কীভাবে পাঠক হয়ে উঠবেন

কীভাবে পাঠক হয়ে উঠেছিলেন খ্যাতিমান লেখকেরা? কোন কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একজন মানুষ পাঠক হয়ে ওঠেন? পাঠক হওয়ার তরিকাগুলো কী? অন্তর্জাল ঘেঁটে জানাচ্ছেন শাকের এহসান

এই তো দিন কয়েক আগে ঢাকার একটি বইয়ের দোকানে বই দেখতে দেখতে কানে এল দুই তরুণের কথোপকথন—

‘ইদানীং বই পড়ার কেন জানি আর ধৈর্যই পাই না!’

‘আমার অবস্থাও সেইম। বই হাতে নিলে কেন যোন চোখে ঘুম চলে আসে!’

‘তারপরও বইয়ের দোকানে েঘারাঘুরি করেন যে!’

কাছে গিয়ে প্রশ্ন করি। এবার দুজনেই হেসে বললেন, ‘একেবারেই যে পড়ি না তা তো নয়। তবে আগের মতো পড়তে পারি না। এখানে এসেছি ঘুরতে। ঘুরতে ঘুরতে দু–একটা বই পছন্দ হয়ে যেতেও পারে। তখন কিনে ফেলব।’

এ কথা শুনে আমার মনে পড়ল ‘পাঠকের মৃত্যু’র কথা। সেই কবে বনফুল লিখে গেছেন। সেদিন এই দুই তরুণকে দেখে মনে হলো এঁদের ভেতরের পাঠকাত্মা কি মরে গেছে? নাকি তাঁরা পাঠকই হয়ে উঠতে পারেননি কখনো?

আসলে কোনো কিছু হয়ে ওঠাই সহজ নয়—না লেখক হয়ে ওঠা, না পাঠক হয়ে ওঠা। হয়ে ওঠার পথে পথে ছড়িয়ে কত শত প্রতিবন্ধকতার কাঁটা ও কাঁকর। লেখক হয়ে ওঠার গল্প লেখকদের মুখে আমরা নানা সময়ে শুনে থাকি। কিন্তু পাঠক হওয়ার গল্প কি আমরা শুনি সচরাচর? কীভাবে একজন মানুষ ‘পাঠক’ হয়ে ওঠেন, তা কি আমরা জানি?

হুমায়ূন আহমেদের আমার ছেলেবেলা পড়ে জেনেছি, কীভাবে তিনি পাঠক হয়ে উঠেছিলেন। ছোটবেলায় এক নির্জন দুপুরে হেঁটে হেঁটে প্রতিবেশী শুক্লাদির বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলেন বালক হুমায়ূন। শুক্লাদি তাঁকে একটি বই উপহার দিয়েছিলেন। বইটির নাম ক্ষীরের পুতুল। এই বই তাঁকে পাঠক হওয়ার পথে এগিয়ে দিয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের ভাষায়, ‘ক্ষীরের পুতুল আমার জীবনধারা অনেকখানি পাল্টে দিল। দুপুরে ঘুরতে আর ভালো লাগে না। শুধু গল্পের বই পড়তে ইচ্ছে করে। কুয়োতলার লাগোয়া হেলান দিয়ে গল্পের বই নিয়ে বসি।’

এরপর বাবার আলমারি থেকে চুরি করে বই পড়তে গিয়ে একদিন খেলেন ধরা। বাবা তাঁকে নিয়ে গিয়ে সদস্য করে দিলেন কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ লাইব্রেরির। তাঁর সামনে এক বিশাল স্বপ্ন জগতের দুয়ার খুলে গেল। তিনি একের পর এক বই পড়তে পড়তে পাঠক হয়ে উঠলেন।

একবার বইয়ের নেশায় পেয়ে বসলে পাঠক হয়ে ওঠা জটিল কিছু নয়। যেমনটা হয়েছিল জাপানি লেখক হারুকি মুরাকামির বেলায়। মুরাকামি তখন টোকিও শহরে একটি রেস্তোরাঁ চালাতেন। উদয়াস্ত পরিশ্রম। দম ফেলার ফুরসত নেই। মুরাকামির ভাষায়, ‘যে বয়সে মানুষ আরাম-আয়েশে, হাসিঠাট্টায় দিন কাটায়, সে বয়সে আমরা রেসের ঘোড়ার মতো ছুটেছি। ফাঁকা সময় প্রায় খুঁজেই পেতাম না। যেটুকু পেতাম, বই পড়তাম। গান শুনতে শুনতে বই পড়া আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার। আমি মাঝেমধ্যে খুব ব্যস্ত থাকতাম, কখনো হতাশায় ভেঙে পড়তাম, আশার আলো দেখতে পেতাম না, কিন্তু বই পড়ার আনন্দটুকু কেউ আমার থেকে কেড়ে নিতে পারেনি।’

হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও মুরাকামি কেন বই পড়তেন? কারণ, বই তাঁকে আনন্দ দিত। এই আনন্দের খোঁজে বই পড়তে পড়তে একসময় তিনি পাঠক হয়ে ওঠেন।

নিউইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার লেখক তিনা জর্ডান বলেছেন, বইয়ের মধ্যে আনন্দ খুঁজে পাওয়া পাঠক হয়ে ওঠার অন্যতম এক কারণ। এর সঙ্গে আরও কিছু কারণ অবশ্য তিনি বলেছেন। যেমন একা হওয়ার ইচ্ছা, অদম্য কৌতূহল, পরিকল্পনা প্রণয়ন, মনোযোগের গভীরতা, বিশ্লেষণী মানসিকতা ও আচরণে সামাজিকতা।

বিষয়গুলোর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন তিনা জর্ডান। তাঁর ভাষ্যমতে, আপনি যদি জাগতিক কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা হতে চান, তাহলে একটি চমৎকার গল্পসমৃদ্ধ বই খুলে বসুন। এই একা হওয়ার বাসনাই আপনাকে পাঠক হিসেবে গড়ে তুলবে। এরপর আপনার ভেতরে যদি কোনো বিষয়ে জানার ব্যাপারে অদম্য কৌতূহল থাকে, তবে এই কৌতূহলই আপনাকে পাঠক বানিয়ে ছাড়বে।

এ ছাড়া যাঁরা পরিকল্পনা করে বই পড়েন, পড়ার সময় গুরুত্বপূর্ণ লাইন, বাক্য, শব্দ রঙিন পেনসিল দিয়ে দাগিয়ে পড়েন, কোনো একটি বই গভীর মনোযোগের সঙ্গে পড়েন, পড়ার সময় লেখকের বক্তব্য বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেন এবং যাঁরা আচরণের দিক থেকে মানুষ হিসেবে সামাজিক, তাঁরা দ্রুত পাঠক হয়ে ওঠেন বলে মনে করেন তিনা জর্ডান।

তিনা জর্ডানের মতো আরেকজন মার্কিন লেখক আছেন জে এ অ্যাপলেয়ার্ড নামে, তিনি সেই নব্বই দশকের গোড়ার দিকে শৈশব থেকে বড় হওয়া অব্দি একজন মানুষ কোন কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পাঠক হয়ে ওঠেন, তা নিয়ে আস্ত একটি বই লিখেছেন। বইটির নাম বিকামিং আ রিডার। গবেষণাধর্মী এ বই প্রকাশ করেছে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস।

সেই বইয়ে লেখক-গবেষক অ্যাপলেয়ার্ড বলেছেন, যদি কোনো মানুষের মধ্যে ধৈর্য, জ্ঞানের প্রতি স্পৃহা, অনুপ্রেরণা অনুসন্ধান করার মতো গুণ থাকে, তবে তিনি দ্রুত পাঠক হয়ে ওঠেন। অ্যাপলেয়ার্ড স্কুলগামী শিশুদের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেছেন, ছোটবেলা থেকেই যাঁদের মধ্যে এসব গুণাবলি ছিল, তাঁরা পরবর্তী সময়ে সিরিয়াস পাঠক হয়ে উঠেছেন।

সাহিত্যের পাঠকের বাইরেও অনেক মানুষ আছেন। তাঁরা দক্ষতা বাড়াতে চান, পেশাগত অভিজ্ঞতা বাড়াতে চান, প্রশিক্ষণ নিতে চান, গভীর হতাশায় অনুপ্রেরণা খোঁজেন। এসব মানুষও একসময় পাঠক হয়ে ওঠেন বলে ওই বইয়ে মতামত দিয়েছেন লেখক ও গবেষক জে এ অ্যাপলেয়ার্ড।

তবে জন্মসূত্রে সব মানুষ যে পাঠক হওয়ার গুণাবলি নিয়ে জন্মান তা নয়। অনেকে চেষ্টা করেও পাঠক হয়ে ওঠেন। এই চেষ্টারত মানুষদের উদ্দেশ্যে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন বিজনেস ইনসাইডার–এর লেখক তানজা লডেনব্যাক।

লডেনব্যাকের মতে, আপনি যদি পাঠক হয়ে উঠতে চান, তাহলে আপনাকে কয়েকটি অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে—নিয়মিত পড়া, বাইরে বেরোনোর সময়ও সঙ্গে বই রাখা, বই নিয়ে সবার সঙ্গে কথা বলা, বড় কলেবরের বই দেখে ভয় না পেয়ে ধৈর্য ধরে পড়ে যাওয়া, একধরনের বই না পড়ে বিভিন্ন ধরনের বই পড়া, দক্ষতা ও আত্মোন্নয়নমূলক বই পড়া, সপ্তাহে অন্তত একটি নতুন বই পড়া, ডিজিটাল মাধ্যমে বই পড়া ইত্যাদি।

সুতরাং বই পড়ার নানা তরিকা আছে। বইয়ের েদাকানে ঘুরতে যাওয়া ওই দুই তরুণের মতো আপনার ভেতরের পাঠকেরও যদি মৃত্যু হয়, তবে ভয় নেই, চেষ্টা করলে আপনি আবারও পাঠক হয়ে উঠতে পারবেন। শুধু দরকার একটু চেষ্টা, আর একটু ইচ্ছা।

সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, টেলিগ্রাফ, দ্য বিজনেস ইনসাইডার, জে এ অ্যাপলেয়ার্ডের বিকামিং আ রিডার ও হুমায়ূন আহমেদের আমার ছেলেবেলা