'সাহিত্যের বর্তমান অবস্থা নিয়ে দু-এক বাক্যে বলা সম্ভব নয়'

আনিসুজ্জামান, আলোকচিত্র: বাতিঘর প্রামাণ্যচিত্র চিত্র থেকে নেওয়া
আনিসুজ্জামান, আলোকচিত্র: বাতিঘর প্রামাণ্যচিত্র চিত্র থেকে নেওয়া

প্রশ্ন: আপনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, মুনীর চৌধুরীরর মতো ব্যাক্তিত্বদের, আজকের ড. আনিসুজ্জামান তৈরিতে তাঁদের কোনো অবদান রয়েছে?
আনিসুজ্জামান: আমি যা হয়ে উঠেছি, তার পেছনে আমার শিক্ষকদের অবদান সবচেয়ে ভালো। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র প্রেরণা আছে, ড. মুহম্মদ আব্দুল হাই আমাকে গবেষণাকর্মে প্ররোচিত করেছিলেন, তিনি না থাকলে হয়তো আমি এত অল্প বয়সে পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণা করতে আসতাম না। মুনীর চৌধুরী আমার জীবনদৃষ্টিকে, সাহিত্যদৃষ্টিকে প্রভাবিত করেছেন। সবার কাছে আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। যাঁদের নাম করিনি, আমার সেসব শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে, কলেজ পর্যায়ে, স্কুল পর্যায়ে—তাঁদের কাছেও আমি ঋণী।

প্রশ্ন: ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারা, যার পরিবর্তিত রূপ মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, এ শিরোনামেই আপনার গবেষণা। মুসলমানদের রাজনীতি, সাংস্কৃতিক দিক—এই বিষয় নিয়েই কাজ করার তাড়না কীভাবে এল ?
আনিসুজ্জামান: পিএইচডি পর্যায়ে গবেষণা করেছি, এই কাজের পটভূমি হিসেবে আমি বলতে পারি, মূলত সাম্প্রদায়িকতা ও দেশভাগ সম্পর্কে চিন্তা করতে গিয়েই আমি বাঙালি, হিন্দু বাঙালি, মুসলমানের চিন্তাধারা বিষয়ে ভাবতে শুরু করি এবং এ বিষয়ে আমার প্রথম লেখা আনন্দমঠ ও বঙ্কিম প্রসঙ্গ। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, তার পরপরই সাহিত্য সভায় পাঠ করি। তারপর বাঙালি মুসলমানদের চিন্তাধারা নিয়ে বা বাঙালি মুসলমানের পুনর্জাগরণ নিয়ে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে একটি বড় প্রবন্ধ লিখি। সেটি পড়েই আমার শিক্ষক মুহম্মদ আব্দুল হাই আমাকে এ বিষয়ে গবেষণা করতে বললেন। এটিই পটভূমি হিসেবে।

প্রশ্ন: আপনি ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। লিখেছেন ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আগে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ওপর প্রথম পুস্তিকা। সেই দিনগুলোর কথা কি মনে পড়ে?
আনিসুজ্জামান: ভাষা আন্দোলন-সম্পর্কিত প্রথম যে পুস্তিকাটি লিখি, সেটি ঘটনাক্রমে; তবে পেছনে তাকিয়ে তার জন্য গৌরব বোধ করি। যে সময় লিখেছিলাম, তখন মনে আশঙ্কা কাজ করছিল যে আমি ঠিকমতো সব কথা লিখতে পারলাম তো? যা-ই হোক, সেই পুস্তিকাটি তখন কাজে এসেছিল, এটি আমার সৌভাগ্য।

প্রশ্ন: বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষা করার জন্য যে আন্দোলন হয়েছিল, সেই সময়কার চেতনা কি এখনো আমাদের ভেতর বিরাজমান? দেখতে পান?
আনিসুজ্জামান: বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য যে আন্দোলন হয়েছে, সেই সময়ের চেতনা আমাদের মধ্যে আছে বলে মনে করি না। আমরা একুশে ফেব্রুয়ারিকে স্মরণ করি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায়, তার জন্য আবেগ অনুভব করি, এ কথা সত্য; কিন্তু তখন জীবনের সর্বস্তরে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে আমাদের মধ্যে যে ব্যাকুলতা ছিল, যে দৃঢ় সম্পর্ক ছিল, সেটি এখন নেই বলে আমার মনে হয়। এখন আমাদের মধ্যে নানা দ্বিধা দেখা দিয়েছে, ফলে সেদিনকার যে অনুভূতি, সেদিনকার যে চেতনা আমাদের আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করেছিল, আজকে সেই চেতনা দৃঢ় পর্যায়ে নেই।

প্রশ্ন: দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কি আপনাকে এখনো ব্যথিত করে?
আনিসুজ্জামান: দেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিশ্চয় আমার মনে জাগে, ব্যথিত করে কি না বলা মুশকিল; কেননা, দুটোর মধ্যেই ব্যথিত করার মতো উপাদান আছে, আবার আশাভঙ্গের অনেক উপাদানও আছে। সুতরাং কেবল ব্যথাহত করে বলব না।

প্রশ্ন: বর্তমানে বিরাজমান অস্থির সময় ও সমাজ নিয়ে কিছু প্রশ্ন আছে। আমাদের এ স্বাধীন বাংলাদেশে এখনো সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। আমরা এ থেকে মুক্ত হতে পারলাম না আজও?
আনিসুজ্জামান: স্বাধীন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক কলহ লেগে আছে। বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের সময় আমাদের কল্পনা ছিল না যে এমন হতে পারে। কিন্তু আজকে এটি মর্মান্তিক সত্য যে বাংলাদেশে কদিন পরপরই সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে, এবং আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার যে মূলনীতি, যেটা আমাদের জীবনের অঙ্গীকার করে নিয়েছিলাম, সেই ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে আছে, আমাদের জীবনে নেই। এটি কেন হচ্ছে বলা খুব মুশকিল। কেননা, আমি বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যাগুরু ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুর মধ্যে স্বার্থের সংঘাত দেখতে পাই না। তবে হয়তো একথা বলা যেতে পারে যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বাড়িঘর ত্যাগ করে চলে গেলে কিছু লোক সেটি অধিকার করতে পারে, এ রকম একটি মনোবৃত্তি অনেকের মধ্যেই কাজ করে। তবে আমার মনে হয় ব্যাপারটি পুরোই রাজনৈতিক। বাংলাদেশ যাতে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে পরিচয় না দিতে পারে, সে জন্যই এই সব নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে, এ থেকে উত্তরণের জন্য সরকারকে অনেক বেশি সক্রিয় হতে হবে, জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসতে হবে এবং যেসব জায়গায় গোলযোগ হয়, সেখানে পাড়া-প্রতিবেশীদের সামনে এসে গোলযোগ প্রতিরোধ করতে হবে, এ ছাড়া অন্য কোনো...
আসলে বাংলাদেশে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার বেড়ে গেছে। এখানে সংখ্যাগুরু ধর্মের মানুষ সংখ্যালঘু ধর্মের মানুষের ওপর অত্যাচার করছে। পুরুষ নারীর ওপর অত্যাচার করছে। প্রাপ্তবয়স্করা শিশুর ওপর অত্যাচার করছে। কাজেই অত্যাচারে একটি লক্ষণীয় হচ্ছে সবলের ওপর দুর্বলের অত্যাচার।

প্রশ্ন: প্রতিটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন কিংবা উন্নতির পেছনে শিক্ষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা কি খুব সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে বলে মনে হচ্ছে না?
আনিসুজ্জামান: আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু ত্রুটি আছে বৈকি। এ থেকে উত্তরণের পথও আছে, কিন্তু নানা রাজনৈতিক কারণে আমরা সে পথ অবলম্বন করছি না। খুব কম দেশেই একসঙ্গে এতগুলো শিক্ষাব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে থাকে।

আনিসুজ্জামান
আনিসুজ্জামান

প্রশ্ন: এখন পাসের হার বাড়ছে, এ-প্লাস বাড়ছে, কিন্তু মানের দিক থেকে তা পিছিয়ে; কেন?
আনিসুজ্জামান: শিক্ষা বিষয়ে মানের প্রশ্নটা খুবই আলোচিত। তবে একটি কথা বলি যে ঊনবিংশ শতকের শেষ দিক থেকেই যতগুলো শিক্ষাবিষয়ক কমিশন রয়েছে, তাদের রিপোর্টে দেখা যায়, তারা বলছে যে শিক্ষার মান কমে যাচ্ছে। শিক্ষার মান যে নামছে, এটি নতুন কথা নয়। এটি বহুদিন আগে থেকেই চলছে। এখন যেটা হয়েছে যে স্কুলে ছাত্রসংখ্যা বাড়ছে এবং এই পর্যাপ্তসংখ্যক ছাত্রের উপযুক্ত শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না। কাজেই এই সংখ্যাবৃদ্ধি কিছুটা মানের অবনমনের কারণ। আমাদের এটি এখন মেনে নিতে হবে। সবাই ন্যূনতম শিক্ষাটা লাভ করুক। তারপর মান উন্নয়নের একটি চেষ্টা থাকতে পারে। একই সঙ্গে এই চেষ্টা সফল হবে বলেও আমার মনে হচ্ছে না। এ-প্লাস বাড়ছে, মানের দিকে তারা পিছিয়ে, এই অভিযোগের মধ্যে নিশ্চয় কিছু সত্যতা আছে। কারণ, আমি দেখি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় তারা ভালো করছে না।

প্রশ্ন: স্যার, এবার ভিন্ন আরেকটা প্রসঙ্গে জানতে চাইব। দেশে যে হারে বেকারদের সংখ্যা বাড়ছে, সে অনুযায়ী কর্মসংস্থানের কোনো উপায় নেই। বেকারত্ব বাড়ছে। এ সমস্যার সমাধান কীভাবে আসবে?
আনিসুজ্জামান: দেশে বেকারদের সংখ্যা বাড়ছে, তবে মনে হয় যে কর্মসংস্থানও বাড়ছে, একেবারে যে কর্মসংস্থান হচ্ছে না, তা নয়। কিন্তু যে সংখ্যক মানুষ বাজারে আসছে কর্মের সন্ধানে, তার তুলনায় কর্মসংস্থান কম। কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে দেশের মধ্যে বিনিয়োগ দরকার। সেই বিনিয়োগ করতে পারছে না। সরকারি যে যন্ত্র, সেটিকে বিনিয়োগের আরও অনুকূল করতে হবে। সাধারণভাবে বিনিয়োগ যারা করতে চায়, তাদের আমরা নানাভাবে হয়রানি করি, তাদের নানাভাবে নিরুৎসাহিত করি, এর বদলে আমরা যদি তাদের উৎসাহ জোগাতে পারি এবং পরিস্থিতি অনুকূল হয়, তাহলে বিনিয়োগ হবে। এখন যারা বিনিয়োগ করছে, তারা গ্যাস বা বিদ্যুতের নিশ্চয়তা পাচ্ছে না। এ রকম হলে তো বিনিয়োগ হবে না। এই সব মৌলিক উপকরণ দিতে হবে। আমার বিশ্বাস যে বাংলাদেশের অশেষ সম্ভাবনা আছে এবং গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান থেকে আমরা দেখছি কর্মসংস্থান বাড়ছে, এটি দ্রুত আরও বেশি পরিমাণে বাড়লে বেকারসংখ্যা কমবে।

প্রশ্ন: আপনাকে নিয়ে প্রকাশিত 'আকাশ আমায় ভরল আলোয়' শিরোনামে স্মারকগ্রন্থ কিংবা সম্মাননা গ্রন্থ। জীবিত থাকাকালীন লেখকের ওপর কমই এমন কাজ হয়েছে, আপনি সৌভাগ্যজনের একজন। জীবিত আরও লেখকদের নিয়ে কাজ করা দরকার মনে করেন?
আনিসুজ্জামান: 'আকাশ আমার ভরল আলোয়' কিংবা 'আনিসুজ্জামান সম্মাননা গ্রন্থ' শিরোনামে যে বই প্রকাশিত হয়েছে, তা একজন জীবিত লেখকের বিরল প্রকাশের একটি, আমি নিশ্চয় সৌভাগ্যবান; যারা এই বই প্রকাশ করেছে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।
জীবিত লেখকদের নিয়ে কাজ হয়, হয় না বললে ভুল করা হবে, তবে সেই লেখক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা দরকার, অন্তত যিনি আলোচনা করবেন, তাঁর কাছে। আমাদের জীবিত লেখক যাঁরা, তাঁদের মধ্যে আমি তো দেখতে পাই তাঁদের সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমাণ লেখালেখি হয়, এ নিয়ে আক্ষেপ করার কিছু নেই।

প্রশ্ন: ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ সম্মান 'পদ্মভূষণ' পদক পেয়েছেন, সে অনুভূতি প্রসঙ্গে কিছু বলবেন পাঠকদের জন্য?
আনিসুজ্জামান: আমি পদ্মভূষণ পেয়েছি সাহিত্য ও শিক্ষায় কিছু ভূমিকা রাখার জন্যে। সেখানে আমার লেখার ধরন-ধারন নিয়ে কোনো কথা নেই, সামগ্রিকভাবে সাহিত্যক্ষেত্রে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে আমি যা করেছি, সেটি তাঁরা বিবেচনায় নিয়েছেন। ওই পর্যায়ে এমন লোকও পুরস্কৃত হয়েছেন, শিক্ষাক্ষেত্রে যাঁদের অবদান আছে, সাহিত্যে তেমন কিছু নেই। আবার সাহিত্যে আছে, শিক্ষাক্ষেত্রে কোনো অবদান নেই। শিক্ষা ও সাহিত্য শ্রেণিতে ওই পুরস্কার আমরা কজন পেয়েছি?

প্রশ্ন: অনেক দিন ধরে দেখছেন; বাংলাদেশের সাহিত্যের বর্তমান গতিবিধি সম্পর্কে আপনার বিবেচনা কী?
আনিসুজ্জামান: বাংলাদেশের সাহিত্যের বর্তমান গতিবিধি নিয়ে দু-এক বাক্যে বলা সম্ভবপর নয়, সুতরাং এ প্রশ্নের উত্তর মুলতবি রইল।

প্রশ্ন: সময় দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
আনিসুজ্জামান: ভালো থেকো তুমিও।

[২০১৫ এবং ২০১৭ সালে নেওয়া সাক্ষাৎকারের অংশবিশেষ]