরা কিছু উদ্যোগ নিয়েছি। সত্যি সত্যিই আমাদের এখানে গ্রন্থ প্রণয়ন, পরীক্ষা করা, সম্পাদনা—এসব ব্যাপারে বরাদ্দ খুবই কম। এর একটা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মাত্রা আছে। সমাজ ও রাষ্ট্র এসব বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে শেখেনি। সরকারকে এটা বোঝাতে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি যে সম্পাদনা বা পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন বা পাণ্ডিত্যের যে কাজ, তা আসলে পরিমাণগত নয়, গুণগত। সেখানে অর্থ বরাদ্দ সে রকমই হওয়ার কথা। অথচ আপনি সেটা বোঝাতেই পারবেন না। তবে এসব ব্যাপারে আমাদের মনোযোগ আছে। গত এক বছরে এসব ক্ষেত্রে বরাদ্দের পরিমাণ খানিকটা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। তবে আবারও বলছি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সচেতন না হলে এ ক্ষেত্রে পূর্ণভাবে সফল হওয়া কঠিন।

এখানে দীর্ঘসূত্রতার কারণে যে অনেকে পাণ্ডুলিপি দিতে অনীহা প্রকাশ করেন, তা একদম ঠিক কথা। বাংলা একাডেমিতে কোনো কোনো পাণ্ডুলিপি ১০ বছর পরে প্রকাশিত হয়। ১০ বছর পরে কোনো পাণ্ডুলিপির প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। সে অর্থে বাংলা একাডেমি বহু বছর ধরে এক অর্থে অপ্রাসঙ্গিক পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করে আসছে।

এ ব্যাপারে আমরা খুবই বড় একটা পদক্ষেপ নিয়েছি। এ পর্যন্ত একাডেমিতে জমা যাবতীয় পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কার্যক্রম নিয়েছি। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এ ঘোষণা দিতে পারব যে বাংলা একাডেমি পাণ্ডুলিপির বিষয়ে হালনাগাদ হয়েছে। পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে জানা যাবে, সেটা প্রকাশিত হবে কি না। এ ঘোষণা দেওয়ার সময় খুব কাছাকাছি চলে এসেছে।

প্রথম আলো:

আপনাদের কাছে কতগুলো পাণ্ডুলিপি জমা আছে?

মোহাম্মদ আজম

আমরা শত শত পাণ্ডুলিপি নিয়ে কাজ করছি। নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। পাণ্ডুলিপিগুলো নানা অবস্থায় আছে।

‘বাংলা একাডেমিতে কোনো কোনো পাণ্ডুলিপি ১০ বছর পরে প্রকাশ হয়। এর মানে আমরা বহু বছর ধরে ইনভ্যালিড বা অবৈধ পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করছি। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি—এখন থেকে পাণ্ডুলিপি জমা দিলে ছয় মাসের মধ্যে জানানো হবে প্রকাশ হবে কি হবে না।’
মোহাম্মদ আজম, মহাপরিচালক-বাংলা একাডেমি
প্রথম আলো:

অনেকে অভিযোগ করেন, একাডেমি তার মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে এসে বইমেলা করা এবং লেখক-সাহিত্যিকদের জন্ম ও মৃত্যুদিবস পালনের আনুষ্ঠানিকতায় সীমিত হয়ে যাচ্ছে? গৌণ কাজে মনোযোগ দিচ্ছে বেশি?

মোহাম্মদ আজম

কথাটি আংশিক সত্য। আমরা অনেক সময় হালনাগাদ তথ্য নিয়ে কথা বলি না। বইমেলার আয়োজন বাংলা একাডেমির কাজ না হলেও বাংলা একাডেমি ঐতিহাসিকভাবে এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। আমরা যত লম্বা কথাই বলি, মেলাকে এখনো বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে সরানো সম্ভব হয়নি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, বইমেলার আয়োজন করা বাংলা একাডেমির প্রধান কাজের মধ্য পড়ে না। সারা পৃথিবীতে মেলা করে সাধারণত প্রকাশক সমিতি। আমাদের এখানে প্রকাশক সমিতি খুবই ভঙ্গুর ও বহুধাবিভক্ত। শক্তিশালী হলে তারা দাবি করতে পারত, এই মেলা আমরা করব।

বাংলা একাডেমির প্রত্যক্ষভাবে গবেষণা করার সুযোগ নেই বা খুব অল্প সুযোগ আছে। বাংলা একাডেমি সারা দেশের গবেষণার যে ফলাফল বইপত্র বা সভা-সমিতি ও সেমিনার আকারে তুলে ধরতে পারে। আমরা বাংলা একাডেমিতে দশটা বাৎসরিক গবেষণাবৃত্তির ব্যবস্থা করেছি। গবেষণার ক্ষেত্রে এটা বেশ বড় ঘটনা। এ ছাড়া আমরা ত্রৈমাসিক ৫০টি গবেষণাপ্রবন্ধের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেছি। এখন এর দ্বিতীয় পর্বের কাজ চলছে। বিজ্ঞানসংক্রান্ত বই লেখার জন্য লেখকদের ডেকেছি। বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষদের ডেকেছি তাদের সাহিত্য ও নৃতত্ত্ব বাংলা অনুবাদে প্রকাশ করার জন্য। এগুলো একধরনের গবেষণারই কাজ।

আমরা পাঠ্যপুস্তক, অনুবাদ ও অপরাপর গবেষণার জন্য নতুন প্রকল্প আহ্বান করেছি। গবেষকেরা একাডেমিকে প্রস্তাব দিলে প্রস্তাব অনুসারে অর্থ বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে। এটা একটা নতুন উদ্যোগ। বলছি না এসব যথেষ্ট। তবে ইতিমধ্যেই অনেকগুলো ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অথচ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের প্রতি সমালোচনার ভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেনি।

গবেষণাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলা একাডেমি যা করতে পারে, তার অনেকগুলো একাডেমি করেছে। তার বড় কাজ হলো ভাষার অভিধান এ ব্যাকরণ প্রণয়ন করা, ভাষার উচ্চারণ নিয়ে কাজ করা। এসব নিয়মিত প্রক্রিয়ায় চলছে।

প্রথম আলো:

একাডেমির একটা বড় কাজ ছিল আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, যা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদনা করেছিলেন। এটি হালনাগাদ করা হচ্ছে না।

মোহাম্মদ আজম

এটা করার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ লাগবে। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, বাংলা একাডেমি ৬৪ জেলার লোকসাহিত্য ভাষা ও অন্যান্য উপাদানের সংকলন করেছে। কিন্তু এর অনেকগুলোই মানসম্পন্ন হয়নি। কারণ, খুব যোগ্য লোক খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি।

আঞ্চলিক ভাষার অভিধান ১৯৬০-এর দশকে বাংলা একাডেমির একটা বড় প্রকল্প ছিল। সেটা আবার করার জন্য ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো একজন মানুষ লাগবে। এটা কেবল টাকার ব্যাপার না। প্রয়োজনীয় টাকা আছে। নির্ভরযোগ্য অন্তত ১০-২০ জন লোক লাগবে। কিছুটা পাণ্ডিত্যপূর্ণ বাসনাও লাগবে যে কাজটা আপনি করবেন। কেউ যদি প্রস্তাব নিয়ে আসে এবং কাদের নিয়ে কাজটা করবে তা জানায়, তবে বাংলা একাডেমি ব্যবস্থা করতে পারে।

প্রথম আলো:

বাংলা একাডেমির বর্তমান যে কাঠামো তা কি একাডেমির কার্যক্রমের জন্য যথেষ্ট, নাকি এর সংস্কার প্রয়োজন?

মোহাম্মদ আজম

লোকবল, কাঠামো এবং বিভিন্ন বিভাগ কাজের জন্য বেশ ভালো বলে আমি মনে করি। কিছু ছোট সমস্যা আছে। যেমন বিভাগ আটটা, কিন্তু অনুমোদিত পদ পাঁচটি। তবে এগুলো বড় কোনো সমস্যা নয়। বড় সমস্যা হলো প্রকাশনা ও গবেষণা করার মতো যোগ্য লোক কমে গেছে। কোনো কোনো পদে সরাসরি কাজ করতে অভিজ্ঞ ও সক্ষম এমন কিছু লোক নিয়োগ দেওয়ার অবকাশ আছে। এটা আরও বাড়াতে হবে বলে বোধ করেছি।

প্রথম আলো:

এর জন্য কি বাড়তি আর্থিক বরাদ্দ প্রয়োজন?

মোহাম্মদ আজম

উন্নত গবেষণার জন্য অবশ্যই বাড়তি অর্থের প্রয়োজন। তবে আমি এখানে আছি ১১ মাস। এখন যে ধরনের কাজ চলছে, তাতে এ মুহূর্তে বাড়তি অর্থের প্রয়োজন দেখছি না। আর্থিক সংকট বাংলা একাডেমির প্রধান সংকট নয়।

প্রথম আলো:

পাঠক, লেখক ও গবেষকদের কাছে একাডেমি কতটা প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পেরেছে বলে আপনি মনে করেন? একাডেমিতে আসার আগে আপনি নিজে যেভাবে একাডেমিকে দেখতেন, এখন কি সেভাবেই দেখেন?

মোহাম্মদ আজম

এখানে আসার আগে একাডেমিতে আমি যেভাবে দেখতাম, সেখানে একটা বড় পরিবর্তন ঘটেছে। গত ১১ মাসে উপলব্ধি করেছি, আগে যতটা ভাবতাম বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মানুষ দুটোই বাংলা একাডেমিকে তার চেয়ে অনেক বেশি ও উঁচু মূল্য দেয়। এর প্রতীকী মূল্য অসাধারণ। এটাকে কাজে লাগিয়ে অনেক কিছু করা সম্ভব। ভাষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস-সংক্রান্ত বহু বিষয়ে রাষ্ট্রও বাংলা একাডেমির ওপরে নির্ভরশীল। আবার বাংলা একাডেমি মানসম্পন্ন কোনো কাজ করছে না, এটা বলাও একপক্ষীয় হবে। বাংলা একাডেমি যে ধরনের কাজ করবে, তা করার যোগ্যতা এবং মানসিকতাসম্পন্ন লোকের সংখ্যা গত দুই-তিন দশকে বাংলাদেশে অসম্ভব হ্রাস পেয়েছে।

প্রথম আলো:

একাডেমির কী অগ্রাধিকার হওয়া উচিত? মহাপরিচালক হিসেবে আপনার অগ্রাধিকারগুলো কী?

মোহাম্মদ আজম

এটা ৭০ বছরের প্রতিষ্ঠান। এর নানা ধরনের মাহাত্ম্য আছে, অনেক রকমের কাজ আছে। আমি এর কোনো বৈপ্লবিক পরিবর্তন চাই না। আমি চেয়েছি বাংলা একাডেমিকে হালনাগাদ করতে এবং কাঠামোগতভাবে মসৃণ করতে; এর সঙ্গে একাডেমির মানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে। কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি।

আমরা বাংলা একাডেমির সম্পূর্ণ ডিজিটাইজেশনের উদ্যোগ নিয়েছি। ইতিমধ্যেই অনেক দূর পর্যন্ত কাজ হয়েছে। পাঠাগারের ডিজিটাইজেশনের কাজ চলছিল, এখন এটা শেষের পথে। বিরাট একটা আর্কাইভ আমরা অনলাইনে পাব। অনলাইন বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছি। পুরো বাংলা একাডেমিকে ডিজিটাইজ করার দিকে অগ্রসর হচ্ছি। একাডেমির পত্রিকাগুলোর মান রক্ষার জন্য অনলাইন এডিশন, ইউনিকোডে ছাপা ই–বুক, ডিওআই, আইএসএসম, ইএসএসএম নম্বর, ডবল রিভিউ সব উদ্যোগ নিয়েছি। আমি মনে করি, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের মান রক্ষা করা ও তার কার্যকারিতা মসৃণ রাখা—এই দুই কাজই প্রধান।

প্রথম আলো:

বইবিমুখ তরুণ প্রজন্মকে সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত করতে আপনার কোনো পরিকল্পনা আছে?

মোহাম্মদ আজম

ঠিক তরুণ বা বিশেষভাবে কম বয়সীদের জন্য কাজ করবে, বাংলা একাডেমি এমন প্রতিষ্ঠান নয়। এর কাজের ধরন একাডেমিক। বাংলা একাডেমি শিশুদের জন্য উপযোগী খুব বেশি পরিমাণে বই প্রকাশ করে না, তবে ‘ধানশালিকের দেশ’ নামে সুন্দর চাররঙা পত্রিকা বের করে। সৃজনশীল লেখার জন্য ‘উত্তরাধিকার’ নামে পত্রিকা আছে। এর বাইরে অনলাইন কার্যক্রমের বড় অংশ তরুণদের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমরা যে অনুষ্ঠানগুলো করি সেখানে তরুণতরদের আমন্ত্রণ জানানোর চেষ্টা করি। গত এক বছরে বাংলা একাডেমির জন্ম ও মৃত্যুদিবসের আয়োজনগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তন করেছি। অনলাইন সম্প্রচারের মাধ্যমে পুরো দেশের সমাজের পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছি। সেখানে তরুণেরাও আছে। তরুণ লেখকদের কর্মশালাও চলছে।

প্রথম আলো:

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য ছড়িয়ে দিতে একাডেমির অর্জন কতটুকু? অনুবাদের মাধ্যমে আমাদের সাহিত্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছে দিতে একাডেমি কী ভূমিকা রাখছে?

মোহাম্মদ আজম

একাডেমি আরও বড় পরিসরে বড় বরাদ্দ রেখে অনুবাদের ব্যবস্থা করতে পারে। এটা একাডেমির একটি প্রধান কাজ। তবে একাডেমি সেই প্রত্যাশিত মাত্রায় পৌঁছাতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে সক্ষমতার প্রয়োজন। কারণ ভাষা বহু। সেই ভাষার ভাবনা ও সাহিত্য বাংলায় আনা এবং বাংলা থেকে ওই ভাষাগুলোয় নিয়ে যাওয়া খুবই বড় কোনো সংস্থারকাজ। সেটা বাংলা একাডেমি একা পারে না। তারপরও বাংলা একাডেমি কিছু বই বাংলা থেকে ইংরেজি বা ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে। অনুবাদের জন্য যে ধরনের লোকের প্রয়োজন, সে রকম আগ্রহী লোকও খুব কমই পাওয়া যায়।

প্রথম আলো:

আপনার আলোচনায় বারবারই যোগ্য লোকের অভাবের কথা আসছে। এ ধরনের যোগ্য মানুষ তৈরি করতে কি বাংলা একাডেমি কোনো ভূমিকা রাখতে পারে?

মোহাম্মদ আজম

আসলে পারে না। এ ধরনের লোক সব সমাজেই তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়।

‘বাংলা একাডেমির প্রতীকী মর্যাদা অসাধারণ; রাষ্ট্র ও জনগণ এর ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশের যোগ্যতর মানুষ আজকাল আর বাংলায় লিখছেন না—এটিই সবচেয়ে বড় সংকট।’
মোহাম্মদ আজম, মহাপরিচালক-বাংলা একাডেমি
প্রথম আলো:

বাংলা একাডেমি কি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে এ কাজটি করতে পারে না?

মোহাম্মদ আজম

এটাও একাডেমির কাজ নয়। পৃথিবীর কোথাও এটা হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় তার মতো করে চলবে এবং সেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সমাজে যোগ্য লোক তৈরি করবে। তারাই কোনো কোনো কাজ বাংলা একাডেমির সঙ্গে করবে। এটাই হওয়া উচিত আদর্শ অবস্থা। এর বাইরে কোনো উপায় তো নেই।

প্রথম আলো:

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানসম্মত যোগ্য মানুষ তৈরি করতে পারছে না কেন?

মোহাম্মদ আজম

আমরা সবাই জানি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানসম্মত হয়ে উঠতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয় মানসম্মত না হলে বিভিন্ন একডেমির বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রগুলো কোনোক্রমেই ভালোভাবে চলতে পারে না। জাতীয়তাবাদী আবেগে বা দেশের কল্যাণচিন্তা যে কারণেই হোক ১৯৫০ থেকে ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত আমাদের বিভিন্ন শাস্ত্রের প্রধান ব্যক্তিদের অনেকেই বাংলায় লিখতেন। নতুন প্রজন্মের মেধাবী মানুষেরা বাংলা ভাষার দক্ষতা অর্জনের প্রয়োজন ততটা বোধ করেন না। কারণ, ইংরেজিতে লেখার ফল লাভজনক। ফলে আমাদের যোগ্যতর লোকেরা আজকাল আর বাংলায় লিখছেন না। এটা আমাদের প্রধান সংকট। এই সংকট কাটানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য লোকদের দিয়ে বাংলা লেখানোর চর্চা খুব জরুরি। সরকারের উদ্যোগও খুব জরুরি।

প্রথম আলো:

এ রকম সংকটময় অবস্থায় সামনে এগোতে হলে বাংলা একাডেমির কী করা উচিত?

মোহাম্মদ আজম

বাংলা একাডেমি সামনে এগোতে চাইলে মানসম্মত পাণ্ডুলিপি পাওয়া এবং অপরাপর কাজের জন্য পরিষ্কারভাবে লক্ষ্য স্থির করে সরকারকে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। অনুবাদকে যদি আমাদের একটা বড় সম্পদ বলে সবাই উপলব্ধি করেন এবং যেটি সঠিক উপলব্ধি, তাহলে অনুবাদের ইনস্টিটিউট করে সেখানে যথেষ্ট পরিমাণ গুণী মানুষ ও যথেষ্ট পরিমাণ বরাদ্দ দিতে হবে। এটা বাংলা একাডেমির ভেতরেই হতে পারে। এ রকম একটা প্রস্তাবও আছে। আর একাডেমি যেন রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সামাজিক চাপের মধ্যে তার স্বাতন্ত্র্য ও কাজের এলাকা রক্ষা করতে পারে, সে জন্য রাষ্ট্র, সরকার, রাজনৈতিক দল ও নাগরিকদের আরও আন্তরিক হতে হবে।

প্রথম আলো:

আপনি অনেকটা সময় দিলেন। আপনাকে ধন্যবাদ।

মোহাম্মদ আজম

প্রথম আলো এবং পাঠকদেরও ধন্যবাদ।