সাক্ষাৎকারে অরুন্ধতী রায়

‘কিছু মানুষ খ্যাতির জন্য মাথা নত করেন না’

অরুন্ধতী রায়ের নতুন বই ‘মাদার মেরি কামস টু মি’ প্রকাশিত হলো ২ সেপ্টেম্বর। বইটি স্মৃতিকথামূলক, ২০২২ সালে মারা যাওয়া তাঁর মা মেরি রায়কে নিয়ে। সাক্ষাৎকারটি বেরিয়েছে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’–এ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন পত্রিকাটির অপিনিয়ন অডিও বিভাগের পডকাস্ট হোস্ট লুলু গার্সিয়া-নাভারো। অনুবাদ করেছেন সারফুদ্দিন আহমেদ

আমরা যখন বড় হই, তখন পরিণত বয়সে এসে আমরা অনেক সময় বুঝতে পারি না, আমাদের মা–বাবা আমাদের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলেন। অরুন্ধতী রায়ের ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটাই হয়েছে। ২০২২ সালে তাঁর মা মেরি রায়ের মৃত্যু তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। সেই শোক থেকেই তিনি লিখেছেন নিজের নতুন আত্মজীবনীমূলক বই ‘মাদার মেরি কামস টু মি’। বইটি সম্পর্কে অরুন্ধতী বলেন, ‘আমি এটা না লিখে অন্য কিছু লিখতে পারছিলাম না। আমার শোকের গভীরতা আমাকে অবাক করেছিল।’ এই বইয়ে অরুন্ধতী তাঁর মায়ের সঙ্গে নিজের জটিল সম্পর্কের গল্প বলেছেন। অরুন্ধতীর ভাষায়—তাঁর মায়ের ‘নখদন্তে খুবলে নেওয়ার মতো রাগ’ অরুন্ধতীকে ও তাঁর ভাইকে মানসিকভাবে আঘাত করেছিল; কিন্তু মায়ের আরেকটি দিকও ছিল—তিনি সারা জীবন লড়াই করেছেন শিক্ষা আর নারীর অধিকারের জন্য। সেই লড়াই অরুন্ধতীকে অনুপ্রাণিত করেছে। সে কারণে তিনি মায়ের সংগ্রামের শক্তিকে গভীরভাবে শ্রদ্ধা করেন। তাই বইটি শুধু মায়ের গল্প নয়, এটি অরুন্ধতীর নিজের লেখক হয়ে ওঠার যাত্রার গল্পও। ১৯৯৭ সালে অরুন্ধতীর প্রথম উপন্যাস ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ প্রকাশিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গেই বুকার পুরস্কার জিতে এই উপন্যাস তাঁকে আন্তর্জাতিক সাহিত্য জগতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে; কিন্তু এই হঠাৎ খ্যাতি তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলেছিল। ২০১৭ সালে তিনি দ্বিতীয় উপন্যাস প্রকাশ করলেও এর মধ্যের দীর্ঘ সময় তিনি মূলত প্রবন্ধ লিখেছেন। লিখেছেন ভারতের জাতপাত ও কাশ্মীরের মুসলিমদের ওপর সামাজিক অবিচার নিয়ে। তাঁর এই লেখা আর রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার তাঁকে বারবার শিকারে পরিণত করেছে। আগস্টের শুরুতে আমি অরুন্ধতীর সঙ্গে দুবার কথা বলেছিলাম। আলাপ শুরু হয়েছিল তাঁর মা আর তাঁর নতুন আত্মজীবনী নিয়ে; কিন্তু শেষমেশ কথাবার্তা চলে গেল অন্যদিকে—সত্য কথা বলার জন্য কী মূল্য দিতে হয়, নরেন্দ্র মোদির ভারত আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকার মধ্যে কী কী মিল আছে, সেসব প্রসঙ্গ এসেছে সে আলাপচারিতায়। — লুলু গার্সিয়া-নাভারো
প্রশ্ন:

আপনি বইতে মাকে খুব জটিল আর কঠিন মানুষ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বইটি পড়তে গিয়ে আমার মনে পড়ল কবি চেশোয়াভ মিউশের একটি কথা, ‘যখন কোনো পরিবারে একজন লেখক জন্মায়, তখন বুঝতে হবে সেই পরিবারের গল্প শেষ।’ মা আর পরিবার নিয়ে এত কিছু লেখার সময় কি দ্বিধায় ছিলেন—কতটা লিখবেন আর কতটা গোপন রাখবেন?

অরুন্ধতী রায়

আপনি যখন এ ধরনের পারিবারিক বিষয় নিয়ে লিখতে বসবেন, তখন কী লেখা উচিত হবে আর কী হবে না, সেই ভাবনা আপনাকে অস্থির করে তুলবে। আপনাকে এ ধরনের লেখায় হাত দিতে গেলে কী লিখবেন আর কী লিখবেন না, তা আগেই ঠিক করে নিতে হবে; কিন্তু আমি ভালো করে জানি, যদি নিজের বা মায়ের ত্রুটি বা সমালোচনা বা খুঁত এড়িয়ে শুধু ভালো ভালো কথা দিয়ে একটি সাজানো ছবি দেখানোর চেষ্টা করি, তাহলে সেটি সাহিত্য হবে না। এ ধরনের লেখা বরং না লেখাই ভালো। তবে এটি আমার জন্য খুব কষ্টকর ছিল না। কারণ, মায়ের একটি দিক আমাকে আঘাত করেছিল, আবার সেই দিকটিই আমাকে গড়েও তুলেছিল। তাঁর একটি অসাধারণ দিকও ছিল, যা আমাকে মুগ্ধ করত। তাই কখনোই বুঝে উঠতে পারিনি, মাকে নিয়ে আমার আসল অনুভূতি কী। এই পুরো বিষয়টিই আমার জন্য লেখক হিসেবে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল—আমি কি এই জটিল ও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা চরিত্রটা ঠিকভাবে লিখে ফেলতে পারব?

প্রশ্ন:

এবার আপনার মায়ের জনপরিসরের জীবনের দিকটা নিয়ে কথা বলি। আপনার জীবনে তিনি যেমন ছিলেন, তার বাইরে তিনি কেমন মানুষ ছিলেন?

মায়ের সঙ্গে অরুন্ধতী রায়
ছবি: সংগৃহীত
অরুন্ধতী রায়

আমার মা কেরালার সিরিয়ান খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মেয়ে ছিলেন। এই গোষ্ঠী ছোট্ট হলেও সচ্ছল ছিল। সুবিধা-সুযোগও ছিল প্রচুর। কড়া নিয়মকানুনও কম ছিল না। সেই সমাজের বাইরে গিয়ে বিয়ে করা, তারপর তালাক নেওয়া—এই দুই কাজই ছিল প্রায় অপরাধের মতো। তবু তিনি তা করেছিলেন।

বাবার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর মা আমাকে আর আমার ভাইকে তামিলনাড়ুর এক পুরোনো কটেজে নিয়ে এলেন। জায়গাটা একসময় ছিল আমার মায়ের বাবার; অর্থাৎ আমার নানার। নানা নিষ্ঠুর ধরনের মানুষ ছিলেন। তবে আমরা যখন কটেজে উঠেছি, তখন তিনি আর বেঁচে নেই। আমরা ভেবেছিলাম, হয়তো এখানে শান্তি পাব; কিন্তু একদিন আচমকা হাজির হলেন আমার নানি আর মামা। তাঁরা মুখের ওপর সোজা বলে দিলেন, ‘এই বাড়ি ছাড়তে হবে।’

তাঁদের দাবি, ত্রিবাঙ্কুর খ্রিষ্টান উত্তরাধিকার আইন অনুযায়ী, বাবার সম্পত্তি থেকে মেয়ে পাবে এক-চতুর্থাংশ। সেই হিসাবে বড়জোর পাঁচ হাজার রুপি। তার মানে, রাতের আঁধারে তাঁরা আমাদের রাস্তায় ফেলে দিতে চাচ্ছিলেন। মায়ের চোখে তখন কোনো ভয়ের ছায়া ছিল না। তিনি আমাদের নিয়ে ছুটলেন এক আইনজীবীর কাছে। আইনজীবী জানান, ওই আইন কেরালায় কার্যকর, তামিলনাড়ুতে নয়। সেদিন আমরা রক্ষা পেলাম, কিন্তু মায়ের ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেল। তিনি সেই অপমান বুকের ভেতর জমিয়ে রাখলেন বছরের পর বছর।

সময় কেটে গেল। মা নিজের পায়ে দাঁড়ালেন। যেদিন তিনি বুঝলেন, আর্থিকভাবে শক্ত হয়েছেন, সেদিনই গেলেন সুপ্রিম কোর্টে। এই অন্যায় আইনকে তিনি অসাংবিধানিক বলে চ্যালেঞ্জ করলেন। লম্বা লড়াইয়ের পর আদালত তাঁর পক্ষেই রায় দিলেন। সুপ্রিম কোর্ট শুধু আইনটি বাতিল করলেন না, তা আগের সময় থেকে কার্যকর করলেন। ফলে সারা দেশের মেয়েরা পেল সমান উত্তরাধিকার অধিকার।

এদিকে মা তখন শুধু আইন নিয়ে লড়ছেন না, নিজের স্বপ্নের স্কুলটিও গড়ে তুলছেন। শুরুটা হয়েছিল খুব ছোট করে—রোটারি ক্লাবের একটি ঘর ভাড়া করে। প্রতিদিন ভোরে আমরা গিয়ে আগের রাতের সিগারেটের ছাই আর কফির কাপ সাফসুতরো করতাম; তারপর ক্লাস হতো। স্কুলটি যেন প্রতিদিন ভাঁজ করে খোলা হতো, আবার গুটিয়ে রাখা হতো; কিন্তু মায়ের জিদ ছিল অন্য রকম। শেষমেশ তিনি বানালেন একটি সুন্দর স্কুল, যা আজও দাঁড়িয়ে আছে। আমি নিজেও সেই স্কুলে পড়েছি।

এই ছিলেন আমার মা—একদিকে কঠোর, অন্য দিকে অসাধারণ সাহসী। তিনি আমাদের ওপর যতটা কঠোর ছিলেন, সমাজের নিয়ম ভাঙার লড়াইয়ে তাঁর সাহস ততটাই অনড় ছিল।

প্রশ্ন:

আপনার মায়ের এক দিকটা আমরা দেখলাম। তাঁর সাহসী আর জনসমক্ষের লড়াইয়ের দিক দেখলাম; কিন্তু বইয়ের শুরুতেই আপনি লিখেছেন, আপনার শৈশবটা কেমন ছিল—দারিদ্র্য, অস্থিরতা আর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের মধ্যে বড় হয়েছেন। আমি জানতে চাই, আপনার মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক বোঝাতে ‘নির্যাতন’ শব্দটি কি ঠিক মনে হয়?

অরুন্ধতী রায়

(একটু থেমে) জানেন, এই শব্দ শুনলেই আমি একটু কেঁপে উঠি। বইয়ে আমি এসব শব্দ ব্যবহার করিনি। কারণ, ব্যাপারটি যদি একটি ব্যাপার হতো—যেমন শুধু নির্যাতন বা সহিংসতা, তাহলে হয়তো একটি শব্দে আটকে দেওয়া যেত; কিন্তু খুব ছোটবেলা থেকেই আমার ভেতরে যেন একটি ভাঙন তৈরি হয়েছিল। আমি বুঝতাম, মা আমার আর আমার ভাইয়ের ওপর যত রাগ ঝাড়ছেন, তার পেছনে তাঁর নিজের জীবনের ব্যথা লুকিয়ে আছে। আমার এক অংশ মার খাচ্ছিল, অন্য অংশটি সব নোট নিচ্ছিল। হয়তো এ কারণেই আমি এত ছোটবেলায় লেখক হয়ে উঠেছিলাম; সব সময় ভাবতাম, ‘মা আমার সঙ্গে এমন করছেন কেন?’

আমার মা—একদিকে কঠোর, অন্য দিকে অসাধারণ সাহসী। তিনি আমাদের ওপর যতটা কঠোর ছিলেন, সমাজের নিয়ম ভাঙার লড়াইয়ে তাঁর সাহস ততটাই অনড় ছিল।
অরুন্ধতী রায়
প্রশ্ন:

বইটিতে যেসব মুহূর্ত পড়তে সবচেয়ে কষ্ট হচ্ছিল, তার মধ্যে একটি ছিল—যখন আপনার মা আপনাকে অপমান করতেন, ছোট করে দেখাতেন। আপনি ছয় বছর বয়সে প্রথমবার প্লেনে চড়ার একটি গল্প বলেছেন। সেটি কি শোনাবেন?

অরুন্ধতী রায়

আমার মায়ের এক বড় বোন ছিলেন। তিনি বাকিদের থেকে আলাদা ছিলেন। তিনি ছিলেন এক পাইলটের স্ত্রী। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসে কাজ করতেন আমার মেসোমশাই। আমার মাসির ছিল একেবারে গোছানো সংসার—একটি সুন্দর বাড়ি, স্বামী, দুটি সন্তান।

আমরা জীবনে প্রথমবার প্লেনে উঠেছিলাম। কারণ, মেসোমশাইয়ের কল্যাণে আমরা ফ্রি টিকিট পেয়েছিলাম। সেদিন আমি মাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘তোমার দিদি এত রোগা কেন?’ মা তখন ভীষণ অ্যাজমায় ভুগছিলেন, স্টেরয়েড খেতে হচ্ছিল বলে তার শরীর খুব মোটা হয়ে গিয়েছিল। আমার প্রশ্ন শুনে মা হঠাৎ প্রচণ্ড রেগে গেলেন। তিনি আমার ছোট্ট বাচ্চা কণ্ঠস্বর নকল করে আমাকে ভ্যাংচাতে লাগলেন। তাঁর সেই ভ্যাংচানি আমাকে ছিন্নভিন্ন করে দিত। তারপর মা বললেন, ‘তুই যখন আমার বয়সে পৌঁছাবি, তখন আমার থেকেও তিন গুণ মোটা হবি।’ কিন্তু আমার মন খারাপ করা দেখে আবার খুব তাড়াতাড়ি বললেন, ‘আমি তোর মা-ও, বাবা-ও। আমি তোকে দ্বিগুণ ভালোবাসি।’

তখন তাঁকে ক্ষমা করতেই হলো; কিন্তু ভেতরটা ততক্ষণে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। মায়ের সঙ্গে এটিই ছিল প্রতিদিনের লড়াই। একমুহূর্তে তিনি যেমন তোমাকে টুকরা টুকরা করে দেন, পরের মুহূর্তেই সেই টুকরাগুলো আবার সেলাই করে দেন। তারপর আবার ছিঁড়বেন, আবার জোড়া লাগাবেন।

প্রশ্ন:

আপনি লিখেছেন, মা যখন আপনাকে বিদ্রূপ করতেন বা ভ্যাঙাতেন, তখন আপনার মনে হতো ‘আমি যেন বেসিনের পানির মতো ঘুরতে ঘুরতে নিচে নেমে গেলাম আর হারিয়ে গেলাম।’ আমি মনে করি, যাঁদের কঠিন স্বভাবের মা–বাবা ছিলেন, তাঁরা এই লাইনটা খুব বুঝতে পারবেন। তখন কি আপনার মনে হতো যে মা রেগে গেলে আপনাকে ‘নেই’ হয়ে যেতে হবে?

শৈশবে মা ও ভাইয়ের সঙ্গে অরুন্ধতী
ছবি: সংগৃহীত
অরুন্ধতী রায়

হ্যাঁ, খুব হতো। কারণ, মা-ই ছিলেন আমার একমাত্র অভিভাবক; আর এই সমাজ আর পরিবার আমাকে স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছিল, আমি যেন কোথাও অন্তর্ভুক্ত নই। তাই মা-ই ছিলেন আমার সবকিছু। বলতে গেলে কোনো আত্মীয় ছিলেন না, কোনো প্রতিবেশী ছিলেন না, কেউ ছিলেন না। ছোটবেলা থেকেই আমি নিজেকে মায়ের সঙ্গে যেন সেঁটে রেখেছিলাম। আর পরে বড় হয়ে আমি বিস্ফোরিত হয়ে আলাদা হয়ে গেলাম।

মায়ের ভীষণ খারাপ অ্যাজমার অ্যাটাক হতো। তিনি বারবার বলতেন, ‘আমি মরে যাচ্ছি, তুই ভালো করে ভেবে দেখ, এরপর তুই কী করবি, কে তোকে দেখবে?’ তাই আমি যেন তাঁর ফুসফুস হয়ে গিয়েছিলাম—তাঁর হয়ে শ্বাস নিতাম। আমার শরীর ছিল যেন তাঁর শরীরেরই একটি অংশ।

তবে যখন আমি ১৬ বছর বয়সে স্থাপত্য নিয়ে পড়তে গেলাম, প্রথম দিন কলেজের লনে দাঁড়িয়ে অন্য ছাত্রছাত্রীদের দেখেই বুঝেছিলাম, আমি ঠিকই বাঁচব। নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারব। যদি মা মারা যান, তাতেও আমি মরব না। আমাকে তাঁর হয়ে শ্বাস নিতে হবে না।

মা সেটি টের পেয়েছিলেন—তাঁর সেই ‘ফুসফুস-সন্তান’ হঠাৎ নিজের শ্বাস নিজে নিতে শুরু করেছে। এটি তাঁর ভেতরে প্রচণ্ড শত্রুতা তৈরি করেছিল; কিন্তু আমি চাই না মা সম্পর্কে শুধু ভয়ংকর গল্পের একটি তালিকা বানানো হোক। কারণ, বইয়েও আমি বারবার বলেছি, আমি তাঁকে ভীষণ শ্রদ্ধাও করতাম।

প্রশ্ন:

আপনি লিখেছেন, স্কুলের ভেতরেও তিনি কীভাবে লড়াই করতেন—ছেলেমেয়েদের লিঙ্গসমতা নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছিলেন। একটি ঘটনা বলেছেন, ছেলেরা মেয়েদের ব্রা নিয়ে মজা করছিল, তখন আপনার মা নাকি ছেলেদের ব্রা পরিয়ে শাস্তি দিয়েছিলেন?

অরুন্ধতী রায়

না, আসলে পরিয়ে দেননি। হয়েছিল কী—মা জানতে পারলেন মেয়েদের ব্রা পরা নিয়ে কিছু ছেলে হাসাহাসি করছে। তখন মা বললেন, ‘যাও, আমার আলমারি থেকে একটি ব্রা নিয়ে এসো।’ তারপর সবার সামনে সেটি হাতে নিয়ে বললেন, ‘এটি হলো ব্রা। এটি একটি দরকারি জিনিস। যদি এটি তোমাদের এত উত্তেজিত করে, তাহলে এটি তোমাদের কাছেই রাখতে পারো।’

এই একটি কাজেই ক্লাসরুমের পরিবেশ বদলে গিয়েছিল। ছেলেমেয়েদের সম্পর্কের ‘পিএইচ ব্যালান্স’ বদলে গিয়েছিল। মেয়েরা বুঝতে পেরেছিল, তাদের পেছনে কেউ আছেন, যিনি তাদের পাশে দাঁড়াবেন।

মা জানতে পারলেন মেয়েদের ব্রা পরা নিয়ে কিছু ছেলে হাসাহাসি করছে। তখন মা বললেন, ‘যাও, আমার আলমারি থেকে একটি ব্রা নিয়ে এসো।’ তারপর সবার সামনে সেটি হাতে নিয়ে বললেন, ‘এটি হলো ব্রা। এটি একটি দরকারি জিনিস।
অরুন্ধতী রায়
প্রকাশের পর থেকে স্যোশাল মিডিয়ায় অরুন্ধতীর বই নিয়ে চলছে নানা চর্চা
ছবি: স্যোশাল মিডিয়া থেকে সংগৃহীত
প্রশ্ন:

বইটিতে আপনি লিখেছেন, ভারত হলো ‘ছেলেসন্তান পূজা’র দেশ; কিন্তু আপনার মা নাকি আপনার ভাইয়ের সঙ্গেও খুব কঠোর আচরণ করতেন। এমনকি ছোটবেলাতেই তাকে বলতেন, ‘তুই একটি পুরুষতান্ত্রিক শুয়োর।’ কিশোর বয়সে তাকে বলেছিলেন, ‘তুই একটি ফালতু গান্ডু। তোর মরা উচিত।’ আপনি লিখেছেন, তিনি যেন আপনার ভাইয়ের ওপর দিয়ে পুরো পৃথিবীর পুরুষদের অপরাধের শাস্তি দিচ্ছিলেন। এটি নাকি আপনার নিজের নারীবাদ–সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গিকেও জটিল করেছিল। সেটি কীভাবে?

অরুন্ধতী রায়

আমার ভাই আমার পরিচিত সেরা মানুষদের একজন। সেদিন ও-ই আমাকে বলছিল, ‘আমি বুঝি না তুই মায়ের মৃত্যুর জন্য এত কষ্ট পাচ্ছিস কেন, মা তো আমাদের সঙ্গে শত্রুর মতো আচরণ করত।’ আমি জানি, আমার ভাইয়ের জন্য এটি খুব বিভ্রান্তিকর, হয়তো কষ্টদায়কও যে আমি মাকে ঘৃণা করি না।

আমার মনে হয়, মাকে আমার ঘৃণা না করার কারণ হলো, আমি দেখেছিলাম, মা জনপরিসরে যে লড়াইগুলো করছিলেন, সেগুলো নারীদের জন্য অধিকারের জায়গা তৈরি করে দিচ্ছিল। আমার জন্যও তিনি সে পরিসর তৈরি করেছিলেন; কিন্তু একই সঙ্গে এটিও সত্যি, নারীবাদী হওয়া মানেই আপনি অসাধারণ মানুষ হবেন তা নয়। নারীবাদ শুধু নারীর অধিকার নিয়ে সংগ্রাম করা নয়। এটি এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে নারী-পুরুষ সমান আর একে অপরকে সম্মান করে। এর মানে একজন ভালো পুরুষকে অবমাননা করা নয়; কিন্তু আমি দেখেছি, আমার ভাইয়ের ক্ষেত্রে সেটি হচ্ছিল। এটি আমাকে গভীরভাবে পীড়া দিয়েছিল।

প্রশ্ন:

এই বই নিয়ে আলোচনা কেমন হয়েছে? আপনার ভাই কি বইটি পড়েছেন?

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় লেখক অরুন্ধতী রায়
ছবি: সংগৃহীত
অরুন্ধতী রায়

হ্যাঁ, পড়েছে। শুরুতে ওর জন্য পড়া কঠিন ছিল। ও হয়তো ভেবেছিল, এগুলো ওর জীবনের পেছনে ফেলে আসা অধ্যায়; কিন্তু পরে সে আমাকে লিখল, ‘আমি হাসছি, কাঁদছি, শ্বাস নিতে পারছি না। হাসতে হাসতে যদি মারা যাই, তার জন্য তুই দায়ী থাকবি।’ সে এটিও বলল, ‘আমি বুঝি না তুই মাকে এতটা ভালোবাসিস কেন।’ তখন আমি তাকে বলেছিলাম, আমি মাকে ঘৃণা করতে পারি না। কারণ, মায়ের এত কিছু আমার ভেতরে আছে যে তাকে ঘৃণা করতে গেলে আমাকে নিজেকেই ঘৃণা করতে হতো।

প্রশ্ন:

বইটিতে একটি দৃশ্য আছে যা আমাকে খুব নাড়া দিয়েছে। আপনাকে আর আপনার ভাইকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠানো হচ্ছিল। আপনার ভাইয়ের রিপোর্ট কার্ডে লেখা ছিল ‘গড়পড়তা’। এ জন্য মা তাকে রুলার দিয়ে মেরেছিলেন। রুলারটি ভেঙে না যাওয়া পর্যন্ত আপনার মা তাকে মেরেই যাচ্ছিলেন। আর সেই সকালে আপনাকে বুকে টেনে নিয়ে তিনি বলেছিলেন, আপনি দারুণ মেধাবী। কারণ, আপনার ফল ভালো হয়েছিল। তারপর আপনি লিখেছেন, ‘যখনই আমাকে নিয়ে প্রশংসা করা হয় বা করতালি দেওয়া হয়, তখনই মনে হয় অন্য ঘরে কেউ চুপচাপ মার খাচ্ছে।’ এই লাইনটা আমাকে থমকে দিয়েছিল।

অরুন্ধতী রায়

হ্যাঁ, তার পরের লাইনটাই হলো, ‘আপনি যদি থেমে চিন্তা করেন, দেখবেন—এটি সত্যি, কেউ না কেউ মার খাচ্ছে।’ কারণ, যখন আপনি প্রশংসিত হচ্ছেন, পুরস্কার পাচ্ছেন, সবাই আপনার জন্য হাততালি দিচ্ছে; তখন আপনি জানবেন, আপনারই কোনো প্রিয় মানুষ, কোনো নীরব মানুষ হয়তো কোনো না কোনোভাবে পিছিয়ে পড়ার কারণে অন্য ঘরে মার খাচ্ছে। আমার কাছে এই অনুভূতিটা কেবল আমার ভাই আর আমার সম্পর্কের সীমায় আটকে নেই। এই অনুভূতি আমার দেশে, আমার পৃথিবীর ক্ষেত্রেও একই।

আমি হয়তো একজন লেখক, যাকে মানুষ সফল বলে জানেন। কিন্তু যাদের নিয়ে আমি লিখি, যাদের গল্প আমি বলি, তারা আজও মার খাচ্ছে। তারা গাজায় ক্ষুধায় মরছে। তারা ভেঙে পড়ছে। তারা দখল হয়ে যাচ্ছে। তাই যদি আপনার হৃদয় পুরো পৃথিবীর হয়ে যায়, তখন এই করতালি বা প্রশংসার মানেটা আপনার কাছে কী দাঁড়াবে?

প্রশ্ন:

যখন আপনি সেই অংশটা লিখছিলেন এবং সেই ঘটনার কথা ভাবছিলেন যে এটা কীভাবে আপনার জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত, তখন কি এটাকে কোনো নতুন আবিষ্কারের অনুভূতি মনে হচ্ছিল?

অরুন্ধতী রায়

না, আমি মনে করি না লেখার সময় আমার বিষয়গুলো নতুনভাবে বোঝার সুযোগ পেয়েছি। আমি লিখেছি কারণ আমি সব বুঝতাম। নিজের জীবন বোঝার বা টিকে থাকার জন্য আমাকে বারবার এসব জিনিস নিয়ে ভাবতে হয়েছিল। যখন আমি বুকার প্রাইজ জিতলাম, তখন আমার মনে একটি অদ্ভুত দ্বন্দ্ব ছিল। আমি ভাবছিলাম—এই দেশে, যেখানে অনেক মানুষ পড়তে জানে না; আর যেখানে এখন যা ঘটছে, তা হচ্ছে সমাজের আসল ছবি; সেই দেশে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া লেখক হওয়া মানে কী? তাই নিজের ওপর গর্ব করার মুহূর্ত আমার কাছে খুব কমই এসেছিল। আত্মগৌরব উদ্‌যাপনের আগেই তা মিইয়ে গিয়েছিল। আমার সাফল্যের উদ্‌যাপন তখন জাতীয়তাবাদী উন্মাদনার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। আমার বরাবরই মনে হয়েছে, যারা ছোটবেলায় অনেক অনিরাপদ পরিস্থিতির মধ্যে বেড়ে উঠেছে, তারা বড় হয়ে শান্তি, স্থিতিশীলতা বা নিরাপত্তা পেলে সেটিকে পুরোপুরি উপভোগ করতে পারে না। জীবনের কোনো একটি পর্যায়ে এসে যখন তারা নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক সুরক্ষা পায়, তখন তা ভেঙে ফেলার প্রবণতাও তাদের মধ্যে থাকে। মানে, জীবন ঝুঁকি আর অস্থিরতায় ভরা—এই ধারণায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া কারও জীবনে যখন স্থিরতা বা নিরাপত্তা আসে, তখন সম্ভবত সে অবচেতনভাবে তা নষ্ট করে ফেলে।

এই দেশে, যেখানে অনেক মানুষ পড়তে জানে না; সেই দেশে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া লেখক হওয়া মানে কী? তাই নিজের ওপর গর্ব করার মুহূর্ত আমার কাছে খুব কমই এসেছিল। আত্মগৌরব উদ্‌যাপনের আগেই তা মিইয়ে গিয়েছিল।
অরুন্ধতী রায়
প্রশ্ন:

আপনার নিজের নিরাপত্তাকে আপনি বহুবার ঝুঁকিতে ফেলেছেন। ভারতেও আপনার লেখার কারণে এবং যা কিছু বলেছেন, তার জন্য আপনার বিরুদ্ধে আইনি হুমকি এসেছে। যখন সেন্সরশিপ চলছে এবং মানুষ আপনাকে চুপ করাতে চাইছেন, তখন লেখক বা স্রষ্টাদের ভূমিকা কী হতে পারে? আপনি কী মনে করেন?

অরুন্ধতী রায়

যে জায়গায় লেখকেরা কাজ করেন, হোক সেটি সোভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব জার্মানি বা সবচেয়ে অন্ধকার সময়—তাঁরা কোনো না কোনোভাবে টিকে থাকতে পেরেছেন। তাঁদের কাজও বেঁচে আছে। আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আমি বারবার একই কথা লিখতে পারি না। শুধু ‘আমার সঙ্গে এটি ঘটেছে, তাই আমি লিখছি’—এভাবে লেখা চলবে না। লেখার কাজকে নতুনভাবে করতে হবে, ভিন্ন দৃষ্টিকোণ দেখাতে হবে, যাতে লেখা শুধু আমার জীবনের প্রতিক্রিয়া না থেকে নিজের একটি অস্তিত্ব পায়। লেখাই হতে হবে একটি জিনিস, একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, অন্য এক বিশ্বের কল্পনা দেখানোর উপায়। এটি চ্যালেঞ্জিং, কারণ আপনি এভাবে কোনো আদর্শের হাতুড়ি দিয়ে সবার মাথায় আঘাত করতে পারবেন না। আপনাকে এটি সুন্দরভাবে করতে হবে।

সম্প্রতি কেউ একজন আমাকে বলেছিলেন, ‘ওহ, আমি আপনার লেখা পছন্দ করি, কারণ আপনি যেন মরার ভয় ছাড়াই লেখেন, আপনার লেখা পড়ে মনে হয় যেন আপনাকে আগেই মেরে ফেলা হয়েছে। আপনি কোনো কিছু লুকান না।’

২০২০ সালে প্রকাশিত অরুন্ধতী রায়ের ‘আজাদি’ বইটি নিষিদ্ধ করেছে কাশ্মীরের আঞ্চলিক সরকার
ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন:

সম্প্রতি কাশ্মীরের ভারতীয় আঞ্চলিক সরকার আপনার একটি বই নিষিদ্ধ করেছে। ২০২০ সালে প্রকাশিত বইটির নাম ‘আজাদি’। এটি মূলত ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে সংগ্রাম এবং স্বাধীনতা ও স্বৈরশাসনের ধারণা নিয়ে লেখা। সরকারের নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, আপনার বইসহ কিছু বই যুবসমাজের মনোবৃত্তিতে গভীর প্রভাব ফেলবে। কারণ, তা ‘অসন্তোষ, জুলুম ও সন্ত্রাসীর বীরত্বের সংস্কৃতি’ প্রচার করে। আপনার বইটি ওই তালিকায় কেন এসেছে বলে মনে করেন? এ নিয়ে আপনার সাধারণ প্রতিক্রিয়া কী?

অরুন্ধতী রায়

কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া না দেওয়াই হলো আমার প্রতিক্রিয়া। কারণ, কী প্রতিক্রিয়া দেওয়া দরকার তা আমি জানি না। নিষিদ্ধ বইয়ের যে তালিকা, তা দেখে মনে হচ্ছে, এটি এমন কোনো তালিকা, যা হয়তো চ্যাটজিপিটি থেকে নেওয়া হয়েছে। কখন কী হয় তা আপনি ঠিক জানেন না। এখন যখন তারা আমাকে টার্গেট করে, আমি কিছুই বলি না। কারণ, কখনো বোঝা যায় না তারা সত্যিই কী বোঝাতে চাইছে। তারা কি এর মাধ্যমে শুধু অন্য কোনো কিছুর দিকে মনোযোগ ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য বিভ্রান্ত করার খেলা চালিয়ে যাচ্ছে কি না তা-ও বুঝতে পারছি না। আদতে আমি কিছুই জানি না, তাই এ বিষয়ে বেশি কিছু বলব না।

প্রশ্ন:

২০১০ সালে কাশ্মীর সম্পর্কে আপনি যে মন্তব্য করেছিলেন, তার জন্য বর্তমানে ভারতের মোদি সরকারের আইনি হুমকির মুখে আছেন। আপনি কি নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন? আর সেই মামলার বর্তমান অবস্থা কী?

অরুন্ধতী রায়

সত্যি বলতে, আমি এ বিষয়ে কথা বলতে চাই না। কারণ, এতে কোনো বিষয় থেকে বেরিয়ে গিয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ করতে পারে। এখন এটি স্থগিত রয়েছে, তাই আমি এ বিষয়টিকে সরিয়ে রাখছি।

ভারতবর্ষে মূলধারার গণমাধ্যম পুরোপুরি আপস করেছে। তারা শুধু দমেই যায়নি; বরং স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অঙ্গ হয়ে গেছে। তারা মানুষকে গ্রেপ্তারের আহ্বান জানাচ্ছে বা মিথ্যা তৈরি করছে।
অরুন্ধতী রায়
প্রশ্ন:

আপনি আইনি প্রতিক্রিয়ার ভয়ে এ বিষয়ে কিছু বলতে চাচ্ছেন না। এটি কী প্রকাশ করে?

অরুন্ধতী রায়

আমি মনে করি, আমেরিকাও এখন এই দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমাদের দেশ তো অনেক আগেই এই পথে হাঁটতে শুরু করেছে। এ পরিস্থিতি কীভাবে সামলাতে হয়, তা আমাদের শিখতে হয়। আর আমি এ বিষয়ে কথা বলি না, কারণ আমি আমার লেখাটা লিখতে চাই, কোনো উটকো মন্তব্যের কারণে বিতর্কে জড়াতে চাই না। এখানে প্রায়ই মানুষকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়, আপনাকে ঠিকভাবে চিন্তা করতে না দিতে চেষ্টা করা হয়। এই আতঙ্কের সংস্কৃতি সব জায়গায় রয়েছে। ফেসবুক বা টুইটারে মানুষ যা বলছে বা না বলছে, তার জন্য মানুষকে আটক করা হয়। আমেরিকায় এটি নতুন মনে হতে পারে; কিন্তু আমরা বহুদিন ধরে এটি সহ্য করছি। এখন এটি স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। এটি খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতি, বিশেষ করে মুসলমানদের জন্য। কারণ, এটি শুধু আদালত বা জেলে থেমে থাকে না। লাঞ্ছনা, হত্যাকাণ্ড, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ, বাড়ি ধ্বংস—সবই ভারতে চলে। আপনি এমন মানুষ পাবেন, যাঁদের গল্প থেকে আপনি চোখ সরাতে পারবেন না।

প্রশ্ন:

আপনি এ বিষয়ে সামান্যই বলেছেন। তবে আমি জানতে চাই, আপনি ভারতীয় হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং আমেরিকার মাগা আন্দোলনের মধ্যে কী ধরনের সাদৃশ্য দেখেন?

মা মেরি রায়ের সঙ্গে অরুন্ধতী রায়
ছবি: সংগৃহীত
অরুন্ধতী রায়

অনেক সাদৃশ্য। মোদি ক্ষমতায় এসেই যা করেছিলেন, তা হলো নোট বাতিল। ৫০০ রুপির নোট হঠাৎ বাতিল ঘোষণা করা হলো। এরপর নাগরিকত্বের ওপর আক্রমণ এল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর আক্রমণ এল, ছাত্রদের ওপর হামলা হলো, অনিশ্চয়তা চলতে থাকল। এখানে যেকোনো সময় যেকোনো কিছু ঘটতে পারে। আমেরিকাতেও তা–ই হচ্ছে। সবকিছু এতটাই মিলছে যে সবাই ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন, এটি কি কোনো প্লেবুক অনুসরণ, নাকি শুধুই স্বাভাবিকভাবে স্বৈরাচারী আচরণ? ভারতে শাসক দল, সরকার—সবই এক ব্যক্তির সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে। আমেরিকাতেও সবাই একই ব্যাপার দেখতে পাচ্ছে। এটি আমাকে চমকে দিচ্ছে। সবাই ভেবেছিলেন, এখানে কিছু ব্যবস্থাপনা আছে, নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য আছে; কিন্তু বাস্তবতা হলো, একজন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণহীন ব্যক্তিকে সামলানোর কোনো উপায় নেই।

ভারতে তথ্যবিশ্লেষকদের বরখাস্ত করা হচ্ছে। কারণ, স্বৈরশাসক তাঁদের দেওয়া তথ্য পছন্দ করছেন না। এটি এখানেও, অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রেও হচ্ছে। অর্থনীতির সরকারি যেকোনো তথ্য বিশ্বাসযোগ্য নয়, কারণ যা শাসক প্রতিষ্ঠানের পছন্দ নয়, তা বাতিল করা হয়, ফেলে দেওয়া হয় এবং নতুন একটি চিত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়।

ভারতবর্ষে মূলধারার গণমাধ্যম পুরোপুরি আপস করেছে। তারা শুধু দমেই যায়নি; বরং স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অঙ্গ হয়ে গেছে। তারা মানুষকে গ্রেপ্তারের আহ্বান জানাচ্ছে বা মিথ্যা তৈরি করছে।

আর যুক্তরাষ্ট্র পুরো ভেঙে পড়া বিশ্বের ওপর বসে আছে। ট্রাম্প যা করছেন তা পুরো বিশ্বকেই প্রভাবিত করছে। আর মোদি যা করছেন, তা শুধু দেশটাকেই প্রভাবিত করছে। এখানেই আমেরিকা-ভারতের পরিস্থিতির পার্থক্য।

প্রশ্ন:

আপনি কেন মনে করেন স্বৈরশাসক নেতারা আপনার মতো যাঁরা চিন্তাভাবনার সঙ্গে কাজ করেন, তাঁদের টার্গেট করছে? আপনি বলেছিলেন, এটি যেন কোনো প্লেবুক। আমরা দেখেছি, এটি বিশ্বের নানা জায়গায় যুগ যুগ ধরে ঘটে এসেছে।

অরুন্ধতী রায়

সমালোচনার মুখোমুখি হওয়া একজন লেখক হিসেবে আমি বুঝতে পারি, কেন এটি ঘটে। আমি ধারণা করি, শাসকেরা এমন মানুষদের ভয়ে থাকেন, যাঁরা শুধু মেধার দিক থেকে নয়, আবেগের দিক থেকেও সাধারণ মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। যতই ছোট বা অখ্যাত হোন না কেন, যতই মূলধারার মিডিয়া বা টিভিতে জায়গা না থাকুক, তাঁরা বোঝেন, কিছু মানুষ আছেন যাঁদের কথা মানুষ শেষ পর্যন্ত শোনেন। তাঁরা জানেন কার লেখা মানুষ পড়েন, কাকে ভালোবাসেন। তাঁরা এটাও জানেন, কারা টাকা, খ্যাতি বা পুরস্কারের জন্য মাথা নত করেন না। তাঁরা জানেন, কিছু মানুষ আছেন যাঁরা কোনোদিনই মাথা নত করবেন না।