‘আমি লিখেছি আমার দেশের লোকের জন্য’

২৭ ডিসেম্বর সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক এবং ১ জানুয়ারি কবি জসীমউদ্​দীনের জন্মদিন। ১৯৭৩ সালে জসীমউদ্​দীনের এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। বিবিসিতে প্রচারিত সাক্ষাৎকারটি এই প্রথম লিখিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। দুর্লভ এ কথোপকথনে লৌকিক বাংলার শিল্প–সাহিত্যসহ নানা চিত্তাকর্ষক প্রসঙ্গের উন্মোচন করেছেন দুই প্রজন্মের দুই কবি।

সৈয়দ শামসুল হক (২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫—২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬) ছবি: অন্য আলো ও জসীমউদ্‌দীন (১ জানুয়ারি ১৯০৩—১৪ মার্চ ১৯৭৬),ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

ভূমিকা ও সংগ্রহ: জামিল বিন সিদ্দিক

ইউটিউব আশ্চর্য খনি, খোঁজার মতো করে খুঁজলে সেখানে আশ্চর্য সব রত্নও পাওয়া যায়। এমনি এক উদ্দেশ্যহীন অনুসন্ধানে সৈয়দ শামসুল হকের নেওয়া কবি জসীমউদ্​দীনের এই সাক্ষাৎকার পেয়ে যাই। আমাদের জানা ছিল যে একাত্তরে অবরুদ্ধ ঢাকা থেকে গোপনে লন্ডনে পালিয়ে যান সৈয়দ হক, চাকরি নেন বিবিসি রেডিওর বাংলা সার্ভিসে, তারপর প্রায় সাত বছর সেখানেই থেকে যান তিনি। বিবিসিতে তাঁর প্রধান কাজ ছিল সংবাদ অনুবাদ, সম্পাদনা ও পাঠ। এর বাইরে তিনিই প্রথম ধ্রুপদি সাহিত্য থেকে নাটক রচনা করে বিবিসিতে প্রচার করেন। একটি-দুটি নয়, বেশ কয়েকটি নাটক নির্দেশনা দেন সৈয়দ হক, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডন কিহোতি, দ্য পিলগ্রিমস প্রোগ্রেস এবং ক্যান্টারবারি টেলস। এই বিবিসিতে কাজ করার সময়ই ১৯৭৩ সালে কবি জসীমউদ্​দীনের এই সাক্ষাৎকার নেন সৈয়দ শামসুল হক। বিখ্যাত কোনো বাঙালি লন্ডনে গেলেই তখন তাঁর সাক্ষাৎকার নিত বিবিসি। খুব সম্ভবত সেই ধারাবাহিকতায়ই অগ্রজ কবির এই সাক্ষাৎকার নেন অনুজ। শুরু ও শেষ শুনে মনে হয় হয়তো সাক্ষাৎকারটি আরও বড় ছিল, সেই পূর্ণাঙ্গ রূপটি এখনো আছে কি না, জানতে হলে বিবিসির আর্কাইভে ঢুঁ মারতে হবে। এই সাক্ষাৎকার ছিল কথ্যভঙ্গিতে। তাই স্বভাবতই কথোপকথনের একটা ভঙ্গি আছে, কোনো কোনো জায়গায় তাঁরা বাক্য শেষ করেননি, কোনো কোনো স্থানে পুরো বক্তব্য পড়ে এর মধ্যে থাকা ভাবটি বুঝে নিতে হয়। ফলে কোথাও কোথাও সম্পাদককৃত তৃতীয় বন্ধনী যুক্ত হয়েছে। আর এখানে প্রকাশের সময়ে ঈষৎ সম্পাদনা করলেও কথোপকথনের ভঙ্গিটি অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রশ্ন:

সৈয়দ শামসুল হক: আচ্ছা বলেন, এই যে [...] কবিতার কথা মনে পড়ে...গ্রামের সেই রাখাল ছেলেটির কথা মনে পড়ে, যার মাথায় লম্বা চুল, যার পায়ে মটরলতা জড়িয়ে পড়ে, যার দেহটা আপনার কবিতার বিবরণ অনুযায়ী অনেকটা ওই বেতগাছের, মানে ওই যে সবদিকে হেলতে-দুলতে পারে, তেমন একটা বাঁশগাছের কথা মনে করিয়ে দেয়। এগুলো তো আপনার কবিতা পড়ে আমাদের মনে হয়। কিন্তু নিশ্চয়ই আপনি আরও অনেক বেশি দেখেছেন গ্রামের সৌন্দর্য। কী চোখে আপনি গ্রামকে দেখেন, বাংলাদেশের গ্রামকে?

জসীমউদ্​দীন: আমি কী চোখে দেখি, তা হয়তো ব্যাখ্যা করে বলতে পারব না; তবে আমার ভালো লাগে। কেন ভালো লাগে! আমি ছোটকাল থেকেই গ্রামে মানুষ হয়েছি। বিএ পর্যন্ত পড়েছি। আমার সেই বাড়ি গোবিন্দপুর, সেখান থেকে শহরে গিয়ে পড়াশোনা করতাম। অনেক বয়স পর্যন্ত গ্রামেই ছিলাম। তা ছাড়া আরেকটা জিনিস, আমি মনে করতাম যে গ্রাম তো আমার; গ্রামের সব লোকজন, এরা তো আমার। এদের কথাই তো আমি বেশি জানি। তবে এদের কথা আমি কেন লিখব না? সে জন্য আমি একবার একটা প্রবন্ধ পড়লাম, ক্লাস নাইনে বোধ হয় পড়ি তখন, ‘রুরাল লাইফ ইন ইংল্যান্ড’। সেই ইংল্যান্ড এখন আর নেই। সেখানে সেই প্রবন্ধকার লিখেছেন যে আমাদের দেশের কবিরা, তারা প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখার জন্য, তারা যে সাময়িকভাবে কখনো কখনো গ্রামে যায়, তা নয়; তারা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস গ্রামে বসে থাকে।

যাহোক, আমার ভালো লাগে গ্রামে ঘুরতে। এককালে ঘুরেছি, খুব ঘুরেছি, এত ঘুরেছি...সেই বাঁশের পাতা কোন সময় কেমন করে দোলে, সেই বেথুল ফুল-ফল—কোন সময় পাড়া যায়; এসব আমার ভালো লাগে। সেই গাবের পাতা যখন নতুন হয়, তখন সেই ঝালর দেওয়া সেই গাবগাছের কাছে কত দিন দাঁড়িয়ে থেকেছি। সেই শর্ষেফুলে যখন আমার বাড়ির সামনের মাঠ ভরে যেত, নদীর ওপারের সেই চর, সেই শর্ষেফুলে দুলে উঠত, যেন সমস্ত চরখানা, যেন বাতাসে ফুল দুলছে তা না, আমার মনে হতো যে সমস্ত বালুচরই দুলে উঠছে। এ আমার খুব ভালো লাগত। সেই চরের মধ্যে ঘুরে বেড়াতাম। সেই শর্ষেফুলের খেতের ভেতরে মটরশুঁটির গাছ, সেই ছোট লাল টুকটুকে ফুল যেন ছোট্ট ঘোমটা পরা একটা বউয়ের মতন মনে হতো।

খুব ঘুরতাম। একবার ঘুরতে ঘুরতে সেই নমঃশূদ্রপাড়ায় গেলাম। সেখানে দেখি যে খুব সুন্দর একটা বউ, সে শাক তুলছে। সে কী আনন্দে শাক তুলছে! আমি ওখানে বসেই ওই কথাটা মনে রেখে শেষে আমার কবিতা লিখেছিলাম ‘শাকতরুণী’ বলে। বাংলাদেশকে আমি ভালোবেসেছি, আমি দেখেছি সেই গ্রামের মেয়ে, সে তার নকশিকাঁথা মোলেম করে ধরে, সেই কাঁথার ওপরে তার মনের যে আনন্দ...

প্রশ্ন:

সৈয়দ হক: তার যত কবিতা, সব...

জসীম: সেটা সে প্রকাশ করতে চেষ্টা করছে। সে হয়তো—রাফেলের ছবি যারা এখানে সূচিকার্যের ভেতর দিয়ে প্রকাশ করে, তারা হয়তো শিক্ষা পেয়েছে কোনো প্রতিষ্ঠানের—এ মেয়েটি কোনো শিক্ষা পায়নি। কিন্তু তার মনের যে আনন্দ, সে কয়টা—তিনটে-চারটে ফোঁড়—তিনটে-চারটে রকমের ফোঁড়ে তিন-চার রকমের রঙে সেই কাঁথার মধ্য দিয়ে সে প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছে। কাঁথা যখন আমি দেখি, তখন সেই গ্রাম্য মেয়েটির মনের যে আনন্দ, তার মনের যে দুঃখ, এই সমস্তটাকে আমি যেন প্রতীকীভাবে দেখতে পাই। তার ভেতরে হয়তো সে যে ফুলটা সে তৈরি করছে, সেই ফুলটার মতো ফুলটা হয়নি, কিন্তু তার মনের রং সেখানে আমি দেখতে পাই। এত ভালো লাগে আমার!

প্রশ্ন:

সৈয়দ হক: আচ্ছা, সেই যে গ্রামের সেই বালিকাবধূটি, যে কাঁথার ওপর দিয়ে মনের আবেগ ঢেলে দিচ্ছে, এর কথা আরেকটু খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করি আপনাকে। সে কি সজ্ঞানে কাজটা করছে? সে কি তখন কাঁথাটা সেলাই করার সময়, কাঁথার ওপরে নকশা আঁকার সময়, সে কি মনে করে যে সে একটা শিল্প সৃষ্টি করছে? না শুধু তার মনের আবেগে-আনন্দে, মনের অভিব্যক্তির জন্যই, নিজের জন্যই করে যাচ্ছে? আপনার কী মনে হয়?

জসীম: আমার মনে হয় সে মনের আনন্দকে কাঁথার ভেতর দিয়ে প্রকাশ করছে। এই কাঁথাশিল্পটা, মা যে কাঁথা আরম্ভ করেছিল, মরার আগে মেয়ের হাতে সুই-সুতো দিয়ে বলে গেল যে এই কাঁথা আমি শেষ করতে পারলাম না, যেসব ডিজাইন ও নকশা এর ভেতরে আমি করেছি এবং যা করতে চেয়েছি, তুই এগুলো শেষ করিস। তো মেয়ে সারা জীবন ভরে সেই কাঁথার ওপরে মায়ের সেই নকশা, নিজেরও নকশা কিছু জুড়ে দিয়ে সেই কাঁথা তৈরি করল এবং তারও যখন মেয়ে হলো, মেয়ের বিয়ে হলো, বিয়েতে সেই জামাই আর মেয়েকে...

প্রশ্ন:

সৈয়দ হক: সেই কাঁথা...

জসীম: সেই কাঁথা উপহার দিল। এখন এই নক্সী কাঁথার মাঠ আমি যে লিখেছি, তা-ও এই কাঁথা যারা তৈরি করে, সেই শিল্পকে ওপরে তুইলে দেওয়ার জন্য আমি চেষ্টা করেছি কিছু। এত সুন্দর! এত সেই বয়কার সেলাই, বাঁশপাতা সেলাই, তেকাটা সেলাই, অনেক রকমের সেলাই—সব আমার খাতায় লেখা রয়েছে। দেখেছি। তো এটা আমাদের দেশে থেকে উঠে গেল এখন। হয়তো আবার এই নতুন গভমেন্ট যখন হলো, হয়তো ভালো লোক...যখন আমাদের শিল্প, তারপর সংস্কৃতির ভার নেবেন...

প্রশ্ন:

সৈয়দ হক: আচ্ছা, সেই প্রসঙ্গে আমরা একটু পরে আসছি, জসীম ভাই। মাঝখান দিয়ে আপনার নিজের কথায় একটুখানি আসি। বাংলার পল্লির, পল্লি মানুষের ওই বেতলতা, মটরশুঁটিলতা, শর্ষেখেতের সৌন্দর্য আপনার আগে আর কেউ ফুটিয়ে তোলেননি। গ্রামের দরিদ্র, অশিক্ষিত এবং খাটিয়ে মানুষ, অর্ধভুক্ত—এদের জীবনেও যে সৌন্দর্য আছে, এদের জীবনে যে সৌকর্য আছে, এদের জীবনে যে শিল্প আছে; আপনার আগে আর কেউ বাংলা সাহিত্যে সেটা ফুটিয়ে তোলেননি এবং বাংলা সাহিত্যের মাধ্যমে এখন বিশ্বসাহিত্যে যেটা ছড়িয়ে পড়েছে, [তাতে] আপনারও অনেক অবদান। সেটা কি আপনি সজ্ঞানে করেছিলেন? আপনি কি মনে করেছিলেন যে এই প্রয়োজনটা আছে? অথবা আপনি শুধু নিজের আনন্দের জন্য আপনি নিজের মনের কথা ব্যক্ত করার জন্য [এটা] লিখেছেন?

জসীম: আমি তো অন্য কারও মতো লিখতে গিয়ে লিখতে পারিনি। নিজের মতন যখন লিখতে আরম্ভ করলাম, তখনই আমার লেখাটা সহজ হয়ে পড়ল। যা দেখেছি, যা ভালো লাগে, সেগুলো যখন লেখা আরম্ভ করলাম, সেগুলো লিখতে লাগলাম, সহজ হলো আমার পক্ষে। এখন এটা তো ভাবিনি যে এই লেখা দিয়ে দেশ-বিদেশে নাম করবে, কী নানান দেশে নিমন্ত্রণ হবে, দাওয়াত হবে, সেখানে যাব। আমি লিখেছি আমার দেশের লোকের জন্য। আমার দেশের কথা আমার দেশের লোকেরা শুনবে। তাদের পানপাত্র নিঙড়িয়ে টুবুটুবু হয়ে যদি বাইরে যায়, তা যাক। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য হলো, আমার দেশের লোকেরা, তারা পড়ুক এবং সেই জন্য, তাদের অবচেতন মনের ভেতরে যে লোকসংগীত ছিল, যে নকশা ছিল, যে পরনকথা ছিল, যে সুন্দর সুন্দর প্রকাশভঙ্গি ছিল গ্রাম্য মেয়েদের বিয়ের গানে, আরও সব নানান গানে, সেগুলো আমি তুলে এনে আমার গল্পের নায়ক-নায়িকাদের মুখের ভেতরে পুরে দিয়েছি। তাতে হয়তো আমি মনে করি যে আমার বই যাদের ভালো লাগে, তাদের অবচেতন—তারা এমনি তো সাধারণ লোক—যারা গ্রামের ছেলে, তারা লেখাপড়া শিখে গ্রামকে তারা অবহেলা করে, গ্রাম্য সংস্কৃতিকে তারা অবহেলা করে। তারা ওই শহরে এসে শহরের মতো গান, শহরের মতো জীবন যাপন করে। তবু তাদের অবচেতন মনে এই সব সংস্কৃতির প্রতি একটা ভালোবাসা, সে তারা নিজেরাও জানে না। আমি চেষ্টা করি যে আমার লেখার ভেতর দিয়ে তাদের সেই অবচেতন মনের যে ভালোবাসাটা, সেটা জাগুক এবং আমার বইপুস্তক যে কিছু লোকে পছন্দ করে, আমার মনে হয় সেই জন্যই করে হয়তো।

প্রশ্ন:

সৈয়দ হক: বাংলাদেশের গ্রামের জীবন—গ্রামের মানুষ আজকে মহীয়ান, গরীয়ান। সাহিত্যে-সংস্কৃতিতে এদের কথা আজকাল সারা দুনিয়ায়ই গ্রাহ্য। এ ব্যাপারে আপনি শুধু যে পথিকৃৎ, তা-ই নন; আপনার অবদান অনেক বেশি। সক্রিয়ভাবে অনেক কিছু আপনি এ ব্যাপারে দিয়ে গেছেন। বাংলাদেশে—এখন রাজনৈতিক অর্থে বাংলাদেশ বলছি আমি, গ্রামের জীবনে অনেক তোলপাড় এসেছে। এই গ্রামের মানুষগুলো ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে, তাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে এবং মুক্তি আদায়ের মাধ্যমে এখন আরও অনেক বেশি গরীয়ান-মহীয়ান হয়েছে। এ দৃষ্টিতে সোজন বাদিয়ার ঘাট কি নক্সী কাঁথার মাঠ-এর মতো কোনো লেখা—আপনি এই নতুন বাংলাদেশের গ্রাম এবং গ্রামের মানুষ নিয়ে লেখার পরিকল্পনা করেছেন?

জসীম: বয়স ভাটি হয়ে চলেছে। যেভাবে একটা ওয়ার অ্যান্ড পিস—এ রকম একটা বই এই নূতন পরিবেশে রচনা করা যায়, সে শক্তি আমার নেই। আমি মনে করি, আমাদের দেশের যেসব যুবক সাহিত্যিক আছে কিংবা যারা আসবে, তারা এ কাজ করবে। তবে আমি এ যুগেও যখন এসে পৌঁছেছি, কিছু কিছু ছোটখাটোভাবে চেষ্টা করব। বড় রকমের কোনো একটা পরিকল্পনা আমার মনের মধ্যে নেই। যে গ্রাম আমি একবার দেখেছিলাম, যে গ্রামের কথা বলার অভ্যাস আমার হয়েছিল, তাদের ভাষা, তাদের প্রকাশ, তাদের ভঙ্গি—সব আমার অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল; সে জিনিস আমি সহজে লেখতে পারি। কিন্তু এই যে নতুন গ্রাম, এই যে নতুন পরিস্থিতি—সেই সৌন্দর্য ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেছে। সেই যে সুখ, সেই যে আনন্দ, সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। সেই দোতারার তার ছিঁড়ে গেছে, সারিন্দার বাজিয়ে নেই, সারিন্দা পড়ে রয়েছে। এই যে পরিবেশ, এই পরিবেশের মধ্যে কীভাবে আমার সোনার বাংলা যে গড়ে উঠবে, সেই গড়নের সঙ্গে সঙ্গে যারা থাকবে, তারাই লিখবে এ দেশের কথা। আমি এদের থেকে অনেক দূরে রয়েছি। আমার হয়তো ওই আগেকার সেই যে বাংলা, সেই বাংলাকেই আমি স্বপ্ন দেখি; এ বাংলায় আমি একজন অতিথি—এই আমার মনে হয় মাঝে মাঝে। আমি ভয়াবহ সেই দিনগুলোর [১৯৭১-এর কথা মনে করে] একখানা ছোট্ট বই লিখেছিলাম, এই গত ৯ মাস যখন আমাদের বিনিদ্র রজনী কেটে গেছে, তখনকার অভিজ্ঞতা দিয়ে। তবে আমার ইচ্ছা আছে যে কিছু কিছু করব।

সৈয়দ হক: জসীম ভাই, ভবিষ্যতের সাহিত্যিক, ভবিষ্যতের স্রষ্টাদের কাছ থেকে আপনি যে আশাবাদ পোষণ করলেন, আমাদের তো প্রার্থনা যে তাঁরা ঠিক আপনার আশার আলোকে বেঁচে ওঠার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য সচেষ্ট হবেন বা তাঁরা সেদিকে সৃষ্টি করবেন। ইতিমধ্যে আপনার কাছ থেকেও আরও অনেক অনেক কিছু আমরা আশা করব। কারণ, আমাদের গ্রামের সবচেয়ে বড় সম্পদ আপনি।

ভাটির দেশের গান

সৈয়দ শামসুল হক

‘পল্লিকবি’—এই বিশেষণে জসীমউদ্​দীনকে দীর্ঘকাল আমরা দূরে সরিয়ে রেখেছি কবিতার চত্বর থেকে; যেন তিনি কেবল পল্লিরই কবি, পল্লির জন্য এবং পল্লির কারণেই তিনি কবি, অথচ আমরা জানি বাংলাদেশ কেন, বিশ্বও তো মানবের বৃহৎ এক পল্লি ব্যতীত আর কিছুই নয়। আমরা আরও চঞ্চল বোধ করি যখন স্মরণ করি যে স্বয়ং জসীমউদ্​দীন এই বিশেষণ ব্যবহার করেছেন অকুণ্ঠ চিত্তে, ধারণ করেছেন গৌরবের সঙ্গে। সম্ভবত তিনি প্রবল এক অভিমানের বশেই এই বিশেষণের আড়ালে আজীবন নিজেকে লুকিয়ে রাখতেন এবং সে অভিমান এ কারণেই যে ঔপনিবেশিক আমলে পাশ্চাত্য শিল্প-সাহিত্য দৃষ্টি ও ভঙ্গিকে এ দেশের মধ্যবিত্ত আপন ঐতিহ্যের চেয়ে মূল্যবান বলে মনে করেছিল। আজ স্বাধীন বাংলাদেশে শিল্পস্রষ্টারা ঘরে ফিরে এসেছে; বস্তুতপক্ষে এই ঘরে ফেরার কাজ অনেক অগেই শুরু হয়ে যায় এবং তারই পরিণামে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়; আজ জসীমউদ্​দীনের দিকে তাই নতুন করে দৃষ্টিপাত করছি, নতুনভাবে তাঁকে আমরা আবিষ্কার করছি; আমরা অনুভব করতে পারছি তাঁর প্রবর্তক সত্তা। জসীমউদ্​দীন রচিত ও সুরারোপিত গান, যার মাত্র কয়েকটি রেকর্ডে সংকলিত হয়েছে, গানের রেকর্ড আমাদের সাহায্য করবে তাঁকে আবিষ্কার করতে, বাংলা সাহিত্যে তাঁর সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আসনটিকে শনাক্ত করতে এবং শেষ পর্যন্ত প্রতিটি শিল্পকর্মের যা কাজ—এই গানগুলো আমাদের ফিরিয়ে আনবে আমাদেরই ভেতর, আমাদের স্বপ্ন, প্রেম ও হৃদয়-সত্যের ভেতরে।

সূত্র: নাসির আলী মামুন সম্পাদিত মাটি ও মানুষের কবি জসীমউদ্​দীন