‘সমাজতন্ত্রের রুশি মডেল ইউরোপ কখনো গ্রহণ করেনি’

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম
আজ নিসর্গবিদ, লেখক ও অনুবাদক দ্বিজেন শর্মার মৃত্যুদিন। মৃত্যুর মাত্র চার মাস আগে ২০১৭ সালের ৬ মে সিদ্ধেশ্বরীর বাড়িতে কথা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। এই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন রাশিয়ায় বসবাস ও প্রগতি প্রকাশনের দিনগুলো নিয়ে। বলেছেন রমনা পার্কের গোড়ার কথাও। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাদিয়া মাহ্‌জাবীন ইমাম।

সাদিয়া মাহ্‌জাবীন ইমাম: প্রগতি প্রকাশন বন্ধের ঘোষণাটা আকস্মিক ছিল?
দ্বিজেন শর্মা: প্রগতির মতো প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেল আর আমরা তখন সেখানেই কাজ করছি। ভাবো কেমন লাগছিল! তবে বন্ধ হবে তা জানতাম। ওখানে কাজ করার সময় মনে হতো সব সময় দেশের সঙ্গে আছি। বাংলা অনুবাদ করছি, সেই লেখা বাংলা ভাষার মানুষ পড়ছে। মানে সেই কাজের মধ্য দিয়ে অত দূর থেকে তাদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছি—এ রকম একটা অনুভূতি হতো তখন। দেশের জন্য খুব টান অনুভব করতাম। আনন্দের জায়গা ছিল প্রগতি।
বন্ধের সময়টা নিয়ে কী বলব, ফোন বাজলেই ভয় পাই। যেকোনো সময় আসবে সেই হুকুম। তবে বিষয়টা যে আকস্মিক একেবারে তা নয়। পেরেস্ত্রোইকা ঘোষণার পরই কিন্তু বোঝা গিয়েছে, এবার অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটবে। প্রগতি তত দিনে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রকাশনালয়ে পরিণত হয়েছে। ৫০টির বেশি ভাষায় অনুবাদ সাহিত্য হচ্ছে ওখান থেকে। সেসব বইয়ের বিষয়-বৈচিত্র্য, ছাপার ধরন বা ভাষার বিচারে সে  সময় প্রগতির দ্বিতীয় কোনো তুলনা ছিল না। অথচ ওটা ছিল একটা অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। রুশ সাহিত্য সবার কাছে পৌঁছে দেওয়াই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য। রুশ ক্ল্যাসিক, শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা, আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক—সব বিষয়ের বইয়েরই অনুবাদ তখন হচ্ছে প্রগতি থেকে। সেসব কথা পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের কাছে। আমরা সবাই মোটামুটি বেশ দ্রুত অনুবাদের কাজটা শেষ করতে চাইতাম। কাজের আকার অনুযায়ী টাকা দিত। কাজ না করলে পয়সা দিত না।
সাদিয়া: কে কে ছিলেন প্রগতির বাংলা বিভাগে? রাদুগা তো পরে হলো, ভাগ হয়ে যাননি আপনারা?
দ্বিজেন: প্রগতির নাম ছিল ‘বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়’। প্রথমে বাংলা অনুবাদ ওরা শুরু করেনি। পঞ্চাশের দশকে বাংলার কাজ শুরু হলে প্রথম দিকে ভারত থেকে গেলেন ননী ভৌমিক, শুভময় ঘোষ, সমর সেন, নীরেন্দ্রনাথ রায়সহ আরও দু-একজন। এর কিছুদিন পরই যান বিষ্ণু মুখোপাধ্যায়। এই ননীদার সঙ্গে আবার আমাদেরও দেখা হয়েছে। একমাত্র ননী ভৌমিকই পাকাপাকি মস্কোয় থেকে গিয়েছিলেন। ননী ভৌমিক প্রথমে ইংরেজি থেকে অনুবাদ করতেন, পরে রুশ ভাষা শিখে সরাসরি করতেন। আমরা কিন্তু তখনো যাইনি।
এরপর যখন প্রগতির বাংলা বিভাগের গুরুত্ব আরও বেড়ে গেল, তখন বাংলাদেশ থেকে যোগ দিয়েছিল হায়াৎ মামুদ, কলকাতা থেকে কবি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায় আর অরুণ সোম। হায়াৎ, অরুণ সোম সরাসরি রুশ ভাষা থেকে অনুবাদ করতে জানত। হায়াৎ গিয়েই বাংলাদেশ থেকে আরও অনুবাদক আনতে হবে বলে হইচই শুরু করল। সে-ই প্রথম বলেছে, বাংলাদেশ থেকে দ্বিজেনকে নিয়ে আসা হোক। কয়েক দিন পরই আমিও যোগ দিলাম।

সাদিয়া: দীর্ঘ দুই দশক ছিলেন ওখানে। এর মধ্যে পতনও যেমন দেখেছেন আবার সমাজতন্ত্রের সুদিনের অভিজ্ঞতাও তো আছে।
দ্বিজেন: মস্কোতে ছিলাম অনেক দিন। চলে আসার পরও যাতায়াত ছিল। তবে পরে যখন গিয়েছি, দেখি আমার ভালো লাগার শহর বদলে গিয়েছে, আর চিনতে পারি না। নতুন নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি, অসংখ্য প্রাইভেট কার, বিদেশি পণ্যে ঠাসা দোকানপাট, সবখানে মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থা। খুব ব্যস্ত-চঞ্চল মানুষ, বাগানগুলো ঝলমল করছে, বিশ্বের সেরা রাজধানীগুলোর সঙ্গে এর তুলনা করা চলে। এতে আমার মুগ্ধ হওয়ার কথা ছিল হয়তো, কিন্তু এক অদ্ভুত অস্বস্তি আমাকে তাড়া করেছিল। সন্দেহ নেই, যা ঘটেছে তার একটা ইতিহাস আছে। রুশ বিপ্লবের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখবে, বিপ্লবের আগে রাশিয়া ছিল ইউরোপের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশ। বিপ্লবের পরও তার স্থিতিশীল হতে অনেক সময় লেগেছে। ১৯১৭ সালে বিপ্লব হয়েছে, ১৯২৩ সাল পর্যন্ত চলেছে গৃহযুদ্ধ। দেশের ভেতরে পরাজিত জমিদার বা ধনিকশ্রেণি। অন্যদিকে দেশের বাইরে বিভিন্ন পুঁজিপতি শ্রেণির সঙ্গে লড়তে হয়েছে, সাম্রাজ্যবাদী আক্রমণের মুখে পড়েছে রাশিয়া। অথচ বিপ্লবের পর এই রাষ্ট্রই এমন সব অধিকার মানুষকে দেখিয়েছিল যে তখন উন্নত পুঁজিবাদী দেশও তা ভাবতে পারত না। কিন্তু এসবই তো সব নয়। সমাজতন্ত্রের রুশি মডেল ইউরোপ কখনো গ্রহণ করেনি, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা তো নয়ই, কমিউনিস্টরাও না। আমি কিন্তু শুধু সমাজতন্ত্রের কথা বলিনি, খেয়াল করো। এর রুশি মডেলটার কথা বলেছি।

দ্বিজেন শর্মা

সাদিয়া: পতনের আগের সময়টা নিয়ে কিছু বলবেন?
দ্বিজেন: সে এক অন্য রকম সময়। আমার ‘সমাজতন্ত্রে বসবাস’ বইতে পাবে। ওই বইটা লিখেছি বলা যায় কিছুটা প্রাপ্তিস্বীকার করতে। বইটা উৎসর্গ করেছি প্রগতির সব সহকর্মী আর মস্কোবাসী বন্ধুদের। তখন রাশিয়ার সামাজিক পরিবেশে আমাদের চামড়া কালো থাকায় কোনো বৈষম্যের স্বীকারই আমরা হইনি। আমাদের কী বলত, জানো? শেখ সাহেবের দেশের মানুষ। ওই সময় কয়েকবার ইংল্যান্ডে গিয়েছিলাম। আত্মীয়স্বজন অনুরোধ করত, থেকে যাও দ্বিজেন। বারবারই বলেছি, না ভাই, আমি সমাজতান্ত্রিক দেশেই যাব।
তখন রাশিয়ায় এক টাকা পকেটে নিয়ে বের হলে তো সারা দিন খেয়ে দেখে ঘুরে বাড়িতে নির্বিঘ্নে ফিরতে পারবে—এ রকম নিশ্চয়তা ছিল। যেকোনো পেশার মানুষই তাদের পেশার ভেদেই বলো আর উপার্জনে—সমতা ছিল সমাজতন্ত্রে। আবাসনের বরাদ্দ হতো মানুষের উপার্জনের ওপর নির্ভর করে নয়, পরিবারের সদস্যসংখ্যার ওপর ভিত্তি করে। আমি অধ্যাপক কিন্তু আমার পরিবারের সদস্যসংখ্যা তিন, সেই হিসেবে আমার জন্য রুম বরাদ্দ হবে। আবার একজন ক্রেইন মিস্ত্রি তার পরিবারের সদস্য, ধরো পাঁচজন। ওই একই বাড়িতে সে পাবে আরও একটি বেশি ঘর। আমাদের বাড়ির পাশে ছিল মস্কোভা নদী, খুব খোলামেলা জায়গা, বুঝলে? সামনের উঠানেই স্কুল, পেছনে ‘দেৎস্কি সাদ’ শিশুভবন আরকি। মানে স্কুলে যাওয়ার আগপর্যন্ত সকাল থেকে সন্ধ্যা ওইখানে বাচ্চাদের রাখার ব্যবস্থা ছিল। চলাফেরা, বেড়ানো, বাজারের কোনো অসুবিধা নেই। আবাসনের যে প্রকল্প তা কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ ও পূর্বপরিকল্পিত ছিল। আমাদের পাশের ঘরে থাকত ইভান নিকোলাইয়েভিচ কারভ। সে ছিল কারখানার শ্রমিক।
সাদিয়া: প্রগতিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা বলুন। নিজেদের মতামত জানানোর সুযোগ পেতেন?
দ্বিজেন: প্রগতি খুব আনন্দের জায়গাই ছিল, তবে ওই যে দমননীতি ছিল না তা নয়। আমাদের অনুবাদের কাজ যাঁরা দিতেন, তাঁদের কাছে খুব বেশি প্রশ্ন করার সুযোগ পেতাম না। ধরো, কোনো একটা বই দিল, বললাম, এটা কেন করতে হবে? ইশারা করল, ওপর থেকে নির্দেশ। সে বইটা আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, তা নিয়ে আমাদের মতামত খুব বেশি গুরুত্ব পেত না। বাংলা ভাষায় কোন বইটা আমার দেশের মানুষ কতটা গ্রহণ করবে, সেটা নিয়ে আমরা আলোচনা হয়তো করতে পারতাম কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম না।
সের্গেই নামে একজন তখন বাংলাটা দেখছে। খুব বেশি বাংলা সে জানত না। তার ওপর যখন বাংলা লিখত, সেটা দেখাত আরেক ভাষার মতো। একবার মঙ্গলাচরণদা বলেই ফেললেন, আমি উর্দু বিভাগে কাজ করতে আসিনি। সের্গেই এমনভাবে বাংলা লিখে তাঁর হাতে দিয়েছিল, মনে হচ্ছিল উর্দু ভাষা লেখা। সেই সের্গেই ওর জানা গুটিকয় শব্দই খুঁজত অনুবাদের মধ্যে। অথচ ওই শব্দ সেখানে ব্যবহার করলে হয়তো মূল ভাবটার অর্থই বদলে যাবে। একজন রুশ ইংরেজি যেমন করে শেখে বা পড়ে, বাংলা সেভাবে পড়তে পারে না। তবু সের্গেইর সিদ্ধান্তই কিন্তু অনুবাদকদের তখন মেনে নিতে হয়েছে। অন্য ব্যাখ্যাও আছে। ওরাও অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে এসেছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতাটা দিলে সবাই যে সেটা সমান ব্যবহার করবে না, সে ভয়ও ছিল।

সাদিয়া: রমনা পার্কের ইতিহাস শুনতে চাই।
দ্বিজেন: ১৯৫৬ সালে আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র এসেছি। একদিন দেখি রমনার এই জায়গাটায় ট্রাক এসেছে। এটা দেখে এমনি গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। জিজ্ঞেস করলাম, এখানে কী হবে? বলল, একটা পার্ক হবে। তবে বোর্ডে লেখা আছে পরিকল্পনা অনেক আগের। ওখানে একটা বড় পাকুড় আর লটকনগাছ ছিল, টিয়া পাখি বসত। তখন জায়গাটা ছিল ফাঁকা। তখন থেকে আমি এই পার্কটার সঙ্গে। বোটানি পড়াতাম, পার্ক আমাদের কাজেরই জায়গা। একদিন মোজাফফর সাহেব এলেন, অ্যাগ্রিকালচারের লোক তিনি। আমাদের বেশ বন্ধুত্ব হয়েছিল। তিনি আমাকে প্রায়ই গাড়ি করে নিয়ে যেতেন এখানে-সেখানে গাছ লাগাতে। রমনা পার্কের মূল ডিজাইনার ছিলেন ফজলুল করিম।
আমি ১৯৫০ থেকে ’৫২ সাল—কলকাতায় সিটি কলেজে পড়েছি। ইডেন গার্ডেনে গিয়েছি। খুব সুন্দর একটা পার্ক, লেকের পাড়ে। ওখানে জাপানি প্যাগোডা ছিল। ওটা ছিল ইনফরমাল স্ট্রাকচারের। যেটা ধরো অ্যাবস্ট্রাক্ট কিছুটা। আঁকাবাঁকা রাস্তা। তিনি এটা করেছিলেন। দুই পাশে নাগেশ্বর ছিল। এরপর তিনি অবসরে যান। এরপর দৈনিক ‘বাংলা’ না দৈনিক ‘পাকিস্তান’-এ লিখতেন একটু-আধটু। আমার সঙ্গে তখন তাঁর ফোনে আলাপ হয়েছে। দেখা হয়নি কোনো দিন। মোজাফফর সাহেব এলেন। মূলত এখনকার গাছপালাগুলো তাঁর লাগানো। তিনি ছিলেন কৃষি বিভাগের। তিনি তো আর গাছ লাগানোর নকশা জানেন না। তিনি অনেক গাছ লাগিয়েছেন, কিন্তু সেগুলো পরিকল্পিত নয়। যেখানে যা পেয়েছেন, লাগিয়েছেন। আমাদের যখন বৃক্ষ রোপণ করা হয়, তখন সরকারের পক্ষ থেকে পার্কে কতগুলো গাছ দিয়ে আসে। অবশ্যই যেগুলো সহজে পাওয়া যায়, সেগুলোই দেয়। এর মধ্যে মেহগনি বেশি। ৫০০ মেহগনি আছে রমনা পার্কে। ১৯৭৪ সালে আমি রাশিয়ায় চলে গেলাম। ফিরে এসে দেখি গাছ অনেক বড় হয়ে গেছে।
মাঝখানে ওয়াজেদা রব নামের একজন আর্কিটেক্ট এলেন। তিনি ঢাকা শহরের ল্যান্ডস্কেপ নিয়ে কাজ করছিলেন। আমেরিকা থেকে স্কলারশিপ করে এসেছিলেন। তিনি কাজের সময় কোনো তথ্য সেভাবে পাননি। কিন্তু আমার তথ্যগুলো তাঁকে সাহায্য করেছে। ওয়াজেদা অনেকগুলো ড্রয়িং করেছিলেন। ওয়াজেদা রোডস অ্যান্ড প্ল্যান্টেশন নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলেন। আমাকে বলেছিলেন, আপনি আমাকে গাছ চিনিয়ে দেবেন। তবে হঠাৎই তিনি আমেরিকায় চলে গেলেন।
সাদিয়া: আজ আসলে বিশেষ আগ্রহ ছিল আপনার সামনে বসে স্মৃতিকথা শোনার। অনেকটা সময় দিলেন।
দ্বিজেন: তরুণদের সঙ্গে আমারও গল্প করতে খুব ভালো লাগে। কিন্তু তোমরা বই পড়ো না কেন? একদম পড়ালেখা করতে চায় না ছেলেমেয়েরা।
সাদিয়া: আবার আসব।

অন্যআলো ডটকমে লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]