‘আমার কিছু খ্যাতি আছে, তাই আমি এমন কিছু বলতে পারি অন্যরা যা পারে না’

নোবেলজয়ী তুর্কি ঔপন্যাসিক ওরহান পামুকের নতুন বই মেমোরিজ অব ডিস্ট্যান্ট মাউন্টেনস: ইলাস্ট্রেটেড নোটবুকস, ২০০৯-২০২২ প্রকাশিত হয়েছে গেল নভেম্বরের শেষে। বইয়ে দৈনন্দিন চিন্তাভাবনাসহ তাঁর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন পামুক। দিনপঞ্জির পাতায় নিজের লেখা আর আঁকা ছবি দিয়ে সাজিয়েছেন বইটি। নিজের পরিবার, বিশ্বভ্রমণ, মাতৃভূমি তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা এবং তাঁর লেখার প্রক্রিয়া নিয়ে লিখেছেন। যেসব বিষয় গল্পের পটভূমি নির্মাণ, চরিত্র সৃষ্টি বা উপন্যাসের বীজ বুনতে সহায়তা করেছে, তা–ও মেলে ধরেছেন অকপটে। সমালোচকদের ভাষ্য, এ বইয়ের মাধ্যমে খুব সহজেই ওরহান পামুকের ভেতরে প্রবেশ করতে পারবেন পাঠকেরা। বইটি প্রকাশের পর গত ১১ জানুয়ারি দ্য গার্ডিয়ান একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছে পামুকের। সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর পিতার শৈল্পিক সমর্থন, মধ্যপ্রাচ্যে নারীবাদী হওয়া, ইস্তাম্বুলের প্রতি তাঁর ভালোবাসা এবং সরকারি দমন-পীড়নের ভয় নিয়ে কথা বলেছেন। অনুবাদ করেছেন সালেহ ফুয়াদ

ওরহান পামুকছবি: পামুকের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট থেকে

আমি একটি মধ্যবিত্ত, বুর্জোয়া ও ধর্মনিরপেক্ষ পরিবারে বেড়ে উঠেছি। বাবার ছিল সুবিশাল লাইব্রেরি। শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে বাবার তুমুল আগ্রহ ছিল। জঁ পল সার্ত্রেকে নিয়ে আলাপ করতেন। কিন্তু আমি যখন বন্ধুদের বাড়িতে গেলাম, আবিষ্কার করলাম, তাদের বাড়িতে খুব একটা বই নেই। তাদের পিতারা চেয়েছেন, তাদের সন্তানেরা বড় হয়ে পাশা (তুর্কি রাজপ্রতিনিধি), ধনী রাষ্ট্রনায়ক, এমনকি ধর্মীয় গুরু হয়ে উঠুক। আমার বাবার মতো কেউ তাদের বলেনি, ‘প্রবল কল্পনাশক্তিসম্পন্ন লেখক বা শিল্পী হও।’

আমার বাবা ছিলেন একজন স্বপ্নবান মানুষ। কবি হতে চেয়েছিলেন। মা ছিলেন একেবারে বিপরীত, ভীষণ বাস্তববাদী। তিনি বলতেন, ‘প্রিয়, তুমি যদি সত্যিই ঔপন্যাসিক হতে চাও, তবে তুমি কোনো অর্থবিত্ত করতে পারবে না। তার চেয়ে ভালো হয়, তুমি স্থপতি হও।’

২২ বছর বয়সে মাকে বললাম, ‘আমি চিত্রশিল্পী হব না, লেখক হব।’ আমার ভেতরের চিত্রশিল্পীকে আমি হত্যা করি। শেষ পর্যন্ত মনে হয়, আমি একজন ভিজ্যুয়াল ঔপন্যাসিক হয়ে উঠেছি। যখন আমি আঁকি, তখন গোসলের সময় গান গাওয়া মানুষে পরিণত হই। কে আমার গান শুনছে, তার কোনো পরোয়া করি না। ভাবি, কেউ আমার ভয়ংকর কণ্ঠ শুনতে পাবে না। এ জায়গায় আমি সুখী। কিন্তু যখন আমি উপন্যাস লিখি, তখন আমার কাছে থাকে শুধু নীরবতা। আমি যেন ভীষণ মনোযোগী কোনো দাবাড়ু। শব্দ তুলছি। মাথা চুলকাচ্ছি। অনেক বেশি আত্মনিয়ন্ত্রিত, মাথা খাটানো কেউ। 

যদি আমার ছাত্রদের বলি, ‘একটি খালি কাগজ নাও এবং লেখো।’ তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। ভেবে পায় না কী লিখবে। কিন্তু যদি বলি, ‘তুমি সবচেয়ে বেশি কী ঘৃণা করো? আজ সকালে কী খেয়েছ?’ তবে তারা ভাবতে পারে। তুমি যা জানো, তার ওপর মনোযোগ দাও এবং এরপর তোমার কল্পনাশক্তিকে কাজ করতে দাও।

আধুনিকতা বনাম ঐতিহ্য শুধু তুর্কিদের সমস্যা নয়, এটি বিশ্বব্যাপী মানবতার সমস্যা। তবে কথিত তৃতীয় বিশ্ব বা ঔপনিবেশিক-উত্তর দেশগুলোতে এটি বেশি দৃশ্যমান। কারণ, এখানে দ্বন্দ্ব আরও স্পষ্ট। এর মূলে যা রয়েছে, তা হলো এখানকার সবাই আধুনিকতা চায়, একই সঙ্গে স্থানীয় সংস্কৃতিকে সম্মান দেখাতেও চায়, যা আসলে অসম্ভব। আধুনিকতা ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির অনেক কিছু বাতিল করে দেয়। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমি লিখতে পছন্দ করি।

ইস্তাম্বুল আমার স্মৃতির অগ্রদূত। সারা জীবন এখানে কাটিয়েছি। এ শহরের সঙ্গে আমার একটা শারীরিক সম্পর্ক রয়েছে। কোনো ঝরনা বা সেতু পেরিয়ে যাওয়ার সময় মনে করতে পারি ঘটে যাওয়া অনেক কিছু। ঈর্ষা, ব্যর্থতা, প্রেমে পড়া, আমার প্রথম বই প্রকাশিত হওয়ার মুহূর্ত, বইয়ের দোকানের জানালায় বইটিকে দেখার ক্ষণটি। স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলা এবং বাঁচিয়ে রাখার বিশেষ কলকবজা রয়েছে এ শহরের।

আমি অনেক কিছুকে ভয় পাই, যেমন আমার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো, শারীরিক আক্রমণ, সরকারি কর্মকর্তা কর্তৃক আমার বই নিষিদ্ধ করা। সারা জীবন আমি দমন-পীড়ন ও বিপদ মেনে না নেওয়ার ভেতর আটকে আছি। আমার কিছু খ্যাতি আছে, তাই আমি এমন কিছু বলতে পারি, যা অন্যরা বলতে পারে না। এটি একটি বিশেষ সুবিধা।

সাহিত্য শুধু দমন-নিপীড়নের কড়চা নয়। বরং আবিষ্কার করা যে দমনের মধ্যেও মানবতা রয়েছে। মানুষের চরিত্র কী? শেষ পর্যন্ত এটিই সমস্ত সাহিত্যের বিষয়।

আমি রান্না করতে ভালোবাসি। নারীর রক্ষক হতে হলে, নারীবাদী হতে হলে মধ্যপ্রাচ্যে একজন পুরুষকে রান্নাঘরে কাজ করতে হবে, পরিবারের জন্য রান্না করতে হবে। আমার জন্য এর অর্থ হলো আমার স্ত্রীকে বলা, আমি কিছুক্ষণ রান্না করব।

আমার বাবা অটোমান কবিতা আবৃত্তি করতেন। তাঁর অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ছিল। বাবা টার্কিশ ন্যাশনাল ব্রিজ টিমের সদস্য ছিলেন। ব্রিজ খেলায় ভালো করা মানে স্বল্পমেয়াদি স্মৃতিশক্তিতে দারুণ।

একজন সৎ লেখক, ভদ্র মানুষ, যিনি ভালো কিছু বই লিখেছেন এবং কিছু চিত্রশিল্প সৃষ্টি করেছেন...আমি এভাবেই স্মরণীয় হতে চাই।