জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় থেকে আপনার পোস্টারগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত হতে শুরু করে। নতুন শিল্পিত ভাষার সঙ্গে মানুষের সংযোগ তৈরি হয় দ্রুতই। কবে থেকে পোস্টারগুলো আঁকতে শুরু করেছিলেন? তখন কী বোধ কাজ করছিল আপনার মধ্যে?
দেবাশিস চক্রবর্তী: পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সঙ্গে সম্পৃক্ত একটা ফর্ম তৈরির চেষ্টা করছি আমি। মাধ্যমটা ভিজ্যুয়াল আর্টের। আমার জন্য দরকার ছিল এমন একটা ফর্ম, যেখানে যত দূর সম্ভব বাস্তবতার সব তল এবং জনগোষ্ঠীর বহুস্বর হাজির করা সম্ভব হবে। প্রচণ্ড ভয়, অনিশ্চয়তা, সংকট ও দৈনন্দিন পরাজয়ের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে নিমজ্জিত যে জনগণ, তাদের অভিজ্ঞতা, আকাঙ্ক্ষা আর দিশাকে নিজের কারিগরি ও শৈল্পিক দক্ষতা কাজে লাগিয়ে ক্রমেই মূর্ত করতে চেয়েছি। আর সব আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে রাষ্ট্র ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাব্যস্ত করেছি। এই অর্থে আমি রাষ্ট্রবাদী মানুষ। কারণ, রাষ্ট্রই সেই প্রতিষ্ঠান, যাকে ব্যবহার করে মানুষের জীবনমান বদলানো সম্ভব। এভাবে প্রতিদিনের লিপ্ততা-এক্সপেরিমেন্ট ও প্রত্যক্ষ বাস্তবতার সঙ্গে মোলাকাত-মোকাবিলার মধ্য দিয়েই প্রজেক্টটা তৈরি হয়েছে।
২০১৮ সালে যখন ‘রাষ্ট্র যন্ত্রণা’ নামে ড্রয়িং সিরিজটা শুরু করেছিলাম, তখন দেশের প্রাতিষ্ঠানিক পরিসরে, চিরাচরিত সেটআপে প্রদর্শনী করার উপায় ছিল না। তাই প্রতিদিন বিভিন্ন ব্যক্তিগত প্রচারযন্ত্র ব্যবহার করতে হয়েছে। কারণ, সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তখন প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত। এই বাস্তবতায় নিজের জনগোষ্ঠীকে সম্বোধন করা ছাড়া আর উপায় কী! তাই হাল জমানার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করতে হয়েছে। এটা এই প্রজেক্টের একটা প্রাথমিক চরিত্রগত চিহ্নায়ন। আর নন্দনতত্ত্বের বিষয়–আশয় ফয়সালা করতে গিয়ে জনপরিসর থেকে উপাদান-অনুপ্রেরণা সংগ্রহ করেছি। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রচলিত-পরিচিত বিভিন্ন ফর্ম, সিনেমার পোস্টার, রাজনৈতিক ব্যানার, বিজ্ঞাপন, বিভিন্ন পণ্যের প্যাকেজিং, এমনকি হাল আমলের মিম–সংস্কৃতি থেকেও উপাদান সংগ্রহ করে নন্দনতত্ত্বের বিষয়টির সমাধান করেছি। বিভিন্ন ফর্মকে ক্রিয়েটিভিটির তাঁবে গলিয়ে আরেকটা গ্রহিষ্ণু ফর্ম তৈরি করতে হয়েছে। মানুষের মুখের ভাষাকে শুধু যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে নয়; বরং রং ও রেখার মতোই শিল্পের উপাদান বা কাঁচামাল হিসেবে বিচার করেছি।
আপনি তো আলোকচিত্রশিল্পী। বাংলাদেশ থেকে বছর কয়েক আগে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন। ওখানে গিয়ে এই কাজে লিপ্ত হলেন কেন?
দেবাশিস: হ্যাঁ, আমার প্রাইমারি ট্রেনিং ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফির। তবে ছাত্রাবস্থায় বা ছাত্রত্ব ঘুচে যাওয়ার পরও আমি ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফির প্রচলিত ফর্মে কাজ করিনি। আমার আগের কাজগুলো ছিল সম্পূর্ণরূপে হাই–আর্ট ঘরানার। কারিগরি দিক থেকে নিত্যনতুন কৌশল রপ্ত করার ঝোঁক ছিল। কাজের বিষয় ছিল মহাবিশ্বে অস্তিত্বশীল ধীমান সত্তার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জগৎকে মূর্ত করে তোলা। বিষয়টি মানুষের অস্তিত্ব এবং অস্তিত্বের গভীর-গোপন ভাঁজ উন্মোচন–সম্পর্কিত। এগুলোই দেশে-বিদেশের আর্ট এস্টাবলিশমেন্টে দ্রুত পরিচিতি এনে দেয় আমাকে। ছাত্র থাকাকালে আমার কয়েকটি প্রদর্শনী হয়। কিন্তু আমার কাজের ধরন এবং বিষয়বস্তু যখন ক্রমেই ক্ষমতা সম্পর্কের অসম অবস্থাকে উন্মোচন করতে শুরু করল, তখনই আমার প্রদর্শনীর সংখ্যা কমতে থাকে। আমার জন্য সময়টা খুব কঠিন ছিল। কেননা সেটা ছিল পেশাজীবী ও শিল্পী হিসেবে সমাজে আমার জেঁকে বসার সময়। নিজের ক্রাফট এবং কাজের পরিসর নির্দিষ্ট করার কাল। ওই সময় নিজের পেশাগত সফলতার অনিশ্চয়তাকে সঙ্গী করে দিনের পর দিন কাজ করেছি। এ নিয়ে বিশেষ কিছু বলতে চাই না। শুধু বলি, ড্রয়িংটা আমাকে শিখতে হয়েছে; যা বলতে চাই, করতে চাই এবং সেসব করার জন্য যতটুকু দক্ষতা অর্জন দরকার, ততটুকুতেই আমি সীমাবদ্ধ থাকার চেষ্টা করেছি।
আমি একজন ফুলটাইম আর্টিস্ট। আমার প্রজেক্টের ধরন হলো, প্রতিদিনই আমি কাজ করি, লিপ্ত হই। তাই এমন একটা নান্দনিক ফর্ম আমার দরকার ছিল, যা দ্রুত শেষ করে ফেলা যায়। মনে হয়, গত ছয়–সাত বছরে এ রকম একটা কাজের প্রক্রিয়া আমি তৈরি করতে পেরেছি। এমনিতেই আমি দৈনিক ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করার একটা ‘অসুস্থ’ প্রক্রিয়ায় ঢুকে পড়েছি। অভ্যাসটা বাংলাদেশে থাকতেই হয়েছে। এর মানে এই না যে আমি ১২ ঘণ্টা টানা টেবিলে ঝুঁকে আঁকি। আঁকার কাজটা চার আনার। বাকি ১২ আনা সময় দিতে হয় বহু শ্রেণি–পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলতে, খবর-বইপত্রসহ বিভিন্ন টেক্সট পড়তে, পর্যবেক্ষণ করতে এবং নতুন উপলব্ধির জন্য স্থির অপেক্ষায়। শেষের কথাটা নিয়ে ভুল–বোঝাবুঝি তৈরি হতে পারে। তবু বলব, নিজেকে আমি এভাবেই কনটেম্পোরারি রাখার চেষ্টা করি।
আর যুক্তরাষ্ট্রে থাকা নিয়ে কী বলব, যুক্তরাষ্ট্রে আমি থাকি বটে, কিন্তু বাস্তবতা সম্পর্কে আমার প্রাথমিক অভিজ্ঞতা ও চিহ্নায়ন তো বাংলাদেশের। একজন আর্টিস্টের পক্ষে, এমনকি একজন মানুষের পক্ষে, তার জীবন–সম্পর্কিত প্রাথমিক চিহ্নায়নের বাইরে গিয়ে কাজ করা সম্ভব না। আমিও তাই নিজের আওতার মধ্যেই কাজ করি।
যুক্তরাষ্ট্রের যে অঞ্চলে থাকি, সেখানকার ভূপ্রকৃতি, মানুষ, সমাজ-রাজনীতিসহ বহু কিছুই আমার অভিজ্ঞতায় সঞ্চিত হচ্ছে। সেগুলোও হয়তো পরে কাজের বিষয়বস্তু হবে। এ নিয়ে আমার বিশেষ তাড়া নেই। আমি মিশিগানে বাস করা এক বাংলাদেশি মাত্র।
১৬ তারিখের পর আরও অনেকের মতো আমিও প্রায় যুদ্ধাবস্থায় দিন গুজরান করেছি। ১৮ জুলাই ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট শুরু হলো। ১৮ কোটি মানুষ তখন জিম্মি অবস্থায়। এ সময় আমি ‘রক্তাক্ত জুলাই’ ছবিটা আঁকি। ঢাকার রাস্তায় তো ছিলাম না, তবু ওই ছবিটাই আমার মধ্যে জমা হয়েছিল। এমনও হয়েছে যে টানা তিন দিন ঘুমাইনি। ঘুমালেও ৩-৪ ঘণ্টা। কী এক শক্তি তখন শরীরে সঞ্চিত হয়েছিল, ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন।
বাংলাদেশে আপনার বেড়ে ওঠা সম্পর্কে বলুন। যুক্তরাষ্ট্রে গেলেন কেন?
দেবাশিস: বাংলাদেশে আমার বেড়ে ওঠার মধ্যে কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য নেই। আমার আর্টিস্ট হওয়ার কথা ছিল না। ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার কথা ছিল। সেটা হয়নি। তবে আমার ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফির তালিম কাজে লেগেছে নিশ্চয়ই। আমার কম্পোজিশন আর ফ্রেমিংয়ের মধ্যে ফটোগ্রাফিক আসর আছে। সিরিজ করার ঝোঁকটা হয়তো ফটোগ্রাফি থেকে এসেছে।
আমার যুক্তরাষ্ট্রে হিজরতের কারণ কিছুটা ব্যক্তিগত এবং অনেকটাই সামস্টিক। আমার স্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক, উচ্চতর পড়ালেখায় নিয়োজিত। তাকে সহায়তা করাও তো আমার কাজ। তা ছাড়া বাংলাদেশে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকার চেষ্টা আমি করেছি। এখনো কাগজপত্রে আমি বাংলাদেশি। কিন্তু দেশে একজন মানুষ হিসেবে আমার বিকশিত হওয়ার—শুধু বৈষয়িক অর্থে বলছি না—সব পথ সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে মানুষ হিসেবে স্বাধীনভাবে চিন্তা-কল্পনা করার স্বাধীনতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষাও জ্ঞানে-অজ্ঞানে কাজ করে থাকতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্দোলন–সংগ্রামে শিল্পীরা রংতুলি নিয়ে সক্রিয় হয়েছেন, কার্টুন ও পোস্টার এঁকেছেন। তখন তাঁরা কাজ করতেন মূলত পুরোনো পদ্ধতিতে। তবে আঁকার ক্ষেত্রে এবার আপনি ডিজিটাল পদ্ধতির শরণ নিয়েছেন। শুধু তা–ই নয়, পোস্টার ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করেছেন। অভিজ্ঞতা কেমন?
দেবাশিস: যেকোনো আন্দোলন-সংগ্রামের চূড়ান্ত সফলতা নির্ভর করে আর্টিস্টদের তৎপরতার ওপর। একমাত্র আর্টের আয়নায়ই বিদ্যমান এবং অবিদ্যমানতাকে ধরা সম্ভব।
শুরুর কয়েক বছর আমিও কাগজে কালি ব্যবহার করে এঁকেছি। তবে দ্রুতই ডিজিটাল মাধ্যমে সরে যাই। নিজের সময়ের প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করব না কেন? আপনি মানুষের ইতিহাস ঘেঁটে দেখেন, যুগে যুগে আর্টিস্টরা তাঁদের সময়ের সবচেয়ে অগ্রসর মাধ্যমগুলো ব্যবহার করেছেন। তেলরংও তার সময়ের সবচেয়ে হাইটেক প্রযুক্তি। তা ছাড়া আমার প্রশিক্ষণ যেহেতু মূলধারার ছিল না, তাই খুব বেশি একটা মানসিক বাধাও ছিল না। ডিজিটালে সরে যাওয়ায় কাজের গতি দ্রুততর হয়েছে, যা আমার কাজের জন্যই দরকারি ছিল। কাগজ-কালি-রঙের খরচ কমেছে। আর্কাইভ সামলানোর খরচা কমেছে। ডিজিটাল মাধ্যমে কাজ না করলে এই শত শত ড্রয়িং আর প্রতিদিন কাজ করা আমার পক্ষে কঠিন হতো। আর আগেই বলেছি, কাজের চরিত্র ও বিষয়বস্তুর কারণে দেশে আমার আর্ট দেখানো সম্ভব ছিল না। আমি তো বাংলাদেশেই ছিলাম, সবার মধ্যেই ছিলাম। খুব একটা আগ্রহ কেউ দেখায়নি। এ ক্ষেত্রে শুধু যে ভয়ের রাজত্বই কারণ ছিল, তা নয়, এ ধরনের আর্টকে বাংলাদেশে একটু ছোট নজরে দেখা হয়। কেউ মুখে বলে না, কিন্তু টের পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালায় আপনার যে প্রদর্শনী চলছেন সেখানে আপনি লিখেছেন, আর্টের ম্যাজিক বা পবিত্র ভাব কমিয়ে এমনভাবে কাজ করতে চেয়েছেন, যেন আর্টকে আর্ট না মনে হয়। কিন্তু আপনার কাজগুলো তো জনশিল্প বা পাবলিক আর্টের রূপই নিয়েছে শেষমেশ।
দেবাশিস: সারা দুনিয়াতেই আর্টকে মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আওতার বাইরের কিছু হিসেবে দেগে দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। আর বাংলাদেশে দুর্বোধ্যতা, জনবিচ্ছিন্নতা, সৌন্দর্য উৎপাদন ইত্যাদিকে শুধু আর্টের সঙ্গে পরস্পর বিনিময়যোগ্য ধারণা হিসেবে দেখা হয় না; বরং আর্টের প্রধান ও একমাত্র প্রবণতারূপে ধরে নেওয়া হয়। এর ঐতিহাসিক পটভূমি আছে। সেদিকে যাওয়ার সুযোগ এখানে নেই। তবে আমি ওই প্রবণতাগুলোকে আর্টের একমাত্র প্রবণতা তো মনে করিই না, এমনকি প্রধানও মনে করি না। আমরা বাস করছি এক অনিঃশেষ সংকটের যুগে, যখন একের পর এক সংকট দুনিয়ার মানুষকে নাস্তানাবুদ করে রাখছে। এই বাস্তবতার মধ্যে আরক্তিম অবস্থায় একজন আর্টিস্টের নিজেকে আবিষ্কারের ‘সৃষ্টিশীল’ ঘটনাকেই আমি ‘কনটেম্পোরারি আর্ট’ বলতে পারি।
প্রতিদিন বহু মানুষের হত্যাকাণ্ডের ছবি দেখতাম, অনেকে ছবি-ভিডিও পাঠাতেন। আমি বহু বিপ্লবী-সাহসী মানুষের আত্মত্যাগ আর হত্যাকাণ্ডের ছবি এঁকেছি। এর গভীর প্রভাব আমার জ্ঞান আর অজ্ঞানে জমা হয়ে গেছে। জুলাই-আগস্টে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে থাকত। সময়টা আমার জীবনের সবচেয়ে সংকটময় ও অনিশ্চিত সময়, যেটা এখনো চলমান। আমার তো সরাসরি কোনো রকমের হুমকি ছিল না। তারপরও হাত-পা কেন ঠান্ডা হয়ে থাকত? কেন এখনো ঠান্ডা হয়ে আছে? কেন দুঃস্বপ্ন দেখি? কেন ঘুমাতে পারি না?
গণ–অভ্যুত্থান চলাকালে পোস্টারগুলো আপনি এঁকেছেন পরিস্থিতি অনুযায়ী। নানা সময়ে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে এবং আপনার পোস্টারের ভাষায়ও পরিবর্তন এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সময় আর বাংলাদেশের সময়ের মধ্যে তো ফারাক আছে। কীভাবে কাজ করেছেন?
দেবাশিস: এমনিতেই টাইম জোনের ফারাকের কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা একটা কঠিন কাজ। সময়ের ফারাকটা রাত আর দিনের। খুব সকাল এবং মাঝরাত ছাড়া যোগাযোগের সময় অল্পই। এভাবেই আগে যোগাযোগ করতাম। কিন্তু জুলাই–আগস্টের পরিস্থিতি ভিন্ন। ১৬ জুলাইয়ের পরের ঘটনার বর্ণনা দেওয়া মুশকিল। ১৬ তারিখের পর আরও অনেকের মতো আমিও প্রায় যুদ্ধাবস্থায় দিন গুজরান করেছি। ১৮ জুলাই ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট শুরু হলো। ১৮ কোটি মানুষ তখন জিম্মি অবস্থায়। এ সময় আমি ‘রক্তাক্ত জুলাই’ ছবিটা আঁকি। ঢাকার রাস্তায় তো ছিলাম না, তবু ওই ছবিটাই আমার মধ্যে জমা হয়েছিল। এমনও হয়েছে যে টানা তিন দিন ঘুমাইনি। ঘুমালেও ৩-৪ ঘণ্টা। কী এক শক্তি তখন শরীরে সঞ্চিত হয়েছিল, ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন। রুহানিয়াতের যে সর্বোচ্চ নজির আমরা মিছিলে মিছিলে দেখেছি, তার কিছু কিছু হয়তো আমার মধ্যেও উছলে পড়েছিল। একমুহূর্তের জন্যও হাত কাঁপেনি। এত অল্প সময়ের মধ্যে প্রায় এক শ ছবি এঁকেছি। খুব বেশি ভেরিয়েশন হয়তো ছিল না, আগে আঁকা কিছু স্কেচের ওপরও কাজ করেছি। কিন্তু সময় তো ঠিকই লেগেছিল। কীভাবে এত শারীরিক-মানসিক শ্রম দিতে পারলাম!
প্রতিটি হামলা, প্রতিটি হত্যা, প্রতিটি প্রোপাগান্ডা নতুন নতুন দৃশ্যের জন্ম দিয়েছে। প্রতিরোধের শরীরী আর মুখের ভাষা তৈরি করেছে। যত বেশি নিপীড়ন হয়েছে, নিজের ভেতর তত বেশি শক্তি অনুভব করেছি।
দেশের রাজনীতি এবং মানুষের মুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক পূর্বশর্তগুলোর সঙ্গে পরিচয় তো আমার ছিলই। পাশাপাশি দেশের সাংস্কৃতিক রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা ও নিজস্ব অবস্থান থাকায় আন্দোলন ক্রমে গণ–অভ্যুত্থানে রূপ নেওয়ার পথে শামিল হতে, ছবিগুলো মূর্ত করে তুলতে আমার বেগ পেতে হয়নি। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ভিন্ন পরিসর আর সময় প্রয়োজন।
পোস্টারগুলোতে এক–দুই শব্দে কিছু কথাও লিখতেন আপনি। যেমন ‘তুমি কে আমি কে—বিকল্প বিকল্প’। পোস্টার আঁকা এবং তাতে স্লোগান সংযোজন—সব কি একাই করতেন?
দেবাশিস: যে ফর্মে আমি কাজ করি, সেখানে বেশি কথা আঁটানোর সুযোগ নেই। বিশেষ সময়গুলোতে অল্প কথায়ই অনেক নাগপাশের বিনাশ করা সম্ভব। তবে কথার অর্থ, সুর-স্বর, পারিপার্শিক বাস্তবতা—এসব মাথায় রাখতে হয়। এখানেও আর্ট কাজ করে। আসলে এসবের ব্যাখ্যা দেওয়া মুশকিল। তবে অতিরিক্ত জাতীয়তাবাদী জোশের ব্যাপারে সজাগ ছিলাম। আমার কথা বা স্বৈরাচার প্রতিরোধের ভাষা যেন আবার ভিন্ন পরিসরে নিপীড়ন উসকে না দেয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হয়েছে। আবার যেহেতু চোখ-কান খোলা রাখি, তাই কোনো মোক্ষম কথা চোখে পড়লেই তা চুরি করে ফেলি এবং প্রয়োজনমাফিক বদলে নিই। এভাবে মূলত কয়েকটা স্তরে কাজগুলো করেছি। একটা টিম থাকলে ভালোই হতো, অনেক শারীরিক-মানসিক জটিলতা থেকে বাঁচা যেত। অনেক সক্ষম আর্টিস্ট বড় দল নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু আমি তো গরিব আর্টিস্ট। আবার অন্যদিক থেকে দেখলে, আমার স্বাধীনতা অনেক। তবে জুলাই-আগস্টে কিছু বন্ধুর সঙ্গে প্রায় ২৪ ঘণ্টা যোগাযোগ রেখেছিলাম। তাঁরা নানাভাবে উজ্জীবিত করেছেন।
গণ-অভ্যুত্থানের সময় যাঁরাই সক্রিয় ছিলেন, নানাভাবে তাঁদের বাধা দেওয়া হয়েছে, এসেছে হুমকিও। বিদেশে থাকার কারণে আপনি বোধ হয় এর বাইরে ছিলেন, তাই না?
দেবাশিস: জুলাই-আগস্টে আমি সরাসরি এবং শারীরিক কোনো রকমের হুমকির মধ্যে ছিলাম না। যাঁরা সরাসরি আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন, মিছিলে-পথেঘাটে প্রাণ দিয়েছেন, পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন, তাঁদের সঙ্গে আমার তুলনা চলে না। জীবন দেওয়ার মানসিকতা নিয়েই অনেকে কাজ করেছেন। এ বিবেচনায় জুলাই-আগস্টের আন্দোলন-সংগ্রাম সর্বোচ্চ অর্থেই বৈপ্লবিক তৎপরতা। কেননা মানুষের জীবন আর যা-ই হোক মশকরার বিষয় নয়। জীবনদৃষ্টির দিক থেকে আমি ব্যক্তির প্রতি খুব বেশি আগ্রহী নই, ব্যক্তি ও তার প্রতিভার চেয়ে ব্যক্তি যে ‘সময়ের’ ফলাফল, সেই সময় এবং ওই বৈষয়িক-ঐতিহাসিক পূর্বশর্তগুলো আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
তারপরও কিছু কথা থেকেই যায়। কারণ, ক্ষমতা, ক্ষমতা-সম্পর্ক আর যা–ই হোক ছেলেখেলা নয়। ২০২২ সালের প্রায় নভেম্বর অব্দি অমি বাংলাদেশে ছিলাম। প্রতিমুহূর্তেই মানুষ হিসেবে কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। একদম প্রাথমিক অর্থে আরও অনেকের মতোই আমার মানসিক বিকাশের পথ যে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তা টের পাচ্ছিলাম। তখনো আমি প্রতিদিন কাজ করছি। একটু আড়াল তৈরি করে কথা বলছি, ছবির ভাষা তৈরি করছি।
আমার মা আমার প্রতিদিনের কাজের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। প্রতিনিয়ত বলতেন, তোমাকে তো তুলে নিয়ে যাবে। বিদেশে আসার পর বলতেন, এফবিআই দিয়ে তুলে নিয়ে যাবে। এসব হয়তো মায়ের মনের কথা। তবে ভীষণ মানসিক আর অস্তিত্বের সংকট সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। আমার জন্য পরিস্থিতি ছিল আরও খানিকটা সংকটময়। কারণ, আমার আর্ট কোনো রকমের বৈষয়িক আয়-উন্নতির জন্য সহায়ক নয়। অথচ আমি একটা বৈষয়িক জগতে বিদ্যমান। বিদেশে থাকলেও আমি তো কাঁটায় কাঁটায় জানতাম না যে গণ-অভ্যুত্থান হবে এবং স্বৈরচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটবে। বাংলাদেশে ফেরার সব সম্ভাবনা বাতিল করে, নিজের পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তার ঝুঁকি স্বীকার করেই জুলাই-আগস্টে আমাকে কাজ করতে হয়েছে, নিজের প্রজেক্টে চলমান আন্দোলন-সংগ্রামকে একীভূত করে নিতে হয়েছে।
প্রতিদিন বহু মানুষের হত্যাকাণ্ডের ছবি দেখতাম, অনেকে ছবি-ভিডিও পাঠাতেন। আমি বহু বিপ্লবী-সাহসী মানুষের আত্মত্যাগ আর হত্যাকাণ্ডের ছবি এঁকেছি। এর গভীর প্রভাব আমার জ্ঞান আর অজ্ঞানে জমা হয়ে গেছে। জুলাই-আগস্টে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে থাকত। সময়টা আমার জীবনের সবচেয়ে সংকটময় ও অনিশ্চিত সময়, যেটা এখনো চলমান। আমার তো সরাসরি কোনো রকমের হুমকি ছিল না। তারপরও হাত-পা কেন ঠান্ডা হয়ে থাকত? কেন এখনো ঠান্ডা হয়ে আছে? কেন দুঃস্বপ্ন দেখি? কেন ঘুমাতে পারি না? আমার শারীরিক-মানসিক এই দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ও ক্ষতের দায় কার? আমাকে বরং নতুন করে নিজের শুশ্রূষা করতে হচ্ছে। কিন্তু খুব একটা সফল হতে পারছি না।
গণ–অভ্যুত্থানের পর এখনো পোস্টার আঁকছেন। সম্প্রতি ভ্যাট নিয়ে একটি পোস্টার এঁকেছেন। আপনার লড়াই কি শেষ হয়নি?
দেবাশিস: এ লড়াই শেষ হওয়ার নয়। যে অনিঃশেষ সংকটের যুগে আমরা বাস করছি, প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন সংকট হাজির হতেই থাকবে। এর যেমন স্থানিক চরিত্র আছে, বৈশ্বিক চরিত্রও আছে। আমি আপাতত স্থানিক পরিসরেই থাকতে চাই। আর বহু ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া সম্ভাবনাটাকে সর্বোচ্চ সফলতার মোকামে পৌঁছে দিতে কাজ করে যেতে চাই।