ফরাসি একাডেমির সদস্যদের ‘অমর’ ডাকা হয়।
মারিও বার্গাস য়োসা: অমরত্ব একটা ক্লান্তিকর ব্যাপার। কাল, পরশু, এভাবে চিরকাল বেঁচে থাকা...নাহ, এর চেয়ে মৃত্যুই ভালো। তবে যতটা দীর্ঘ জীবন কাটানো সম্ভব আরকি, এরপর মরে যাওয়া।
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিয়ে কী ভাবেন আপনি? মৃত্যু–পরবর্তী খ্যাতি প্রসঙ্গে?
য়োসা: এটা নিয়ে কখনো কিছু ভাবিনি। আমার সন্তান, নাতিপুতিদের কথা ভাবি। কিন্তু নিজের বইয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করি না।
আসলেই এমন ভাবেননি কখনো যে, ‘এই বইটা টিকে যাবে চিরকালের জন্য, বা ওই বইটা?’
য়োসা: হ্যাঁ, এমন বই তো আমার আছে, যেগুলো আমার মৃত্যুর পরও টিকে থাকার যোগ্য। কনভারসেশন ইন দ্য ক্যাথিড্রাল, দ্য ওয়ার অব দ্য এন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড। খুব খেটেছিলাম উপন্যাস দুটি লেখার সময়। কিন্তু মৃত্যু নিয়ে ভাবি না। মৃত্যুর পর আমার বইগুলোর কী পরিণতি হবে, কে জানে।
কী কী ভাবনা মাথায় আসে আপনার?
য়োসা: যা সবচেয়ে অপছন্দ করি, তা হলো ধীরে ধীরে অবনতি ও ক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যাওয়া। এই যে মানবদেহ ক্রমান্বয়ে ধ্বংস হতে থাকে, এত ভয়ানক ব্যাপারটা! উদাহরণ দিই, আজকাল ভুলে যাওয়ার ব্যারাম হয়েছে। আগে আমার স্মরণশক্তি খুব স্বচ্ছ ছিল। কিন্তু এখন অনেক কিছুই আর মনে রাখতে পারি না, বুঝি যে স্মৃতিগুলো ক্ষয়ে যাচ্ছে। বয়স ৮৬ এখন, সে হিসাবে অন্যদের তুলনায় বহু কিছু আজও মনে আছে, কিন্তু কিছু নাম, ধরেন, এত সব মুখ স্মরণ করতে পারি, কিন্তু ওদের নামগুলো কিছুতেই আর খেয়াল হয় না।
স্মৃতিকাতরতায় ভোগেন?
য়োসা: কিছুটা। অনেক কিছুই অতীত হয়ে গেছে, যা মনে পড়লে আজ আফসোস হয়। ধরেন, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বছরগুলো। খুব পরিষ্কার খেয়াল আছে। অন্যদিকে যখন এর ঠিক পরবর্তীকালের কিছু ভাবতে চেষ্টা করি, কেমন একটা ধাঁধার মধ্যে পড়ে যাই। স্মৃতির মেঘেরা কখনো আমাকে আনন্দ দেয় বা দুঃখ দিয়ে চলে যায়। মনে পড়ে বলিভিয়ায় কাটানো ছেলেবেলার কথা, চার্চের ব্রাদার হুস্তিনিয়ানো, যাঁর কাছে পড়তে শিখেছিলাম। ছোটখাটো এক ইতালীয় বৃদ্ধ, তাঁকে ঘিরে নাচতাম আমরা। আমাদের হাতে ধরে চিনিয়েছিলেন অক্ষর আর সন্ধি। কী অপূর্ব সব দিন গেছে!
আপনার জীবনকে যা গড়ে তুলেছে—যেমন বইপড়া।
য়োসা: বই সবকিছুকেই বদলে দিয়েছিল। হুট করেই সীমানাহীন এক বিশ্বে ঢুকে পড়লাম, কোচাবাম্বার মতো ছোট্ট শহরের তুলনায় যা ছিল একেবারেই ভিন্ন কিছু। অনবরত ভ্রমণ যেনবা, সময়ের নানা প্রান্তে ছুটে বেড়াতাম—ভবিষ্যতে আর অতীতে। বই মানেই অভিযান, চিরকাল। মা যেমন একটা বই পড়তে আমাকে মানা করেছিলেন। খুব মনে আছে, মায়ের বালিশের পাশে থাকত নীল অক্ষরের হলুদ একটা বই, পাবলো নেরুদার টোয়েন্টি লাভ পোয়েমস অ্যান্ড আ সং অব ডেসপেয়ার। বইটার কিছু লাইন আজও মনে আছে, ‘আমার এই রুক্ষ চাষার দেহ খুঁড়ে চলে তোমার শরীর, পৃথিবীর গহন গহ্বর ফুঁড়ে উঠে আসে আমাদের সন্তান।’ সে বয়সে কবিতাটি পড়ে ভেবেছিলাম, এ তো ভারি পাপকর্ম। কিন্তু কেমন পাপ? আমি জানতাম না, কিন্তু ধরেই নিয়েছিলাম এর সঙ্গে নির্ঘাত কোথাও কোনো একটা পাপকর্ম জড়িয়ে আছে।
আপনার বাবা সম্পর্কে কিছু বলেন।
য়োসা: বাবার সঙ্গে সম্পর্কের শুরুটা বাজে ছিল। একদিন আমি অকস্মাৎ আবিষ্কার করলাম, তিনি মৃত নন, বেঁচে আছেন। আমাদের মধ্যে বোঝাপড়াটা ঠিক গড়ে ওঠেনি কোনোকালেই, শুধু যেন একটা ধারাবাহিক প্রবল উদ্বেগের আবহ ছিল। আপনি মনে হয় ধরে নিচ্ছেন, এখানে আমিই অপরাধী। কিন্তু লোকটা খুবই গোঁড়া আর গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন, আমার মাকে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন আমার কাছ থেকে। ওনার প্রবল আধিপত্যের বিরুদ্ধে টিকে থাকার জন্যই সাহিত্যের দিকে ঝুঁকেছিলাম আমি।
আত্মজৈবনিক বই জলের মাছ-এ আপনি লিখেছেন যে পত্রিকায় আপনার নাম দেখে বাবা বিব্রত হতেন, ব্যাপারটা তিনি পছন্দই করতেন না, এমনকি বিখ্যাত পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমসে লেখা ছাপা হলেও না।
য়োসা: বাবা ভাবতেন কবি ও লেখকেরা সব মদ্যপ আর সমকামী। আমার লেখালেখি নিয়ে আতঙ্কিত ছিলেন। ওনার পুত্র এক লেখক যে কিনা রাতে কোথাও চলে যায়, মাতাল হয়ে পড়ে থাকে—আমার সাহিত্যিক অভিযাত্রা নিয়ে এই ছিল তাঁর ধারণা। এ জন্যই আমাকে লেওনসিও প্রাদো সেনা একাডেমিতে পাঠিয়ে দিলেন। ওনার দৃঢ়বিশ্বাস ছিল, সৈনিক জীবন আর সাহিত্য দুটি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। কিন্তু হিতে বিপরীত হয়েছিল তাঁর জন্য, কারণ লেওনসিও প্রাদোয় পড়ার সময়টাতেই আমি পেশাদার লেখালেখি শুরু করি: একাডেমির কর্মচারীদের হয়ে আমি প্রেমপত্র লিখে দিতাম। দারুণ মজার একটা ব্যাপার ছিল, তাঁদের প্রেমিকাদের পাঠানো সব চিঠি আমি পড়তাম, যাতে ঠিকঠাক উত্তর লিখে দিতে পারি।
আপনার বইপত্র ও সাক্ষাৎকারে প্রায়ই নিজের সম্পর্কে একটা কথা বলে ফেলতেন, ‘কীভাবে এত কিছু আমি লিখলাম?’ আপনি তো সব সময়েই পড়তেন, লিখতেন। এদিক–ওদিক ছুটে বেড়াতেন। ভ্রমণ করতেন। আপনার মতো একজন লেখকের কাছে লেখালেখি কি তাহলে একটা অচেতন প্রক্রিয়া, ঠিক যেমন নিজের অজান্তেই আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস চলমান থাকে?
য়োসা: আরে নাহ। লিখতে গিয়ে কম ভোগান্তি পোহাতে হয়নি আমাকে, একই সঙ্গে, সব সময় চাইতাম আরও ভালো লিখতে। আমার লেখার ধরন ছিল খুবই সেকেলে। ব্যাপক উন্নতির জায়গা ছিল, কিন্তু সংবাদপত্রে কাজ করে সেটা তো সম্ভব নয়। আপনি তো জানেনই, পাতা ভরানোর জন্য তাৎক্ষণিক সব লেখা লিখতে হয় সংবাদপত্রের জন্য। লেখার ধার বাড়াতে বহু সাধনা করেছি। লিখতে বসে তখন বারবার নিজেকে বলতাম, বিশেষণগুলো ছেঁটে ফেলো, এইটাই একমাত্র উপায়।
‘গদ্য নির্মাণের উদ্দেশ্যে গল্প লিখতে চাইনি, সব সময় চেষ্টা করেছি গল্প অনুযায়ী আমার গদ্য নির্মিত হোক।’—এ তো আপনারই কথা।
য়োসা: চরিত্রগুলোকে শ্বাস নিতে দিন, ওরা বেঁচে থাকুক যার যার নিজের মতো করে। এটা আমার কাছে খুবই জরুরি ছিল যে চরিত্রেরা যাতে ভাষার স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত না করতে পারে, তেমনই একটা উপন্যাসের ভেতরের লোকজনকে কেন্দ্র করেই যেন এর ভাষাটা গড়ে ওঠে। এই চিরকাল ছিল আমার ধ্যানজ্ঞান। এখন অবশ্য আর নেই। কিন্তু প্রথম দিকের উপন্যাসগুলো লেখার সময় আমার টনটনে সতর্কতা জারি ছিল—ভাষা যেন আমার উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে।
গুস্তাভঁ ফ্লবেয়ার...
য়োসা: আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার। আজ আমি যেটুকু লেখক হতে পেরেছি, তাঁর জন্যই পেরেছি। ফ্লবেয়ার একটা রোগ আবিষ্কার করে তাঁর বাবাকে জানালেন যে হুটহাট কী রকম আলো দেখতে পান আর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সেভাবেই বাবার ঠিক করে রাখা পেশা বেছে নেওয়ার হাত থেকে রেহাই পেলেন। ডাকসাইটে চিকিৎসক ছিলেন তাঁর বাবা, এক হাসপাতালের পরিচালক, খুব হতাশ হয়ে শেষ পর্যন্ত ছেলেকে ক্রঁসে নামের এক ছোট্ট শহরে ঘরবন্দী করে রেখেছিলেন, আর ওই সময়টাতেই মাদাম বোভারি লিখে ফেললেন ফ্লবেয়ার। পাঁচ বছর লেগেছিল তাঁর, প্রতিদিন লিখতেন। আমি...
আপনি?
য়োসা: ভাবছিলাম পেরুর মতো একটা দেশে একজন লেখক হয়ে ওঠা কী রকম ঘটনা ছিল, কোনো প্রকাশক ছিল না, বইয়ের দোকান হারিকেন দিয়ে খুঁজতে হতো। এ জন্যই ফ্রান্সে যাব এই স্বপ্ন দেখতাম। আর মজার বিষয় কি জানেন, যত দিনে আমার ফ্রান্সে যাওয়ার সুযোগ হলো, হুট করে ফরাসি লোকজনেরা তখন লাতিন আমেরিকান সাহিত্য পড়তে শুরু করেছে। ওরা তখন পড়ত বোর্হেস, কোর্তাসার, ফুয়েন্তেস আর গার্সিয়া মার্কেসের লেখা। প্যারিসে বসে নিজেকে আমার পেরুর লোকও মনে হতো, লাতিন আমেরিকানও মনে হতো, আবিষ্কার করলাম, সীমান্ত নামের জিনিসটা খুব মেকি, পেরুর সঙ্গে কলম্বিয়া বা বলিভিয়ার পার্থক্যটা কোথায়? কোনো পার্থক্যই নেই। এসব দেশের সমস্যাও ছিল একই রকম—সেনাবিদ্রোহ।
পেরুতে আপনাকে কোন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল?
য়োসা: সব সময় একজন লেখকই হতে চাইতাম, কিন্তু পেরুতে আমি পড়ে গিয়েছিলাম মানসিক যন্ত্রণার এক কূপে এবং আমাকে উদ্ধার করেন সার্ত্রে। লোকটা ছিলেন এক প্রাকৃতিক শক্তির মতো, যিনি আপনাকে বলবেন, আফ্রিকার এক ছোট্ট দেশের নাগরিক হতে পারো তুমি, যেখানে সবাই অক্ষরজ্ঞানহীন, কিন্তু ওসব তুমি অস্বীকারও করতে পারো, ওসব নিয়ে তুমি লিখতেও পারো। সার্ত্রের বিশ্বস্ত ভক্ত ছিলাম আমি, তারপর ষাটের দশকের কোনো এক সময় পড়লাম, দুজন আফ্রিকান লেখককে তিনি বলেছিলেন, ‘সবার আগে তোমাদের কাজ হলো বিপ্লব করা, তারপর সাহিত্য।’ আমার কাছে কথাটা বেইমানির মতো ঠেকেছিল এবং ধীরে ধীরে সার্ত্রের সঙ্গে আমার দূরত্ব বেড়ে যায়।
নিশ্চিত নই, এটাকে প্রাপ্তমনস্কতা বা বিকশিত হয়ে ওঠা বলা যায় কি না, কিন্তু বহু পাঠক যাঁরা সার্ত্রে পড়তে শুরু করে, তাঁরা শেষ অব্দি এসে থামেন আলব্যের কাম্যুর কাছে।
য়োসা: হ্যাঁ। কাম্যুর প্রাথমিক শিক্ষা সার্ত্রের পর্যায়ের ছিল না। সার্ত্রে যা কিছু পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, কাম্যু তা পাননি, কিন্তু কাম্যু অনেক বেশি বাস্তববাদী ছিলেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল একবার। একবার শুনলাম গ্রান্দ বুলেভার্দের এক নাট্যশালায় বিকেলের দিকে গেলে তাঁকে পাওয়া যাবে। হাতে করে লিতারেতুরা নামের ছোট্ট একটা পত্রিকা নিয়ে গিয়েছিলাম আমি, অল্প কয়েকটি পাতা, পেরুতে ওটা আমরা বের করতাম। কাম্যুর সঙ্গে তখন ছিলেন মারিয়া কাসারেস (স্পেনীয় বংশোভূত জনপ্রিয় ফরাসি অভিনেত্রী)। তাঁদের সঙ্গে আমি ফরাসিতে আলাপ শুরুর চেষ্টা করলাম, কাম্যু এস্পানলেই আমাকে উত্তর দিলেন। বেশ কিছুক্ষণ কথা বললাম আমরা, আর কয়েক মাস পরেই গাড়ি দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হলো। চমৎকার এক মানুষ ছিলেন কাম্যু, খুবই নম্র।
হুলিও কোর্তাসারকে নিয়ে কিছু বলবেন?
য়োসা: প্যারিসে প্রথম যে লাতিন আমেরিকান লেখকের সঙ্গে আমার পরিচয় তিনি কোর্তাসার। পথেঘাটে আমরা প্রায় সব সময়ই একসঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম। একদিন বললেন, ‘বিকেলের দিকে র্যুয়েলার কিছু অংশ (কোর্তাসারের বিখ্যাত উপন্যাস হপস্কচ) লিখে ফেলব ঠিক করেছি, কিন্তু কী যে লিখব মাথায় আসছে না।’ অবাক হয়ে বললাম, ‘আপনি কীভাবে লেখেন বলেন তো? টাইপরাইটার নিয়ে বসে পড়েন আর...?’ কোর্তাসার বলেছিলেন, ‘একদম, লিখতে বসি, আঙুলগুলো এই যে এইভাবে খেলা করতে থাকে, আর তখনই আমার স্মৃতি নিজের কাজ শুরু করে দেয়।’ হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম শুনে। কারণ, আমি নিজে লেখা শুরুর আগে প্রচুর হোমওয়ার্ক করতাম, ঠিক করে রাখতাম যে কী লিখতে যাচ্ছি।