প্রশ্ন :
মুক্তির কথা ছবি সম্পর্কে বলতে গিয়ে আপনি ইদানীং প্রায়ই সাবঅল্টার্ন বা নিম্নবর্গ শব্দটি ব্যবহার করছেন, এর কারণ কী?
তারেক মাসুদ: নিম্নবর্গ কথাটা বলা খুব সহজ। কিন্তু আসল কাজটি হচ্ছে ওদের কাছে গিয়ে ওদের কথা ধারণ করা। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো ধারণ করার পর আমি কীভাবে সেটা হাজির করছি। মানে আমাদের নাগরিক সমাজের ধারণায় সেটা পরিবর্তিত করছি কি না; নিজেদের সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে সেটা ব্যবহার করছি কি না। মুক্তির কথায় আমরা তাদের কথা এমনিই ধারণ করছি না, করছি অংশগ্রহণমূলক উপায়ে। তাদের কথা আমরা তাদের মতো করেই বলতে দিচ্ছি। কোনোভাবেই মতাদর্শায়ন করছি না।
প্রশ্ন :
স্বাভাবিকভাবেই তাহলে ইতিহাসের আনুষ্ঠানিক ভাষ্যের সঙ্গে নিম্নবর্গের ভাষ্যের মৌলিক পার্থক্যের প্রসঙ্গ এসে যায়। একে আপনি কীভাবে চিহ্নিত করবেন?
তারেক মাসুদ: আনুষ্ঠানিক ইতিহাসের মধ্যে এমন একটা ভান রয়েছে যে এটা বস্তুনিষ্ঠ ব্যাপার। আনুষ্ঠানিক ভাষ্যে এই ইতিহাস কীভাবে কার দ্বারা লিখিত হলো, তার বিচার না করে একধরনের নৈর্ব্যক্তিকতা তৈরি করা হয়। নিম্নবর্গের ইতিহাসের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো এখানে ইতিহাস লেখার কোনো ভণিতা নেই। গল্পের মতো করেই বিবৃত করা হচ্ছে সবকিছু। মনে হবে একজন মানুষ তার নিজের জীবনকাহিনিই বর্ণনা করছে। তার বর্ণনা ইতিহাসের অনেক ভাষ্যের মতো আরেকটা ভাষ্য। এ যেন আকিরা কুরোসাওয়ার ছবি রাশোমন–এর মতো ব্যাপার। চারটি চরিত্র চারভাবে একই ঘটনার বিবরণ দিচ্ছে। মুক্তির কথা ছবির ক্ষেত্রেও তা–ই ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের একটি ঘটনার শিকার চারজন নারী ভিন্ন ভিন্নভাবে একই ঘটনার বিবরণ দিচ্ছেন। কেউই দাবি করছে না যে তারা ইতিহাস বর্ণনা করছে। এটা তাদের নিজের গল্প, নিজেরাই বলছে। এসব গল্পের মধ্যে ইতিহাসের অনেক উপাদান রয়েছে। এটাই কিন্তু মৌখিক ইতিহাস।
প্রশ্ন :
এর মাধ্যমে কি আঞ্চলিক ইতিহাসের গল্পও তুলে আনা সম্ভব হবে?
তারেক মাসুদ: মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস তুলে আনাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আঞ্চলিক ইতিহাসই জাতীয় ইতিহাস নির্মাণ করে। তবে ইতিহাসের এই রূপান্তর খুব সংকটজনক। কারণ, তার মধ্যে আমরা নিজেদের ভাষ্য তৈরি করি। নৈর্ব্যক্তিকতার নামে বিমূর্ততা চলে আসে। শুধু আঞ্চলিক ইতিহাস তুলে আনাই যথেষ্ট নয়, আঞ্চলিক ভাষাটাও আনা জরুরি। কী বলা হচ্ছে, তার সঙ্গে কে বলছে এবং কীভাবে বলছে, সেটাও মৌখিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিকতাবাদীরা এই গল্পগুলোকে আড়াল করার চেষ্টা করে। তাদের বর্ণনা থেকে মনে হয়, ঈশ্বর এসে এসব গল্প ও ইতিহাস রচনা করে গেছেন।
মুক্তির কথায় দেখা যাবে যারা ছবিটি প্রদর্শন করতে গেছে, তারাই আবার এই নিম্নবর্গের মানুষদের কথা ধারণ করেছে। সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের ছবি দেখতে দেখতে নিজেদের গল্প বলতে শুরু করেছে ক্যামেরার সামনে। দর্শকেরা সেটা দেখে নিজেদের মতো করে ভাষ্য তৈরি করে নিচ্ছেন।
একটা মজার ঘটনা বলি। এক গ্রামে আমরা একটি গণহত্যার ঘটনা শুটিং করি। গ্রামের মহিলারা তা আবার করে দেখান আমাদের। ঠিক এক বছর পর সেই গ্রামে গিয়ে কিছু অংশ সম্পাদনা করে তাদের দেখাই এবং সেটাও শুটিং করি। ফলে পুরো প্রক্রিয়াটাই চলে যাচ্ছে চলচ্চিত্রের নিজস্ব কাঠামোর বাইরে। এ যেন একটা প্রবহমান প্রক্রিয়া। এই প্রতিক্রিয়াধর্মী আচরণও আমরা মুক্তির কথায় আনার চেষ্টা করেছি।
প্রশ্ন :
মুক্তির গান প্রামাণ্য ফুটেজের ভিত্তিতে তৈরি হলেও ডকুমেন্টারি ছবির মূল ধরনের বদলে আপনি একটি বর্ণনাত্মক কাঠামো বেছে নিয়েছেন।
তারেক মাসুদ: এক অর্থে কথাটি সত্যি। অনেকেই আমাদের প্রশ্নে করেছেন, ডকুমেন্টারি ফিল্ম কি আসল এবং নৈর্ব্যক্তিক হওয়া উচিত নয়? আমি বলব এটা একটা আধুনিকতাবাদী ধারণা। আধুনিকতাবাদী ডকুমেন্টারির ধারণা হলো একে আসল হতে হবে, নৈর্ব্যক্তিক ইতিহাস তুলে আনতে হবে। কোনো গল্প থাকবে না। আমরা কিন্তু সচেতনভাবেই গল্প বলার ধরনটা বেছে নিয়েছি, পুনর্নির্মাণ করেছি। এমনভাবে করেছি যাতে মনে হয় এটা একটা গল্প, প্রকৃত ইতিহাস নয়। সনাতন ডকুমেন্টারির বিভ্রম বা ভণিতার বদলে মানুষের জীবনে সত্যিকারের যা ঘটেছে, তাই আমরা দেখাচ্ছি। যে ব্যক্তির জীবনে ঘটনাটি ঘটেছে, এতে তার ব্যক্তিগত প্রতিফলন থাকবেই, প্রচলিত প্রামাণ্যচিত্রে যা আড়ালে পড়ে যায়।
মুক্তির কথায় যারা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অত্যাচারিত তাঁরা তাঁদের নিজেদের কথা নিজেরাই বলেছেন। তাঁদের গ্রামেই শুটিং করা হচ্ছে। এখানে কেউ অভিনয় করছেন না। একে আমি এক অর্থে বলব উত্তর–আধুনিক একটা দৃষ্টিভঙ্গি। এটা ইতিহাস নয়, গল্প। এটা হাজারো গল্পের একটা।
প্রশ্ন :
গল্প বলার এই কাঠামো কি এ জন্যই বেছে নিয়েছেন, যাতে সাধারণ দর্শককে অনেক সহজে যুক্ত করা যায়?
তারেক মাসুদ: এটা এক অর্থে সত্যি। কারণ, এতে সাধারণ দর্শকের কাছে অনেক সহজে পৌঁছানো যায়। এই কাঠামোতে দর্শককে কম প্রতারিত করা হয়। কারণ, যেকোনো ডকুমেন্টারিতেই ম্যানিপুলেশন থাকতে বাধ্য। ডকুমেন্টারি অনেক সময় ফিকশনের চেয়েও বেশি ম্যানিপুলেট করে। কারণ, ফিকশনে মানুষ আগে থেকেই ধরে নেয় যে এটা একটা গল্প। কিন্তু গল্পের মধ্যেও তো সত্য থাকে, তা–ই না? আসল আর সত্যের মধ্যে বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকে। শিল্পে তো আসল হওয়ার চেয়েও সত্য হওয়া বেশি জরুরি। ডকুমেন্টারিতেও তা–ই। আসলে বাস্তবের সৃষ্টিশীল প্রয়োগের নামে যা ঘটে, তা বাস্তবের রাজনৈতিক প্রয়োগে পরিণত হয়। এটা অস্বীকারের উপায় নেই। এটা আড়াল করার চেষ্টাই সমস্যাজনক।
মুক্তির গান-এও আমরা ইলিউশন তৈরির চেষ্টা করেছি, যাতে মনে হয় এটা একটা গল্প। তাই ছবির শুরুতেই লিখে দিয়েছি, এটা একটা প্রামাণ্য গল্প। অনেকে একে প্রামাণ্যচিত্র বললেও আমরা তো জানি কীভাবে এটা নির্মাণ করা হয়েছে। লিয়ার লেভিনের ফুটেজ তো ছিলই। আরও ফুটেজ কেনা হয়েছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। মুক্তির গান ছবির সম্পাদনার মূল কাজই ছিল একটা গল্প বলা। যদি আমরা ভান করতাম যে এগুলো আসল, তাহলে সেটা হতো প্রতারণা।
দর্শকেরা কিন্তু তাদের যৌথ অচেতন থেকেই সেই গল্পের বার্তাগুলো সংগ্রহ করে নেয়। কাজেই আমি বলব ডকুমেন্টারি আর ফিকশনের মধ্যে যে যথেচ্ছ সীমানা, এটা থাকা উচিত নয়। কারণ, দুটিই প্রতিনিধিত্বশীল শিল্প। দুটোই একধরনের ভাষ্য।
প্রশ্ন :
আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ ডকুমেন্টারি দেখতে চায় না। দর্শকেরা যাতে ছবি দেখতে আগ্রহী হয়ে ওঠে, ডকুমেন্টারির প্রথাগত কাঠামো ভেঙে দেওয়ার পেছনে সে রকম কোনো ভাবনা ছিল?
তারেক মাসুদ: প্রামাণ্যচিত্র মানুষ দেখে না, এই ধারণা এসেছে মূলত সরকারি প্রচারচিত্রগুলোর কারণে। সরকারি ডকুমেন্টারি তৈরিই করা হয় এমনভাবে, যাতে মনে হবে এটা কোনো প্রচারণা নয়। কিন্তু এ ধরনের ছবি সনাতন প্রচারণামূলক প্রামাণ্যচিত্রের পুরো ধারণাটিই কিন্তু বহন করছে। এ ধরনের প্রামাণ্যচিত্রে আরও থাকে ধারাবিবরণী, যাতে শুধু কথা শোনা যায়, মনে হয় যেন ঐশীকণ্ঠ। একে অনেকটা তুলনা করা চলে আনুষ্ঠানিক ইতিহাসের লেখকের সঙ্গে, লেখার মধ্যে যার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। উত্তর–আধুনিক ধারায় যিনি লিখছেন, তার উপস্থিতিও আসতে হবে। কীভাবে তিনি ইতিহাসটা লিখছেন, লেখার মধ্যে তা থাকতে হবে।