আপনি রোলাঁ বার্থের ‘রচয়িতার মৃত্যু’ অনুবাদ করেছেন। বইটিতে বিখ্যাত এক ‘সাহিত্যতত্ত্ব’ পাই আমরা। সেটা হলো, লেখকের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পাঠকের জন্ম হয়। একটু ঘুরিয়ে যদি বলি, লেখকের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অনুবাদকের জন্ম হয়। এটা কত দূর খাটে?
জি এইচ হাবীব: এ ক্ষেত্রে কয়েকটি ঘটনা ঘটে। অনেক ‘মৌলিক’ লেখক যখন অনুবাদ করেন, তখন হয়তো তিনি নিজের লেখক সত্তা টিকিয়ে রাখেন। মূল টেক্সটেও অনুবাদকের লেখকসত্তার অনুরণন দেখা যায়। অনুবাদক যদি চান, লেখকের মূল লেখার ওপর তাঁর পুরো সত্তা চাপিয়ে দেবেন, তবে তা আর অনুবাদ থাকে না। বুদ্ধদেব বসু বোদলেয়ার: তাঁর কবিতা অনুবাদ করতে গিয়ে অনেকটা সে রকমই করেছেন বলে অনেকে বলে থাকেন। যদিও সব মিলিয়ে সেটা অসাধারণ একটা কাজ হয়েছে। তবে সচরাচর একজন অনুবাদককে প্রথমেই নিজেকে বিলীন করে অন্য এক লেখকের অনুগামী হতে হয়। তাঁকে মূলের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হয়। তবু অনেক সময় অনুবাদ মূল লেখার ছায়ামাত্র। এ ক্ষেত্রে কেউ যদি বলেন যে মূল লেখকের মৃত্যু হলো কি না, হতেই পারে তা। কারণ, হুবহু অনুবাদ নানা কারণেই সম্ভব নয়। একই লেখকের তিনটি অনুবাদ তিন রকম হয় এ কারণেই। তাই লেখককে হত্যা বলুন, আর যা-ই বলুন, অনুবাদে তা খানিকটা বদলে যায়। ‘লস্ট ইন ট্রান্সলেশন’ বলে একটা কথা আছে। এ প্রসঙ্গে অনেক আলোচনা হয়। অনুবাদে কী হারিয়ে গেছে, তা নিয়ে সবাই উচ্চকিত। কিন্তু ‘লস্ট ইন ক্রিয়েশন’ অর্থাৎ রচনার সময় কী হারিয়ে গেল, তা নিয়ে কেউ ভাবিত নয়। ধরুন, একজন মৌলিক লেখক যা ভাবলেন, দেখলেন বা অনুভব করলেন, তার কতটুকু আনতে পেরেছেন, তার বিচার কে করবে? এ ক্ষেত্রে যেহেতু সমালোচকদের সামনে মূল আর অনুবাদ দুটো টেক্সটই অনেক সময় সহজলভ্য, তাই অনুবাদকের ‘বমাল গ্রেপ্তারের’ ঝুঁকি রয়েছে। মৌলিক লেখকের তা নেই। আর আমি বলি, অনুবাদ অনেক ক্ষেত্রেই আপস। কিন্তু তাই বলে এটা দ্বিতীয় স্তরের কাজ নয় কিছুতেই।
আপনার লেখালেখি কি অনুবাদ দিয়েই শুরু? কখন অনুবাদ করার কথা মাথায় আসে?
জি এইচ হাবীব: ছোটবেলায় সেবা প্রকাশনী, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি ও রাদুগা প্রকাশনীর বই পড়তাম। একসময় ভাবা শুরু করলাম, আমিও চেষ্টা করলে অনুবাদ করতে পারি। ক্যাডেট কলেজে পড়ার সময়ই অনুবাদে হাত দিই। তখন সেবার রহস্য পত্রিকায় আমার করা একটা অ্যাডাপটেশন ছাপা হয়েছিল, ‘জেগে তাই তো ভাবি’ নামে। এরপর স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের ‘ব্রাজিলিয়ান ক্যাট’ নামের একটি গল্প অনুবাদ করি। ক্যাডেট কলেজের পাট চুকিয়ে যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেছি, তখন আমার প্রথম বই ডয়েলের দ্য সাইন অব ফোর সেবা থেকে বেরিয়ে গেছে। ১৯৮৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বইটি বের হয়। আমি তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। এরপর জাহাঙ্গীরনগর থেকে পাস করে বের হওয়ার পর ১৯৯৯ সালে বের হলো আইজ্যাক আসিমভের ফাউন্ডেশন। শুরুটা বলা যায় এভাবেই হয়েছে।
অনুবাদক হিসেবে অনেককে একটা টানাপোড়েনের মধ্যে থাকতে হয়। মূলানুগ থাকার দায়, আবার পাঠকের কাছে পৌঁছাতে গিয়ে কিছুটা সরে যাওয়া নিয়ে দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। বিষয়টাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
জি এইচ হাবীব: মূলানুগ তো থাকতেই হবে, তার মানে এই নয় যে পাঠক বুঝতেই পারবে না, তেমন অনুবাদ করব। এ নিয়ে হয়তো একটা ‘এলিটিজম’ আছে। রুশ উপন্যাস ললিতার লেখক ভ্লাদিমির নাবোকভ একবার বলেছিলেন, ‘ক্লামজিয়েস্ট অব দ্য লিটারারি ট্রান্সলেশন ইজ বেটার দ্যান দ্য প্রিটিয়েস্ট অ্যাডাপটেশন।’ এ ধারণার সঙ্গে আমি একমত নই। অনেক সময় মূলানুগ করার অনেক সাংস্কৃতিক ও স্থানিক বাধা থাকে। সে কারণে জেমস জয়েসের ইউলিসিস উপন্যাসের চীনা অনুবাদে পাঁচ হাজার টীকা দিতে হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে আমি মধ্যপন্থী। মূলের প্রতি দায়বদ্ধ থেকেও পাঠকের কাছে পৌঁছাতে চাই যত দূর সম্ভব।
আপনি বরাবরই এমন মধ্যপন্থী থাকতে পেরেছেন কি? বিশেষ করে উমবের্তো একোর ‘গোলাপের নাম’ বইতে দেখি, টীকাভাষ্য জর্জর, এক জটিল বুনন, বারবার রেফারেন্সের উল্লেখের কারণে মূল কাহিনির রস আস্বাদনে বিঘ্ন ঘটে কি না!
জি এইচ হাবীব: এটি আসলেই জটিল ভাষা আর বহুস্তরী আখ্যানে গড়া এক উপন্যাস। আমি এমন দ্বিতীয় কোনো বই পড়িনি। ১৬ বছর ধরে বইটির অনুবাদের কাজ করেছি। তাই পাঠককে মূল বইয়ের স্বাদ এনে দিতে চেয়েছি। আসলে এটা একটা বড় দ্বন্দ্ব। পাঠক অনেক সময় অভিযোগ করেন যে আমার বইয়ের অনুবাদ দুরূহ লেগেছে। তখন আমি পরের সংস্করণের আগে সেটা আবার সম্পাদনা করি। একোর বইয়ের ক্ষেত্রেও সম্পাদনা করতে হবে বলে মনে হয়।
আপনার শুরুটা হয়েছিল আর্থার কোনান ডয়েল দিয়ে। পরবর্তী সময়ে লেখক বাছাইয়ে দেখি আমোস টুটুওলা, ইতালো কেলভিনো, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, উমবের্তো একোর বই বেছে নিয়েছেন অনুবাদের জন্য। এঁরা সবাই আভাঁ গার্দ লেখক। আপনার কি এই ধারার সাহিত্যের প্রতি বিশেষ পক্ষপাত রয়েছে?
জি এইচ হাবীব: এসব লেখকের গদ্যের ভাষাই মূলত আমাকে ভীষণ টানে। আমি প্রতিটি বইয়ের প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পর এমন একটা আচ্ছন্ন করা অনুভূতিতে পড়ে যাই, তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যে অনুবাদ করব। আর এঁদের লেখা পড়ে খুব চ্যালেঞ্জ অনুভব করি। আমার নিজের ভাষা বাংলা, এমন সব ভাঙচুর আর দীর্ঘ সব বাক্যের জন্য প্রস্তুত কি না, সেটা পরীক্ষা করে দেখতে ইচ্ছা হয়। পাঠযোগ্য রেখেই তা করার কথা ভাবি।
একটা উপন্যাসের পর আর মার্কেস করেননি কেন? বিশেষত অনেকেই একটা ধারা তৈরি করতে চান।
জি এইচ হাবীব: আমি মনে হয় বড় লেখকের ‘শ্রেষ্ঠ কাজই’ অনুবাদে আনতে চেয়েছি। তা ছাড়া যখন যেটা তীব্রভাবে টেনেছে, সেটাই অনুবাদ করেছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন যোগ দিই, তখন আমাকে হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন আইডিয়াস পড়াতে হতো। সেটা পড়াতে গিয়ে ইয়েস্তান গার্ডারের সোফির জগৎ অনুবাদের কথা মাথায় আসে। এটি আমার অনুবাদের বইয়ের মধ্যে সর্বাধিক বিক্রি হয়েছে।
ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে লক্ষ্য নিয়ে বাংলা একাডেমি পথচলা শুরু করেছিল, তা কি পূরণ হয়েছে? অনুবাদের মধ্য দিয়ে একটা জ্ঞানভান্ডার গড়ে তোলার যে কাজ, তা কি প্রতিষ্ঠানটি করতে পেরেছে?
জি এইচ হাবীব: এককথায় যদি বলতে হয়, আমার উত্তর হবে, না, পারেনি। বিশেষত, শুরুর দিকে অসাধারণ সব কাজ হয়েছে অনুবাদে। সেই ধারাবাহিকতা তো দেখা যায়ইনি, বরং আগের বইগুলোর পুনর্মুদ্রণও আর হয়নি। এ ক্ষেত্রে আমি বাংলা একাডেমিকে একা দোষ দিতে চাই না। এর দায় দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও নিতে হবে। ঢাকা ইউনিভার্সিটি বা চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু প্রকাশিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। অথচ প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্যভাষা পড়ানো হয়, তারা কেন কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ করতে পারেনি, সে প্রশ্ন এসেই পড়ে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এত শিক্ষক রয়েছেন, তাঁরা তাঁদের বিষয়ের কয়টি বই অনুবাদ করেছেন? গবেষণা খুবই জরুরি। কিন্তু মানসম্পন্ন গবেষণা কয়টি হচ্ছে? একটা ‘সাইটেশনও’ পাওয়া মুশকিল হয়। বিকল্প ছিল অনুবাদ। সেটার দিকে মনোযোগই দেওয়া হলো না। ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে। তারা এ ধরনের প্রচুর কাজ করছে। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, জয়া চৌধুরীরা বলেছেন, ‘ভালো অনুবাদও গবেষণাকর্ম।’ এখানে সেই দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হলো না। জিওদার্নো ব্রুনোর একটা কথা আছে, ‘অনুবাদ হলো বিজ্ঞানের সন্তানসন্ততি।’ যুক্তরাষ্ট্রের এক বিজ্ঞান লেখক নাথানিয়াল বোউডিচের জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে একটা বইয়ের অনুবাদের পর সে দেশে সে বিষয়ে গবেষণার সূত্রপাত হয়। অথচ এ দেশে অনুবাদ একেবারেই অবহেলিত। বাংলা একাডেমিকে এ জন্য দায়মুক্তি দেওয়া চলে না। তারা এ বিষয়ে নেতৃত্ব দিতে পারত। ইউজিসি একটা নীতিমালা নিতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সবই হয়, কেবল জ্ঞানচর্চা ছাড়া।
অনুবাদে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। গুগল ট্রান্সলেটরের প্রথম দিককার কাজগুলো নিয়ে হাসাহাসি হয়েছিল, এআইকে কিন্তু অনেক গোছানো মনে হচ্ছে। অনুবাদকের কাজটা যন্ত্রই দখলে নেবে শেষ পর্যন্ত?
জি এইচ হাবীব: হাসাহাসির দিন শেষ, কান্নার সময় এসেছে। এআই অনুবাদকের জায়গা এখনই অনেকটা নিয়ে নিয়েছে। ভবিষ্যতে পুরোটা নিয়ে নিলেও অবাক হব না। তবে বিষয়টা এভাবেও দেখা যায়, ভাষার ব্যবধান আর থাকবে না একসময়। অনেকেই পেশা হারাবে। চিকিৎসকদেরও এআই ‘রিপ্লেস’ করছে কোথাও কোথাও। চীনে এমন একটা হাসপাতাল চালু হয়েছে। তবে এটা কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে, মৌলিক সাহিত্যও যন্ত্রের দখলে চলে যাবে কি না, সে প্রশ্নও এসে যায়।