বাতাসে বহিছে প্রেম

অলংকরণ: আরাফাত করিম

বসন্তের আনাগোনা চারদিকে। দিন কয়েক বাদেই বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। 

এদিকে বইমেলার বাতাসেও লেগেছে অন্য রকম দোলা।

লালপেড়ে হলুদ শাড়িতে খোলা বইয়ে চোখ বোলাতে কাকে দেখেছিল সে? মেয়েটির লম্বা বেণিতে কমলাটে গাঁদা গোঁজা ছিল। ছেলেটা কাছে ঘেঁষেনি। চারদিক খোলা প্যাভিলিয়নের আরেক দিক থেকে চোরাচোখে তাকিয়ে ছিল। তারও হাতে ছিল বই। চারদিকে শত শত মানুষের আনাগোনা, কিন্তু মেয়েটা কীভাবে বুঝেছিল যে তাকেই লক্ষ করছে ছেলেটা? না বুঝলে না তাকানোর মতো করে সেদিকে তাকাল কেন সে! মেয়েটার দৃষ্টির তিরের সামনে ছেলেটা বই তুলে মুখ ঢাকল ঘোলা হওয়া চোখ অবধি। নাকের কাছে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ লাগল প্রথম প্রেমের সুবাসের মতো। প্রেমের আকর্ষণ নাকি চোখের মণিকে দ্রবীভূত করে! আর তখন নাকি মানুষটাকে অপূর্ব লাগে! ছেলেটাকে যে সে রকমই দেখাচ্ছিল, তা মেয়েটার চোখে লেখা ছিল।

সত্যি, এমনই হয়েছিল। এমনই হয় মানুষের মনে প্রেম জানান দিলে। প্রেম যেন মনের ভেতর পুষে রাখা কোনো পাখির ছানা, দানার দরকার হলে কিচিরমিচির করে। তাকে শান্ত করতে প্রেমে বাতাস দিতে হয়, আর তাতে আগুনটা ভালোমতো জ্বলে ওঠে। ভেতরে ভেতরে সরু কিচিরমিচির ডাকটা তখন হয় চেঁচামেচি। মানুষটা অবাক হয়ে দেখে, অন্তরে প্রেমের উপস্থিতি তাকে গোপনে গোপনে শক্তি দেয়। শক্তির সেই অচেনা ফল্গুধারা কেমন করে কাউকে এতটা আত্মবিশ্বাসী করে তোলে, তা কেউ বলতে পারে না। তখন মনে হয়, সামনে এলে উতরে যাওয়া যাবে যেকোনো উচ্চতার পাঁচিল, ঝাঁপ দেওয়া যাবে গহিন সমুদ্রে! প্রেম হয়তো এমনই এক নেশা, যে নেশার ঘোরে ঘূর্ণির কেন্দ্রে বসেও মনে হতে পারে, চারপাশে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। জাগতিক কোনো দুশ্চিন্তা সেই ঘোরের ঘেরাটোপ ছিঁড়ে কাউকে স্পর্শ করতে পারে না। প্রেম তাই এক মোহই বটে!

আবার প্রেম এমনই যে মানুষ নিজের হৃদয়ে ঈশ্বরকে দেখতে পায়। তাই কারও ছোটখাটো অপরাধকে আর অপরাধ মনে হয় না, ইচ্ছা করে, ক্ষমা করে দিই। প্রেমে এত উদারতা কোত্থেকে আসে কে জানে! বুকের ছাতিটা বড় হয়ে যায়। সেখানে হয় সাহস আর সহানুভূতির বাসা। যেকোনো অনিশ্চয়তায় ঝাঁপিয়ে পড়া যায় চোখ বুজে, কেউ বাধ্য না করলেও অন্যের কষ্টের গভীরে প্রবেশ করা যায়, হয়ে ওঠা যায় সমব্যথী। প্রেম মানুষের মনে এমন অনুভূতির সাগর বইয়ে দেয় যে সামান্য আবেগেই কান্না আসে, আসে হাসিও।

ছেলেটা কিন্তু মেয়েটাকে দেখা থামায়নি তখনো। তবে লুকিয়ে। মেয়েটা কি এরই মধ্যে কয়েক পাতা বই পড়ে ফেলল, নাকি ছেলেটাকে দেখতে দেওয়ার ছলে পড়ার অভিনয়? কেউ তাকে লুকিয়ে দেখছে, যাকে সে-ও লুকিয়ে দেখছে, এর চেয়ে রোমাঞ্চকর কিছু হতে পারে নাকি! ছেলেটা একবার প্যাভিলিয়নের কোণে রাখা বইয়ের শোকেসের পেছনে সরে যায়; দেখে, মেয়েটা চোখ তুলেই হাতের বই নামিয়ে ছেলেটার ছেড়ে আসা জায়গাটায় অস্থির চোখ বোলায়। একেই বলে ধরা পড়া—সে তো ছেলেটাকেই দেখছিল! ছেলেটা এক পা এগিয়ে আগের জায়গায় আবির্ভূত হয়। মেয়েটা চমকে চোখ রাখে বইয়ে। এবারে আর সহজে চোখ তুলবে না সে, তাই ছেলেটা মন ভরে তাকে দেখতে থাকে। সুযোগ পেয়ে ফোন হাতে দুবার ক্লিকও করে ফেলে। মনটা খচখচ করে, না বলে ছবি তোলা কি ঠিক? পরমুহূর্তে মনে হয়, ছবি না থাকলে হারিয়ে যাবে না? ছবি তো অবয়ব। থাকুক।

প্রেম নিয়ে যে যেভাবেই ভাবুক না কেন, মানুষের প্রেম শুরুই হয় শরীরী আকর্ষণ দিয়ে। শরীরটাই যেন প্রেমের আধার। অবয়ববিহীন কল্পনা হয়? প্লেটো নিজেও কি কেবল প্লেটোনিক প্রেমের চর্চা করেছেন আজীবন? শরীরের প্রতি প্রথম দৃষ্টিতেই তো প্রাথমিক চিন্তা আসে একজন মানুষ সম্পর্কে! নাক-চোখ-মুখ-উচ্চতা-কমনীয়তা, এমনকি ত্বকের মসৃণতা বা পেলবতা—কোন দিকে চোখ না যায় মানুষের! বস্তুত আকার-আকৃতি চোখের সামনে থাকে বলেই মানুষ গুণবিচারের দিকে যায়, নইলে এগোনো যেত না। আর মজার ব্যাপার হলো, ভালোবাসা অন্ধ। আকার–আকৃতি বা মানসিক গঠন যেমনই হোক না কেন, যার যার প্রেমময়তায় তা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সৌন্দর্য। প্রেমে পড়লে মানুষ ভালো লাগার মানুষের যাবতীয় দোষ-গুণ ভালো তো বাসেই, এমনকি তার যে গুণ নেই, সে গুণেও তাকে কল্পনা করে; ‘আমি আমার মনের মাধুরী মিশায়ে তোমারে করেছি রচনা’; প্রেমের অন্ধত্ব চোখ ফোটার আগপর্যন্ত মুগ্ধতায় ভরা। আর প্রেমের মরা চায় না ফুটুক চোখ। তবে ফুটে গেলেও দীর্ঘদিনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে আকর্ষণীয় শরীরের মোহ চলে গিয়ে অনুভূতি কেমন যেন শুধু হাতের স্পর্শ কিংবা মুখের হাসিতে এসে ঠেকে। আর ওইটুকুই শক্তির আধার হয়ে বেঁচে থাকে। এমনই শক্তি যে ভালোবাসার মানুষের হাসি দেখলে কি হাত ধরলেই শরীর আর মনের সব ব্যথা চলে যায়।

প্রেমের অনেক ধাপ আছে। এই ছিল মায়াবী কিংবা রোমান্টিক ভালোবাসা, আবার এই হয়ে গেল যৌক্তিক, শোধ করার দায়ের মতো ভালোবাসা। শুরুর আবেগ আর উত্তেজনা কমলে সেখানে জায়গা নেয় দায়িত্ব। প্রেম এমন এক খাঁচা, যার ভেতর ছটফট করা ছাড়া উপায় নেই, কিন্তু সবকিছুরই তো শেষ আছে। তুমুল উত্তেজনাও একসময় স্তিমিত হয়। তখন শুরু হয় কর্তব্যের পালা। তা–ও কি প্রেম নয়? মায়া তখন উত্তেজনার জায়গা দখল করে। মায়া এমন এক জিনিস, যার উপস্থিতিতে পুরুষ বা নারীর কাছে সঙ্গী পৃথিবীর অন্য সব নারী–পুরুষ থেকে পৃথক। মায়ার জন্যই একজনের অভাব আরেকজনকে দিয়ে পূরণ হয় না।

মেয়েটি কি বুঝতে পারে ছবি তোলার ব্যাপারটা? চোখে চোখে কপট রাগ দেখিয়ে বইয়ের দাম জানতে চায়। ছেলেটা একটু এগিয়ে যায়, তাই দেখে মেয়েটা সঙ্গের বান্ধবীকে বলে, ‘চল ওদিকের স্টলে।’ ছেলেটা মনে মনে ভয় পায়, খেপে গেল নাকি! জায়গাটা এমন বড় যে তাদের অনুসরণ করার জন্য ছেলেটাকে রীতিমতো কসরত করতে হয়। বইমেলা এত বড় হলো কেন? আগের দিনে নাকি মানুষ এমাথা–ওমাথা কবি-লেখকের পেছনে ছুটে বেড়াত। একটা চক্কর দিলে মুখস্থ হয়ে যেত বইয়ের তালিকা। মানুষ হারাতও না চোখের সামনে থেকে। ফোনে ছবি উঠেছে কি না দেখতে গিয়ে মেয়েটা চোখের সামনে থেকে গেল হারিয়ে। ছেলেটা স্টলে স্টলে খোঁজে, কে জানে কোন গলিতে চলে গেছে! আচ্ছা, মেয়েটাও কি তাকে খুঁজছে না?

ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলার ভয়ের নাম, থানাটোফোবিয়া। উহ্​, সে কী ভয়ানক যন্ত্রণা! এই মনে হয় আছে, আবার এই মনে হয়, চলে গেছে ছেড়ে। প্রেম মানুষকে এমন শান্তি দেয় যেন কানের কাছে সুমধুর সংগীত বাজে অবিরাম, প্রজাপতি ওড়ে; কিন্তু তারপরও, প্রেম মানুষকে যতই শান্তি দিক, স্বস্তি দেয় না। মানুষ কতবারই–না ভালোবাসার মানুষকে জিজ্ঞাসা করে, আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো? উত্তর আসে, না তো! তোমাকে ছেড়ে কোথায় যাব? কিন্তু তারপরও ঠিকই চলে যায়। যাওয়ার উপলক্ষ না থাকলেও যায়। প্রেমে জটিলতা আসে কিংবা খোদ প্রেমটাই হয়ে ওঠে অসহনীয়, মারাত্মক বন্ধনের মতো। ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে যেন বাঁচে মানুষ। আর তারপর প্রেমের স্মৃতি নিয়ে কাটানো—নতুন প্রেম সেখানে ছায়ার মতো পড়ে তবে পুরোনো প্রেম থেকে যায় দগদগে ঘা কিংবা সুগন্ধি রুমালের মতো, যার গন্ধ ফুরায় না। প্রেমের আনন্দ থাকে অল্পক্ষণ, কিন্তু তার বেদনা রয়ে যায় সারা জীবন। তবে বেদনার ভয়ে কে কবে প্রেমকে পায়ে ঠেলেছে? এই সংসারে যে ভালোবাসা পেল না, আর যাকে কেউ ভালোবাসল না, তার মতো হতভাগা আর নেই।

তবু প্রেমকে সফল করতে গিয়ে তা বিয়েতে গড়াতে হয়। শুরুতে প্রেমের জন্য শরীরে যতই ডোপামিন আর এন্ডরফিন নিঃসৃত হোক, উত্তেজনা কেটে যেতেই দেখা যায়, প্রেমের বাস্তবতা ভিন্ন জিনিস। প্রেমের বাস্তবতায় যে দায়িত্ব-কর্তব্য আসে, তা কয়জন পালন করতে পারে? সেখানে বুক ঢিপঢিপ করা উত্তেজনার স্থান কম, বেশি হিসাব-নিকাশ। পরিবার আর সমাজকে খুশি করা, দুজন মিলেই। কে কত দিন চালিয়ে নিতে পারে, সে এক পরীক্ষা বটে। নরওয়ের এক প্রেমিক-প্রেমিকা দম্পতি কাটিয়েছিলেন ৮৬ বছর ২৭০ দিন। আবার সময়ে কী আসে-যায়, সামান্য কয়েক দিনের প্রেমও কারও সারা জীবনের পাথেয় হতে পারে।

মেয়েটা নিজে লুকিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু খুঁজছিল ছেলেটাকেই, বইমেলার এই স্টলে–ওই স্টলে। আর যখন তারা আবারও মুখোমুখি হয়, চোখে চোখ পড়লে দুজনের হৃৎপিণ্ড একই তালে ওঠে–নামে। ভালোবাসার মানুষেরা চোখে চোখে তাকালে তাদের হৃদয় একরেখায় চলে। দুজনে কেউ আর কারও কাছে লুকাতে চায় না। কে না জানে মাতাল আর প্রেমে পড়া মানুষ নিজেদের লুকাতে পারে না! মানুষের নাকি কাউকে ভালো লাগছে কি না, সিদ্ধান্ত নিতে লাগে সেকেন্ডের পাঁচ ভাগের এক ভাগ। তাই তাদের সিদ্ধান্ত হয়েই যায়। প্রেমে পড়া আর নেশাগ্রস্ত হওয়া একই ব্যাপার। নেশায় ডোবা দুটো মানুষ দুজনের দিকে এগোয় তাই। অবাক হয়ে লক্ষ করে, দুজনেরই মনে হয় দুই পা এগোলেই তাদের জীবনের গন্তব্য!

প্রেমের ঘোর লাগা মানুষ ঘুরেফিরে সঙ্গীকেই খোঁজে। এ যেন নিয়মে বাঁধা জীবন, যা কিছু করে, তাতে সঙ্গীকেই চায় আর সবটাতেই সঙ্গীর ভালোমন্দ বিচার করে। প্রেমের সঙ্গে তখন ধীরে ধীরে যুক্ত হয় সততা, নির্ভরতা, ঘনিষ্ঠতা আর বন্ধন। প্রেম মানুষকে সৃষ্টিশীল করে। এমনকি সঙ্গীর সঙ্গে মানসিক বা শারীরিক প্রেমের চিন্তাও মানুষকে সৃষ্টিশীল করে। প্রেমের দ্রবণ থেকে কত সৃষ্টিশীলতা দেখা গেছে, তার সীমা নেই। আবার প্রেম ভেঙে গেলে সত্যি সত্যি হৃদয় ভাঙে। প্রেম ভেঙে যাওয়ার পর মানুষের বুকের ব্যথা আর শ্বাসকষ্টে দুর্বল হৃদ্​যন্ত্রের লক্ষণের মতোই। প্রাকৃতিকভাবে একজন মানুষের প্রেমের স্মৃতি থেকে মুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে ১৫ মাসের বেশি সময় লাগে। কেউ কেউ আবার আজীবন বিগত প্রেমের কারাগারেই বন্দী থাকে।

মেয়েটার কাছাকাছি আরেকটি ছেলে, আগে তো ওকে দেখা যায়নি! প্রেমিক নাকি ওর? বিভ্রান্ত ছেলেটার মনে পড়ে, প্রেমে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবেই। প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকলে মানুষেরা একঘেয়েমিতে ভুগে আত্মহত্যা করত দলে দলে। ছেলেটি তাই এগোয় আবার। পৃথিবীর প্রত্যেক প্রেমিক-প্রেমিকা যেভাবে সঙ্গীর দিকে এগোয় আর দুশ্চিন্তায় ভোগে, আমি ওর যোগ্য তো? তবু তারা এ জন্যই এগোয়, জানে, ‘আমার না যদি থাকে সুর, তোমার আছে, তুমি তা দেবে আমার গন্ধহারা ফুল তোমার কাছে সুরভি নেবে’,—এরই নাম প্রেম।