‘কবিতা লেখা আর আপাতদৃষ্টিতে দেখতে কবিতার মতো কিছু লেখা এক নয়’

সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন কবি জাহিদুল হক। গীতিকার হিসেবেও খ্যাতিমান ছিলেন তিনি। ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’সহ অনেক জনপ্রিয় গানের রচয়িতা এই কবি। তাঁর এ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় ২০২২ সালে। সাক্ষাৎকারে সাহিত্য ও পুরস্কার নিয়ে বেশ কিছু তির্যক কথা বলেছিলেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ইমরান মাহফুজ

জাহিদুল হক (১১ অগাস্ট ১৯৪৯—১৫ জানুয়ারি ২০২৪)ছবি: সংগৃহীত

ইমরান মাহফুজ: আপনার কাছে কবিতার মানে কী?

জাহিদুল হক: যে শব্দগুচ্ছ নিয়ত তার অর্থ পাল্টায়, অচেনা রসে পৌঁছায়, তার বাস্তবতাকে অবাস্তব করে তোলে, তা–ই আমার কাছে কবিতা।

ইমরান: ব্যক্তিগত জীবন আর কবির জীবন কি আলাদা কিছু?

জাহিদুল: জীবন আর কবিতা অবশ্য আলাদা। তবে কবিতা, বস্তুতপক্ষে কবির জীবনও আলাদা। আমার কবিতাও তা–ই। আমি কবিতায় যা লিখি, তা আমাকেই লিখি—একজীবন। আমি কবিতায় আমার সঙ্গে কথা বলি, বলেছি।

ইমরান: সাহিত্যে কঠিন শাখা হলো কবিতা। এই পথে কীভাবে এলেন?

জাহিদুল: আসিনি এই পথে, জন্মেছি। কবিতায় আসা যায় না, কবিও হওয়া যায় না। কবিরা জন্মায়। তবে জন্মানোর পর কঠিন সাধনার মাধ্যমে সারা পৃথিবী চষে তার শব্দগুচ্ছটিকে ধরে আনতে জানতে হয় কবিকে। কবিতা লেখা আর আপাতদৃষ্টিতে দেখতে কবিতার মতো কিছু লেখা এক নয়। ভাষাশিল্পের তো বটেই, আমার কাছে মনে হয়, দুনিয়ার সব শিল্পের রানি হলো কবিতা!

ইমরান: ঐতিহাসিক ৭ মার্চের সময় আপনি বেতারে কাজ করতেন। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচারের ক্ষেত্রে আপনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল...।

জাহিদুল: হ্যাঁ,  আমি সে সময় শাহবাগ কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলাম। সহকর্মীদের নিয়ে পরিকল্পনা করলাম, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্প্রচার করব। আবেগ–অনুভূতি নিয়ে প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু সে পরিকল্পনা হিসেবে কাজ হয়নি, ওপর থেকে বাধা এল। করাচি থেকে জানাল, বঙ্গবন্ধুর আজকের ভাষণ প্রচার করা যাবে না। তাদের মধ্যে  ভয় ছিল, বঙ্গবন্ধু যদি স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেন।

বিষয়টি আমি মেনে নিতে পারিনি। একসময় রাজনীতি করেছি, সেটা মনে আছে। ফেনী কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলাম। পরে রাজনীতি থেকে সরে এলেও দেশের জন্য যেকোনোভাবে কাজ করব, সেটা মাথায় ছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিই, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ যেকোনোভাবে হোক প্রচার করতেই হবে। না হয় ঢাকা কেন্দ্র বন্ধ করে দেব, আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি আর আশফাকুর রহমান খান। তিনি আমার সিনিয়র, বন্ধুর মতো। তাঁকে বললাম, ‘চলো রেডিও বন্ধ করে দেই।’ সবাই তখনই মাস্টার কন্ট্রোল রুমে (এমসিআর) গেলাম সন্ধ্যায়। হাতে হাত রেখে স্টেশন সুইচ অফ করে দিলাম। কারণ, বঙ্গবন্ধুর কথা মনে ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি...।’ সেই প্রেরণায় বন্ধ করে বেরিয়ে পড়লাম। এইভাবে আমরা স্বাধীনতার সময় কাজ করেছিলাম।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের সাহিত্য এখন একদল অশিক্ষিত, গ্রাম্য এবং নিম্নশ্রেণির রাজনৈতিক দলবাজের হাতে ধ্বংস হচ্ছে। আমাদের সাহিত্য এখন তলানিতে!

ইমরান: সে সময় রেডিওতে থাকতে লেখা হয়, ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’ গানটি। এই গানের যে ‘সে’, তার পরিচয় কী?

জাহিদুল: হ্যাঁ, ১৯৭১ সাল থেকে আমি রেডিওতে কর্মরত। ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’ গানটি রেডিওর জন্যই লেখা হয়েছিল। গানটির পরিমার্জিত রূপ ১৯৭৩ সালে সিনেমায় আবার ব্যবহার করা হয়। এ গানের ভেতরের চরিত্রটি কে? জানি না। হবে হয়তো ‘আমি’, ‘আমার আমি’ এবং সেই সঙ্গে আমার ভালোবাসার মানুষটির ‘আমার আমি’ও!

ইমরান: স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম কবিতা লিখেছেন আপনি। সেটা নিয়ে কিছু বলবেন?

জাহিদুল: হ্যাঁ, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে আমার কবিতাটিই ছিল প্রথম। এটি ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারিতে লেখা। স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম কবিতা। তখন আমার সে কী অনুপ্রেরণা! স্বাধীনতা, স্বাধীনতা! ১০ জানুয়ারিতে দৈনিক পূর্বদেশে ছাপা কবিতাটি তিনি আমার মুখে শুনতে চান বলে বাদশা ভাইকে বললেন। আমিনুল হক বাদশা, বঙ্গবন্ধুর প্রেস সচিব। তিনি আমাকে একদিন আমন্ত্রণ জানালে আমি গণভবনে যাই। গিয়ে কবিতাটি বঙ্গবন্ধুকে শুনিয়ে আসি। খুবই খুশি হয়েছিলেন তিনি। এ আমার অসামান্য স্মৃতি।

ইমরান: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আপনার আর কোনো স্মৃতি আছে?

জাহিদুল: বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন ফেনীর প্রখ্যাত আওয়ামী লীগ নেতা খাজা আহমেদ। প্রথম যৌবনে ছিলেন গণতন্ত্রী পার্টি ও কমিউনিস্ট পার্টির লোক। আমি ছাত্র ইউনিয়নের লোক সত্ত্বেও তাঁর দল আওয়ামী লীগের যেকোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমার সঙ্গে শেয়ার করতেন। তিনিসহ একবার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে দেখা হয় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। দ্বিতীয়বার ১৯৭০–এর নির্বাচনের সময় ফেনীতে জনসভায় তাঁর ভাষণের আগে। ফেনী সার্কিট হাউসে আমিসহ কয়েকজন ছাত্রনেতার সঙ্গে মতবিনিময় করেন বঙ্গবন্ধু। আরেকবার গণভবনে খাজু মিয়াসহ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা ও কথা হয়।

বেতারে চাকরির সুবাদে অবশ্য বেশ কয়েকবার তাঁর সঙ্গে আমার আন্তরিক দেখা এবং ডিউটি রুম থেকে টেলিফোনে কথা হয়। একবার ফোন করে জানতে চেয়েছিলেন যে অধিবেশনের শেষে আমরা ক্লোজিং অ্যানাউন্সমেন্টটা কীভাবে দিই? আমি আমার পরিচয় দিই। তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘ও, জাহিদ নাকি, তুই কেমন আছস রে?’ তিনি ‘জয় বাংলা’র সঙ্গে ‘খোদা হাফেজ’ যুক্ত করতে বলেছিলেন এবং ‘মুকুল’কে, অর্থাৎ সেই সময়ের বেতারের ডিজিকে ফোন করতে বলার জন্য আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

ইমরান: আপনাদের সময় প্রেম ও রাজনীতির। আপনার ভাবনায় প্রেম ও কবিতার সম্পর্ক কী?

জাহিদুল: প্রেম শিল্পের অনল। সমগ্র সৃষ্টি প্রেম থেকেই জন্মেছে।

ইমরান: বিশ্বসাহিত্য নিয়ে নিয়মিত টিভি অনুষ্ঠান করেন আপনি। বাংলা সাহিত্যে আমরা কতটা এগিয়েছি বলে মনে করেন?

জাহিদুল: বিশ্বসাহিত্য নিয়ে কথা বলবে না! আমাদের লেখাপড়া একেবারেই নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের সাহিত্য এখন একদল অশিক্ষিত, গ্রাম্য এবং নিম্নশ্রেণির রাজনৈতিক দলবাজের হাতে ধ্বংস হচ্ছে। আমাদের সাহিত্য এখন তলানিতে! কেউ বলে না সে কথা!

ইমরান: আধুনিক সাহিত্যে আমাদের জীবনযাপন কতটা উপস্থাপিত হয়?

জাহিদুল: আধুনিক সাহিত্যে আমাদের জীবন কতটা উপস্থিত, সেটা শিল্পের আলোচনার বিষয় নয়, আলোচনার বিষয় হলো আমাদের সাহিত্য কতটা আধুনিকতায় উপস্থিত হলো।

ইমরান: এখন যেকোনো পুরস্কার নিয়ে লোকজন সমালোচনা করে। পদক-পদবি নিয়ে নিন্দা জানায়। কী বলবেন এ বিষয়ে?

জাহিদুল হক: মনে পড়ে, ২০০২ সালে আমি যখন বাংলা একাডেমি (পুরস্কার) পাই, সেবার সবাই বলাবলি করছিল কবিতায় আমার কথা। বিশ্বাস হয়নি আমার। বইমেলা থাকায় বিষয়টি জানতে বাংলা একাডেমির গেটের দিকে গেলাম। আমাকে দেখেই কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘জাহিদ তুমিই কি প্রমাণ না, তদবির ছাড়াও যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া যায়?’

সময় বদলেছে। বাস্তবতা আসলে খারাপ, যথাযথ লোক সম্মান পাচ্ছেন না। আমি বাংলা একাডেমি পেয়েছি ২০০২ সালে। দেশের বাকি সম্মানও হয়তো পাব। কিন্তু এখন যাঁরা পান, তাঁদের অনেকে এত নিম্নমানের যে তাঁদের নাম লোকেরা খারাপভাবে উচ্চারণ করে।