পুরুষ যখন পুরুষতন্ত্রের ‘ভিকটিম’

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ওই যে কিছু শব্দ থাকে না? তুমি একে যতই ভাঙো, যতই বোঝানোর চেষ্টা করো অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা—কোনো লাভ হয় না। লোকে বোঝে না বা বুঝতে চায় না কিংবা মেনে নিতে বড্ড কষ্ট, যেন হাঁপানি ওঠে, যেমনটা ঘুমের মধ্যে স্লিপ প্যারালাইসিস হওয়াকে আমাদের বলতে ভালো লাগে ‘বোবায় ধরা!’

অমন এক বিখ্যাত শব্দ হলো, ‘পুরুষতান্ত্রিকতা’, ইংরেজিতে যাকে আমরা বলি, ‘Patriarchy’। এই শব্দটি প্রাচীন রোমান এবং গ্রিক সমাজে পুরুষ নেতৃত্ব বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হতো। ১৮৮৪ সালে মূলত ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস তার বই ‘দ্য অরিজিন অব দ্য ফ্যামিলি, প্রাইভেট প্রপার্টি অ্যান্ড দ্য স্টেট’–এ ব্যাখ্যা করেছিলেন শব্দটি।

আক্ষরিক অর্থে পুরুষতান্ত্রিকতা এসেছে ‘পুরুষ’ ও ‘তন্ত্র’ থেকে, যার মানে হলো, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর এমন একটি অবস্থা, যেখানে পুরুষদের আধিপত্য, নিয়ন্ত্রণ এবং প্রাধান্যকে স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য হিসেবে ধরা হয় এবং অন্যান্য লিঙ্গের মানুষের কথা চিন্তা করা হয় না; বরং তাদের ওপর চাপানো হয় অনেক কিছু।

সাধারণত পুরুষতান্ত্রিকতা নারীর ওপর নেতিবাচক প্রভাবের আলোচনা-সমালোচনায় গুরুত্ব পায় ও দারুণ মুখরোচক, তবে একই কাঠামো পুরুষকেও বহুমাত্রিকভাবে প্রভাবিত করে, যা কিনা আলোচনার টেবিলে খুব একটা উঠে আসে না।

প্রায়ই আমরা ভুলে যাই যে পুরুষতান্ত্রিকতা একটা সিস্টেমের নাম, ধারক ও বাহক। যেই সিস্টেমের প্রভাব শুধু নারীর ওপরই পড়ে না। পুরুষেরাও ভুক্তভোগী পুরুষতান্ত্রিকতার, যা আমরা সাদা চোখে টের পাই না, বুঝেও বুঝি না কিংবা সহসাই উপেক্ষা করি পুরুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য ভেবে। সাধারণত পুরুষতান্ত্রিকতা নারীর ওপর নেতিবাচক প্রভাবের আলোচনা-সমালোচনায় গুরুত্ব পায় ও দারুণ মুখরোচক, তবে একই কাঠামো পুরুষকেও বহুমাত্রিকভাবে প্রভাবিত করে, যা কিনা আলোচনার টেবিলে খুব একটা উঠে আসে না বা এলেও কিঞ্চিৎ অস্বস্তিতে পড়ে যায় সমাজ। এই অস্বস্তিই কিন্তু পুরুষতান্ত্রিকতার একটা জলজ্যান্ত প্রমাণ।

পুরুষতান্ত্রিকতার কারণে পুরুষদের নির্দিষ্ট সামাজিক ভূমিকা পালনের প্রত্যাশা তৈরি হয়, যেখানে শক্তি, কর্তৃত্ব, অর্থনৈতিক সাফল্য পুরুষত্বের সূচক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এমনকি আক্রমণাত্মক আচরণকেও উৎসাহিত করতে দেখা যায়, আরবান ডিকশনারিতে অনেকেই যাকে বলতে পছন্দ করে, ‘ব্যাডাগিরি’। ব্যাডাগিরি ফলানোর অজুহাতে অনেক সময় তারা সহিংসতা ও ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে পড়ে। এই প্রবণতা কেবল অপরাধের হারই বাড়ায় না, বরং দুর্ঘটনা ও স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কাও বাড়ায়।

সমাজ যখন পুরুষদের শক্ত, নির্ভীক, আবেগহীন হতে বাধ্য করে, তখন তারা নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে ভয় পায়। ‘আসল পুরুষ’ হওয়ার চাপ তাদেরকে এমন এক ছাঁচে ফেলে দেয়, যেখানে দুর্বলতা দেখানো নিষিদ্ধ।

সমাজ যখন পুরুষদের শক্ত, নির্ভীক, আবেগহীন হতে বাধ্য করে, তখন তারা নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে ভয় পায়। ‘আসল পুরুষ’ হওয়ার চাপ তাদেরকে এমন এক ছাঁচে ফেলে দেয়, যেখানে দুর্বলতা দেখানো নিষিদ্ধ। ফলে তারা মানসিকভাবে একা হয়ে পড়ে, সাহায্য চাইতে দ্বিধা করে এবং অনেক সময় বিষণ্নতা বা উদ্বেগে ভোগে। ‘Hegemonic masculinity’ তত্ত্বে ব্যাখ্যা পাওয়া যায় যে সমাজ পুরুষকে একমাত্রিক মানদণ্ডে আবদ্ধ করে ফেলে, ফলে ব্যর্থ হলে তারা সামাজিক অবমূল্যায়ন ও আত্মসম্মানের সংকটে পড়ে।

পরিণত বয়সেও পুরুষেরা বন্ধু হয়তো বানায় ঠিকই, কিন্তু ছোট্টবেলার সেই বন্ধুর কাছে সে তার মনের কথা যেভাবে খুলে বলত বা বলার সাহস পেত বা অতশত থিওরি, মানসম্মানের বালাই ছাড়াই বলত, সে রকম আর দ্বিতীয় বন্ধুটি তৈরি হয় না পরবর্তী জীবনে। মনের ভেতর জমতে থাকে মেঘ একে একে পাহাড়সম; কিন্তু মেঘ থেকে বৃষ্টির পানি আর ঝরার সাহস পায় না কোনো দিঘির জলে। ফুল ফোটে না দ্রুত। চারদিকে শুধু বিরানভূমি। এর ফলে যা হয়, পুরুষেরা তার মনের বিক্ষিপ্ত অনুভূতিকে ঠিকঠাক প্রসেসও করতে পারে না।

পৃথিবীর যাবতীয় সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের মূল একটি ব্যাপারই তো সেই, ‘মানুষ সামাজিক প্রাণী।’ পুরুষও অবশ্যই তার ব্যতিক্রম নয়? স্বাভাবিক মানুষের মতো তাকেও মিশতে হয় অনেকের সঙ্গে। তার মনের বাগানে কেউ গেঁথে যায় নীলমণিলতা, কেউ লালন করে কিছু শিউলি ফুল, কেউ চারা লাগায় লাল টুকটুকে জবার, কখনো দরকার পড়ে হয়তো অশ্বগন্ধার। কিন্তু এই সব কি অযত্নে বাঁচে?

প্রয়োজন পড়ে ভালোবাসার, ধৈর্যের, সহনশীলতার, কাছে এসে আলতো ছোঁয়ার। কিন্তু এক্স ওয়াই ক্রোমোজোম নিজেকে প্রমাণ করার তাড়নায়, পুরুষতান্ত্রিকতা শব্দের ভুল ব্যাখ্যায়, দোটানায় হয়ে যায় খরখরে ফাটল ধরা জমিন!