মেলার বই নিয়ে লেখকের মুখোমুখি

ছফার বাঙালি মুসলমানের সমালোচনা মোটের ওপর সার্থক

রাশি রাশি বইয়ের ভারে সরগরম হয়ে উঠছে একুশে বইমেলা। মেলায় প্রকাশিত হয়েছে বা হবে, এমন বই নিয়ে এই সংখ্যা। কথা বলেছেন বইয়ের লেখক

কদিন আগেই বেরিয়েছে সলিমুল্লাহ খানের নতুন বই আ মরি আহমদ ছফা: বিষয় বাঙালি মুসলমানের মন সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাফসান গালিব

রাফসান গালিব:

আ মরি আহমদ ছফা বইয়ের মধ্য দিয়ে আহমদ ছফার আলোচিত প্রবন্ধ ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ নতুন করে হাজির করলেন। কেন এটা করার দরকার ছিল বলে মনে করেন?

সলিমুল্লাহ খান: আহমদ ছফা মৃত্যুবরণ করলেন ২০০১ সালের মাঝামাঝি। তত দিনে আমি তাঁর বিষয়ে সাকল্যে তিন কি চারটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধটি নিয়ে তখনো কিছু লিখতে পারিনি। 

আহমদ ছফা প্রবন্ধটি লিখেছিলেন ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে। রাষ্ট্র তখন আর পাত্রে রাখা যায় না এমন অবস্থায়। তখন একটা স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতন হয়েছে অথচ নতুন কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তার স্থলাভিষিক্ত হয়নি। ছফা এই সংকটের উৎস অনুসন্ধান করেছিলেন বাংলাদেশে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব যারা বাস্তব করেছিলেন তাদের—বাঙালি মুসলমানের—ইতিহাসে। এই সমাজের হীনম্মন্যতার আদি কারণ তিনি খুঁজেছিলেন পশ্চিম ভারত হয়ে আগত তথাকথিত ‘আর্য’ জাতির বিজয় ও বাংলার আদিবাসীদের পরাজয়ের ঘটনায়। একটি নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর ইসলাম গ্রহণ বা ধর্মীয় জাগরণ ছিল আহমদ ছফার কথা অনুসারে অত্যন্ত যুক্তিসংগত কাজ। কিন্তু ইসলামের আদর্শও (সাম্য ও ন্যায়) বাঙালি মুসলমানের সামাজিক হীনদশার অবসান ঘটাতে পারেনি।

আহমদ ছফার এই তিতকষা সমালোচনা অনেকেই পছন্দ করেননি। সে–কালেও, এ–কালেও। নতুন সমালোচকদের একজন অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। তাঁর একটি নাতিদীর্ঘ নিবন্ধ পড়ে আমার মনে হয়েছিল, নতুন সমালোচকেরাও আহমদ ছফার প্রস্তাব বুঝতে পারেননি। এটাই আমার ‘অলৌকিকতার ভূত’ নামক নিবন্ধটি লেখার আশু কারণ। কিছুদিন পরে ‘আ মরি আহমদ ছফা’ নামে আরেক প্রবন্ধযোগে আমি দেখাতে চেষ্টা করেছিলাম আমার বিচারে আহমদ ছফা লেখার কোনো দুর্বল দিক আছে কি না। থাকলে তা কি এবং কেন।

ছফা বাঙালি মুসলমানের যে সমালোচনা করেছেন, তা আমার চোখে মোটের ওপর সার্থক। তারপরও একটা সত্য তিনি বুঝতে চাননি বলে আমার মনে হয়েছে। হিন্দু বাদ দিয়ে মুসলমান সমাজের আলোচনা চলে না। বাঙালি সমাজ বলতে একসময় কেবল হিন্দু বোঝাত। বিশেষত বর্ণহিন্দু সমাজের ঘৃণা ও বিদ্বেষের রাজনীতিটা বাদ দিলে মুসলমান সমাজের হীনতা বোঝা অসম্ভব। এই সত্য তুলে ধরতে হবে। নইলে মুসলমান কি হিন্দু–কারোরই মঙ্গল নেই ।

অথচ আহমদ ছফার শ্যেনদৃষ্টিও এই সত্য অবলোকন করতে পারেনি। তিনি একতরফা বাঙালি মুসলমানের মন বিচারের দাবিতে অনড় রইলেন। আমি একফোঁটা শিশিরের কৃতিত্ব দাবি করলে অন্যায় হবে। অতি অবশ্যই ১৯৯৭ সালে ‘শতবর্ষের ফেরারি: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ লিখে তিনি এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন।

রাফসান গালিব:

ছফার ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধটি পত্রিকায় একরকম এবং বইয়ে আরেক রকমভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। আপনার বইয়ে প্রবন্ধের এই দুই সংস্করণ মেলানোর প্রয়োজন পড়ল কেন?

সলিমুল্লাহ: আহমদ ছফার ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ ১৯৭৬ সালে মাসিক সমকাল–এ ছাপার সময় মোট ১০টি অধ্যায়ে ভাগ করা ছিল। পাঁচ বছর পরে ১৯৮১ সালে বই আকারে ছাপার সময় ভাগ পাওয়া গেল ৯টি। অনুসন্ধান করে দেখতে পেলাম, আসল ঘটনা একটি ছাপার ভূত বা অতীত। পত্রিকায় মুদ্রিত একটি ভাগের শিরোনাম নম্বর মনে হয় ছাপাখানার ভূতের ভয়ে আত্মগোপন করেছিল। আমরা হারানো নম্বরটা পুনরুদ্ধার করেছি মাত্র।

এই কৃতিত্বের বা অপরাধের ভাগটা অবশ্য আমার তরুণ বন্ধুদের প্রাপ্য । সমকাল–এর কপিটা প্রথম আমার নজরে এনেছিলেন মধুপোক প্রকাশনার আলা আবুল খায়ের মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান। বলা বাহুল্য ইনি আ মরি আহমদ ছফা বইয়ের সম্পাদক বটে।

আমাদের বইয়ের পরিশিষ্ট অংশে আরও অনেককিছু দেখবেন।

আহমদ ছফার আরও তিনটি লেখাও পুনর্মুদ্রণ করেছি ‘আ মরি সংবর্ধনা’ অংশে। এগুলোর মধ্যেও লেখকের মনোবিবর্তনের একটা নীরব সাক্ষাৎকার হাজির আছে। একটি নির্দেশিকাও যোগ করেছি ।

রাফসান গালিব:

আপনি তো দীর্ঘদিন ধরে ছফাচর্চা করে যাচ্ছেন, এ সময়ে এসে ছফার বুদ্ধিজীবিতাকে আমরা কীভাবে পাঠ করব? 

সলিমুল্লাহ: শহীদ হওয়াই বুদ্ধিজীবীর একমাত্র কাজ নয়। এই কাজ ছাড়া বুদ্ধিজীবীর আর সব কাজই আহমদ ছফা সম্পন্ন করেছিলেন। তাঁর বৃত্তি ছিল সাহিত্যসাধনা। জীবনধারণের নিমিত্ত তিনি মাঝেমধ্যে সংবাদপত্রে কাজ করতেন। তবে সাংবাদিক বলতে যে কলঙ্ক বোঝায়, তা তাঁকে কখনো স্পর্শ করেনি বলেই জানি। ষাটের দশকে তিনি ঢাকায় আসেন। দরিদ্র মানুষের সঙ্গে দিন কাটান। সব মিলিয়ে মোট ৪০ বছরের জীবনে তিনি অনেক দেখেছেন, ঢের করেছেনও। আমাদের দেশে শ্রমজীবী শ্রেণির সহজ বুদ্ধিজীবী কে? উদাহরণ আহমদ ছফা।

পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের জাতীয় আন্দোলন এবং বাংলাদেশের স্বৈরতন্ত্র আর গণতন্ত্রের বিরোধ—দুটোই তাঁর দেখা। বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের হীনম্মন্যতা কোথা থেকে এল? এই প্রশ্নের বিশ্লেষণ তাঁর মতো আর কেউ করতে রাজি হননি।

আহমদ ছফার বুদ্ধিশুদ্ধি আশায় ভর করেছিল আর আবেগ বাসা বেঁধেছিল নিরাশার বাড়িতে। এ ক্ষেত্রে তিনি ইতালির মনীষী আন্তনিও গ্রামসির বিপরীত।

রাফসান গালিব:

এবনে গোলাম সামাদ থেকে শুরু করে এখনকার মোহাম্মদ আজম পর্যন্ত ছফার প্রবন্ধটির নানা সমালোচনা করেছেন। আনিসুজ্জামানের মতে, এটি বাংলা সাহিত্যের সেরা ১০ প্রবন্ধের একটি। এ প্রবন্ধ নিয়ে আসলে বিতর্ক বা সমালোচনার কারণ কী?

সলিমুল্লাহ: আহমদ ছফা, আহমদ শরীফ ও আনিসুজ্জামান—এই তিনজনকে এক ঘরে বন্দী করেছেন মূলত গৌতম ভদ্র। তাঁর ধারণা, এই তিনজনের কেউই বাঙালি মুসলমানের নিশানাটা চিনতে পারেননি। এবনে গোলাম সামাদের বিচারে ছফা বাংলাদেশের ইতিহাস বিষয়ে একান্তই অজ্ঞান। মোহাম্মদ আজম ভেবে কূল পাননি, লোকে কেন এই প্রবন্ধ পড়ে আজও সময় নষ্ট করে।

বাঙালি মুসলমানের আসল দুর্বলতা তার জ্ঞান অনীহা ও অনুচিকীর্ষায় ধরা পড়ে, ছফা ঠিকই এই ছিদ্রপথটি খুঁজে পেয়েছিলেন। আফসোস! যে বাঙালি বর্ণবাদের অবিচার এড়ানোর জন্য ইসলাম কবুল করেছিল, সেই বর্ণবাদের অতীত জেনেও তার বর্তমান ঠিকানা সে ধরতে পারেনি।

আমরা দেখেছি প্রবন্ধটিতে ছফা আক্ষেপ করছেন বাঙালি মুসলমান কেন বর্ণহিন্দুর মতো পশ্চিমা যুক্তিবাদের পথ ধরল না। ছফা মনে করতেন, বঙ্কিমচন্দ্র বর্ণহিন্দু সমাজের ব্যতিক্রমবিশেষ। আমরা মনে করি, তিনি নিয়ম। আধুনিক বাংলাদেশের বিয়োগ ও বিপর্যয়ের দায় ছফা একা বঙ্কিমচন্দ্রের ঘাড়ে তুলে দিয়ে দায়মোচনের কোশেস করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতন পুনর্জন্মকাতর বা পুনরুজ্জীবনবাদী লেখককেও তিনি অপরিসীম ছাড় দিয়েছেন। অনুসন্ধানে অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ হয়!

রাফসান গালিব:

বাংলা অঞ্চলের মুসলমানরা নতুনভাবে তার ভাবচিন্তা ও ধর্মচর্চায় পরিগঠিত হয়েছে। পাশাপাশি অন্যরা যেমন বৌদ্ধ বা সনাতনী বর্গও পরিগঠিত হয়েছে। এখন বাঙালি মুসলমান পরিচয়টাকে সামনে আনার ফলে অন্য বর্গগুলো প্রান্তিক হয়ে যায় কি?

সলিমুল্লাহ: বাঙালি মুসলমান মোটেও কোনো অলীক বর্গ নয়, ঐতিহাসিক একপ্রস্ত ঘটনা বা প্রপঞ্চের নাম ‘বাঙালি মুসলমান’। আহমদ ছফার মতে, বাঙালি সমাজের যে অঙ্গ ইতিহাসের একপর্যায়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ বা অবলম্বন করেছে, তাকেই বলে বাঙালি মুসলমান। অথবা যারা বাংলায় কথা বলে এবং ইসলাম ধর্মের ছায়া কবুল করে থাকে, তারাই বাঙালি মুসলমান। বাঙালি মুসলমান একটি নির্যাতিত জনসমাজ। একদা যারা আর্য নামে অভিহিত উচ্চবর্ণের হিন্দুসমাজের হাতে নিপীড়িত ও সমাজচ্যুত হয়েছিল, তারাই বা তাদের অংশবিশেষ পরে অন্য আদর্শ অবলম্বন করে।

ছফার মতে, বাঙালি মুসলমানের মন গড়ে উঠেছে ইতিহাসের এই প্রতিজ্ঞা দিয়ে—বাংলা ভাষা, ইসলাম ধর্ম ও নিম্নবর্গ। এক নিম্নবর্গের কথা বললে অন্যায় কোথায়? ১৭৫৭ সালের বিপর্যয়ের কথা বললে কি ১৮৫৭ সালের কথা বলা যাবে না? বাংলাদেশে বর্তমান শাসকশ্রেণি তো এই দুঃখের মধ্যেই জন্মগ্রহণ করেছিল। এই দুঃখের ইতিহাস যতখানি বাঙালি মুসলমানের তরফে, অন্যান্য বর্গের জমিতে বোধ করি ততখানি নয়। ছফার দাবি, বাঙালি মুসলমানের মন না বুঝলে বাংলাদেশের ইতিহাসের অনেকগুলো দোলা বোঝা যায় না।

সবচেয়ে বড় কথা, ছফা জানতেন বাঙালি মুসলমান তারাই, যারা যুগে যুগে ধর্ম পরিবর্তন করেছে অথচ এই পরিবর্তনের ফসল নিজের ঘরে তুলতে পারেনি। 

তদুপরি ছফার মতে, বাঙালি মুসলমানের দুর্দশাটা নিছক ইংরেজ দখলদারদের আমলে ঘটেনি। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেও নিম্নবর্ণের বা অজাতের কৃষক মুসলমান কৃষকই থেকে গেছে। জাত পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের নায়ক হয়েছে বাঙালি মুসলমান, প্রাণও দিয়েছে। কিন্তু তার ফলাফল অপরে আত্মসাত করেছে। পাকিস্তান কায়েম করেছিল এই জনগোষ্ঠী, বাংলাদেশের নায়কদের মধ্যেও তারাই অগত্যা মধুসূদন। এই বলাটিই কাল হয়েছিল আহমদ ছফার। বাঙালি মুসলমান সমাজের যে অংশ পুরোনো হীনম্মন্যতায় আজও ভোগে, তারাই আহমদ ছফার ওপর সবার চেয়ে বেশি খড়্গহস্ত হয়েছে।

প্রবন্ধ

আ মরি আহমদ ছফা: বিষয় বাঙালি মুসলমানের মন

সলিমুল্লাহ খান

প্রকাশক: মধুপোক, ঢাকা