দশ দিগন্ত
ওয়েব সিরিজে কেন বেছে নেওয়া হচ্ছে সাহিত্য
বিশ্বব্যাপী ওটিটি প্ল্যাটফর্মগুলোতে জনপ্রিয় সাহিত্য অবলম্বন করে হচ্ছে এন্তার ওয়েব সিরিজ। কিন্তু এই প্রবণতা কেন? অন্তর্জাল ঘেঁটে জানাচ্ছেন মারুফ ইসলাম
বেশ একটা জোয়ার লক্ষ করা যাচ্ছে বিশ্বের ওটিটি (ওভার দ্য টপ) প্ল্যাটফর্মগুলোতে। সেই জোয়ার কী? সাহিত্য থেকে টিভি সিরিজ কিংবা ওয়েব সিরিজ তৈরি। এটা শুধু দেশি প্রবণতা নয়, বরং বৈশ্বিক প্রবণতা। দেশি বিনোদনমাধ্যম এই প্রবণতা থেকে বরং কিছুটা পিছিয়েই আছে বলা যায়। কিন্তু নেটফ্লিক্স, আমাজন প্রাইম, এইচবিও কিংবা বিবিসি টেলিভিশনের সাম্প্রতিক সিরিজগুলো লক্ষ করে দেখুন, সেসব মাধ্যমে বেস্টসেলার বইয়ের গল্প থেকে সিরিজ নির্মাণের হিড়িক পড়েছে। নেটফ্লিক্সের ব্রিজারটন, সেক্রেড গেমস, আমাজন প্রাইমের কুইন সুগার, দ্য ম্যান ইন দ্য হাই ক্যাসল, এইচবিওর গেম অব থ্রোনস, বিবিসির হিজ ডার্ক ম্যাটেরিয়ালস, হইচইয়ের ব্যোমকেশ ইত্যাদি সিরিজগুলো জনপ্রিয় উপন্যাস থেকে নির্মাণ করা। এগুলোর লেখক যথাক্রমে জুলি পটিংগার, বিক্রম চন্দ্র, নাটালি বাসজিলে, ফিলিপ কে ডিক, জেমস আর আর মার্টিন, ফিলিপ পালম্যান ও বাঙালি লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।
তো এই জোয়ার দেখে অনেকেই মনে করতে পারেন, সাহিত্যকে রঙিন পর্দায় রূপ দেওয়ার এ প্রবণতা বুঝি নতুন। আদতে তা নয়, ধারাটি বেশ পুরোনো। উইলিয়াম শেকস্পিয়ারের অ্যাজ ইউ লাইক ইট নিয়ে নির্বাক যুগেই (১৯১২ সাল) চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন তিন মার্কিন পরিচালক জন স্টুয়ার্ট ব্ল্যাকটন, চার্লস কেন্ট ও জেমস ইয়ং। বাংলা উপন্যাস দেবদাস নিয়েও নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায় চলচ্চিত্র। দেবদাস নিয়ে ১৯২৭ সালে প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন নরেশ মিত্র।
আমরা বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসের দিকে তাকালেও একই চিত্র দেখতে পাব।
এরই ধারাবাহিকতায় এখন তৈরি হচ্ছে টিভি সিরিজ ও ওয়েব সিরিজ। সে ঢেউ এসে লেগেছে বাংলাদেশেও। সম্প্রতি বাংলাদেশি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘চরকি’ থেকে কথাসাহিত্যিক শিবব্রত বর্মনের উপন্যাস ও গল্প অবলম্বনে সিনেমা এবং ওয়েব সিরিজ নির্মিত হচ্ছে। আবার কলকাতার পরিচালক সৃজিত মুখার্জি বাংলাদেশের কথাসাহিত্যিক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের জনপ্রিয় উপন্যাস রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো খেতে আসেননি নিয়ে ওয়েব সিরিজ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছেন।
প্রশ্ন উঠেছে, বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় সাহিত্য থেকে টেলিভিশন বা ওয়েব সিরিজ নির্মাণের দিকে প্রযোজনা সংস্থাগুলোর এভাবে ঝুঁকে পড়ার কারণ কী? কানাডার কবি ও সাংবাদিক আলিশা মোহামেদ কুইন্স ইউনিভার্সিটির জার্নালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে লিখেছেন, বেস্টসেলার বই থেকে ওয়েব সিরিজ নির্মাণের প্রধান কারণটা অর্থনৈতিক। এ ধরনের সিরিজে যে অর্থ লগ্নি করা হয়, তা ঝুঁকিমুক্ত থাকে। ঝুঁকিমুক্ত এই অর্থ যে বেস্টসেলার বইয়ের কাহিনিগুলো ইতিমধ্যেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। যাঁরা বইটা পড়েছেন, তাঁরা টেলিভিশনের পর্দায় অথবা ওয়েব পর্দায় সেই কাহিনির রূপায়ণ দেখতে আগ্রহী হবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নতুন কাহিনি অবলম্বনে সিরিজ নির্মাণের ঝুঁকি হচ্ছে, গল্পটা মানুষ জানে না। বিপুলসংখ্যক মানুষ নতুন গল্পটা গ্রহণ করবে কি না, তা অনিশ্চিত। আর এই অনিশ্চয়তাই মূলত অর্থ লগ্নি করার প্রধান ঝুঁকি। সেই ঝুঁকি সম্ভবত নিতে চাচ্ছেন না এই সময়ের প্রযোজক-পরিচালকেরা। তাই তাঁরা গল্পের জন্য জনপ্রিয় সাহিত্যের কাছে ফিরে আসছেন।
কারেন লেয়ার নামের একজন মার্কিন লেখক ও চলচ্চিত্র সমালোচক লিখেছেন, মোটামুটি তিনটি কারণে সাহিত্য থেকে নির্মিত ওয়েব সিরিজগুলো জনপ্রিয় হচ্ছে। এক. গল্পগুলো দর্শক ধরে রাখার মতো শ্বাসরুদ্ধকর, দুই. সেন্সরশিপের বালাই কম, অনেক প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রাপ্তমনস্ক দৃশ্য দেখানো যায়, তিন. গল্প উপস্থাপনায় সৃজনশীলতা।
ওপেন এডিশন জার্নালে ফ্রান্সের ইউনিভার্সিটি অব বুরগগনের শিক্ষক শ্যানন ওয়েলস লাসেং ‘টেলিভিশন কালচার’ নিয়ে দীর্ঘ এক প্রবন্ধ লিখেছেন। সেখানে শ্যানন লিখেছেন, দর্শককে শুধু অভিনয় দিয়ে পর্দায় বেঁধে রাখা যায় না। দরকার হয় উপযুক্ত গল্পের। সাহিত্য সেই গল্পেরই জোগান দেয়।
লেখক ও প্রকাশক কেট এলিজাবেথ ওরগেরা বলেছেন, মানুষ শেষ পর্যন্ত একটি চমৎকার গল্পই চায়। সেটা বইয়ের পাতায় হোক কিংবা রুপালি পর্দায়। আর চমৎকার গল্পের জন্য সাহিত্যের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। কারণ, সাহিত্যিকেরাই পারেন একটি সাধারণ ঘটনাকেও বহুবর্ণিল উপায়ে উপস্থাপন করতে। সে জন্যই সিরিজ নির্মাতারা জনপ্রিয় সাহিত্য বেছে নিচ্ছেন।
প্রায় একই ধরনের কথা বলেছেন টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিও-টেলিভিশন-ফিল্ম বিভাগের প্রভাষক ক্লাইরে সিনহেয়া লি। সেজ জার্নালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে তিনি লিখেছেন, সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ রুদ্ধশ্বাস গল্প পছন্দ করেছে। এখনো করছে। একমাত্র ঔপন্যাসিকেরাই পারেন মানুষকে গল্পের মাধ্যমে এক রুদ্ধশ্বাস ভ্রমণের অভিজ্ঞতা দিতে। তাই সিনেমা নির্মাতাদের বারবার সাহিত্যের কাছে ফিরে যেতে হয়েছে। এখনো হচ্ছে।
সব মন্তব্য আসলে একটি বিষয়ের দিকেই ইঙ্গিত করে। সেটা হচ্ছে গল্প। গল্প বা কাহিনিই হচ্ছে সাহিত্যের প্রাণ। সেটা হতে পারে সমাজের গল্প, সময়ের গল্প, মানুষের গল্প বা সভ্যতা ও ইতিহাসের গল্প। মোদ্দা কথা, সাহিত্য থেকে ওয়েব সিরিজ নির্মাণের নেপথ্য কারণ ওই গল্পই। তাই সাহিত্যিকদের বারবার গল্পের কাছেই ফিরে যেতে হবে।
সূত্র: কুইন্স জার্নাল, ওপেন এডিশন জার্নাল, সেজ জার্নাল, নেয়ারডিস্ট, কেটওরগেরা, কোরা, স্টাইলিস্ট ও হিন্দুস্তান টাইমস।