এজরা পাউন্ডের সাক্ষাৎকার

‘কৌশল হলো আন্তরিকতার পরীক্ষা’

সাক্ষাৎকারটি প্যারিস রিভিউ, সংখ্যা-২৮ ‘সামার-ফল ১৯৬২’-তে প্রকাশিত হয়। আজ এজরা পাউন্ডের ১৪০তম জন্মদিনে আমাদের নিবেদন—সাক্ষাৎকারটির নির্বাচিত অংশের বাংলা অনুবাদ

আলাপচারিতা: ডোনাল্ড হল
ভূমিকা ও অনুবাদ: ঋতো আহমেদ

এজরা পাউন্ড ১৮৮৫ সালের ৩০ অক্টোবর আইডাহোর একটি সীমান্ত সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করেন এবং পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও হ্যামিল্টন কলেজে শিক্ষালাভ করেন। তাঁর প্রথম কবিতার বই ১৯০৮ সালে ভেনিসে প্রকাশিত হয়। তখন থেকে তিনি ৯০টির বেশি কবিতা, সমালোচনা ও অনুবাদ বই প্রকাশ করেছেন—বিশেষ করে কবিতার অনুবাদ।

তরুণ কবি হিসেবে, পাউন্ড প্রথমে লন্ডনে এবং তারপর ১৯২০-এর দশকের গোড়ার দিকে প্যারিসে থাকতেন। পরে তিনি ইতালির রাপালোতে চলে যান। যুদ্ধ তাঁকে উচ্ছেদ না করা পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন। তরুণ বয়সে তিনি বেশ কয়েক বছর কবিতার সম্পাদক ছিলেন।

বহু বছর ধরে পাউন্ড জাতীয় আর্থিক ব্যবস্থা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন, যাকে তিনি সব সামাজিক ব্যবস্থার ভিত্তি বলে মনে করতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ইতালিতে থাকতেন এবং অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমেরিকার অংশগ্রহণের নিন্দা জানিয়ে রেডিও সম্প্রচার করতেন। আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে ঘটনার মধ্যে একটি হলো ১৯৪৫ সালের বসন্তে বন্দী হওয়ার সময় পাউন্ডের সঙ্গে যে নোংরা আচরণ করা হয়েছিল। আমেরিকার একটি শৃঙ্খলা প্রশিক্ষণকেন্দ্রে তাঁকে ধাতব বিমানের স্ট্রিপ ম্যাট দিয়ে তৈরি খাঁচায় বন্দী করে রাখা হয়েছিল, যার মেঝে ছিল কংক্রিটের, বিছানার জন্য কেবল কম্বল, টয়লেটের জন্য একটি ক্যান এবং একটি চির জ্বলন্ত আলো। তিন সপ্তাহ পর তিনি আংশিক স্মৃতিভ্রংশ এবং ক্লাস্ট্রোফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন। মোটের ওপর তাঁকে ছয় মাসের বেশি সময় ধরে কঠোর নির্জন কারাগারে রাখা হয়েছিল। এই সময়কালে তিনি বারবার হিস্টিরিয়া ও ভীতির আক্রমণে ভুগছিলেন। পরে তাঁকে ওয়াশিংটনে নিয়ে যাওয়া হয়। রাষ্ট্রদ্রোহের জন্য বিচার করা হয় এবং পাগল সাব্যস্ত করা হয়। সেন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চৌদ্দ বছর থাকার পর তিনি ১৯৫৮ সালে ইতালিতে ফিরে আসেন, যেখানে তিনি তাঁর মেয়ে, নাতি–নাতনিসহ থাকতে শুরু করেন।

পাউন্ডের প্রধান কাব্যগ্রন্থ, ‘দ্য ক্যান্টোস’, ১৯১৭ সালে প্রকাশিত হতে শুরু করে এবং এর সর্বশেষ অংশ, ‘থ্রোনস’, ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর ছোট কবিতাগুলো ‘পারসোনা’ (১৯২৬, বর্ধিত সংস্করণ ১৯৫০) নামক বইতে সংগৃহীত হয়। তাঁর করা অনুবাদ ‘প্রাচীন মিসরের প্রেমের কবিতা’ প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে। পাউন্ড ও মার্সেলা স্প্যান সম্পাদিত কবিতার সংকলন, ‘ফ্রম কনফুসিয়াস টু কামিংস’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে।

ইতালিতে ফিরে আসার পর থেকে পাউন্ড তাঁর বেশির ভাগ সময় তিরলে কাটিয়েছেন। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী, মেয়ে মেরি, জামাতা প্রিন্স বরিস ডি রাচেউইল্টজ এবং তাঁর নাতি-নাতনি। সেখানে ক্যাসেল ব্রুনেনবার্গে থাকতেন তাঁরা। তবে মেরানোর কাছের এই রিসোর্ট অঞ্চলের পাহাড়গুলো শীতকালে প্রচণ্ড ঠান্ডা থাকে। পাউন্ড রোদ পছন্দ করতেন। সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে ইংল্যান্ড ছেড়ে মেরানোর উদ্দেশে রওনা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঠিক তখনই একটি টেলিগ্রাম তাঁকে থামিয়ে দেয়: ‘মেরানো এখন বরফে আবদ্ধ। আপনি রোমে আসুন।’

এজরা পাউন্ডের প্রধান কাব্যগ্রন্থ, ‘দ্য ক্যান্টোস’, ১৯১৭ সালে প্রকাশিত হতে শুরু করে এবং এর সর্বশেষ অংশ, ‘থ্রোনস’, ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর ছোট কবিতাগুলো ‘পারসোনা’ (১৯২৬, বর্ধিত সংস্করণ ১৯৫০) নামক বইতে সংগৃহীত হয়। তাঁর করা অনুবাদ ‘প্রাচীন মিসরের প্রেমের কবিতা’ প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালে।

রোমে পাউন্ড একাই ছিলেন। উগো ড্যাডোন নামে এক পুরোনো বন্ধুর অ্যাপার্টমেন্টের একটি ঘরে থাকতেন। মার্চের শুরুর সেই সময়টা ছিল অসাধারণ উষ্ণ। ঘরের জানালা ও শাটারগুলো খোলাই ছিল। বাইরে থেকে ভেসে আসত ভিয়া অ্যাঞ্জেলো পলিজিয়ানোর শব্দ। ডোনাল্ড হল একটি বড় চেয়ারে বসে ছিলেন। আর পাউন্ড অস্থিরভাবে অন্য একটি চেয়ার থেকে সোফায় সরে গিয়ে আবার চেয়ারে ফিরে যান। ঘরে ছিল দুটি স্যুটকেস, তিনটি বই: ‘ফ্যাবার ক্যান্টোস’, ‘কনফুসিয়াস’ আর রবিনসনের ‘চসার’, যা তিনি আবার পড়তে শুরু করেছিলেন।

সন্ধ্যায় ক্রিস্পিসে ডিনার করতে করতে অতীত স্মৃতি রোমন্থন, এরপর একটা ক্যাফেতে আইসক্রিম খেয়ে পাউন্ড যেন এক টগবগে যুবকের মতোই হাঁটলেন রাস্তায়। বিশাল টুপি, শক্ত লাঠি, ছুড়ে ফেলা হলুদ স্কার্ফ আর তাঁর কোট, ঠিক যেন কেপ মনে হচ্ছিল তাঁকে। মনে হচ্ছিল, তিনি আবার লাতিন কোয়ার্টারের সিংহ হয়ে উঠেছেন। তারপর তাঁর অনুকরণ প্রতিভা সামনে এল। মজা করলেন। হাসলেন খুব। সেই সঙ্গে নড়ে উঠল তাঁর ধূসর দাড়ি।

তিন দিন ধরে চলা সাক্ষাৎকারের দিনের বেলায় তিনি মনোযোগসহকারে কথা বলতেন। অবশ্য মাঝেমধ্যে প্রশ্নগুলো তাঁকে ক্লান্তও করে তুলত। পরদিন সকালে যখন সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী আসতেন, পাউন্ড আগের দিনের ভুলগুলো পুনর্বিবেচনা করতেন এবং ঠিক করে দিতেন।

প্রশ্ন:

আপনি তো ক্যান্টোস প্রায় শেষ করে ফেলেছেন। ভাবছি, এর শুরুটা কেমন ছিল। ১৯১৬ সালে একটা চিঠিতে আপনি সিফারার ছন্দে আন্দ্রেয়াস ডিভাসের একটা সংস্করণ লেখার কথা বলেছিলেন। মনে হচ্ছে, ওটা ছিল ‘ক্যান্টো ১’-এর কথা। আপনি কি ১৯১৬ সালেই ‘ক্যান্টোস’ শুরু করেছিলেন?

এজরা পাউন্ড: না। ১৯০৪–এর দিকে ‘ক্যান্টোস’ শুরু করেছিলাম। বিভিন্ন পরিকল্পনা ছিল আমার, ১৯০৪ বা ১৯০৫ সাল থেকে। সমস্যা ছিল একটি ফর্ম তৈরি করা। প্রয়োজনীয় উপাদান সব গ্রহণ করতে পারবে এমন উদার কোনো ফর্ম। এমন একটি ফর্ম, যা কেবল উপযুক্ত না হওয়ার কারণে কিছু বাদ দেবে, এমন নয়। প্রথম দিকে, বর্তমানের প্রথম ‘ক্যান্টো’র একটি খসড়া ছিল তৃতীয় হিসেবে।

মধ্যযুগের স্বর্গের মতো স্পষ্টতই আমার কাছে সুন্দর ছোট কোনো রোডম্যাপ নেই। তবে আমি জানি, সংগীতের গঠনই কেবল গ্রহণ করতে পারে আমার ভাবনা আর কনফুসিয়ান মহাবিশ্ব। পারস্পরিক উত্তেজনা এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মহাবিশ্ব।

প্রশ্ন:

কনফুসিয়াসের প্রতি আপনার আগ্রহ কি ১৯০৪ সালে শুরু হয়েছিল?

এজরা পাউন্ড: না, প্রথম ব্যাপারটি ছিল: বিগত ছয় শতাব্দীতে যে কাজ হয়েছে, তার মূল্যায়নের কোনো ধারাবাহিক সংকলন ছিল না। এমন সব বিষয় নিয়ে কাজ করার প্রশ্ন উঠছিল যা ‘ডিভিনা কমেডিয়া’তেও (ডিভাইন কমেডি) ছিল না। ‘হুগো লেজেন্ডে ডেস সিক্লেস’ (শতাব্দীর কিংবদন্তি) করেছিলেন অবশ্য, কিন্তু সেখানেও কোনো মূল্যায়ন ছিল না। বরং তা কেবল ইতিহাসের টুকরোগুলো একত্র করেছিল। দরকার ছিল একটা রেফারেন্স বৃত্ত তৈরি করা—আধুনিক মনকে মধ্যযুগীয় মন হিসেবে গ্রহণ করা, যেখানে রেনেসাঁর পর থেকে ধ্রুপদি সংস্কৃতির ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছিল। এ রকমই ভাবছিলাম আমি। আমাকে নিজের বিষয় নিয়ে কাজ করতে হয়েছিল তখন।

প্রশ্ন:

আলফ্রেড ভেনিসনের কবিতা ছাড়া ‘ক্যান্টোস’–এর বাইরে আপনি আর কোনো কবিতা লেখেননি ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর হয়ে গেছে। কেন এমন হলো?

এজরা পাউন্ড: আমি এমন একটা জায়গায় পৌঁছে গেছি যেখানে মাঝেমধ্যে হালকা আবেগ ছাড়াও আমার যা বলার ছিল, তা পরিকল্পনামাফিকই হয়েছে। তারপরও বলব, অন্য অনেক কাজ বাদ দেওয়া হয়েছে, কারণ আমি ঐতিহাসিক চরিত্রের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। তারপর দেখতে পেলাম, অনেকে আমার ফর্মের সঙ্গে মেলে না, প্রয়োজনীয় মূল্যবোধ ধারণ করে না। আমি ‘ক্যান্টোস’কে ঐতিহাসিক করে তোলার চেষ্টা করেছি (ভিড জি জিওভানিনি, ট্র্যাজেডির সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক নিয়ে দশ বছরের ব্যবধানে দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় কয়েকটি ভাষাতাত্ত্বিক সাময়িকীতে। সোর্স ম্যাটেরিয়াল নয়, কিন্তু প্রাসঙ্গিক) তবে কল্পকাহিনিভিত্তিক নয়। যে উপাদান নিয়ে কাজ করতে চাই, তা সব সময় যে কাজ করে, তা নয়।

প্রশ্ন:

এখন যখন আপনি একটা ‘ক্যান্টো’ লেখেন, তখন আপনার পরিকল্পনাটা কেমন থাকে? আপনি কি প্রতিটি ‘ক্যান্টো’র জন্য একটি বিশেষ পাঠক্রম অনুসরণ করেন?

এজরা পাউন্ড: না, তেমন কিছু পড়ছি না। জীবন নিয়ে কাজ করছি। পদ্ধতি নিয়ে বলতে পারব না। তবে আমার মনে হয় কি, ‘কীভাবে’ প্রশ্নটির চেয়ে ‘কী’ প্রশ্নটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে আমি বলেছি ইতিমধ্যে। কৌশল হলো আন্তরিকতার পরীক্ষা। যদি কোনো লেখার কৌশল উল্লেখযোগ্য না হয়, তবে তা নিকৃষ্টমানের। এগুলোকে অবশ্যই অনুশীলন হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।
এজরা পাউন্ড
প্রশ্ন:

কিন্তু যখন আপনি যুবক ছিলেন, তখন কবিতার প্রতি আপনার আগ্রহ ছিল ফর্মের ওপর। তখন থেকেই পেশাদারত্ব ও কৌশলের প্রতি আপনার নিষ্ঠা প্রবাদতুল্য হয়ে ওঠে। কিন্তু গত ত্রিশ বছরে আপনার আগ্রহ বদলে গেছে বিষয়বস্তুর দিকে। পরিবর্তনটা কি নীতিগত ছিল?

এজরা পাউন্ড: আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে আমি বলেছি ইতিমধ্যে। কৌশল হলো আন্তরিকতার পরীক্ষা। যদি কোনো লেখার কৌশল উল্লেখযোগ্য না হয়, তবে তা নিকৃষ্টমানের। এগুলোকে অবশ্যই অনুশীলন হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। রিখটার তাঁর ‘ট্রিটিস অন হারমোনি’তে বলেছেন, এগুলো হলো সাদৃশ্য ও বিপরীত নীতি; রচনার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই, যা বেশ আলাদা কার্যকলাপ। কেউ একজন বলেছিলেন, ‘আপনি ইংরেজিতে প্রোভেনসাল ক্যানজোনি ফর্ম লিখতে পারবেন না।’ কথাটা মিথ্যা। তবে যুক্তিসংগত ছিল কি না, সে প্রশ্ন আলাদা। যখন প্রাকৃতিক ভাষার কোনো মানদণ্ড ছিল না, তখন ফর্মগুলো ছিল স্বাভাবিক। সংগীতের মাধ্যমে সেগুলো উপলব্ধি করা যেত। ইংরেজিতে সংগীতের প্রসার সীমিত। দেখুন, আমাদের আছে চসারের যথার্থ ফরাসি, আছে শেক্‌সপিয়ারের পরিপূর্ণ ইতালীয়, আছে ক্যাম্পিয়ন ও লয়েস। আমার মনে হয় না, আমি ‘ট্র্যাচিনিয়া’র কোরাসগুলো আয়ত্ত না করা পর্যন্ত এ ধরনের ফর্মের কাছাকাছি পৌঁছাতে পেরেছিলাম। আমি আসলে কিছু করতে পেরেছি কি না জানি না, তবে আমি ভেবেছিলাম এটা স্বরলিপিরই সম্প্রসারণ। ভ্রান্ত ধারণাও হতে পারে। শব্দ ও সুরের মিলনে পিচের পরিবর্তনের প্রভাব বিষয়ে আমি সব সময় আগ্রহী ছিলাম।

প্রশ্ন:

‘ক্যান্টোস’ লিখতে গিয়ে কি এখন আপনার সব প্রযুক্তিগত আগ্রহ নিঃশেষ হয়ে যায়, নাকি অনুবাদ? যেমন ‘ট্র্যাচিনিয়া’র কথা উল্লেখ করেছেন আপনি।

এজরা পাউন্ড: যখন একটা কাজ করার দরকার বলে মনে হয় আমার, আমি সেটা শুরু করে দিই। নতুন সংস্করণের ‘ফেনোলোসা নো’ নাটক পড়ার পর ‘ট্র্যাচিনিয়া’ লিখতে উদ্ভুদ্ধ হই। একই মাধ্যম এবং মিনোরো কোম্পানি কর্তৃক মঞ্চস্থ হওয়ার পর গ্রিক নাটকের কী দশা হয়, তা দেখার খুব ইচ্ছা হয়েছিল। সেখানে গ্রিক ভাষায় ক্যাথেকে কবিতার মতো দেখতে দৃশ্যটি আন্তস্রোতকে সত্যিই উদ্দীপিত করেছিল।

প্রশ্ন:

আপনার মতে ফ্রি ভার্স কি বিশেষ কোনো আমেরিকান ফর্ম? আমার মনে হয়, উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস সম্ভবত তা–ই মনে করেন এবং ইয়াম্বিককে ইংরেজি বলে ভাবেন।

এজরা পাউন্ড: এলিয়টের একটা বাক্য আমার খুব পছন্দের: ‘যে ব্যক্তি ভালো কাজ করতে চায়, তার জন্য কোনো পদই মুক্ত নয়।’ আমার মনে হয় পরিমিত মাত্রায় ফিরে যাওয়ার প্রচেষ্টা থেকেই সেরা ফ্রি ভার্স তৈরি হয়।

বিশেষভাবে আমেরিকান না হয়েও অ-ইংরেজি হতে পারে। আমার মনে আছে, একবার কক্তো একটি জ্যাজ ব্যান্ডে এমনভাবে ড্রাম বাজাচ্ছিলেন, মনে হয়েছিল যেন খুব কঠিন গাণিতিক সমস্যা।

আমার মনে হয় আমেরিকান একটি ফর্ম হচ্ছে জেমসিয়ান বন্ধনী। আপনি হয়তো বুঝতে পারলেন, যার সঙ্গে কথা বলছেন, তিনি লাইনচ্যুত হননি, তাই আপনি সেগুলো আবার বিবেচনা করতে পারেন। আসলে জেমসিয়ান বন্ধনীর ব্যবহার খুব বেড়ে গেছে। এটি অবশ্যই আমেরিকান। অর্থাৎ যখন কোনো লোক অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেন, কথা বলেন, যাঁর অনেক অভিজ্ঞতা রয়েছে, তখন সেখানে দুটি অভিজ্ঞতার বিনিময় হয়। তখন সে সত্যিই বুঝতে পারে, আপনি কী বিষয়ে কথা বলছেন।

প্রশ্ন:

আপনার কাজের মধ্যে অভিজ্ঞতার বিশাল পরিসর রয়েছে, পাশাপাশি ফর্মও রয়েছে। একজন কবির সবচেয়ে বড় গুণ কী বলে মনে করেন?

এজরা পাউন্ড: আমি জানি না আপনি প্রয়োজনীয় গুণাবলিকে বড় থেকে ছোট একের পর এক সাজাতে পারবেন কি না, তবে একজন কবির অবশ্যই অবিরাম কৌতূহল থাকতে হয়। যা অবশ্য কাউকে লেখক করে তোলে না, তবে যদি তা না থাকে, তার বিকাশ ব্যাহত হবে। কিছু করার বা কিছু লেখার প্রশ্ন এক অফুরান শক্তির ওপর নির্ভর করে। আগাসিজের মতো মানুষও কখনো বিরক্ত হন না, কখনো ক্লান্ত হন না। জীবন থেকে উদ্দীপনা গ্রহণ করে সেটা অন্তরে প্রতিস্থাপন করা, তারপর সেই আন্তসম্পর্কের দিক পরিবর্তন করতে করতেই জীবনের পুরো শক্তি ব্যয় করেন কবি।

এজরা পাউন্ড (জন্ম: ৩০ অক্টোবর ১৮৮৫—মৃত্যু: ১ নভেম্বর ১৯৭২)
ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন:

আপনি কি মনে করেন যে আধুনিক বিশ্ব কবিতা লেখার ধরনকে বদলে দিয়েছে?

এজরা পাউন্ড: এখন এমন অনেক প্রতিযোগিতার উদ্ভব হয়েছে যা আগে কখনো ছিল না। ডিজনির গম্ভীর দিকটার কথাই ধরুন, ডিজনির কনফুসীয় দিকটা। পেরির মতো নীতিবোধ গ্রহণ, যেখানে সাহস ও কোমলতার মূল্যবোধগুলো এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যাতে সবাই বুঝতে পারে। একটা পরম প্রতিভা আছে। আলেকজান্ডারের সময় থেকে প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের একটা বৃহত্তর সম্পর্ক বিদ্যমান। আলেকজান্ডার জেলেদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, যদি তাঁরা মাছ সম্পর্কে আকর্ষণীয়, নির্দিষ্ট কিছু জানতে পারেন, তাহলে যেন তাঁকে জানানো হয়। এই সম্পর্কের মাধ্যমে মানুষ ইকথিওলজিকে বৈজ্ঞানিক পর্যায়ে নিয়ে এসেছে যেখানে এটা প্রায় দুই হাজার বছর টিকে ছিল। এখন ক্যামেরার সঙ্গে বিশদ বিবরণের বিশাল সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। যোগাযোগ স্থাপনের এই ক্ষমতা সাহিত্যের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। কী করা দরকার আর কী করা অতিরঞ্জিত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

প্রশ্ন:

হয়তো এটাও একটা সুযোগ। বিশেষ করে যখন আপনি তরুণ ছিলেন, এমনকি ক্যান্টোসের সময়েও, আপনি বারবার আপনার কাব্যিক ধরন পরিবর্তন করেছেন। আপনি কখনোই কোথাও আটকে থাকতে চাইছিলেন না। আপনি কি সচেতনভাবে আপনার ধরনকে প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন? শিল্পীর কি সব সময় গতিশীল থাকা দরকার?

এজরা পাউন্ড: আমার মনে হয়, শিল্পীকে সারা জীবন গতির মধ্যেই থাকতে হয়। আমি তো জীবনকে এমনভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি যাতে মানুষ বিরক্ত না হয়। আমার পর্যবেক্ষণে একটা আড়াল রাখার চেষ্টা করেছি।

একজন কবির অবশ্যই অবিরাম কৌতূহল থাকতে হয়। যা অবশ্য কাউকে লেখক করে তোলে না, তবে যদি তা না থাকে, তার বিকাশ ব্যাহত হবে। কিছু করার বা কিছু লেখার প্রশ্ন এক অফুরান শক্তির ওপর নির্ভর করে।
এজরা পাউন্ড
প্রশ্ন:

সমসাময়িক আন্দোলন সম্পর্কে আপনার কী ধারণা? সাম্প্রতিক কবিদের সম্পর্কে আপনার মন্তব্য আমি আর কারও ক্ষেত্রে দেখিনি।

এজরা পাউন্ড: সবকিছু পড়ে শেষ করা যায় না। অনেক ঐতিহাসিক তথ্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিলাম। আমার মনে হয় না যে কেউ তাঁর অনুজদের সঠিক সমালোচনা করতে সক্ষম হয়েছেন বলে এমন কোনো নজির আছে। একজন মানুষ কতটা পড়তে পারে, তা নিছকই একটা প্রশ্নমাত্র।

নিজের লেখা, নাকি তাঁর সংগ্রহ করা জানি না, তবে যা–ই হোক, ১৯১২ সালে লন্ডনে ফ্রস্ট বলেছিলেন: ‘প্রার্থনার সারসংক্ষেপ হলো, হে ঈশ্বর, আমার দিকে মনোযোগ দিন।’ তরুণ লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গিও সেই রকম—ঠিক দেবত্বের দিকে নয়! এই জন্য সাধারণত তরুণ কবিদের পড়া সীমাবদ্ধ রাখতে হয় আমাকে। কেবল সুপারিশ করা তরুণ কবিদের ক্ষেত্রে কিছু লেখা পড়ি। অবশ্য এ ধরনের পাঠ ভুল পথেও পরিচালিত করতে পারে, তবে যা–ই হোক...

তরুণদের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে বলতে পারি, তুলনামূলক আলোচনা করার সময় কারোর থাকে না। যাঁদের কাছ থেকে তারা শিখছে, তাঁদের সঙ্গেই তুলনা করছে। এখন অবশ্য একটা পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু...

প্রশ্ন:

আপনি সারা জীবন তরুণদের উপদেশ দিয়েছেন। এখন কি তাঁদের জন্য বিশেষ কিছু বলার আছে?

এজরা পাউন্ড: আমি চাই, তাঁদের কৌতূহল বাড়ুক। মিথ্যে কৌতূহল নয়। তবে সেটাই যথেষ্ট নয়। কেবল পেটব্যথার কথা উল্লেখ করা আর ছাই ফেলে দেওয়া যথেষ্ট নয়। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র পাঞ্চবোলের একটা নীতিবাক্য ছিল এ রকম—যেকোনো আস্ত বোকাই স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারে।

প্রশ্ন:

একবার লিখেছিলেন, পূর্বসূরিদের কাছ থেকে চারটি প্রয়োজনীয় পথের ইঙ্গিত পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন টমাস হার্ডি, উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস, ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ড ও রবার্ট ব্রিজেস। ইঙ্গিতগুলো কী ছিল?

এজরা পাউন্ড: ব্রিজেস ছিলেন সবচেয়ে সরল। ‘সমকামী’ শব্দের বিরুদ্ধে জীবন্ত সতর্কবার্তা। আর হার্ডির লেখা ছিল বিষয়বস্তুর ওপর। তিনি পদ্ধতির ওপর ততটা মনোযোগ দিতেন না। ফোর্ডের লেখায় ছিল ভাষার সতেজতা। আর ইয়েটস ছিলেন চতুর্থ, আপনি বললেন? আচ্ছা, ইয়েটস ১৯০৮ সালের মধ্যে এমন সব সরল গান লিখেছিলেন, যেখানে শব্দের স্বাভাবিকতার কোনো বিচ্যুতিই ছিল না।

প্রশ্ন:

আপনি ১৯১৩ ও ১৯১৪ সালে ইয়েটসের সেক্রেটারি ছিলেন। তখন তাঁর সঙ্গে কী ধরনের কাজ করতেন?

এজরা পাউন্ড: বেশির ভাগ সময় জোরে জোরে পড়তাম। যেমন ডাউটির ‘ডাউন ইন ব্রিটেন’ ইত্যাদি। আর ঝগড়াঝাঁটি। আইরিশরা পরস্পরবিরোধিতা পছন্দ করে। তিনি পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে কীভাবে বেড়া তৈরি করতে হয়, শেখার চেষ্টা করেছিলেন। সময়টা খুব মজার ছিল। তিমির মতো ফয়েল দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। মাঝেমধ্যে এমন সব প্রভাব রাখতেন যে তাঁকে আমার চেয়ে বোকা মনে হতো।

উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস (জন্ম: ১৩ জুন ১৮৬৫—মৃত্যু: ২৮ জানুয়ারি ১৯৩৯)
ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন:

ইয়েটসের ওপর আপনার প্রভাব নিয়ে বিতর্ক আছে। আপনি কি তাঁর সঙ্গে তাঁর কবিতা নিয়ে কাজ করেছিলেন? তাঁর কোনো কবিতা ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর মতো কেটেছেন?

এজরা পাউন্ড: আমার মনে হয় না, আমি এ রকম কিছু করেছি। কেবল বিশেষ কিছু অভিব্যক্তির বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়েছিলাম। রাপালোতে যাওয়ার পর আমি ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে তাঁকে একটা বই প্রকাশে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। বলেছিলাম, ওগুলো আবর্জনা। তিনিও ওটার ভূমিকায় লিখে দিয়েছিলেন যে আমি বলেছি ওগুলো আবর্জনা।

আমার মনে আছে যখন ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথ) তাঁর ডুডলিং (অন্যমনস্ক পেইন্টিং) শুরু করেছিলেন, অনেকেই একে শিল্প বলেছিলেন। প্যারিসে এর একটি প্রদর্শনীও হয়েছিল। ওটা কি শিল্প ছিল? যদিও কেউ ওই ডুডলিংগুলোয় খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না, তবে অনেকেই তাঁকে মিথ্যা প্রশংসা করেছিলেন।

ইয়েটসের পরিবর্তনের কথা বলতে গেলে, ফোর্ড ম্যাডক্স ফোর্ডের কিছু কৃতিত্ব থাকতে পারে। ইয়েটস কখনো ফোর্ডের কাছ থেকে পরামর্শ নিতেন না, তবে আমার মনে হয়, ফোর্ডই তাঁকে আমার মাধ্যমে লেখার স্বাভাবিক নিয়মে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন।

প্রশ্ন:

আপনি ইউরোপে আসার আগে আমেরিকায় আপনার সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে আমি খোঁজ নিয়েছি। যা–ই হোক, প্রথম কবে এসেছিলেন?

এজরা পাউন্ড: ১৮৯৮ সালে। বারো বছর বয়সে। আমার প্রপিতামহীর সঙ্গে।

প্রশ্ন:

আপনি কি তখন ফরাসি কবিতা পড়তেন?

এজরা পাউন্ড: না, আমার মনে হয় আমি গ্রে-এর ‘এলিজি ইন আ কান্ট্রি চার্চইয়ার্ড’ বা অন্য কিছু পড়ছিলাম। ফরাসি কবিতা পড়ছিলাম না। আর পরের বছর লাতিন শুরু করেছিলাম।

প্রশ্ন:

যদি ভুল না বলি, আপনি পনেরো বছর বয়সে কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন?

এজরা পাউন্ড: মিলিটারি একাডেমির ড্রিল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমি সেটা করেছিলাম।

প্রশ্ন:

কীভাবে কবি হওয়া শুরু হলো আপনার?

এজরা পাউন্ড: আমার দাদু তখন স্থানীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পদ্যে চিঠিপত্র লিখতেন। অন্যদিকে আমার দাদি আর তাঁর ভাইয়েরা তাঁদের চিঠিতেও পদ্য ব্যবহার করতেন। তখনকার দিনে স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া হতো, যে কেউ এভাবে লিখতে পারে।

প্রশ্ন:

আপনি কি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এমন কিছু শিখেছেন যা আপনাকে কবি হতে সাহায্য করেছে? যত দূর জেনেছি, আপনি সাত-আট বছর ধরে ছাত্র ছিলেন।

এজরা পাউন্ড: মাত্র ছয় বছর। ছয় বছর চার মাস। আমি সব সময় লিখতাম। বিশেষ করে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে। প্রথম বর্ষে লায়ামনের ব্রুট ও লাতিন পড়া শুরু করেছিলাম। লাতিন ভাষা সাবজেক্ট নিয়ে কলেজে ভর্তি হই। এ জন্যই তারা আমাকে ভর্তি নিয়েছিল। পনেরো বছর বয়সে আমার মাথায় একটা সাধারণ জরিপ করার ধারণা এসেছিল। অবশ্যই আমি কবি হব কি হব না, তা ওপরওয়ালার সিদ্ধান্তের ব্যাপার, তবে আমার ওপর নির্ভর করত অন্তত কী করা হয়েছে, না হয়েছে, তা খুঁজে বের করা।

আমার দাদু তখন স্থানীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পদ্যে চিঠিপত্র লিখতেন। অন্যদিকে আমার দাদি আর তাঁর ভাইয়েরা তাঁদের চিঠিতেও পদ্য ব্যবহার করতেন। তখনকার দিনে স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া হতো, যে কেউ এভাবে লিখতে পারে।
এজরা পাউন্ড
প্রশ্ন:

আপনি মাত্র চার মাস শিক্ষকতা করেছিলেন, যেমনটা আমার মনে আছে। কিন্তু আপনি জানেন যে এখন আমেরিকার কবিরা বেশির ভাগই শিক্ষক। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সঙ্গে কবিতা লেখার সম্পর্ক নিয়ে আপনার কোনো ধারণা আছে?

এজরা পাউন্ড: এটা অর্থনৈতিক বিষয়। একজন মানুষকে যেভাবেই হোক, তাঁর খরচ মেটাতে হবে।

প্যারিসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯৩০
ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন:

ইউরোপে এত বছর কীভাবে কাটালেন?

এজরা পাউন্ড: ওহ, ঈশ্বর! সেটা এক অলৌকিক ঘটনা। ১৯১৪ সালের অক্টোবর থেকে ১৯১৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত আমার আয় ছিল ৪২ দশমিক ১০ পাউন্ড। সংখ্যাটি আমার স্মৃতিতে স্পষ্টভাবে খোদাই করা আছে।

আমি কখনোই ম্যাগাজিনের জন্য লেখালেখিতে খুব একটা দক্ষ ছিলাম না। একবার ‘ভোগ’-এর জন্য একটা ব্যঙ্গাত্মক প্রবন্ধ লিখেছিলাম। লেখাটা ছিল এক চিত্রশিল্পীকে নিয়ে, যাঁকে আমি তেমন পছন্দ করতাম না। তারা ভেবেছিল, আমি ঠিক সুরেই লিখেছি এবং তারপর ভারহায়েরেন মারা গেলে তারা আমাকে ভারহায়েরেন সম্পর্কে একটি নোট লিখতে বলে।

প্রশ্ন:

কোথাও পড়েছিলাম, আপনি লিখেছিলেন যে একবার উপন্যাস লেখার চেষ্টা করেছিলেন। সে বিষয়ে কিছু জানতে চাই।

এজরা পাউন্ড: সৌভাগ্যবশত, ওটা ল্যাংহাম প্লেসের ফায়ারপ্লেসে ঢুকে পড়ে। উপন্যাস কেমন হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা হওয়ার আগেই দুবার চেষ্টা করেছিলাম। উপন্যাসকে পদ্যের আকারে ছোট করার চেষ্টা করেছিলাম।

প্রশ্ন:

আপনি বলেছিলেন, ফোর্ডই আপনাকে স্বাভাবিক ভাষা শিখতে সাহায্য করেছিলেন, তা–ই না? চলুন, আবার লন্ডনে ফিরে যাই।

এজরা পাউন্ড: সহজ ও স্বাভাবিক ভাষার খোঁজ করছিলাম তখন। আর ফোর্ড আমার চেয়ে দশ বছরের বড় ছিলেন। তিনিই এগিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি ত্বরান্বিত করেছিলেন। এ ধরনের আলোচনা চলছিল ক্রমাগত। তার আগে যাঁরা সেখানে ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো জানতেন ফোর্ড। উইন্ডহ্যাম, আমি আর আমার প্রজন্ম আসার আগপর্যন্ত তাঁর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো কেউ ছিল না। তিনি লিওনেল জনসন ও অক্সফোর্ডের উপভাষার বিরোধী ছিলেন।

প্রশ্ন:

আপনি অন্তত দুই বা তিন দশক ধরে সে সময়ের সব শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি লেখক এবং অনেক চিত্রশিল্পী, ভাস্কর ও সংগীতজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন। এসব ব্যক্তির মধ্যে শিল্পী হিসেবে আপনার কাছে সবচেয়ে বেশি প্রাণোচ্ছল ও প্রভাববিস্তারী কে ছিলেন?

এজরা পাউন্ড: ফোর্ড ও গৌডিয়ারের বেশির ভাগই কাজই দেখেছি। যাঁদের সম্পর্কে লিখেছি, তাঁরাই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। এখানে খুব বেশি সংশোধন করার কিছু নেই।

আমি হয়তো কাজ সীমিত করে ফেলেছি, এসবে আগ্রহও এখন কম, তবে আমার বন্ধুদের সম্পূর্ণ চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের দিকে না তাকিয়ে, নির্দিষ্ট কিছু মানুষের বিশেষ বুদ্ধিমত্তার ওপর মনোযোগ দিয়েছিলাম। উইন্ডহ্যাম লুইস সব সময় দাবি করতেন যে আমি কখনো ব্যক্তি মানুষকে দেখিনি। কারণ আমি কখনো লক্ষ করিনি যে তারা কতটা দুষ্ট। বন্ধুদের দুষ্টুমিতে মোটেও আগ্রহী ছিলাম না, বরং তাঁদের বুদ্ধিমত্তায় আগ্রহী ছিলাম।

প্রশ্ন:

আপনার ইউরোপে চলে আসাটা ভালো হয়েছে! দ্রুতই সেরা সব জীবিত লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিলেন। ইউরোপে আসার আগে কি আমেরিকার কোনো কবির সঙ্গে পরিচয় ছিল? যেমন রবিনসন?

এজরা পাউন্ড: আইকেন আমাকে রবিনসনের ব্যাপারে জানান। পড়তে দেন। আমার অতটা ভালো লাগেনি। পরে আমি তাঁর কথা শুনে বুঝতে পারলাম যে হার্ভার্ডে এক লোক ভালো কাজ করছেন। হ্যাঁ, মি. এলিয়ট, তিনি আমার এক বছর বা তারও বেশি সময় পরে এসেছিলেন।

না, আমি বলতে চাইছি ১৯০০ সালের দিকে, আমার সঙ্গে ছিলেন কারম্যান, হোভে, কারওয়াইন ও ভ্যান্স চেনি। তখন ধারণা ছিল যে আমেরিকান লেখাপত্র কোনোভাবেই ইংরেজদের মতো ভালো নয়। আমার কাছে তখন মাশারের ইংরেজি লেখাপত্রের পাইরেটেড কপি ছিল। আমি লন্ডনে গিয়েছিলাম, কারণ, ভেবেছিলাম ইয়েটস কবিতা সম্পর্কে অন্য যে কারও চেয়ে বেশি জানেন। লন্ডনে আমার সময় কেটেছে বিকেলে ফোর্ডের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আর সন্ধ্যায় ইয়েটস। একজনের কাছে অন্যজনের কথা বলে আলোচনা শুরু করা যেত। এমনই ছিল আমার অনুশীলন। ইয়েটসের কাছে পড়াশোনা করতে গিয়েছিলাম। দেখলাম, ফোর্ড অনেক বিষয়ে তাঁর সঙ্গে একমত নন। তাই প্রায় বিশ বছর ধরে তাঁদের সঙ্গে আমার মতের অমিল ছিল।

প্রশ্ন:

১৯৪২ সালে আপনি লিখেছিলেন, আপনি আর এলিয়ট একে অপরকে প্রোটেস্ট্যান্ট বলে অভিহিত করতে চান না। কখন আপনি আর এলিয়ট আলাদা হয়ে গেলেন?

এজরা পাউন্ড: এলিয়ট আর আমার প্রথম থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে আলাদা অভিমত ছিল। বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধুত্বের মজাই হচ্ছে, তোমরা কোনো কোনো বিষয়ে ভিন্নমত হবে আর কিছু বিষয়ে হবে একমত। এলিয়ট সারা জীবন ধরে খ্রিষ্টীয় ধৈর্য আর সহনশীলতা বজায় রেখেছেন এবং আমাকেও পরিশ্রম করতে দেখেছেন। পরিচয়ের পর থেকেই আমরা বেশ কিছু বিষয়ে আলাদা অভিমত পোষণ করতাম। কিছু বিষয়ে একমতও হতাম। আমার মনে হয়, আমরা দুজনই কোনো কোনো বিষয়ে ঠিক ছিলাম।

প্রশ্ন:

আচ্ছা, এমন কোনো সময় ছিল কি যখন কাব্যিক ও বুদ্ধিগতভাবে আপনি নিজেকে আগের চেয়ে আরও বেশি আলাদা বোধ করেছিলেন?

এজরা পাউন্ড: কনফুসিয়ানিজমের সঙ্গে খ্রিষ্ট ধর্মের সম্পর্কের সমস্যা এখানেই। খ্রিষ্ট ধর্মের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সম্পূর্ণ সমস্যাও এখানেই। গির্জার জন্য এলিয়টের গোঁড়ামি আছে। এক অর্থে এলিয়টের কৌতূহল কমসংখ্যক সমস্যার ওপর কেন্দ্রীভূত বলে মনে হবে। এমনকি বলার অপেক্ষা রাখে না যে পরীক্ষামূলক প্রজন্মের প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ব্যক্তিগত নীতির দিকে।

আমি লন্ডনে গিয়েছিলাম, কারণ, ভেবেছিলাম ইয়েটস কবিতা সম্পর্কে অন্য যে কারও চেয়ে বেশি জানেন। লন্ডনে আমার সময় কেটেছে বিকেলে ফোর্ডের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আর সন্ধ্যায় ইয়েটস। একজনের কাছে অন্যজনের কথা বলে আলোচনা শুরু করা যেত।
এজরা পাউন্ড
প্রশ্ন:

আপনার লেখা দুটি অপেরা ‘ভিলন’ ও ‘ক্যাভালকান্তি’র কথা মনে পড়ছে। আপনি কীভাবে সংগীত রচনায় এলেন?

এজরা পাউন্ড: শব্দ ও সুর নিয়ে কাজ করতে চাইছিলাম। চাইছিলাম দুর্দান্ত কবিতাগুলো গাওয়া হোক। ইংরেজি অপেরা লিব্রেটোর কৌশল তেমন সন্তোষজনক ছিল না। চাইছিলাম, ‘ভিলন’ ও ‘ক্যাভালকান্তি’র লেখার মানসহ, একক লিরিকের চেয়ে আরও বিস্তৃত কিছু হোক। এটুকুই।

প্রশ্ন:

‘মিসেস ফেনোলোসা’ লেখার ধারণা কীভাবে পেলেন?

এজরা পাউন্ড: আমি যখন সরোজিনী নাইডুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, সেখানেই প্রথম। তিনি বলেছিলেন, ফেনোলোসা হচ্ছে অধ্যাপনা ও একাডেমিকের বিরোধিতা। তিনি বলেছিলেন, আমার কিছু লেখাপত্র তিনি দেখেছেন। আমিই নাকি একমাত্র ব্যক্তি যে কিনা এই নোটগুলো শেষ করতে পারতাম। কারণ, আর্নেস্ট চাইতেন সেগুলো সম্পন্ন করা হোক। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কী করা দরকার কিন্তু তার কাছে শেষ করার সময় ছিল না।

প্রশ্ন:

শুনেছি, আপনার দাদু রেলপথ তৈরি করেছিলেন। গল্পটা একটু বলবেন?

এজরা পাউন্ড: আচ্ছা, হ্যাঁ, তিনি চিপ্পেওয়া জলপ্রপাত পর্যন্ত রেলপথটি নির্মাণ করেছিলেন। নির্মাণের আগে তাঁর বিরুদ্ধে লোকেরা এককাট্টা হয়েছিল এবং তাঁকে কোনো রেলও কিনতে দিচ্ছিল না। ঘটনাটা ‘ক্যান্টোস’–এ আছে। তাই তিনি নিউইয়র্ক রাজ্যের উত্তরে গিয়ে সেখানে একটি পরিত্যক্ত রাস্তায় কিছু রেলিং খুঁজে পেয়েছিলেন। সেগুলো কিনে পাঠান। তারপর কাঠুরেদের সঙ্গে তাঁর কৃতকৌশল ব্যবহার করে চিপ্পেওয়া জলপ্রপাতে যাওয়ার রেলপথটি তৈরি করেন। প্রকৃতপক্ষে বাড়িতে আমরা যা শিখি, তা এমনভাবে শিখতে পাই, যা স্কুলে শেখায় না।

প্রশ্ন:

কয়েনের প্রতি আপনার বিশেষ আগ্রহ কি বাবার টাকশালে কাজ করার সময় থেকেই শুরু হয়?

এজরা পাউন্ড: এটা নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। তখন সরকারি অফিসগুলোর নিয়মকানুন অতটা কঠিন ছিল না। যদিও আমার জানা নেই, অন্য শিশুরা ভেতরে ঢুকতে পারত কি না। এখন তো দর্শনার্থীদের কাচের সুড়ঙ্গ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। দূর থেকে জিনিসপত্র দেখতে দেওয়া হয়। কিন্তু আমি তখন গলানোর ঘরেও যেতে পারতাম। সেখানে সেফের মধ্যে সোনার স্তূপ দেখতে পাওয়া যেত। আমাকে একটা বড় সোনার ব্যাগ দেওয়া হয়েছিল একবার। বলা হয়েছিল, যদি আমি সেটা নিয়ে যেতে পারি, তাহলে ওটা আমার।

শেষ পর্যন্ত ডেমোক্র্যাটরা যখন ফিরে এল, তখন তারা সব রুপার ডলার—চার মিলিয়ন ডলার রুপার কথা বলল। সব ব্যাগ ওই বিশাল ভল্টে থেকে থেকে যেন পচে গিয়েছিল। তারা কয়লার বেলচার চেয়ে বড় বেলচা দিয়ে গুনতে শুরু করেছিল। এমনভাবে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখানো হচ্ছিল যেন আবর্জনা! লোকেরা কোমর পর্যন্ত নগ্ন হয়ে গ্যাসের আগুনে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল; ব্যাপারটা কল্পনাকেও বিস্মিত করে।

তারপর আছে ধাতব টাকা তৈরির পুরো একটা কৌশল। প্রথমত, সোনা পরীক্ষা করার চেয়ে রুপার পরীক্ষা অনেক বেশি জটিল। সোনা সহজ। প্রথমে ওজন করা হয়, তারপর পরিশোধিত করে আবার ওজন করা হয়। আপেক্ষিক ওজন দ্বারা আপনি আকরিকের গ্রেড বলতে পারবেন। কিন্তু রুপার পরীক্ষা একটি ঘোলাটে ব্যাপার। মেঘের পুরুত্ব পরিমাপে চোখের নির্ভুলতার মতোই নান্দনিক উপলব্ধি। ধাতুর সূক্ষ্মতা আমার ভালো লাগে। সে সময় আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, সোনার ইট ও লোহার পাইরাইটের নমুনাগুলো বাবার অফিসে আনা হয়েছিল, যেটি সোনা ভেবে ভুল করেছিল ওরা।

প্রশ্ন:

আমি জানি, আপনি আর্থিক সংস্কারকে সুশাসনের চাবিকাঠি মনে করেন। আমি ভাবছি, কীভাবে আপনি নান্দনিক সমস্যা থেকে সরকারি সমস্যার দিকে এগোলেন? সেই মহাযুদ্ধ, যে যুদ্ধে আপনার অনেক বন্ধু নিহত হয়েছিলেন, সেটাই কি সেই পরিবর্তনের পথ তৈরি করেছিল?

এজরা পাউন্ড: প্রথম মহাযুদ্ধটি ছিল এক আশ্চর্যজনক ঘটনা এবং অবশ্যই ইংরেজদের, যারা কখনো কিছুই করেনি, নিজেদের ধরে রাখতে দেখা, লড়াই করতে দেখা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ছিল। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা যেন মিলিয়ে গেল। তারপর দ্বিতীয় যুদ্ধটা রোধ করার জন্য পরবর্তী বিশ বছর ধরে চেষ্টা করে গেল। সরকার সম্পর্কে আমার পাঠ কোথা থেকে শুরু হয়েছিল, তা আমি ঠিক বলতে পারছি না। আমার মনে হয়, নিউ এজ অফিস আমাকে যুদ্ধ কোনো পৃথক ঘটনা হিসেবে নয় বরং একটি ব্যবস্থার অংশ হিসেবে দেখতে সাহায্য করেছে। একের পর এক যুদ্ধ।

প্রশ্ন:

আপনার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড যুদ্ধের সময় ইতালি থেকে সম্প্রচারিত হয়েছে। যখন আপনি ওই বক্তৃতাগুলো দিয়েছিলেন, তখন কি আমেরিকার আইন ভঙ্গ করার বিষয়ে সচেতন ছিলেন?

এজরা পাউন্ড: না, আমি পুরোপুরি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। দেখুন, আমার সেই প্রতিশ্রুতিটুকু ছিল। আমাকে সপ্তাহে দুবার মাইক্রোফোনের স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। ‘তাঁকে তাঁর বিবেকের বিরুদ্ধে বা আমেরিকার নাগরিক হিসেবে তাঁর কর্তব্যের বিরুদ্ধে কিছু বলতে বলা হবে না।’ আমার মনে হয়েছিল এতটুকুই যথেষ্ট।

নিঃসন্দেহে ইউরোপ ছিল একটা ধাক্কা। নিজেকে কোনো কিছুরই কেন্দ্রবিন্দুতে দেখতে না পাওয়ার ধাক্কাটাও সম্ভবত এরই অংশ। কেউ একজন বলেছিলেন, ইউরোপের ট্র্যাজেডিতে বেঁচে থাকা আমিই শেষ আমেরিকান।
এজরা পাউন্ড
প্রশ্ন:

রাষ্ট্রদ্রোহের আইন ‘শত্রুকে সাহায্য ও সান্ত্বনা দেওয়ার’ই কথা বলে না কি? আর শত্রু কি সেই দেশ নয়, যার সঙ্গে আমরা যুদ্ধ করছি?

এজরা পাউন্ড: ভেবেছিলাম আমি একটি সাংবিধানিক বিষয়ের জন্যই লড়াই করছি। আমি বলতে চাইছি, আমাকে হয়তো পাগল মনে হতে পারে, কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, ব্যাপারটা কোনোভাবেই বিশ্বাসঘাতকতা নয়।

ওডহাউস তার সম্প্রচার শুরু করলে ব্রিটিশরা তাকে সেটা করতে নিষেধ করে। কিন্তু আমাকে কেউ নিষেধ করেনি। কিছুই বলেনি। পতনের আগপর্যন্ত এমন কোনো ঘোষণা ছিল না যে রেডিওতে যারা কথা বলেছিল, তাদের বিচার করা হবে।

যুদ্ধ রোধের জন্য বছরের পর বছর কাজ করার পর ইতালি ও আমেরিকার যুদ্ধের বোকামি দেখে— আমি তো সৈন্যদের বিদ্রোহ করতে বলিনি। ভেবেছিলাম, সাংবিধানিক সরকারের অভ্যন্তরীণ প্রশ্নের সঙ্গে লড়াই করছি। যদি কোনো ব্যক্তি, যেকোনো ব্যক্তি বলতে পারে যে জাতি, ধর্ম বা বর্ণের কারণে সে আমার সঙ্গে খারাপ চুক্তি করেছে, তবে তাকে বিশদ বিবরণসহ তা বলতে বলুন। ‘দ্য গাইড টু কুলচুর’ বেসিল বান্টিং ও লুই জুকোভস্কিকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। তাঁদের একজন ছিলেন কোয়েকার আর একজন ইহুদি।

আমি জানি না আপনি কী মনে করেন, রাশিয়ানদের বার্লিনে থাকা উচিত কি না। আমি জানি না, আমি কোনো ভালো কাজ করছিলাম কি না, আমি কোনো ক্ষতি করছিলাম কি না। আমি সম্ভবত অফসাইড ছিলাম। কিন্তু বোস্টনের আদালত রায় দিয়েছিলেন, বিশ্বাসঘাতকতার উদ্দেশ্য ছাড়া কখনো কোনো বিশ্বাসঘাতকতা হয় না।

আমি যা বলেছিলাম, তা হলো ব্যক্তি অধিকার সংরক্ষণ। যদি, যখন নির্বাহী বা অন্য কোনো শাখা তার বৈধ ক্ষমতা অতিক্রম করে, কেউ প্রতিবাদ না করে, তাহলে আপনি আপনার সব স্বাধীনতা হারাবেন। ত্রিশ বছর ধরে স্বৈরাচারের বিরোধিতা করা আমার পদ্ধতি ভুল ছিল; বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক ছিল না। যদি ব্যক্তি অথবা ধর্মদ্রোহী, কিছু অপরিহার্য সত্য ধরে ফেলে অথবা অনুশীলন করা ব্যবস্থায় কোনো ত্রুটি দেখতে পায়, তাহলে সে নিজেই এত বেশি প্রান্তিক ভুল করে যে তার বক্তব্য প্রতিষ্ঠা করার আগেই সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

বিশ বছরে বিশ্ব তৃতীয় একটি যুদ্ধ, আমলাতান্ত্রিক অত্যাচার ও কাগজপত্র থেকে উদ্ভূত উচ্ছ্বাসের স্তূপ তৈরি করেছে। ১৯০০ সালের মতো স্বাধীনতার যে বিশাল ক্ষতি হয়েছিল, তা সত্যিই অনস্বীকার্য। আমরা স্বৈরাচারী আচরণ কেবলই বাড়তে দেখেছি, যা একজন মানুষকে ভাবনায় ফেলার জন্য যথেষ্ট। যুদ্ধগুলো আসলে ঋণ করার জন্য বাধানো হয়। আমি মনে করি, যুদ্ধ নয়, ঋণ করা যেতে পারে উপগ্রহ গবেষণার মতো মহৎ কাজে।

প্রশ্ন:

যখন আপনাকে আমেরিকানরা গ্রেপ্তার করেছিল, তখন কি ভেবেছিলেন যে দোষী সাব্যস্ত হবেন? ফাঁসি হবে?

মিত্রশক্তির হাতে গ্রেপ্তারের পর
ছবি: সংগৃহীত

এজরা পাউন্ড: প্রথমে আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে কোথাও একটা স্কোয়াড হয়তো মিস করেছি। ভেবেছিলাম আমি কী শিখেছি সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। জিজ্ঞাসা করা হবে আমি কী করেছি আর কী করিনি। সম্প্রচারের সময় বেশ কয়েকবার নিজেকে পরীক্ষা করেও দেখেছিলাম। অন্য দেশের সঙ্গে কাজ করা আমার নিয়ন্ত্রণের ওপর থাকে না সব সময়। দখলদারত্বের বিরুদ্ধে, আমেরিকাকে যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলার জন্য যুদ্ধ শুরু করা লোকেদের বিরুদ্ধে কেউ যে তর্ক করতে পারে, তা ভাবাটা ছিল ভীতিকর। তবু আমি এমন কিছুর প্রতি আনুগত্যের ধারণা ঘৃণা করি, ঘৃণা করি ভুল পদক্ষেপ।

পরে আমাকে চিয়াভারির কোর্টে চালান করে দেয়। আমেরিকানরা ওখানে গুলি করছিল। আমি ভেবেছিলাম, তখনই শেষ হয়ে গেছি।

প্রশ্ন:

এখন যেহেতু আপনি শেষের দিকে পৌঁছে গেছেন, ‘ক্যান্টোস’ শেষ করার পর আর কী পরিকল্পনা আছে আপনার?

এজরা পাউন্ড: আমি জানি না। বিস্তারিত ব্যাখ্যা কিংবা আরও একটু স্পষ্টীকরণের প্রয়োজন আছে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, বিস্তৃত কোনো সংশোধনের দরকার কি না। নিঃসন্দেহে লেখাটি যেমন দাঁড়িয়েছে, অনেকটাই অস্পষ্ট, তবে আমি আশা করছি, ‘প্যারাডিসো’ পাঠের ক্রম আরও স্পষ্ট হবে। কিছু ত্রুটি থাকার কারণে এর সংশোধিত সংস্করণ হওয়া দরকার।

প্রশ্ন:

আপনার কি আবার আমেরিকায় যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা আছে? কী চান?

এজরা পাউন্ড: নিঃসন্দেহে চাই যেতে। কিন্তু সেই আমেরিকা কি আর আছে? হয়তো আছে, হয়তো নেই। আমার মাথার মধ্যে, নস্টালজিয়ায়, যে আমেরিকা আছে, সেটা বিমূর্ত, সেই অ্যাডামস–জেফারসন-অ্যাডামস-জ্যাকসন আমেরিকা এবং আসলে এখন যা ঘটছে, সেখানে তার মধ্যকার তফাৎ নিয়ে ভাবছি। এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যখন আমেরিকায় যেতে খুব ইচ্ছা করে। কিন্তু সাধারণ এই আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে বদলে যাওয়া আমেরিকার অসুবিধাগুলোও ভাবনায় ফেলে। রিচমন্ড একটি সুন্দর শহর, কিন্তু আপনি যদি গাড়ি না চালান, তবে আপনি সেখানে থাকতে পারবেন না। আমি বছরে অন্তত এক বা দুই মাস যুক্তরাষ্ট্রে কাটাতে চাই।

প্রশ্ন:

সেদিন বলেছিলেন, যত বড় হই, ততই নিজেকে আরও আমেরিকান মনে হয়। এই অনুভূতি আপনার মধ্যে কীভাবে কাজ করে?

এজরা পাউন্ড: হ্যাঁ, এই অনুভূতি কাজ করে আমার মধ্যে। নিজের ভেতর দেশের মজবুত ভিত্তি স্থাপনের জন্য বিদেশি অভিজ্ঞতার প্রয়োজন ছিল। তাই নিজেকে প্রতিস্থাপিত করি ভিন্ন দেশে। বেড়ে উঠি। পরে নিজেকে টেনে তুলে আবার সেই স্থানে নিয়ে যাই। তখন বিদেশ আর থাকে না আমার মধ্যে। নিজের জৈব প্রকৃতিতে ফিরে যাই। আপনি কি কখনো অ্যান্ডি হোয়াইটের স্মৃতিকথা পড়েছেন? তিনিই কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৯০০ সালের দিকে, পতনের আগে, সময়টা ছিল উচ্ছ্বাসের সময়, যখন সবাই ভেবেছিল যে আমেরিকার সব ভালো প্রচেষ্টাই সফল হবে। মি. হোয়াইট ইতিহাসের এমন একটি সময়কালকে দেখিয়েছেন যা বুকাননের সময়কালকেও কাভার করে। তিনি রাশিয়ায় রাষ্ট্রদূত এবং অন্যদিকে কর্নেলের প্রধান ছিলেন।

প্রশ্ন:

আপনার ইতালিতে ফিরে আসাটা হতাশাজনক, তাহলে?

এজরা পাউন্ড: নিঃসন্দেহে ইউরোপ ছিল একটা ধাক্কা। নিজেকে কোনো কিছুরই কেন্দ্রবিন্দুতে দেখতে না পাওয়ার ধাক্কাটাও সম্ভবত এরই অংশ। আর আছে আমেরিকা সম্পর্কে ইউরোপের বোধগম্যতার অভাব ও অজ্ঞতা। এমন অনেক কিছু আছে যা একজন আমেরিকান হিসেবে আমি একজন ইউরোপীয়কে বলতে পারি না। কারণ, সে বুঝবে না। কেউ একজন বলেছিলেন, ইউরোপের ট্র্যাজেডিতে বেঁচে থাকা আমিই শেষ আমেরিকান।