সাহিত্যে নোবেলজয়ী আনি এরনোর সাক্ষাৎকার

‘আমার বইয়ে বর্ণিত ঘটনাগুলো প্রত্যেকের—ইতিহাসের, সমাজবিজ্ঞানের’

সাহিত্যে নোবেল ঘোষণা হলো কিছুক্ষণ আগে। ২০২২ সালে এ পুরস্কার পেলেন ফরাসি সাহিত্যিক আনি এরনো। আত্মস্মৃতিকে উপজীব্য করে লেখালেখি করেন তিনি। তাঁকে নোবেল দেওয়ার কারণ হিসেবে সুইডিশ একাডেমির ভাষ্য, সাহস ও তীক্ষ্ণতার সঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত স্মৃতির শিকড়, বিচ্ছিন্নতা ও সম্মিলিত অবদমন উন্মোচন করায় ৮২ বছর বয়সী আনি এরনোকে দেওয়া হয়েছে পুরস্কারটি। ২০১৯ সালে ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় তাঁর এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। এখানে নিজের ‘দ্য ইয়ার্স’ বইটি নিয়ে বিস্তর কথা বলেছিলেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন মাহীন হক
প্রশ্ন:

আপনি এই বইটিতে (‘দ্য ইয়ার্স’) ‘একজন’ ও ‘আমরা’ আর কখনো কখনো ‘সে’ কিংবা ‘তারা’ সর্বনামও ব্যবহার করেছেন। কিন্তু একবারও ‘আমি’ ব্যবহার করেননি। বইটা একটা নৈর্ব্যক্তিক আত্মজীবনী হলেও ব্যাপারটা বেশ অস্বাভাবিক...

আমি যখন আমার জীবনের কথা ভাবি, তখন আমি আমার শৈশব থেকে শুরু করে আজকের দিন পর্যন্ত গল্পটা দেখতে পাই। কিন্তু এই গল্পকে আমি আমার যাপিত দুনিয়া থেকে আলাদা করতে পারি না। আমার গল্প আমার গোটা প্রজন্মের সঙ্গে ঘটা প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে মিশ্রিত। আত্মজীবনী লেখার যে চিরাচরিত ঐতিহ্য, তাতে আমরা নিজেদের কথাই বেশি বলি এবং ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো পেছনে ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে পড়ে থাকে। আমি এই ব্যাপারটাকে বদলে দিয়েছি। এই গল্পটা হলো একজন ব্যক্তিমানুষের সঙ্গে গত ৬০ বছরে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা আর চড়াই–উতরাইয়ের এক বিবরণ, যা নিজেকে ‘আমরা’ ও ‘তাদের’ মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। আমার বইয়ে বর্ণিত ঘটনাগুলো প্রত্যেকের—ইতিহাসের, সমাজবিজ্ঞানের।

আনি এরনো
ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন:

‘দ্য ইয়ার্স’ মূলত অর্ধশত বছর ধরে ফ্রান্সে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন পরিবর্তনের একটি ক্রমধারা—যদিও এখানে আপনি গোটা বিশ্বে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার প্রভাব উল্লেখ করেছেন যেমন দ্য বিটলস, ইরাক যুদ্ধ, ৯/১১—তবু বইটা মূলত ফ্রান্সের বাস্তবতা থেকেই লেখা। এ বই বিশ্বের অন্যত্র কেমনভাবে গৃহীত হয়েছে? ম্যান বুকার ইন্টারন্যাশনাল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হওয়াতে কি আপনি অবাক হয়েছিলেন?

হ্যাঁ, ভীষণ অবাক হয়েছিলাম। তবে বইটা জার্মানি ও ইতালিতে সাদরে গৃহীত হয়েছে। এবং চীনা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ফলে ধারণা করি, বইটার মধ্যে স্রেফ ফ্রান্সের ইতিহাসের চেয়েও ব্যাপক কোনো টান রয়েছে। আমি সরাসরি না বললেও বইটা স্পষ্টতই একটি ব্যক্তিগত জীবনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ইতিহাস—আমার ব্যক্তিগত জীবনের, আমার স্মৃতির। একটা সামগ্রিক ইতিহাসকে আমি উঠিয়ে এনেছি আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি ও স্মৃতির আলোকে। বইটির প্রধান চরিত্র হলো সময়; সে বয়ে যায়, সেই সঙ্গে নিয়ে যায় সবকিছু—আমাদের জীবনও।

প্রশ্ন:

বইটিতে যে বর্ণনাভঙ্গি, তা তো পুরোপুরি নিরাবেগ। এতে আপনি ব্যক্তিগত জীবনের খুব কম অংশই উন্মোচিত করেছেন। আপনার পরিবার, সন্তান, আপনার বিয়ে ভেঙে যাওয়া, যৌনতার কথাও আপনি লিখেছেন, কিন্তু ভালোবাসা বিষয়ে কিছু লেখেননি। নিজের মায়ের আলঝেইমার্স রোগের কথা ঠিকই লিখেছেন, মেরে ফেলা হবে জানার পর আপনার বিড়ালের চোখের চাহনিও বর্ণনা করেছেন, আপনার সাবেক প্রেমিক আপনার চেয়ে কম বয়সী আরেক সঙ্গী খুঁজে পাওয়ায় নিজের হিংসার কথা ব্যক্ত করেছেন। তবে এগুলো ছাড়া বইটিতে বাকি যে অংশ রয়েছে, তা বেশ অদ্ভুত রকমভাবে অনুভূতিশূন্য।

আমি তেমন লেখক নই যে অনুভূতির ওপর খুব গুরুত্ব আরোপ করব। তা ছাড়া এটা ‘দ্য ইয়ার্স’–এর প্রধান বিষয়বস্তু ছিলই না। এই বইয়ের মূল ব্যাপারই হলো ব্যক্তিকে নিয়ে বেশি কথা না বলা। সামগ্রিক চিত্রগুলোর মাধ্যমেই তাকে বুঝে নিতে হবে। প্রতিটি দশকের জন্য আমি একটি সামগ্রিক চিত্র নির্মাণ করেছি, সেসব দশকের জামাকাপড়, আলো ইত্যাদির বর্ণনা করেছি। আর তারপর আমি নিজেকে স্থাপন করেছি সেই সামগ্রিক চিত্রে। ওই চিত্রগুলোর মাধ্যমেই আমি আমার বাবার মৃত্যু, আমার সন্তানদের কথা বলেছি। কিন্তু আবেগীয় কথাবার্তা আমি সচরাচর লিখিনি।

নিজের বইয়ে স্বাক্ষর করছেন আনি এরনো
ছবি: সংগৃহীত
আত্মজীবনী লেখার যে চিরাচরিত ঐতিহ্য, তাতে আমরা নিজেদের কথাই বেশি বলি এবং ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো পেছনে ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে পড়ে থাকে। আমি এই ব্যাপারটাকে বদলে দিয়েছি
আনি এর্নো

প্রশ্ন :

আপনার পারিবারিক অবস্থা খুব সচ্ছল ছিল না। আপনার বাবা-মা ছোট একটা দোকান চালাতেন। তবে আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। অন্যান্য ফরাসি লেখক—যাঁদের পরিবার ছিল খেটে খাওয়া শ্রেণির অংশ, যেমন এদোয়ার লুই—তাঁরা লিখেছেন, এই অভিজ্ঞতা তাঁদের নিজের পরিবারের থেকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছিল...

আমার ব্যাপারটা বেশ ব্যতিক্রম। আমি ছিলাম আমার বাড়ির একমাত্র সন্তান। আমার বোন আমার জন্মের আগেই মারা যায়। আর যেহেতু আমার মা ছিলেন একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী; এবং তিনি নিজেও পড়তে ভালোবাসতেন, ফলে আমাকে তিনি বেশ উৎসাহ দিয়েছিলেন। তবে হ্যাঁ, এতে আমার ও আমার মা–বাবার মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়েছিল বৈকি। ৪০ বছর আগে লেখা আমার প্রথম বইটির বিষয়বস্তু ছিল এই দূরত্ব।

 

প্রশ্ন :

‘দ্য ইয়ার্স’–এ যে ছয় দশকের বর্ণনা আপনি করেছেন, তার মধ্যে কোন সময়টা আপনার কাছে সবচেয়ে মনোগ্রাহী, সৃষ্টিশীল ও সুখী বলে মনে হয়?

সামগ্রিক অভিজ্ঞতার কথা বললে, ১৯৬৮ সালের ঠিক আগের সময়টা, যখন বিটলসের উদ্ভব। আশির দশকের আগে ওটাই সম্ভবত সবচেয়ে মজার সময় ছিল। আর ব্যক্তিগত দিক থেকে বললে, আমার জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল সময় ছিল আমার ৪৫ থেকে ৬০ বছর বয়সের মধ্যকার সময়টা। তখন আমার মধ্যে সত্যিই একজন স্বাধীন নারী বাস করত—নিজের ইচ্ছামতো যা খুশি করে, তা–ই করে বেড়াতাম। সেই সময়টা আমার জন্য ছিল মুক্তির। তখন জীবনকে সুন্দর মনে হতো।

প্রশ্ন :

আর এখন?

এখন তো আমার বয়স হয়ে যাচ্ছে। এ বছর আমার বয়স হবে ৭৯। সব সময়ই কোনো না কোনো স্বাস্থ্যগত সমস্যা লেগেই আছে। তা ছাড়া ক্লান্তি তো আছেই। সিমোন দ্য ব্যুভোয়ারের শেষ দিকের এক বইতে এক নারী বলেন, পেছনে একটা দীর্ঘ অতীত ফেলে আসার মধ্যে কেমন একটা মিষ্টি ব্যাপার রয়েছে। এই বয়সে এসে একমাত্র এই রকম একটা ইতিবাচক ধারণাই রাখা সম্ভব আমার পক্ষে। ‘দ্য ইয়ার্স’–এর শেষ যে ছবিটা—এক নারী তার নাতনির সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে—সেই ছবিতেও এই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া মিষ্টতার ব্যাপারটা আছে।

প্রশ্ন :

বইটাতে আপনি আপনার ভেতর বাড়তে থাকা নারীবাদের কথা বলেছেন। এ ছাড়া বিয়েশাদি ও পরিবার নিয়ে আপনার যুগের অন্য নারীদের বিভ্রান্তির কথাও উল্লেখ করেছেন। আজকের দিনে নারীবাদ নিয়ে আপনার মতামত কী? বিশেষত হ্যাশট্যাগ মিটু আন্দোলন নিয়ে, যা কিনা ফ্রান্সে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া কুড়িয়েছে। যেমন ক্যাথেরিন দেনেভ্যু বলেছেন ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে...

সত্যি বলতে, আমার কাছে তাঁর বক্তব্যটা...জঘন্য লেগেছিল। আমি হ্যাশট্যাগ মিটু আন্দোলনের সঙ্গে পুরোপুরি সহাবস্থান করি। কিছু বাড়াবাড়ি হয়তো হয়েছে, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নারীরা এখন আর এমন আচরণ চুপচাপ মেনে নিতে রাজি নন। ফ্রান্সে আমাদের প্রলুব্ধতার ঐতিহ্যের কথা অনেক শোনা যায়, কিন্তু আদতে তা প্রলুব্ধতা নয়, বরং পুরুষের আধিপত্য। এই দমন কেবল যৌন পর্যায়ে হয় তা নয়, এটা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে, এমনকি সাহিত্যেও। নারী লেখকদের আপনি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে অত দেখতে পাবেন না, প্রতি তিনটি পুরুষের জন্য একজন নারীকে জায়গা দেওয়া হয়। এমন এক ধারণা প্রচলিত আছে যে নারীরা হলো ঔপন্যাসিক আর পুরুষেরা লেখক...

প্রশ্ন :

আপনি বলেছেন, সব সময়ই সর্বগ্রাসী পাঠক ছিলেন আপনি। কোন বইগুলো আপনার ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে?

বাছাই করা বেশ কঠিন হবে। জার্মেইন গ্রিয়ারের ‘দ্য ফিমেল ইউনুখ’ আমি এমন একসময়ে পড়েছিলাম যখন আমার পঠিত সবকিছু আমার লেখাকেই প্রভাবিত করছিল। জ্যঁ পল সার্ত্রের ‘নজিয়া’, সিমোন দ্য ব্যুভোয়ার ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’। এখানে একটু বলি, ভার্জিনিয়া উলফ এক অসাধারণ লেখক, যাঁকে আমি বিশ বছরে পা দেওয়ার পর আবিষ্কার করি, এ ছাড়া আছেন জর্জেস পেরেক। এমন অনেক বই ছিল, যা পড়ার পর আমার ও রকম করে লিখতে মন চাইত। আমার জন্য গল্প ও বিষয়বস্তুর চেয়েও ফর্ম বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন :

এখন কোন বই পড়ছেন?

এ মুহূর্তে আমি পড়ছি লরেন এলকিনের ‘ফ্লানিউস: উইমেন ওয়াক দ্য সিটি ইন প্যারিস, নিউইয়র্ক, টোকিও, ভেনিস অ্যান্ড লন্ডন’। ফ্ল্যানিউরের ধারণাটা ফ্রান্সের পৌরুষের সঙ্গে খুবই সম্পৃক্ত। এই বইয়ে তিনি সেই ব্যাপারটাকে নারীদের সঙ্গে খুব সুন্দরভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন।